প্যাকেজ
১.
সময়টা এখন খুব কঠিন হয়ে গেছে। মানচিত্রের যেখানেই চোখ বুলানো হোক, সেখানেই একটা বিভাজন রেখা দিন দিন খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সেই বিভাজনটা হক্ব এবং বাতিলের। চিত্রটা পুরো বিশ্বেই এক। আমাদের আটপৌরে জীবনেও সেটা ইদানীং প্রকট হয়ে উঠছে। দেশে যত নামধারী মুসলিম রয়েছেন তারা হক্ব এবং বাতিলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। যুগ যুগ ধরে চলে আসা জীবনযাত্রা আজ নানান বিভ্রান্তি, প্রতারণা আর হঠকারিতার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে প্রবলভাবে। এর মধ্যে খুব কম মানুষই হক্ব আর বাতিলকে আলাদা করতে পারছেন। এই আঘাতটা অবশ্য সবসময়ই ছিলো। বর্তমানে চলতে থাকা দেশ এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনগুলো যেই আঘাতটা করে চলেছে, মিডিয়ার কল্যাণে আজ তা খুব প্রবল। এই ধাক্কাটা সামলে উঠতে না পেরে দেশে এখন যেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে আশাবাদী হবার সুযোগটা খুব কম।
কলেজ জীবনে আমরা কয়েকজন বন্ধু প্রায়ই একসাথে বসে গল্প করতাম। আমাদের সেই আড্ডাগুলোর একটা প্রধান বিষয় ছিল চলমান অরাজক পরিস্থিতি থেকে দেশ কীভাবে উদ্ধার পাবে। অল্প বয়সের সেই গভীর আলাপে আমরা শেষপর্যন্ত আশাবাদী হয়ে আসর ছাড়তাম, ভাবতাম আগের প্রজন্মের করা ভুলগুলো পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকই শুধরে নেবে। আমরা ভালো ভালো স্কুল কলেজে পড়ছি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের প্রজন্মের মাধ্যমেই তো তবে দেশের পরিস্থিতির উন্নয়নটা হবে। কিছুদিন আগে সেই আড্ডার এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে আলাপ করছিলাম। দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে সে অনেক কথা বললো। এক পর্যায়ে আমাদের কলেজ জীবনের আড্ডার প্রসঙ্গ টেনে বললো যে যেই প্রজন্ম নিয়ে আমরা প্রচন্ড আশাবাদী ছিলাম সেই প্রজন্ম এখন আরো বেশী বিভ্রান্ত, আরো বেশী বিকৃত। সময়ের সাথে আমরা এগিয়ে যাইনি বরং উল্টো রাস্তা ধরে অনেক পেছনে চলে গেছি। এই বিপরীত স্রোতের মাঝেও প্রজন্মের একটা অংশ খুব ভালভাবে নিজেদের এগিয়ে নিতে পেরেছে এবং সেই সংখ্যাটা বড় নগণ্য। তার বক্তব্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। এই প্রতিকূল স্রোতে ভেসে যাওয়া অংশের সাথে এগিয়ে যাওয়া অংশের পার্থক্যটা বেড়েই চলছে দিনদিন। হক্ব আর বাতিলের অবস্থানের মাঝামাঝি বিভাজনটা তাই বড় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রায় প্রতিদিন হতাশাজনক একেকটা ঘটনা তাই সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। এমন কেনো হচ্ছে? এই এমন হয়ে যাওয়াটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফলাফল। এই অধঃপতন প্রক্রিয়ার শুরুর সময়টাতে আমাদের অসচেতনতাটা এখানে দায়ী। এখন শুরু হয়েছে কেবল ফলাফল দেখার পর্ব। এখনও সঠিক পথ অনুসরণ না করলে ভবিষ্যতের ফলাফলটা আরো কতো করুণ হবে তা চিন্তাও করা যায়না।
২.
একটা শিশুর জন্মের পর থেকে তার পরিবার শিক্ষা দিতে শুরু করেন তাকে আধুনিক করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এই গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় বাদ যায় না প্রায় কিছুই। হারমোনিয়াম দিয়ে গান শেখানো আর নাচের স্কুলে পাঠানোটা দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সুরুচির নিদর্শন। সিম্পসন-সিনডারেলা আর মহাভারত-রামায়ণের কাহিনীর আদলে তৈরী ‘ছোটা ভিম’ টাইপ কার্টুন যেগুলো শিশুকে পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, অশ্লীলতাকে সহজে গ্রহণ করা আর মনের মধ্যে শিরকের ধারণা জন্মানোর কাজ করে সেগুলো শিশুদের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা আমাদের দেশে এখন নূন্যতম দাবী। সাথে রয়েছে ভয়ঙ্কর সব অ্যাকশন গেমস, একটা শিশুর কোমল সত্তাকে হিংস্র করে তোলার জন্যে যা যথেষ্ট। আমাদের আটপৌরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এগুলোই এখনকার লাইফস্টাইলের অনুষঙ্গ। এই পরিবারগুলোতে ইসলাম শিক্ষার ব্যবস্থাটা থাকে গৌণ যার দৌড় কেবল বাসায় হুজুর রেখে সন্তানকে কিছু সূরা মুখস্থ করা আর আরবী বানান করে পড়তে শেখানো পর্যন্ত। অভিভাবকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে আর খুব বেশী শেখাতে যান না (আসলে শেখাতে পারেন না) এবং কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে দাদী-নানীর কাছ থেকে শিখতে পাঠান। বাড়ীর দাদী-নানীদের ইসলাম জানার উৎস ‘বিষাদ সিন্ধু’ বা ‘ফাযায়েলে আমল’ টাইপ কিছু ভয়ংকর পুস্তক।
একটা সন্তান বড় হতে থাকে তাই এক অদ্ভূত প্রক্রিয়ায়। অতি অল্প রসদ নিয়ে বড় হয়ে সেই সন্তানটি যখন ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে চলে আসে তখন শুরু হয় আরেক নতুন খেলা। অযত্নে বেড়ে উঠা সেই ছেলেমেয়েদেরকে বোঝানো হয় তারা যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে এবং তারা নিজের ভালোটা বেশ ভালোই বুঝে নিতে পারে। তাদের চোখ তখন আড়াল হয়ে যায় রঙীন চশমার আড়ালে। তারা ফ্রি-মিক্সিং, সমাজতন্ত্র, ‘ধর্ম যার যার- রাষ্ট্র সবার’ থিওরী, বন্ধু-আড্ডা-গান, গিটার, প্রেম, নেশা, দেশপ্রেমের ফাঁকা বুলি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বাধীনতার চেতনা, জাতীয়তাবাদ, মেটালিকা, বেসবাবা ইত্যাদির প্রবল চাপে পারিবারিকভাবে পাওয়া নূন্যতম ধর্মীয় বোধটা আর টিকিয়ে রাখতে পারে না। ফলাফল, কোনো রক্ত গরম করা কথায় কিংবা কোনো মধুর বানীর ধোঁকায় এই প্রজন্ম চোখ বুজে ঝাপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। এমন একটা তরুণ প্রজন্মের কাছে ভালো কিছু আশা করার সুযোগটা কই!
আমার সময়ের কথিত ‘তরুণ প্রজন্ম’ কি মনে করে যারা স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজের ইচ্ছেগুলোকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে দিয়েছে তারা বেকুব, বোকা আর গর্ধব? তারা কি কিছু না বুঝেই এমনটা করেছে নাকি এমন কিছু তারা বুঝতে পেরেছে যা এখনও বাকীদের জানা হয়নি। জীবনটা কি কেবল উপভোগের, নাকি উপলব্ধির কিছু আছে এখানে?
৩.
জীবন বিপন্ন অবস্থায় বার্মার অসহায় মুসলমানরা আমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলো। আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। আমরা ভেবেছি তাদের আশ্রয় দিলে আমাদের খাদ্য ঘাটতি হবে, ক্রাইম বেড়ে যাবে, পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের উপর গোস্বা করবে। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম রিযিকের মালিক আল্লাহ, আমরা নই। আল্লাহ আমাদেরকে কেবল পরীক্ষা করে নিলেন এবং আমরা তাতে বিপুলভাবে হেরে গেলাম। আমরা তাদের ভয়ার্ত আর ফ্যাকাশে অসহায় মুখগুলোর ছবি দেখেছি মিডিয়ায়। তবুও আমাদের কোনো অনুশোচনা বা কষ্ট হয় না। সেসব অসহায় মানুষ বুকফাটা আর্তনাদ করেছিলো, আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিলো। সেই মযলুমের অভিশাপ কি আমাদের উপর একদমই আসবে না? এতটা কীভাবে আমরা আশা করি!
আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা এখন সাধারণ ঘটনা। এভাবে কোনো মানুষ মারা হলে তার ভিডিও দেখে আমরা কষ্ট পাই। পরবর্তীতে যখন জানি যে সেই ছেলেটা শিবির করতো তখন আমাদের সেই কষ্টবোধটা নিমিষেই হাওয়া হয়ে যায়। শিবির করলে তাকে মেরে ফেলতে হবে কেনো? সেই মেরে ফেলাটা আবার আমাদের কাছে ‘জাস্টিফাইড’ হয় কীভাবে? মানুষ হিসেবে কতটা অধঃপতন হলে এমন জঘন্য চরিত্র তৈরী হয় তা বোধগম্য নয়। গণতন্ত্রের সৈনিকরা একে অপরকে প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলে, সিসি ক্যামেরার রেকর্ড দেখে আমরা খুনীর সহজ আর নির্লিপ্ত ভাবটা ধরতে পারি। বুঝতে পারি মানুষ মারা তার কাছে কত সহজ একটা কাজ। হাযার মানুষের সামনে তরুণ প্রজন্ম লগি বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে শিবিরের ছেলেদের মেরে ফেলেছিলো, বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে মেরে ফেললো। এই প্রজন্ম মানুষ মারাটাকে উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেনো। এছাড়া চলন্ত ট্রেন থেকে মানুষ ফেলে দেয়াটা নাকি ইদানীং সম্মান বাড়ানোর একটা পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ দিয়ে মতিঝিলে হুযূরদের হত্যা করার বিষয়টা আমাদের কাছে কোনো কাহিনীই না। আমরা মৃতের সংখ্যা নিয়ে বাৎচিতেই নিজেদের জয়ী মনে করছি। মাদ্রাসার ছাত্র আর হাফেযরা কুরআন পুড়িয়েছে এমন জঘন্য মিথ্যাচার আমরা অবলীলায় বিশ্বাস করছি। তেমনি আজ সিরিয়া বা মিশরে এত হতাহতের বিষয়গুলো আমাদের অন্তরকে স্পর্শ করেনা। তাদের কষ্টে আমাদের কান্না আসে না। এমন জঘন্য অবস্থায় ভালোমতো চিন্তা করাটা শুরু করে দিতে হবে। এগুলো মুসলিমের বৈশিষ্ট্য নয়।
অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ব্যভিচারের ‘ইন্ডিকেটর’গুলো আমাদের সামনে সবসময়ই দৃশ্যমান। রাস্তার বিলবোর্ড থেকে ঘরের টেলিভিশন পর্যন্ত সর্বত্র অশ্লীলতার জয়জয়কার। পার্ক, সাইবার ক্যাফে, ‘লিটনের ফ্লাট’, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, কনসার্ট, মডেলিং, বি.এফ, জি.এফ, ব্রেকআপ, রিলেশন এগুলো এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে ধর্মের মতো একটা কিছু। আজকের এই সস্তা ‘কালচারে’র শুরুটা বেশ আগেই হয়েছে। সাদাকালো টিভির যুগে বাসায় সবাই একসাথে বসে টিভি দেখার সময় বিজ্ঞাপন আসলেই পর্দা কালো করে দেয়া হতো যাতে নাচ-গানগুলো বাচ্চারা দেখতে না পায়। এখন পারিবারিকভাবে এগুলো অবলীলায় দেখা হয়। পতনটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়।
আজকের তরুণ প্রজন্ম অবশ্য এসবে কান দেয় না। ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে তারা মেধা-শ্রম উজাড় করে দিতে প্রস্তুত কিন্তু ইসলামটা তবু জানা হয় না তাদের। ইসলামের ব্যপ্তিটা তাদের কাছে কেবল ঈদ ফ্যাশন, এয়ারটেলের ঈদের নাটক এইসব পর্যন্তই। এই তরুণ প্রজন্ম নিয়ে কি কোনো স্বপ্ন দেখা সম্ভব? আমাদের দেশের সাম্প্রতিক এই করুণ অবস্থাগুলো কি আমাদের কৃতকর্মের প্রতিফল নয়?
৪.
পত্রপত্রিকা বা বইয়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন গুণীজনের জীবন আলোচনা পড়লে একটা বিষয় খুব নিশ্চিতভাবে কমন পাওয়া যায় সেটা হলো ‘…এত সালে এই মহান ব্যক্তি অমুক এলাকার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন’। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই তাদের জীবনে বেশীরভাগ সময়ই তারা ইসলামকে রিপ্রেজেন্ট করেন না। মুসলিম পরিচয়টার পেছনে জীবনে ইসলাম না থাকাটা কি ইসলামের সীমাবদ্ধতা, নাকি সেই মহান ব্যক্তির ইসলাম না জানার বিষয়টা দায়ী এটা আমাদের বোঝা উচিত। ইসলাম একটা পরিপূর্ণ প্যাকেজ। এর বাইরে একই সাথে অন্যান্য প্যাকেজ অনুসরণ করলে যা হবে সেখানে বিভ্রান্তি ছাড়া অন্য কিছু নেই। সাধারণ মুসলিম মাত্রই এটা মেনে নিতে হবে। পরিপূর্ণ প্যাকেজ না মানার কারণটা স্রেফ প্যাকেজটা না জানার ফলাফল। ইসলাম অনুসরণ করে কেউ জাতীয়তাবাদের গান গাইতে পারে না, গণতন্ত্রে সমাধান খুঁজতে চায় না, মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে পারে না, মাযারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারে না। তবুও এসব হয় কেবল না জানার কারণে।
ইসলাম শিক্ষার বিষয়টা পরিপূর্ণ হওয়া তাই আবশ্যক। ইসলাম শেখাটা কেবল সূরা মুখস্থ করা আর আরবী রিডিং পড়তে পারা নয়। জানতে হবে ইসলামের ইতিহাস, তাওহীদের অর্থ, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন, রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণকারী শ্রেষ্ঠ প্রজন্মের মানুষদের জীবন। কীভাবে রাসূল (ছাঃ) ইসলাম প্রচার করেছেন, ছাহাবীরা কীভাবে তা পালন করেছেন এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জানতে হবে কুরআনের বাণী সম্পর্কে। ভালো ভালো তাফসীর আর হাদীছের বই এখন বাংলায় পাওয়া যায়। এসব থেকে কুরআন আর সুন্নাহ সম্পর্কে জেনে তা জীবনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ইসলাম শিক্ষার একদম নূন্যতম দাবী। এগুলো দিয়ে ইসলাম জানার প্রক্রিয়া কেবল শুরু হয়। এই বিষয়গুলো ছেড়ে প্রচলিত বিষাদ সিন্ধু, ঝাড়-ফুঁক-তাবিজ, ওয়াযিফা, মিলাদ, খতম পড়ানো, পীর-দরবেশ, ঈদে মীলাদুন্নবী, ফাতেহা ই-ইয়াজদহম, ফাযায়েলে আমল, শবে বরাত ইত্যাদি কালচার থেকে ইসলাম জানার আর মানার চেষ্টা করলে জেনে নেয়া উচিত, এসব আদৌ ইসলাম নয়।
যারা ইসলাম বিশ্বাস করেন না তাদের কথা আলাদা। যারা কড়কড়ে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরে অন্তত জুম‘আর ছালাত আর ঈদের ছালাত আদায় করেন তাদের ক্ষেত্রে যদি ধরে নেই যে তারা বিশ্বাসী তবে তাদেরকে ইসলাম জানতেই হবে। আপনি মুসলিম পরিচয় দিচ্ছেন যেহেতু, সেহেতু আপনাকে অবশ্যই এর বেসিকটা অন্তত জানতে হবে। পরিবারে ওই নূন্যতম ইসলাম শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা ছাড়া মুসলিম কীভাবে হবেন? তাওহীদ না জেনে কেবল ঈদ আর জুম’আ‘র ছালাত দিয়ে কোনো কাজ হবার কথা না। নিজে জানার চেষ্টা করতে হবে এবং পরিবারকে জানাতে হবে, সন্তানকে শেখাতে হবে।
অন্তত বেসিকটা জানতে পারলে একজন মুসলিম তরুণ উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে বাধা দেয়ার কারণে ঐশীর মতো নিজের বাবা-মাকে হত্যা করতে পারবে না। সে ইয়াবার নেশায় মত্ত হবে না। একজন তরুণী লাক্স সুন্দরী হবার জন্যে নাম নিবন্ধন করবে না। রাজপথ কাঁপানো সন্ত্রাসী বা গণতন্ত্রের সূর্যসৈনিক কোনো ছাত্রনেতা হবার চেষ্টা করবে না। রেজাল্ট খারাপ করে আত্মহত্যা করবে না। পার্কের শীতল পরিবেশ প্রেম-প্রেম খেলায় গরম করে তুলবে না। রাসূল (সাঃ)-কে নিয়ে কটূক্তি করবে না। একজন সাধারণ মুসলিম তো সন্তানকে এগুলো থেকেই বেঁচে থাকতে বলবেন। ন্যূনতম ইসলাম শিক্ষা নিশ্চিত করুন, কেবল এগুলোই তখন প্রাপ্তি হবে না, ইনশাআল্লাহ পরকালে যেই প্রতিদান পাবে তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। একজন মুসলিম পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে আল্লাহর ইবাদতের জন্য, যাতে পরকালে জান্নাত পাবার আর জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকার ব্যবস্থাটা করা যায়। এজন্যে সেই রাস্তাটা তো জানতে হবে প্রথমে। সঠিক রাস্তায় চলার ব্যাপারটা বেশ কঠিন যদি পর্যাপ্ত জ্ঞানটা না থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাতিলটা বড় সহজলভ্য আর আকর্ষণীয়। অল্পজ্ঞানের একটা তরুণ তাই অতি সহজে ধোঁকায় পড়ে যায়। সন্তানকে পৃথিবীর কর্দমাক্ত রাস্তায় ছেড়ে দেবার আগে ঈমান নিয়ে টিকে থাকার পর্যাপ্ত রসদটুকু সরবরাহ না করলে সে বিভ্রান্ত হবেই।
৫.
আমাদের সেলিব্রিটি কারা হবেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু। একজন মুসলিম তো তাকেই সেলিব্রিটি হিসেবে মেনে নেবে যারা কুরআন-সুন্নাহকে প্রচন্ডভাবে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের চাইতে আর কে অগ্রগামী? একেকজন ছাহাবীর জীবন একেকটা মহাকাব্য যেনো। একজন মুসলিম যদি ছাহাবীদের জীবন সম্পর্কে না-ই জানেন তাহলে তো তাদের কাছে ভ্রান্ত লোকেরাই সেলিব্রিটি হিসেবে আসন গেড়ে নেবে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে একটা সময় এস.এস.সি বা এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টারভিউ ছাপা হতো। এখনও হয় সম্ভবত। তাতে সেই মেধাবীর ‘প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে?’ এমনটা জানতে চাইলে অনেকেই বলতো মুহাম্মদ (ছাঃ)। এই কথাটা কেবল মুখে বলা পর্যন্ত না, কাজে প্রমাণ করাটাই ইসলামের দাবী।
এইসব দাবীগুলোর পূর্ণতা নিশ্চিত করার জন্যে ইসলামকে পরিপূর্ণ প্যাকেজ হিসেবে মেনে না নিয়ে উপায় নেই। অল্প অল্প ইসলাম, খানিকটা প্রগতিশীলতা, একটু গণতন্ত্র, সামান্য সমাজতন্ত্র আর এসব মিলে যেই ককটেলটা হয় তা কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্মকে অতল গহবরেই নিয়ে যায়। আজকের এই অশান্ত আর অস্থির সময়ে অভিভাবকদেরকে তাই নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এতদিন ধরে অনুসরণ করে আসা রাস্তাটা যে সঠিক ছিলো না তা বুঝে নিতে আর যেনো দেরী না হয়।
তওবার দরজা আল্লাহ বন্ধ করে দেন নি। এখনও সময় আছে, জীবিত থাকা অবস্থায় ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের। আল্লাহ আমাদের হেদায়াতের রাস্তা অনুসরণ করার তাওফীক দিন। আমীন!
আহসান সাদী আল-আদেল
চেমসফোর্ড, ইংল্যান্ড