জীবনের বাঁকে বাঁকে

বিষাদের নিরালায়

গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর। ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা প্রকৃতির অগ্নি শ্বাস-প্রশ্বাসের টানা ঝাপটায় চেহারাটা হয়ে গেছে শূষ্ক মরুভূমির মত। দূরের সারি সারি কড়ইয়ের সবুজ সজীবতা আর পাকা ধানের স্বর্ণালী ঢেউ মাঝে মাঝে শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে দৃষ্টির পরে। ছোট জানালা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একেকটি দৃশ্যপট প্রতি মুহূর্তে কালের গতিতে… আগামীর প্রতি সশ্রদ্ধায় আত্মনিবেদন করে..

দৃষ্টির বিভ্রমে কখনো দ্রুত কখনো বা ধীরে। ছন্দময় ঝিক ঝিক শব্দে নিমগ্নতায় পেয়ে বসা মনের গহীনে গচ্ছিত হাযারো স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে। চোখের তারায় ভেসে বেড়াচ্ছে অধরা কোন স্বপ্ন। কোন এক সূদুরে মনটা বিধে রইল কে জানে… তখনো ট্রেন প্লাটফর্মে স্থির হয় নি। সম্বিত ফিরলো জানালার বাইরে থেকে হাত বাড়ানো ময়লা, জীর্ণ বস্ত্র পরিহিতা নারীর ভিখ্ মাগায়। কোলে মুদ্রিত চোখে এলিয়ে থাকা রুগ্নদর্শন শিশু। একদন্ড দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পকেট হাতড়ে নির্বিকার ভাবে দু’টাকা বাড়িয়ে দেই। ভীখারীনী পরের জানালায় এগিয়ে যায় ব্যস্তভাবে। সবার আগে আগে প্রথম ভিক্ষাটা সংগ্রহে সে খুব সচেতন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় ওর নিশ্চয়ই জানা ভিক্ষাদাতার মনস্তত্ব। খানিক বাদে ট্রেন আবার নড়ে উঠল পরবর্তী গন্তব্যের পথে। অবলা নারী ক্ষণিকের বিশ্রাম পায় পরবর্তী ট্রেন আসার পূর্ব পর্যন্ত। নিত্য পরিচিত এ দৃশ্যটি আজ কেন যেন অস্বস্তিকর ঠেকল। আবার তাকালাম নারী ও শিশুটির যাত্রাপথের দিকে। কে এই নারী.. কার এ সন্তান.. কেন সে রাস্তায়..কেমন এদের জীবন.. কোলের সন্তানটিও কি বড় হয়ে ওর মায়ের মতই রাস্তায় ঘুরে ফিরবে.. স্রষ্টা কি ওদের এজন্যই সৃষ্টি করেছেন.. এভাবেই কি ওদের জীবন একদিন শেষ হয়ে যাবে..!

দীর্ঘ তন্ময়তা ভঙ্গ হয় পরের স্টেশনে এসে ট্রেন থামায়। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরে এলো প্লাটফর্মের এ মাথা থেকে ও মাথা। হরেক কিসিমের মানুষের মাঝে উত্তপ্ত গরমে দেয়াল ঘেষে তন্দ্রাচ্ছন্ন কিংবা শূণ্য বোবা দৃষ্টিতে শুয়ে থাকা অপুষ্ট, নোংরা পোষাক পরিহিত মানুষগুলো দৃষ্টি এড়ায় না। কারো চুল পীতাভ লম্বা জটাধরা। শরীর বহুদিন পানির পরশ থেকে বিচ্ছিন্ন। কেউ বা পান চিবুচ্ছে একমনে। সিগারেটের কাপা কাপা ধোঁয়ায় নেশাচ্ছন্ন হচ্ছে কেউ। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি ওদের লক্ষ্যহীন, গন্তব্যহীন, পশুবৎ জীবনযাত্রার দিকে।

গলা শুকিয়ে আসে। ঘাড় ব্যাথায় টনটন করে। কিন্তু দৃষ্টি ফেরাতে পারি না। বিষাদের মেঘে মনটা খুব ভারী হয়ে আসে। এক সময় নীল আকাশের স্রষ্টার দিকে অভিযোগের নেত্র নিবদ্ধ হয়। হায় মালিক! ওরা কি তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টজীব নয়? এ দশা কেন ওদের? কি অপরাধ ওদের? নাকি শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার এই আমাদের মত পাপীষ্ঠদের জন্য পরীক্ষার নির্মম গিনিপিগ হিসাবে রেখেছ ওদের?..অশ্রুর কুয়াশায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে..। ভেবে যাই, এদের জন্য কি সরকার, প্রশাসন বা স্থানীয়দের কিছুই করার নেই? জাতীয়-আন্তর্জাতিক হাযারো সংস্থা যারা হররোজ দারিদ্র বিমোচন সেমিনার আর প্রশিক্ষণে কোটি কোটি টাকা ঢালছে তাদের কি নজর কোনদিন পড়েনা রেল লাইনের এ মানুষগুলোর প্রতি? দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলেম-ওলামা ও দ্বীনী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ যাদের দায়িত্ব ছিল সামাজিক নেতৃত্ব প্রদান করা, তারা কি সমাজের অতি নিম্নস্তরের এই মানুষগুলোর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন না? দ্বীন কি শুধু উচু-মধ্য তলার মানুষগুলোরই অলংকার.. এতে কি নীচতলার এই নোংরা অস্পৃশ্যগুলোর কোন অধিকার নেই.. এদের কি জান্নাত, জাহান্নাম নেই..।

ভাবতে ভাবতে ট্রেন আবার নড়ে উঠেছে গন্তব্যপানে। সহসাই চমকে উঠি.. ওদের জন্য কি আমারও করণীয় আছে কিছু? মনের ভিতর যেন ছোটখাট ঝড় বয়ে যায়। দূর্বল আত্মা এক লম্বা, ভারী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আটকে পড়ে সংশয়ের খাঁদে। অক্ষমতার এক দূর্বহ ভার চেপে বসে চিন্তার অলি-গলিতে। মধ্যবিত্তের পিছুটান মানসিকতা সাঁজ সাঁজ রব নিয়ে হাজির হয় মুহূর্তেই। বাস্তববাদী হবার তাগাদা দেয়। তাচ্ছিল্যের সাথে এক ঝটকায় দূরে ঠেলে দেয় নিরর্থক কষ্টকল্পনাকে। খামছে নিবৃত করে দেয় আমার অসার কর্তব্যবোধকে। উপদেশ দিয়ে বলে চলে, ওরা চলুক ওদের পথে.. ওদের দেখার প্রয়োজন নেই.. নিজেকে সামলাও.. ওদের রূযির মালিক, হেদায়েতের মালিক আল্লাহ.. তোমাকে ভাবতে হবে কেন ওদের জন্য।.. মুমিনদের উদ্দেশ্যে কাফিরদের কথাটি মনে পড়ে যায় এ সময় ‘আমরা কি তাকে খাদ্য দান করব যাকে আল্লাহ চাইলেই খাওয়াতে পারেন? তোমরাতো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ডুবে আছ (ইয়াসীন ৪৭)।

তবুও ভাবান্তর আসে না.. মনে হয় কথাটা যেন ঠিকই..। পথের ধুলোদের জন্যই তাহলে ওদের সৃষ্টি.. আমার দয়াদ্র চিত্ততা, ঔদার্য, শোকরগোজারী, দানশীলতা আর হাযার রকম অনুগ্রহ পরীক্ষার জন্যই হয়ত স্রষ্টা ওদের এই অবয়ব দিয়েছেন..। শেষ বেলায় প্রবোধটা মেনে নিতে দেরী হয় বেশ। সেই ফাঁকে হঠাৎই কেন যেন ভাবতে ইচ্ছা করে- এই অস্পৃশ্যগুলোকে আলোর পথ দেখাতে স্রষ্টা কেবল আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন। এ দায়িত্ব আমাকে নিতেই হবে। মনটা আনচান করে উঠে ওদের জন্য।

-তানভীর হাসান লাবীব, কলেজ রোড, প্রফেসরপাড়া, মাগুরা।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button