জীবনের বাঁকে বাঁকে

ভলতেয়ারের বামুন

টিয়া-ময়নার জন্য খাঁচা জিনিসটা বেশ জুৎসই, এমনকি কুকুর-বিড়াল-বানরের জন্যও। খোদ হাতি পর্যন্ত পলকা দড়িতে বাঁধা পড়ে। মানুষের কাহিনী অবশ্য আলাদা, তার দৃষ্টির ঔদ্ধত্যের সাথে পাল্লা দেয় তার চিন্তার গোয়ার্তুমি। তালাবদ্ধ মন তার ধাতে নেই। কাজেই মধ্যযুগের কিছু পেটমোটা সন্ন্যাসী যখন বলে বসল- চার্চ যা বলবে তাই হবে, বোঝা গেল এদের কপালে খারাবি আসছে শীঘ্রই। খাঁচায়-পোরা প্রজ্ঞা আকাশের দিকে তাকিয়ে ডানা ঝাপটানোর চেষ্টা করল- হে মহাজীবন, আর এ ধোঁয়াশা নয়; এবার কঠিন, কঠোর যুক্তি আনো!

অতঃপর ইতিহাসের রসিকতাঃ এতদিনের জাঁকিয়ে বসা সাধু-সন্ন্যাসীদের আসন টলল, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার “ঘাট হয়েছে” বলে ইউরোপের মাটি ছাড়ল, মানুষ ভাবতে শিখল, সন্দেহ শিখল, নতুন দিনের পথে আরো একবার পা বাড়াল। এই বিপ্লবের সময়টাকে আমরা ভালবেসে ডাকি Age of Enlightenment– আলোকপ্রাপ্তির যুগ। এই যুগের মানুষগুলোর একজন ছিলেন Francois Marie-Arouet। এই কিম্ভূত নাম বইপত্রে থাকলে মুশকিল, কাজেই ইতিহাস সিদ্ধান্ত নিলঃ এই ব্যক্তিকে মানুষ ডাকবে ভলতেয়ার। ওনারই লেখা একটা গল্প বলতে এত আয়োজন করলাম।

গল্পের নামঃ The Good Brahmin. মূল গল্পটা বেশ বড়, তার মাঝখানের কিছু অংশ বাংলায় তুলে দিলাম।

“দুচ্ছাই, বৃথাই জন্ম এ জগৎ সংসারে- ঝাঁ করে একদিন বামুন বলে বসল।

কেন কেন? জন্ম বৃথা হতে যাবে কেন? শুধোলাম আমি।

বামুন বলল, আরে বাপু, এক-দেড় মাস নয়, চল্লিশ-চল্লিশটা বছর ধরে আমি পড়াশোনা করে আসছি, বুঝলে- আর এখন মনে হচ্ছে বছরগুলো স্রেফ নষ্ট হল। আমার অবস্থা দেখে আমি চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছি কেবল। এই পৃথিবীর কিচ্ছু আমার ভাল লাগে না- কিচ্ছু না। জীবন তো নয়, যেন সাক্ষাৎ বেতালকে কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছি।

এই যেমন ধর- আমার জন্ম আর বেঁচে থাকা সময়ের মধ্যেই, অথচ সময় যে আসলে কি-বস্তু, তা আজও জানিনি। পণ্ডিতেরা বলেন, অতীতে অসীম সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, যেমন যাবে ভবিষ্যতেও; অর্থাৎ দুই অসীমের মাঝে আমাদের অবস্থান। কিন্তু অসীমকে চেনা দূরে থাক, তার সম্পর্কে আমার ধারণামাত্র নেই। পদার্থ দিয়ে আমার শরীর গড়া- অন্তত সেরকমটাই মনে হয়- এদিকে চিন্তা-চেতনা-প্রজ্ঞা কিভাবে এল, এসম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। প্রজ্ঞা কি কোন ক্ষমতা, নাকি চলাফেরা বা পরিপাক জাতীয় কোন তন্ত্র- এটা পর্যন্ত জানি না, এমনই দুরন্ত বে-ওয়াকেফ আমি। আমার জ্ঞানের দৌড় প্রজ্ঞা আর বুদ্ধির তত্ত্বকথা দূরে থাক, গতির তত্ত্ব পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি। কেনই যে আছি আর কেনই বা এলাম সে এক অনন্ত রহস্য, আমার প্রত্যেকটা দিন কাটছে সেই রহস্যের পেছনে মাথা খুঁড়ে। কিছুই কি জানলাম? উত্তর আমার চাই-ই চাই, কিন্তু তার আশা যেন প্রতিদিনই নিভে আসছে। আমি কথা বলি প্রচুর, কিন্তু কথা শেষ করার পর নিজেই লজ্জিত বিভ্রান্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি।

ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন যদি কর- আরও বিপাকে পড়ব। ভগবান বিষ্ণু কি ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন, নাকি তাঁরা উভয়ই অনাদিকাল থেকে ছিলেন? ঈশ্বর জানেন আমি নিতান্তই নির্বোধ, এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান গ্রীষ্মকালের গঙ্গার মত হাঁটুতে এসে ঠেকে। মানুষ এসে আমায় প্রশ্ন করে, “ঠাকুর, জলে-জমিনে এতরকমের পাপ-দুষ্কৃতি-কষ্ট-বেদনা কেন জানাবেন?” জানাতাম, যদি সে হতভাগার চেয়ে আমার গম্যি বেশি হত। কখনও তাদেরকে বোঝাই- দেখো বাছারা, সবকিছুই তোমাদের ভালোর জন্য। বুড়ো বেতো পেটে-পাথরওয়ালা আর যুদ্ধে ঠ্যাং-হারানোদের কাছে সেটা ভীষণ বেখাপ্পা শোনায়, যেমনটা শোনায় আমার কাছেও।

মাথায় একরাশ কৌতূহল নিয়ে তখন ঘরে ফিরি- ভাবি সেই বৈদিক যুগের মুনিঋষিরা এই সব ঝামেলা ঘায়েল করে গেছেন। কিন্তু শাস্ত্র হাতড়ে আমার বিভ্রান্তি বাড়ে বৈ এতটুকু কমে না। আমার সমমনাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা যখন বলি- দেখি আক্ষরিক অর্থেই নানা মুনির নানা মত। কেউ বলে- নিকুচি করি অত চিন্তার, ঋণং ঘৃত্য বহিং পঠেৎ, যাবং জীবেৎ সুখং জীবেৎ। অন্যেরা মনে করে তারা বেশ অনেক কিছু জানে, কিন্তু তাদের প্রস্তাব-উপপ্রমেয়-সিদ্ধান্তের জটিলতার শেষ মাথায় শুধু ছন্নছাড়া বিভ্রান্তি। এই গোলকধাঁধায় যতই এগোই, পথের প্যাঁচ ততই বাড়ে, আর দিশে আরো বেশি করে হারায়। কি অন্তহীন হতাশা ভেবে দেখেছ? মাঝে মাঝে মনে হয় এই হতাশার কাছে হাল ছেড়ে দেই, আর তখনই মনে হয়- না তো, কিছুই তো জানা হল না। কে আমি? কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাব? সেখানে আমার পরিণতি কি হবে? কিছুই জানি না, কিচ্ছু না।

বেচারাকে এই অবস্থায় দেখে আমার বেশ খারাপ লাগল, এর মত বুদ্ধিবাদী, সৎ, খোলামনের মানুষ আর কে থাকতে পারে? মনে হল, তার চিন্তার গভীরতা আর হৃদয়ের স্বচ্ছতাই এরকম পীড়ার কারণ।

ঐদিনই বামুনের এক বুড়ি প্রতিবেশীর সাথে আমার সাক্ষাৎ হল। আমি তাকে শুধোলাম, তোমার আত্মা কিভাবে এসেছে এ সম্পর্কে তুমি জান? এইসব চিন্তাভাবনা কি তোমাকে কষ্ট দেয়? বুড়ির কাছে আমার প্রশ্নটা বোধগম্যই হল না।

কপাল! বামুনমশাই যেসমস্ত উৎকট চিন্তায় হাঁপিয়ে মরছেন- একটিবারের জন্যও, জীবনের অসতর্কতম মুহূর্তটির জন্যেও এই বুড়ির মনে সেসব চিন্তার উদয় হয় নি! বুড়ি তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভগবান বিষ্ণুকে বিশ্বাস করে এসেছে, গঙ্গা থেকে প্রক্ষালনের জন্য একঘটি পবিত্র জল পেলেই তার চাইবার আর কিচ্ছু নেই। চোখ বন্ধ করে একে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ তকমা দিয়ে দেওয়া যায়।

হতভাগীর সুখ দেখে ফিরলাম আমার সেই বামুনের কাছে।

মশাই, আচ্ছা মানুষ বটে তুমি। তোমার পঞ্চাশ গজের মধ্যে এক থুত্থুড়ে বুড়ি তোমার মত এসব কিচ্ছু ভাবছে না, অথচ তার জীবনে সুখের কমতি নেই। এভাবে কষ্টে দিন কাটিয়ে তোমার লাভটা হচ্ছে কি শুনি? শুধোলাম তাকে।

বামুন বলল, তা তুমি মন্দ বলনি। আজ পর্যন্ত আমি সহস্রবার নিজেকে বলেছি, আমার প্রতিবেশীর মত নির্বোধ হলেই আমার সব কষ্ট-দুঃখ-দুশ্চিন্তা চুকে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা কি জান? এরকম সুখের আমার দরকার নেই।

পৃথিবী নামের এই নাট্যশালার অনেক কিছুই আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছে, কিন্তু বামুনের এই উত্তরটার মত আর কিছুই নয়।”

গল্পতো শুনলেন, এবার ঈশপের গল্পের মত নিচে লেখা নীতিকথাটাও পড়ুন।

আমাদের অনেকেরই একটা ধারণা এরকমঃ মানুষের ধর্ম পালন করার কারণ হচ্ছে শান্তি বা স্বাচ্ছন্দ্য। ব্যাপারটা একদিক থেকে ঠিক, আবার আরেকদিক থেকে ভুল। ধর্মের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষকে শান্তি দেওয়া নয়, বরং মানুষকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা জানানো। মাটির রসে মজে মানুষ যখন তার স্রষ্টাকে ভুলে থাকে, ধর্ম তখন তাকে নাড়া দেয়- হে বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি! ওঠ, তোমার প্রভুর মহিমা ঘোষণা কর! ডাক শুনে চিন্তাশীল মানুষ ধড়মড়িয়ে উঠে বসে, সামনে তাকিয়ে দেখে গন্তব্য বহুদূর। যাত্রা দীর্ঘ হতে পারে, কষ্টকর হতে পারে, কিন্তু সে জানে, মহাবিশ্বের কোত্থাও যদি মুক্তি থেকে থাকে, তবে তা এখানেই, এখানেই, এখানেই। এই চেতনাই তাকে সকল কষ্টের মধ্যে সান্ত্বনা দিয়ে রাখে। কাজেই শান্তি হচ্ছে ধর্মের byproduct- কিন্তু কিছুতেই মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের বামুনের কথাটা ভেবে দেখুন- বেচারা কিন্তু সহজেই দর্শন ফেলে রেখে সুখী হতে পারত, কিন্তু এই যে কষ্ট- এই যে কিছু একটা না পাওয়ার বেদনা, এটাই ছিল তার সম্বল। তার আত্মার কাঠগড়ায় তার এই ব্যাথার দান তুলে ধরে সে বলতে পারতঃ আমার যথাসাধ্য আমি করছি। ধর্মের চেতনা এর খুব কাছাকাছি। জীবন থেকে ধর্মকে ছেঁটে ফেলে কেউ কেউ হয়ত সুখী হতে পারবে, কিন্তু তার আত্মার কাছে (এবং হয়ত স্রষ্টার কাছে) তাকে থাকতে হবে অপরাধী। কাজেই, ধর্ম আপনার জীবনে কিরকম সুখ এনে দিচ্ছে তা নিয়ে ধর্মের সত্যতা বিচার করলে হবে না। চিন্তা করে দেখুনঃ আমাদের নবীর (সা) জীবনী পড়লে কি মনে হয় তিনি মহাসুখে দিন কাটিয়েছেন? মরুর ফুটন্তপ্রায় বালুর মধ্যে বিলাল যখন পাথর বুকে নিয়ে পড়ে থাকতেন, তখন কি তিনি খুব সুখে ছিলেন? কিন্তু এসবের পরেও এঁরা শেষ পর্যন্ত সুখী হয়েছেন, কারণ এই সব আত্মত্যাগ, এই যে আল্লাহর সামনে এই বুঝি ভুল করে ফেললাম- জাতের অস্থিরতা, এগুলোই তাদের প্রশান্তি এনে দিয়েছে। প্রশান্তি আর সুখ তাই ভিন্ন ব্যাপার। আল্লাহ কুর’আনে কোথাও সেভাবে বলেননি যে বিশ্বাসীরা ইহকালে সুখী জীবন উপভোগ করবে, বরং উলটো- আল্লাহ সবসময় বিশ্বাসীদের তটস্থ রেখেছেন, তাদের শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন, জীবনের কষ্টের সাথে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কিন্তু বিশ্বাসীদের উপর প্রশান্তি নেমে আসবে- একথা কিন্তু ঠিকই বলেছেন।

আল্লাহর দেওয়া সেই প্রশান্তির সাথে তুলনীয় কিছু নেই। আসলেই নেই।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button