জীবনের বাঁকে বাঁকে

অনার্সের অরিয়েন্টেশনের দিন

দূর থেকে নিকোলের সাথে মেয়েটাকে দেখে আমি একটু চমকে গিয়েছিলাম। আমার চেয়ে বেশ লম্বা। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চির মত হবে উচ্চতা। আরও লম্বা লাগছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো কুচকুচে বোরকা পরে আছে তাই। দুই চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চোখের যতটুকু শুধু দেখার জন্য দরকার, ঠিক ততটুকুই খোলা। একটু চমকে গিয়েছিলাম, কারণ আমাদের পুরা ফ্যাকাল্টিতে অনার্সের মুসলিম স্টুডেন্ট এতদিন দুই জন ছিল, কিন্তু আমি একাই হিজাবী/ব্যক্তিগত পর্যায়ে সিরিয়াস প্রাকটিসিং ছিলাম। প্রেজেন্টেশন করার সময় পুরা হলের সামনে একা হিজাবী দাঁড়াতে একটু সাহস সঞ্চয় করতে হত! ফর্মাল পোশাক কি পরব, সেই চিন্তায় তটস্থ থাকতাম। এখন আরেকজন দলে জুটলো, তাও একেবারে কালো বোরকা আর চোখ ছাড়া সব ঢাকা! ধারণা করলাম, আরব-টারব হবে হয়তো। মুখ খুলতেই আরব উচ্চারণে কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখনই দ্বিতীয় চমক পেলাম। ‘হাই, আই অ্যাম ফেইথ, ফেইথ মরিস, হাউ ডু য়ু ডু’, হাত বাড়িয়ে দিলো মেয়েটা। ফেইথ মরিস নামটা আরব দূরে থাক, মুসলিমই শোনাচ্ছে না, আর উচ্চারণ আরবদের ধারে কাছে নেই, পুরাপুরি সফিস্টিকেটেড, প্রফেশনাল ইংরেজী! আমাদের ফ্যাকাল্টি এক হলেও ডিপার্টমেন্ট আলাদা, সেই সুবাদে খুব নিয়মিত দেখা হয় না, কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক কথাই হল। ও কনভার্টেড মুসলিম। সতের বছর বয়সে মুসলিম হয়েছে নিজে পড়াশোনা করে। ও অন্য ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে আন্ডারগ্রাজুয়েডের গত তিন বছর। আমাদের ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী থাকার প্রেস্টিজ বেশি, তাই এখানে অনার্স করতে চেয়েছে।

অনার্সের প্রথম প্রেজেন্টেশনের দিন ফেইথ যখন বিশাল বড় লেকচার থিয়েটারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তখন হঠাৎ করেই সব কথা বন্ধ হয়ে গেল। হল ভর্তি বিজ্ঞানীরা নড়ে চড়ে বসলেন। উচ্চারণ বুঝা যাবে তো? ফেইথ কথা শুরু করতেই সবাই হতভম্ব। দারুণ প্রেজেন্ট করলো, প্রশ্নোত্তর পর্বের উত্তরগুলোও দারুণ আত্মবিশবাসী ছিল। আমার কেমন অদ্ভুত একটা ভালো লাগা হচ্ছিল। অনার্সের ফাইনাল প্রেজেন্টেশনটাও যথারীতি ফাটাফাটি। এক অডিটরিয়াম ভর্তি ডাক্তার, ইউনিভার্সিটি প্রফেসর, অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন প্রথম সারির বিজ্ঞানীর সামনে শুধু চোখ ছাড়া আর সব ঢাকা এই মেয়েটার আত্মবিশবাস আর সাবলীলতা রীতিমত ঈর্ষণীয়। প্রেজেন্টেশনের পরে কথা হচ্ছিল ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে। জানলাম ও সিডনী ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট গ্রাজুয়েড মেডিসিনে চান্স পেয়েছে!!!! এতগুলো আশ্চর্যবোধক চিহ্নের কারণ হচ্ছে, সিডনী ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম এবং মহা ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা। সিডনী ইউনিভার্সিটির মেডিসিন ভীষণ রকমের প্রেস্টিজাস, চান্স পাওয়াটাও তাই খুবই কঠিন। সাবকন্টিনেন্টের মানুষজন গাল ফুলিয়ে বলে মুসলিম, হিন্দু আর বাদামী চামড়ার কেউই নাকি চান্স পায় না, হিজাবী মুসলিম তো দূরের কথা (নিকাবী তো অকল্পনীয়)! শুনেছি, বিবাহিতদেরও নাকি নিতে চায় না, ক্যারিয়ার ফোকাস কমে যাবে তাই। আর এই মেয়ে সবগুলো প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে তিন ধাপের সিলেকশন স্টেইজ পার হয়ে, সামনা-সামনি মৌখিক পরীক্ষাতেও উতরে গেল! আমার অদ্ভুত ভালো লাগা হল।

মেইকআপ আর আমি – তেল আর জল, এক সাথে মিশ খাই না। এ যুগের মেয়ে হয়েও কাজল ছাড়া আর কিছু দিতে জানি না, সেটাও খুব মাঝে মাঝে। কিন্তু পোশাক-আশাক ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য খুব দরকার, সেটা সব সময় বিশ্বাস করতাম। বোরকা পরব, কিন্তু ফুল তোলা নাকি মেটে আর ফর্মাল রঙের, এসব সিদ্ধান্ত নেই পরিস্থিতি বুঝে। এই মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, হয়তো ব্যক্তিত্বে ঘাটতি আছে বলেই পোশাক-আশাক দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করাটা এত দরকারি মনে হয়! বুঝি, নিকাব পরতে অনেকটুকু সাহসের দরকার হয়। অতটুকু সাহস আমার নেই। আমার ফাইনাল প্রেজেন্টেশনের পরে একজন বুড়ো প্রফেসর মন্তব্য করেছিলেন, ‘তোমার প্রেজেন্টেশন দারুণ হয়েছে। স্লাইড, স্টাইল সুন্দর। আর তোমার হাসিটা চমৎকার, সবাইকে মাতিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট’। সেদিনই ফেইথের প্রেজেন্টেশন দেখে মনে হল, মেয়েটাকে কেউ কখনও শেষের লাইনটা বলবে না। ওর সুন্দর প্রেজেন্টেশনের সেকেন্ডারী কৃতিত্ব কখনও সুন্দর হাসির হবে না। সব সময় ওর আসল মেধা, ব্যক্তিত্ব আর একেবারে ভিতরের সত্তাটাই মানুষের শ্রদ্ধা কুড়াবে।

 

– আমাতুল্লাহ, সিডনী থেকে

মন্তব্য করুন

Back to top button