জীবনের বাঁকে বাঁকে

শূন্যস্থান পূরণ

অনেকক্ষণ হল চুপ করে পড়ার টেবিলের সামনে বসে আছে ফারিহা। কেন যেন বার বার মনে পড়ছে তিনজন মানুষের কথা। দুজন তার পুরানো বান্ধবী জেরিন আর রীতা। আর আরেকজনের সাথে আজই প্রথম দেখা। রাস্তায়। ঘুরে ফিরে ভাবতে লাগলো ফারিহা সেই তিনজন সফল মানুষের কথা! 

১)

রীতা সেই কোন ছোটবেলায় ফারিহার স্কুলে পড়ত। তারপর কোথায় চলে গেল, শেষ পর্যন্ত কি নিয়ে পড়ালেখা করেছে ফারিহার জানা নেই। হঠাত যখন বহু বছর পর দেখা, রীতা তখন অন্য জগতের বাসিন্দা। মডেলিং করে। ছবিও তোলে। অনেক বন্ধু বান্ধব। আজকে এখানে পার্টি করছে, কাল সেখানে তাদের ছবির প্রদর্শনী চলছে! আর্ট এন্ড ক্র্যাফটসের লাইনে মনেহয় রীতা জড়িত, তাই ঈদেও তাদের কি সব স্টল থাকে, পূজাতেও থাকে। বিয়ে করেনি এখনো, পাত্র নাকি পায় না। তবু ফারিহা ওর ব্যাপারে তেমন কিছুই জানে না। ভাসা ভাসা জ্ঞান, আর ফেসবুকের কারণে যেহেতু আজকাল মানুষের ঘরের খবর সবই জানা যায়– ওটুকুই জানে! আজ হঠাত রীতা সকালে ফোন দিয়ে বলেছিলও ওর সাথে একটু দেখা করতে চায়। রীতার বাসা ধানমন্ডিতে। গিয়েছিল ফারিহা। সুন্দর ছিমছাম বাসা রীতাদের। ওর মা বাবা কেউ বাসায় ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে রীতার কথা শুনল সে। একটা ছেলেকে ভালবাসত। পরে ঠিক বিয়ের আগে জেনেছে যে সেই ছেলে আরও অনেকের সাথেই ভালবাসার প্রতিজ্ঞা করেছে। এই অবস্থায় তো আর বিয়ে করা যায় না সেই ছেলেকে। এখন চলছে ডিপ্রেশান। সান্তনা খুঁজে বেড়াচ্ছে "হাসো জিও মুসকুরাও" বুলির মাঝে। স্পট লাইটের মাঝে। বন্ধু বান্ধবদের মাঝে যারা নাকি ফ্রেন্ড ও, আবার ছবির মাঝে "হট এন্ড … " কমেন্ট দিতেও ভুল করে না কখনো। ফারিহাকে কেন ডাকল তবে রীতা? ও তো কোনও ভাবেই খাপ খায় না রীতার ফ্রেমে!! এখন ও রীতাকে কী বলবে, কোথা থেকেই বা শুরু করবে?? 

২)

জেরিনের সাথে দেখা করার কথা ছিল দুপুরে। রীতার বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগলো ফারিহা। এখান থেকেই ওকে পিক করবে জেরিন। যেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, দেখলো সেটা একটা বিউটি পার্লারের সামনের রাস্তা। কত মানুষ ঢুকছে। কর মানুষ বের হচ্ছে! "হ্যাঁ আমি মেনিকিওর করাতে এসেছি!" এত জোরে বললেন পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় একজন মহিলা যে ফারিহা চমকে গেল! মহিলাকে দেখল ভালো করে। দেখে মনে হচ্ছে না মহিলার মেনিকিওর দরকার! এমন জরাজীর্ণ যার হাত পা, তিনি একদিন মেনিকিওর করে কোনও লাভ হবে না। কেন জানি খুব মায়া লাগলো হঠাত মহিলাকে দেখে। আবার চমকাবার পালা– খিল খিল হাসির শব্দে। দুটা মেয়ে বের হচ্ছে পার্লার থেকে। সেই মহিলাকে দেখে তাদের এই হাসি। একটু অবাক হয় ফারিহা। মানুষের ভদ্রতা বোধটাও আজকাল আর নেই। মেয়েগুলো রিক্সা খুঁজতে পাশে এসে দাঁড়ায়। ওরা বলছিল, "জানিস না শ্বশুরবাড়িতেও কেউ পাত্তা দেয় না, অফিসেও না! হি হি, আমাদের পাশেই থাকে তো– যাকে তাকে বলে বেড়ায় নিজের কথা আর সারাদিন পার্লার আর শপিং মলে ঘুরে। নিজেকে আয়নাতেও দেখে না মনেহয়!!… আর জানিস…"

বলতে বলতে রিক্সা নিয়ে চলে যায় মেয়েদুটো। ফারিহা ভাবতে থাকে– হয়ত এই মহিলা নিজের জীবনে অসুখী। হয়ত বা মানুষকে বলেছেন সেসব। এখন সবাই ঠাট্টা করছে! হয়ত বা তাঁর ধারণা তাঁর চেহারা খারাপ বলে তাঁকে কেউ পাত্তা দেয়না, তাই এসেছেন এই আশ্রয়ে!

নাহ, জেরিনটা বড্ড দেরী করছে। ফোন বের করতে যেয়ে দেখলো সেই মহিলা বের হয়ে আসছেন পার্লার থেকে। যেমন ঢুকেছিলেন তেমনই। পার্লারের ম্যাজিক চোখে পড়লো না। আর মনটাও ভালো হয়েছে কিনা, তাও বুঝা গেল না!!

৩)

গাড়িতে উঠে দেরী করার জন্য জেরিনকে একটা ধমক দিয়ে ফারিহার গাড়িটার দিকে চোখ পড়লো। কি বিশাল গাড়ি! কি গাড়ি কে জানে?? গরম থেকে গাড়ির মনোরম এসিতে এসে মন্দ লাগছে না! গাড়ি থামল গ্যাস নিতে। ও না তো! গ্যাস না, পেট্রোল!! ফারিহাদের গাড়ি আছে। জেরিনদের মত জনপ্রতি একটা গাড়ি না থাকলেও পুরা পরিবারের জন্য একটা আছে। তবে ওটা গ্যাসে চলে। সেটা যার যার ব্যাপার, ভাবলো ফারিহা। আমার কি??

জেরিনদের আলিশান নতুন বাড়িতে আজই প্রথম এল ফারিহা। ওদের ব্যাপার যে আলাদা সে ফারিহা আগে থেকেই জানে। অনেক অনেক জিনিস, দামী ব্যাগ, দামী জুতা… বড় বড় মানুষদের পার্টিতে যাওয়া। বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়া। বড় চাকরি, বড় ব্যবসা। এই বান্ধবীকে বড় ভালবাসে ফারিহা। তাই হয়ত ওর কান্না পায় এসব দেখলে। ফারিহা জানে, এসব হৈ চৈ ডিভোর্সের কষ্ট কবর দিয়ে উঠতে পারছে না। পারছে না শূন্যতাকে ঢেকে রাখতে! 

———————

ভাবতে ভাবতে কখন টেবিলে মাথা নামিয়ে রেখেছে ফারিহা নিজেও তা টের পায়নি! ওর নিজের জীবনের কথা ভাবতে লাগলো। কষ্ট আছে। যন্ত্রণা আছে। আছে প্রতি পদে পরীক্ষা! আছে আরও অনেক কিছু। কিন্তু সে নিজে কোনদিন কাউকে কিছু বলেনি। তার প্রয়োজনই বোধ করেনি কখনো! কোনদিন বন্ধু বান্ধবের কোলাহলে কষ্ট চাপা দেয়ার চেষ্টা করেনি– নাহ, কোনদিন করেনি কথাটা ঠিক না। করেছে। যখন জানতো না যে ওভাবে কষ্ট চাপা দেয়া যায় না তখন করেছে। কিন্তু এখন আর করেনা। ওর কাছে হয়ত আসে অনেকে নিজের সমস্যা নিয়ে। ও যায় না আর কারুর কাছে! হ্যাঁ, তাতে লোকে ভাবে সে সুখী মানুষ। ভাবুক! কিন্তু, কী তাকে মনের জোর জুগিয়েছে??? 

মনে মনে ফারিহা বলল, আলহামদুলিল্লাহ। টেবিল থেকে কুরআনটা নিয়ে গিয়ে বসলো ঘরের কোনে পেতে রাখা জায়নামাজে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। হাত দিয়ে চোখ জ্বালা করে নেমে আসা পানির ফোঁটাগুলো মুছল। হ্যাঁ, এটা। এই কুরআন। এই নামাজ। এই দোয়া। এই চোখের পানি, যার হিসেব রেখেছেন কেবল আল্লাহ। এখানেই শান্তি। এখানেই আশ্রয়। স্পট লাইটের চোখ ধাঁধানো আলোর আড়ালের অন্ধকারের হাতছানি ওর দেখতে হয় না তাই। দেখতে হয় না থাই ফুডের ধোঁয়ার আড়ালে ঢাকা পড়া নিজের চোখের পানির ব্যর্থতা! খুঁজতে হয়না নিজের মূল্য কাপড় জামা আর নেইল কাটারের আড়ালে! জীবনটা এসবের চেয়েও আরও অনেক, অনেক অর্থবহ! ওর কষ্ট ওর রব জানেন। শূন্যতা তিনিই পূরণ করতে পারেন! তার চোখের পানি এক ফোঁটাও বিফলে যায়না কারণ সে কাঁদে তার রবের কাছে! 

ভুল জায়গায় পূর্ণতা খুঁজতে যাওয়ার ভয়াবহ পরিণতি ও আজকে দেখে এসেছে! জীবনের উদ্দেশ্য নেই, পরিণতির চিন্তা নেই! কিছু নেই জীবনে, কিচ্ছু না! কষ্ট সবার জীবনে থাকে। পূর্ণতা থাকে কেবল তাদের জীবনে যারা রবের কাছে তা খুঁজতে যায়! থাকে এক প্রকার সামনে চলার শক্তি! পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মত মনের জোর! 

সত্যিই, এই জীবনটাই শেষ না– শুরু মাত্র– এই বিশ্বাসটা কতই না সহজ করে দেয় সবকিছু! যাদের এই বিশ্বাসটা নেই, তাদের যে ভরসাও নেই! এই জীবনটা তছনছ হয় গেলে আর কোনও পথও জানা নেই! 

মনে মনে আবার বলল, আলহামদুলিল্লাহ!

আর ভাবলো, আমি একা নই! কক্ষনো না!

আলহামদুলিল্লাহ! 

– নায়লা নুজহাত

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button