এত কষ্ট কেন বেঁচে থাকায়?
জীবন নিয়ে আমাদের কমবেশি কমপ্লেইন আছে প্রায় সবারই। আমাদের দুঃখের তালিকা যেন আর শেষ হয় না! স্বামী-স্ত্রীর মাঝে না-পাবার গল্প, মায়ের মুখে সন্তান শোনে কতো আক্ষেপ আর বেদনার হাহাকার, দু’ বন্ধুর কথা শুনুন, সেখানেও দুঃখেরই প্রলাপ!
আমরা সবাই (অন্তত যারা এই নোটটা পড়ছেন), খাচ্ছি-দাচ্ছি, আমাদের মাথার উপর ছাদ আছে, গায়ে কাপড় আছে, সামনে একটা পিসি/ হাতে মোবাইল সেট! এই হয়তো এক্ষণ আপনার কথায় এক কাপ চা এনে সামনে রাখা হলো, বা আপনি পড়াশুনার (বা আড্ডার উদ্দেশ্যে) কলেজ/ ভার্সিটির দিকে যাচ্ছেন… এতোকিছু পেয়ে তবুও আমাদের মনে না পাবার দুঃখ। আমাদের সবসময় মনে হয় এটা পেলাম না, ওটা পেলাম না… বাড়ি নাই, গাড়ি নাই, ডিজাইনার কামিজ নাই, ডি.এস.এল.আর ক্যামেরা নাই, দামী মোবাইল সেট নাই, সুন্দর একটা ব্যাগ নাই, ভালোবাসার মানুষ নাই, বন্ধু নাই!! আরো কতো কী…!
কার সাথে তুলনা করছি আমরা? আমাদের সামনে দু’ ধরনের এক্সাম্পল রয়েছে। এক, দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন, যেখানে তিনি মদীনায় যাবার পর পরপর তিন দিন কোনদিন পেট পুরে খেতে পারেন নি। ক্ষুধার কষ্ট জানেন তো? কখনো রমজানের রোজা রেখে থাকলে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারবেন, অবশ্য সন্ধ্যায় বাহারি ইফতার হয়তো আপনার সামনে ঠিকই প্রস্তুত থাকবে। তিন দিন না খেয়ে থাকার কষ্ট তাই আমাদের কল্পনাতীত! আমাদের যখন লাগে, বলতে অন্তত পারি “ডিম এনো, সবজি এনো, মাংস কিনো”। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না খেয়ে থাকতেন, সেটা ভেবে দেখার আমাদের সময় কোথায়?
মুস’আব ইবন উমাইর (রা) এর কথা আমরা ক’জন জানি? তিনি রাসূল (সা) এর একজন সাহাবী। তাঁর পরনে থাকতো সবচেয়ে সুন্দর পোশাক, গায়ে দামী পারফিউমের গন্ধ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে রাস্তার মানুষেরা তার দিকে একবার হলেও ফিরে তাকাতো। অনেকটা আমাদের যুগের ‘সেলিব্রিটি’দের মত! তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁর মা অনেক অত্যাচার করে, তিনি ইসলাম ত্যাগ না করলে সে ক্ষান্ত হবে না! কিন্তু ইসলামের সাথে আপোস করবে মুস’আব? তা হয় না। একসময় মা বাড়ি থেকে তাকে বের করে দিল। ছেলে পালিয়ে বিয়ে করেছে দেখে ত্যাজ্য পুত্র করতে দেখেছি আমি অনেককে। তবু তো গায়ের জামাটা খুলে রাখে না! মুস’আব ঘর থেকে বের হয়েছিলেন চটের একটা বস্তা পরে! কিন্তু ইসলাম ছাড়েন নি।
আমরা এই মুস’আবের সাথে নিজেদের তুলনা করি? উঁহু! আমরা তুলনা করার সময় টেনে আনি পাশের বাড়ির মেয়েটার কথা যে গাড়িতে করে কলেজে যায়, অথচ আমি পারি না! সেই বন্ধুর কথা যার হাতে আইফোন বা ব্ল্যাকবেরী, বগলে গার্লফ্রেন্ড! আমাদের তুলনা তার সাথে যে আঙ্কেল-আন্টি সুদের টাকায় ব্যাংকের লোন নিয়ে বাড়ি বানায়, গাড়ি চালায়, হারাম টাকার উপর হজ্জ্ব করে! কেন? কেন আমরা এদের তুলনা হিসেবে বেছে নিব? কারা এরা? মুসলিম? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নাই, ছেলেমেয়ের হিজাব নাই! জুম্মার নামাজ পড়া মুসলিম? সুদের টাকায় যাকাত দিয়ে মুসলিম? যারা মুসলিম কিনা তা নিয়েই সন্দেহ তাদের সাথে করি আমরা নিজেদের তুলনা! বাহ!
আমাদের সামনে দুই রকমের উদাহরণই উপস্থিত। আমরা কয়বার তাদের সাথে নিজদের তুলনা করি যারা আমাদের সামনে ঈমানের দৃঢ় পরিচয় রেখেছেন! কয়জন সাহাবার নাম জানেন আপনি? আর দেখুন তো কতোজন bollywood-hollywood actor-actress এর নাম গড়গড় করে বলে দিচ্ছেন, সাথে হয়তো তাদের life-এর আদ্যোপান্ত কাহিনী মুখস্থ!
এই আমরাই আবার আল্লাহর বিরুদ্ধে নালিশ করি (নাউযুবিল্লাহ)! মুসলিমদের বলতে শুনি, “দুআ করে লাভ কি? যেটা হবার সেটাই তো হবে”… “আল্লাহর ইচ্ছাতেই যদি সব হয় তাহলে দুআ চাওয়ার দরকার কি?” এটা নিয়ে বহুদিন আগে পড়া একটা কথোপকথনই তুলে দিচ্ছি। হয়তো এটা অনেকেরই পড়া –
ইবরাহীম ইবন আযম (আল্লাহ তাঁর উপর রহমত বর্ষণ করুক) ছিলেন একজন শিক্ষক এবং সুফিয়ান আস-সাওরির একজন সঙ্গী। তাকে একটা আয়াত নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো যেখানে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব।” (সূরাহ গাফির ৪০:৬০)
মানুষগুলো বললো, আমরা দুআ করি কিন্তু আমাদের দুআ কবুল হয় না কেন? … তিনি তাদেরকে বললেনঃ
তোমরা আল্লাহকে চিনো, তারপরও তাকে মেনে চলো না
তোমরা কুরআন পরো,অথচ সে অনুযায়ী পালন করো না
তোমরা শয়তানকে জানো, তবুও তার কথাই মেনে নাও!
তোমরা বলো মুহাম্মাদ (সা) কে ভালোবাস, কিন্তু তাঁর সুন্নাহ্র অনুসরণ করো না
তোমরা বলো জান্নাতে যাতে চাও, কিন্তু তা পাবার জন্য কাজ করো না
তোমরা বলো জাহান্নামের আগুনকে ভয় পাও, অথচ তোমরা নিজেদেরকে গুনাহ থেকে দূরে রাখো না
তোমরা বলো নিশ্চয়ই মৃত্যু সত্য, কিন্তু তোমরা নিজেদেরকে তার জন্য প্রস্তুত করো না
তোমরা অন্যের ভুল খুঁজে বের করো, তবে নিজের ভুলের দিকে দৃষ্টি দিতে ভুলে যাও
তোমরা আল্লাহর দান করা খাবার খাও, অথচ তোমরা তাঁর শুকরিয়া আদায় করো না।
সুতরাং আপনি আল্লাহর সাথে দায়িত্ব পূরণ করুন, আল্লাহ আপনার খেয়াল রাখবে। আপনি কি আপনার দায়িত্ব পালন করছেন? আপনি কি বলবেন – ‘এসব আগের যুগের মানুষের কথা, এখন এরকম ইসলাম পালন সম্ভব না’?… তাহলে শুনুন, আপনি সেই যুগেই বাস করছেন যখন আফিয়া সিদ্দিকী ইসলামের কাজ করার জন্য প্রতিদিন ধর্ষিত হয়। আপনার সাথে/ আপনার মা-বোনের সাথে কেউ একটু খারাপ ব্যবহার করলে কেমন লাগে? তাদের গায়ে হাত দিলে? চিন্তা করুন, এরকম অসংখ্য মা-বোনের দেহ-মন নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে এই দ্বীন পালনের জন্য, তবু তারা পিছপা হয় না। হাজারো ভাইকে ধরে জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইসলাম পালনের জন্য। এদের সামনে আপনার ‘ঈমান কম’ এই অজুহাত অত্যন্ত দুর্বল। এটা হলো আপনার ‘দুঃখ থেকে দূরে’ থাকার অজুহাত মাত্র।
এই অল্পদিনের আরাম-আয়েশের কথা ভেবে ইসলামের জন্য কি করলেন আপনি? আল্লাহ আপনাকে ইসলাম দিল, মুসলিম হবার তওফিক দান করলো। আপনি এ সুযোগ হেলায় দূরে ঠেলে দিলেন। ছিঃ… দুনিয়ার একটু সুখ-শান্তির জন্য জন্য কি করলেন? আখিরাত ভুলে গেলেন। আপনার জীবনের লক্ষ্যই হয়ে গেছে এ জীবনে সব পাওয়া! তাই দুঃখ আপনার সহ্য হয় না। এ জীবনের ভোগ-বিলাস পাবার আশায় কতো অল্প মূল্যেই না ইসলামকে বিকিয়ে দিচ্ছেন…
আল্লাহ বলেন, “এরাই হল সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করেছে এবং (খরিদ করেছে) ক্ষমা ও অনুগ্রহের বিনিময়ে আযাব।” সূরাহ বাক্বারার ১৭৫ নম্বর আয়াত। মুসলিমদেরকে নিয়ে কথাটা বলা হয়নি। কিন্তু মনে পড়লে ভয় লাগে! গোমরাহি মানে ভুল পথ। ইসলামকে পেয়েও আমরা তা নিয়ে চিন্তিত নই! আমরা এখন টাকা-পয়সা-শক্তি-সমর্থ-সময়-মন সবকিছু দিয়ে নিশ্চিত করছি কীভাবে এই দুনিয়াটাতে আরাম পাওয়া যায়, সফল হওয়া যায়, মৌজ-মাস্তি করা যায়! আর এসব করতে যায়ে ভুলে যাচ্ছি নিজের দ্বীনকে, ভুলে যাচ্ছি আমাদের অস্তিত্বকে, ভুলে যাচ্ছি আমি মুসলিম।
মনে রেখেন, যত চেষ্টা-চরিত্রই করুন না কেন, সেই “সুখ-পাখি” আপনাকে ধরা দিবে না! কারণ এই দুনিয়ায় কখনো পুরা সুখ পাওয়া সম্ভব না। দুঃখ-বেদনা-কষ্টে জর্জরিত হয়ে আপনি আল্লাহর সাথে অভিমান করতে পারেন, কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনি কি আল্লাহর সাথে আপনার ওয়াদা পালন করেছেন? আল্লাহ আমাদের কী পরীক্ষা নিচ্ছেন, এই কমপ্লেইন না করে একবার ভাবুন আল্লাহকে খুশি করার জন্য আপনি কতোবার চিন্তা করেছেন…? আপনার সুখের দৃষ্টান্ত যেন শুধু এই দুনিয়া না হয়ে যায়। ‘কারো এটা আছে-আমার ওটা নেই’ এই তুলনা করার আগে মনে রাখবেন, আজো শত শত ফাতিমা, আফিয়া, তারেক মেহান্না, বাবর আহমেদ ইসলাম বুকে নিয়ে চলছে। তুলনা যদি করতেই হয়, তো সেরা জনের সাথেই করুন।
– অনিকা ওয়ারদা তুবা