জীবনের বাঁকে বাঁকে

সরোবর

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

১.

ইকবাল রোড থেকে রিক্সায় উঠেছি বাসায় আসব বলে। রিকশাওয়ালা সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটের অপকারীতা নিয়ে অনেক কথা বললাম।

–       ভাই আমি যে টেনশনে আছি…পরিবারের তিনজন মানুষ অসুস্থ। কীভাবে কি করব বুঝে উঠতে পারতেছি না।

বহুল প্রচলিত যুক্তি। ক্যাঁক করে ধরলাম, উনারা অসুস্থ কবে থেকে?

–       এই তো কয়েক সপ্তাহ।

–       আপনি সিগারেট খান কবে থেকে?

ভদ্রলোকের মুখে আর কথা সরল না।

উনাকে বুঝালাম উনি সিগারেট খেলে মা সুস্থ হয়ে যাবে না। প্রথম কাজ ধৈর্য ধরা। ব্যাপারটাকে একটা বিপদ হিসেবে নেওয়া এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া। দ্বিতীয় কাজ চিকিৎসা করান। টাকা? সেটার জন্যও আল্লাহর কাছে বলতে হবে, তার উপরে ভরসা করতে হবে। আর কষ্ট করতে হবে। একবেলায় জায়গায় দুবেলা রিক্সা চালাতে হবে। সেই সামর্থ্যও যেন আল্লাহ দেন সেটা আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। অপব্যয়, যেমন বিড়ি খাওয়া বন্ধ করতে হবে। সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে ভালো চিকিৎসা করার জন্য।
এরপরে কথা প্রসঙ্গ সরে গেল। একটা রিক্সার জমা এক বেলায় একশ টাকা। আর আল্লাহ যে আমাদের হাত-পা দিলেন, পুরো শরীরটা এক জীবনের জন্য আমাদের কাছে জমা নিলেন তার জন্য আল্লাহ কোনো টাকা জমা নেন না। তিনি চান আমরা যেন শরীরটার যত্ন নেই। বিড়ি-সিগারেট খেয়ে ফুসফুসের বারোটা না বাজাই। কোনো রিক্সার মালিক যেমন পছন্দ করবে না রিক্সাওয়ালারা রিক্সার ক্ষতি করুক তেমনি আমাদের দেহের মালিক আল্লাহও পছন্দ করেন না আমরা আমাদের দেহের ক্ষতি করি। এজন্য তামাক-মদ-হেরোইন-গাঁজা সহ যাবতীয় নেশার বস্তু মুসলিমদের জন্য হারাম করেছেন আল্লাহ। মানুষ যখনই আল্লাহর আইন অমান্য করে সে নিজের আত্মার উপরে যুলম করে, দেহের উপরে অত্যাচার করে, সমাজের জন্য অনিষ্ট বয়ে আনে।

কথায় কথায় বাসায় পৌছে গেলাম। ভাড়া দিলাম। বললাম একটু দাঁড়ান। একজন বোনের দেওয়া জাকাতের টাকা ছিল ২০০০। তার সাথে আরো ১০০০ যোগ করে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বললাম, মায়ের চিকিৎসা করেন। আর যদি কোনো দরকার থাকে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করেন। পাঁচ ওয়াক্ত সলাতে সিজদায় তাঁর সাথে দেখা করেন।

 

২.

সাভারে রানা প্লাজার বিপর্যস্তদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন তৈরি করতে হলো। হুট করে নাম দিয়েছিলাম ‘সরোবর’। সরোবর মানে বিশুদ্ধ পানির হৃদ। সংগঠনটির মাধ্যমে প্রায় দশজনকে রিক্সা আর ভ্যান দেওয়া হয়েছে। প্রায় একশজনকে প্রশিক্ষণসহ সেলাই মেশিন। গরু কিনে দেওয়া হয়েছে চারজনকে। ব্যবসা করার মূলধন একজনকে। যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকের পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি রানা প্লাজা থেকে পাখা মেলে আকাশে উড়ে গেছে। সংবাদপত্রের ভাষায় নিখোঁজ। স্বজনদের ভাষায় মারা গেছে, লাশ গায়েব হয়েছে। যত কম লাশ তত কম ক্ষতিপূরণ। অনেকে আহত। অনেকে নিহত।

একদিন কী মনে হওয়ায় তালিকার মানুষদের ফোন দিলাম। কী আশ্চর্য, যাকে জিজ্ঞেস করি সেই বলে কিছু পায়নি। আমার চোখের সামনে ছবি, সে রিক্সা নিচ্ছে—অথচ বেমালুম অস্বীকার করে গেল। যতই জিজ্ঞেস করি ততই বলে, কিচ্ছু পাইনি। শেষমেশ বলল, আর্মির দেওয়া ২০ কেজি চালের কথা, বিকাশের পনের হাজার টাকার কথা। আমাদের বিশ হাজার টাকার রিক্সাটা? মনে করিয়ে দিতে বলল, হ্যা রিক্সাও একটা পাইছি একখান থেকে। আমরা নাম নেইনি, তাই নাম না উল্লেখ করাতেও সমস্যা নেই কিন্তু একটা মানুষ লোভে মিথ্যা বলবে কেন? অকৃতজ্ঞ হবে কেন? সেলাই প্রশিক্ষণসহ মেশিন পাওয়া একটা মেয়ে এত তাড়াতাড়ি এভাবে চোখ উল্টিয়ে ফেলবে?

 

প্রথমে কষ্ট পেয়েছিলাম। রেগে গিয়েছিলাম। ভাবলাম যাহ কাজ করবই না আর। পরে ব্যাপারটা নিয়ে একজন সমাজসেবার স্কলারের সাথে বসলাম। তিনি বললেন, এটা ডিফেন্সিভ মেকানিসম। সে যদি বলেছে সে পেয়েছে তাহলে তো আর পাবে না। কিন্তু অভাব তো তার আছেই। সুতরাং সে অস্বীকার করবেই। বিকাশ আর আর্মির কথা স্বীকার করেছে কারণ সেগুলো প্রতিষ্ঠিত সংস্থা। যদি অস্বীকার করে তাহলে বিপদ আসতে পারে। সরোবর কোথাকার কী… আমাদের কাছে সত্য কথা বলার দরকার নেই তাদের।

 

৩.

মানুষের জন্য মানুষকে নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার খুব বেশি দিনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে বন্যার্তদের জন্য টাকা তুলেছিলাম সোবহানবাগ কলোনীতে। কেউ দিয়েছিল, কেউ বলেছিল মাফ কর। পাশের বিল্ডিং-এ ভিক্ষুক থাকে—এ জ্ঞান হয়ত ত্যক্তও করেছিল অনেককে। আমি সমাজকর্ম বলতে তখন ওটাই বুঝি—টাকা তুলে প্রথম আলোর হাতে তুলে দেওয়া। গরীব মানুষের টাকার দরকার—এর বাইরে কোনো বোধ ছিল না। কিন্তু যখন থেকে নিজে মাঠে কাজ করা শুরু করলাম, দেখলাম আমাদের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য নয়—অলসতা এবং অসততা। একটা চারশ টাকার কম্বলের জন্য মানুষ সারাটা দিন নষ্ট করবে, দরকার হলে চারশ টাকার দিনমজুরের কাজও বাদ দেবে। আল্লাহ দুটো হাত, দুটো পা দেওয়ার পরেও ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখের কথা বলবে, গরিবী গাঁথা শোনাবে। দরকার হলে মিথ্যা বলবে একটা কম্বল বেশি নেওয়ার জন্য। আবার নেওয়া শেষে আরেকবার মিথ্যে বলবে, আমরা নাকি যারা আসল গরীব তাদের দেইনি। একটা গ্রামের পাঁচশ পরিবার থেকে একশ পরিবার বেছে নেওয়া কতটা কঠিন আমরা জানি। কত সময় লাগে, কত বাসা ঘোরা লাগে—এটা যে করেনি সে বুঝবে না। ঢাকা থেকে এত কষ্ট করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার পর যখন শুনি সৌদি কম্বল আমরাই খেয়ে নিচ্ছি তখন বুকটা কীভাবে ভেঙে যায় এটা বলে বোঝানো যাবে না।

আমরা যদি সাধারণ মানুষ হতাম তাহলে বলতাম, যারা গরীব তারা গরীবই থাক। আল্লাহ তাদের গরীব বানিয়েছে তাদের এই খাসলতের জন্য। এই সমস্ত সমাজসেবা বন্ধ করে এনজিও ব্যবসা শুরু করতাম। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে গলায় পাড়া দিয়ে আদায় করতাম টাকা। কিন্তু আমরা পারি না। কারণ আমরা মুসলিম। আমরা নিজেরাই আল্লাহর নি’আমাতের কত অকৃতজ্ঞ, মানুষকে কীভাবে দোষ দেই। মানুষের এই সামান্য কথাও যদি আমরা ক্ষমা করতে না পারি তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাব কীভাবে? আল্লাহ আমাদের সম্পদে এই গরীব মানুষদের হক রেখেছেন। আমাদের সেটা আদায় করতেই হবে। নাহলে তারা হয়ত মুক্তি পেয়ে যাবে, আমরা আটকে যাব।

সমস্যাগুলো তলিয়ে দেখলে দেখা যায় মানুষের অকৃতজ্ঞতা, অলসতা, অসততা সব কিছুর পেছনে আছে আল্লাহকে না চেনা, না জানা। সত্যিকার অর্থে মুসলিম না হতে পারলে মানুষ বুঝবে না এই পৃথিবীতে সে কেন এসেছে। সে খালি সুযোগ খুঁজবে আরামের। কম কষ্ট করে কীভাবে টাকা পাওয়া যায় সে ফিকির করবে। আত্মসম্মানবোধ খুইয়ে হাত পাতবে। কখনও জানবে না আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ক্ষুধার জ্বালায় মদীনার রাস্তায় গড়াগড়ি করতেন কিন্তু তাও কাউকে বলতেন না পেটের আগুনের কথা।

ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা যে মানুষকে দীনহীন অবস্থার জন্য দায়ী এটা সেকুলার কাউকে বোঝানো যাবে না। অভাব সম্পদের স্বল্পতায় নয়, ঈমানে স্বল্পতায়—এটা বুঝতে হলে অনেক পথ হাটতে হবে। যখন লালমনিরহাটে চরের মাদ্রাসায় বিকেলবেলায় আপনি আট বছরের একটা বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করবেন সে আজ দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছে, সে চুপ করে থাকবে। তরকারি তো দূরের কথা, তাদের মাদ্রাসার চাল যে গত রাতে শেষ হয়ে গেছে সেটা সে আপনাকে বলবে না। প্রায় অন্ধ এক ইমাম আপনাকে বলবে না সে তার পৈত্রিক সম্পত্তির পুরোটাই অন্ধদের মাদ্রাসাতে দান করে সে এখন নিজের দেশের বাড়িতে মুসাফির। এই আত্মসম্মানবোধ ঈমান থেকে আসে। দুনিয়াতে রিক্সা চালিয়েও তাই একজন মুসলিম কারো কাছে হাত পাতবে না, সে জানে নীচের হাত থেকে উপরের হাত ঢের ঢের ভালো। সে ভিক্ষুককে দুটাকা ভিক্ষে দেবে; কাউকে ঠকিয়ে পাঁচ টাকা ভাড়া বেশি নেবে না।

এই ব্যাপারগুলো যবে থেকে বোঝা শুরু করলাম তখন থেকে এটাও মাথায় আসল আমাদের অবুঝ, জ্ঞানহীন ভাইদের আমরা এই অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারি না। এই দেশে অধিকাংশ আব্দুল করিমের মধ্যে নাম ছাড়া ইসলাম খুবই সামান্য। গরিবী হঠাতে ইসলামকে আনা লাগবে। মানুষকে ইসলাম বোঝাতে হবে। এই দুনিয়ার কষ্টের বিশাল পুরষ্কার যে জান্নাত তার সুসংবাদ মানুষকে দিতে হবে। তবে শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না। সহানুভূতিটা মন থেকে আসতে হবে। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেটে দুটো পাথর বেঁধেছিলেন বলেই যার পেটে একটা পাথর বাঁধা তার কষ্টটা ধরতে পেরেছিলেন। মানুষজনের জন্য কাজ করতে হলে মানুষের কাছে যেতে হয়। ধান গাছের নৌকায় বসে মানুষের জন্য কাজ করা যায় না।

 

৪.

বান্দরবানের লামার কথা। আমরা টেম্পু চড়ে যতদূর যাওয়া যায় গেলাম। লক্ষ্য একটি পাহাড়ি মাসজিদ। চেয়েছিলাম দিনের আলো থাকতেই যাব কিন্তু খাবার জন্য চাল-ডাল-মশলা আর একটা মুরগি কিনতে দেরি হয়ে গেল। সবাই প্রকৃতিকে কিছুটা সময়ও দিয়ে এল। মাগরিবের সলাতের পর রওনা। পাহাড়ে সন্ধ্যা আসে ঝুপ করে। ভাগ্যিস সে গ্রামের কিছু ভাইয়েরা কম্বলগুলোর বোঝা সিংহভাগই কাঁধে নিয়েছিল। অন্ধকারে পথ। কখনও বালু, কখনও কাদা, কখনও কাঁটা, কখনও পাথর। শীতের রাতে যখন ঝিরি পার হতে হয় তখন মোজাসহ কেডসের দশারফা। দু ঘন্টা হাটার পরে এসে পৌছলাম সে মাসজিদে। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান অনেকটা জায়গা কিনে দিয়েছিলেন নওমুসলিমদের বাস করার জন্য। অনেক জায়গা এখন বেদখল। যিনি মাসজিদের ইমাম তিনিই মুয়াজ্জিন, তিনিই বাচ্চাদের শিক্ষক। বাচ্চারা ইসলাম শেখে, বাংলা-ইংরেজি শেখে। পরের দিন ভোরে রওনা দিলাম কাছের আরেকটা গ্রামে কম্বল দিতে। ৬০-৬৫ ডিগ্রি খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয়। তারপর নাম, তারপর আবার ওঠ, কিছুটা সমতল। আবার পাহাড়, ঝিরি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পরে সেই গ্রামে এসে পৌছলাম আমরা। পুরোটাই খ্রিষ্টান গ্রাম। হেডম্যান জানালেন শিশু বয়সে খ্রিষ্টান হয়েছেন তিনি। বয়স তার চল্লিশেক। খৃষ্ট ধর্মের বার্তাবাহকেরা তাহলে কত আগে এসেছিল এ গ্রামে? আরো কত দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের? তারা কিন্তু টাকা ছড়ায়নি। খালি সাধারণ মানুষকে বলেছে তোমরা যে এই পাথরকে শ্রদ্ধা কর—এটা তো তোমাদের কিছু দিতে পারে না। তোমরা যিশুর প্রার্থনা কর, তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন, পরকালে স্বর্গ দেবেন। যিশু যে মানুষ, আর মানুষ হয়ে যে মানুষের পূজা করা যায় না এ কথা ঐ গ্রামে আমাদের আগে কেউ বলেনি। ওই গ্রামে ‘বাঙালি’রা এসেছে। গরু চুরি করেছে, ফসল কেটে নিয়ে গেছে, মেয়েদেরও ধরে নিয়ে গেছে সুযোগ পেলে। কিন্তু আল্লাহর কথা কেউ বলেনি। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কেউ আসেনি। সাহায্য করা তো দূরে থাক।

 

আমরা খ্রিষ্টানদের দোষ দেই তারা সবাইকে ধর্মান্তরিত করছে। তারা তাদের বিশ্বাস প্রচার করছে আর আমরা তাদের গালি দিয়ে খালাস। আমাদের কী উচিত ছিল না পাহাড়িদের বাংলা-ইংরেজি-অঙ্ক শেখানোর জন্য একটা স্কুলের ব্যবস্থা করা? আমরা করিনি তাই বিদেশি মিশনারিরা করেছে। দোষ কাদের? আমাদের কী উচিত ছিল না উত্তরবঙ্গের সাওতালদের জন্য একটা হাসপাতালের ব্যবস্থা করার। চাওয়াটা বোধহয় একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের মুসলিম মাদ্রাসার বাচ্চাদেরই আধুনিক শিক্ষা দেই না। আমরা শহরের রিকশাওয়ালাদের বউদের জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থা করি না। কোথায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আর কোথার মঙ্গাপীড়িত এলাকা। যারা নিশ্চিত তাদের ধর্মগ্রন্থ মানব রচিত তারা নিজেদের জীবন সেই মিথ্যা বিশ্বাসের পেছনে খরচ করছে। আর যারা নিশ্চিত তাদের ধর্মগ্রন্থে স্রষ্টার শব্দ রক্ষিত আছে তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। জবাব আমাদের দিতে হবে—মরণ আসুক খালি।

 

৫.

আমরা সরোবরের মাধ্যমে অন্যরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছি। এটা ভুড়িওয়ালা, আরামপ্রিয়, স্বার্থপর মানুষদের জন্য না। চিন্তাশীল মুসলিমদের জন্য। যারা একটু বাক্সের বাইরে ভাবতে ভালোবাসেন। যারা সামাজিক থিঙ্কট্যাঙ্কের গুরুত্ব বোঝেন। যারা নিছক সমালোচনার উর্ধ্বে উঠে সত্যি সত্যি সমাজকে বদলানোর দায় অনুভব করেন তাদের জন্য।

আমাদের উদ্দেশ্য সমাজের দুটো প্রান্তের মাঝে একটা যোগসূত্র করা, শহুরে চশমা পড়া চোখের সামনে দারিদ্রের, বাস্তুবতার রূপ তুলে ধরা। আমাদের মধ্যে যাদের মানবতাবোধ আছে তাদের চোখটা খুলে দিলে তারা দুনিয়াটাকে অন্যভাবে দেখা শুরু করবে। আমাদের কাছে স্বশরীরে অংশগ্রহণ অনেক বড় ব্যাপার। যে দিনাজপুরে মাদ্রাসার টিনের বেড়ার নীচ দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে শোয়নি সে কখনও বুঝবে না শীত কী! সে বুঝবে না সে কত সৌভাগ্যবান। আল্লাহ তাকে কত নি’আমাত দিয়েছেন। যখন মানুষ নিজের আত্মার কাঁপনে বুঝতে পারবে অন্যের কষ্ট—তখন সে মানুষের জন্য কী করা যায় তা ভাবা শুরু করবে। যাকাতের টাকাতে লুঙ্গি আর শাড়ি দান করে মিথ্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে না। শুধু অর্থ নয়, আমাদেরকে দেওয়া মেধাতেও যে আল্লাহ গরীব মানুষের হক রেখেছেন সেটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব তত মঙ্গল।

 

আমরা কীভাবে একজন অসৎ, অলস, খারাপ মানুষকে বদলে দিতে পারি? প্রথমত, তার অবস্থাটা বুঝতে হবে। সহানুভূতি মেশানো একটা হাসি দিতে হবে। এরপরে কেন সে জীবনে বাঁচবে সে কথাটা বোঝাতে হবে। পরিশ্রমের মূল্য বলতে হবে। তৃতীয়ত, কিছু অর্থ দিয়ে পুঁজি তৈরি করে পথ নির্দেশনা দিতে হবে। মাছ কিংবা মৌমাছি যেটাই চাষ করুক সেটা ভালোভাবে শেখাতে হবে। ব্যবসা করার কিছু বুদ্ধি দিতে হবে। তারপরে সাথে থেকে দেখতে হবে সে কাজগুলো করতে পারছে তো? একদিন আমরা দেখব সামান্য একটা সাহায্য  মানুষের জীবনকে কীভাবে বদলে দিতে পারে। আমরা সে চেষ্টাতেই আছি।

 

এখনকার পৃথিবীতে সবকিছুর খরচ আছে। মানুষ আমাদের বিশ্বাস করে টাকা দান করেন গরীব মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য। দানের টাকা আমরা ধরতে চাই না। জাকাতের টাকাতে হাত দেওয়া যায়ই না। তাহলে আমাদের এই উদ্যোগটা চলবে কীভাবে? যে ভাইটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বহু টাকার চাকরি ছেড়ে সরোবরের মাধ্যমে সমাজে একটা পরিবর্তন আনার জন্য কাজ শুরু করেছেন তার বেতন আমরা কীভাবে দেব? ফোনের খরচ? যাওয়া আসার খরচ? হিসেব রাখা সামান্য কাজ মনে হতে পারে কিন্তু তারও তো খরচ আছে। পরিকল্পনা করে কাজ করলে অল্প টাকায় অনেক বড় কাজ করা যায়। কিন্তু পরিকল্পনা করতেও যে একজন মানুষকে সব চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে সময় দেওয়া লাগে! এই সময়টার মূল্য তার মেধার মতই অনেক বেশি। আমরা বাইরের কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রজেক্ট আনতে পারি, কিন্তু তাতে আর দশটা এনজিওর সাথে আমাদের পার্থক্য থাকে কোথায়? USAID আর UNDP যা বলবে, যেভাবে বলবে সেভাবেই কাজ করতে হবে আমাদের।

আমরা সরোবরকে একটা ফাউন্ডেশন হিসেবে রেজিস্টার করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের সদস্য হবেন দু ধরণের:
সাধারণ সদস্য: স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমাদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করবেন—দু’আ দিয়ে, সময় দিয়ে, মেধা দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে।

বিশেষ সদস্য: এসবের অতিরিক্ত সরোবরকে প্রতি মাসে ন্যুনতম ৫০০ টাকা দেবেন। বেশি দিলে আরো ভালো। এই টাকাটা জমিয়ে সরোবর তার নিজের খরচা চালাবে। কিছু সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে। আস্তে আস্তে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালাবে।

এই বিশেষ সদস্যদের মধ্যে আগ্রহী এবং যোগ্য কিছু ভাইদের নিয়ে আমরা আমাদের কার্যকরী কমিটি তৈরি করব। সৎ কাজ দিয়ে, খোলা মন নিয়ে আমরা কাজ শুরু করব ছোট্ট পরিসরে। যাদের সাহায্য করব তাদের টাকা ভিক্ষে দেব না, তাদের জীবনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব ইন শা আল্লাহ। আমরা যখন মাদ্রাসায় কাজ করব তখন শুধু পেটের ভাত দেব না, মনের খোরাকও দেব। অংক-বিজ্ঞান-বাংলা-ইংরেজি শেখাব। তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার, আত্মসম্মানী হওয়ার শিক্ষা দেব। আমরা যখন গার্মেন্টস কর্মীকে সেলাই মেশিন দেব তখন শুধু একটা যন্ত্র না, একটা আদর্শও দেব। এই আদর্শ তারা যেন তারা বাকী জীবনে ধারণ করতে পারে সেজন্য যথাসাধ্য সাহায্যও করব। আমাদের মুসলিম বোনেরাই করবে।

 

৬.

আজ মাসজিদ থেকে আসরের সলাত পড়ে বের হয়ে দেখি সেই রিকশাওয়ালা ভাই। গতকাল তার মা রংপুর থেকে একটা বস্তা পাঠিয়েছেন, ঢাকার না দেখা ছৈলের কাছে। কী আছে সেই বস্তায়? পাকা পেপে, একটা লাউ, এক বয়ম গুড়, জলপাই, মুড়ি, বেলের মোরব্বা। আরো ছিল ভালোবাসা। সেটা বস্তায় ভরা যায়নি। চোখ বন্ধ করলেই সেই রংপুর থেকে ভেসে আসে। ইথার লাগে না, বাতাস লাগে না। মন থেকে মনে ভেসে আসে। জানালেন তিনি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন। গ্যারেজেই নামাজ পড়েন তবে চেষ্টা করবেন মাসজিদে পড়তে। আলহামদুলিল্লাহ। একজন মুসলিমের জীবনে আর কী চাওয়ার থাকতে পারে!

আল্লাহ সরোবরের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ সদস্যের ব্যবস্থা করবেন এই বিশ্বাস রাখি। যারা মন থেকে আগ্রহী তাদের জন্য – www.shorobor.org

 

কল্যাণকর কাজের কাফেলাটাকে আল্লাহ সবসময়ই গন্তব্যে পৌছে দেন। যারা সে কাফেলায় যোগ দিতে পারেন তারাই আসলে সৌভাগ্যবান, বুদ্ধিমান। ইহকালে ও পরকালে। আল্লাহ যেন আমাদের সবার এই কল্যাণকামীদের দলে স্থান করার তাওফিক দেন। আমিন।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

মন্তব্য করুন

Back to top button