জীবনের বাঁকে বাঁকে

প্রতিযোগিতা

পড়ন্ত বিকেল। একটা বন্ধুচক্র। জোরেশোরে চলছে আড্ডা। হঠাৎ সাইফের আগমন। চোখেমুখে খুশি যেন উপচে পড়ছে।

“আসসালামুয়ালাইকুম”- রেদয়ানের লম্বা সালাম।

“ওয়ালাইকুম সালাম, কি অবস্থা তোদের। কী নিয়ে কথা চলছিল?”

উৎসুক দৃষ্টিতে সাইফের দিকে তাকিয়ে ফয়সালের প্রশ্ন, “তার আগে তুমি বল মামা, তুমি এত খুশি কেন?”

“একটা জিনিস কিনলাম। মোবাইল। সনি এরিক্সন এক্সপেরিয়া মিনি।” পকেট থেকে বের করতে করতে সাইফের উত্তর।

রবিউল ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “চরম একখান জিনিস কিনসোস মামা।”

নিজ থেকেই সাইফ বলে উঠল, “হুম! অ্যান্ড্রয়েড ২.৩। জেনন ফ্লাস ক্যামেরা। 800mHz প্রসেসর…”

ফয়সালের বিস্ময়, “জিঞ্জারব্রেড তো চরম করছে!”

সবাই ফোনটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাকি সময়টুকু এই ফোনটাকে কেন্দ্র করেই কেটে গেল।

মাস পর

আবারও একটা বিকেলে যথারীতি চলছে আড্ডা। সবাই কে উদ্দেশ্য করে ফয়সাল বলল, “তোদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।” সবাই ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলল “কী সারপ্রাইজ রে?” আমার মামা, আমেরিকা থাকেন। আমার জন্য একটা মোবাইল নিয়ে এসেছেন। সনি এক্সপেরিয়া জে।”

হাতে নিয়ে যথারীতি পণ্ডিত সকলের গবেষণা শুরু হয়ে গেল। এর আদি অন্ত নিয়ে শুরু হয়ে গেল বিশাল আলোচনা। এটা এমন কেন? ওটাতো খুব সুন্দর করেছে। এই সেই… এই ভরা আলোচনার মধ্যেও কেন যেন মলিন লাগছে সাইফকে। যেন অন্য একটা চিন্তা তার মাথায় চেপেছে। কেউ বুঝতে না পারলেও রেদয়ানের চোখ এড়িয়ে যায়নি বিষয়টা।

রাতে রেদয়ানকে কল করল সাইফ,

রেদয়ানঃ  আসসালামুয়ালাইকুম, কী অবস্থা বন্ধু?

সাইফঃ ওয়ালাইকুমআসসালাম। এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। দোস্ত, একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

রেদয়ানঃ  কী সিদ্ধান্ত?

সাইফঃ  আমার মোবাইলটা বিক্রি করে দিব।

রেদয়ানঃ  কেন?

সাইফঃ  না এমনিতেই।

রেদয়ানঃ  কোন সমস্যা?

সাইফঃ   না কোন সমস্যা না। নতুন একটা কিনব।

রেদয়ানঃ  কেন, তোর টা তো ১ বছরও হল না। আর সমস্যা না থাকলে নতুন কিনবি কেন?

সাইফঃ  না, আসলে এখন নতুন কত কিছু চলে আসছে, একটু আপডেটেড থাকার একটা ব্যাপার আছে না?

রেদয়ান বুঝতে পারল আসল সমস্যা কোথায়। রেদয়ান এই ব্যাপারে কিছু না বলে অন্য দিকে চলে গেল।

রেদয়ানঃ  আচ্ছা, সাইফ, কাল বিকেলে তোর কোন কাজ আছে? মানে ফ্রি আছিস?

রেদয়ানের এই আচরণে সাইফ কিছুটা বিরক্ত হল। তবুও বিরক্তি প্রকাশ না করে কথা চালিয়ে গেল।

সাইফঃ  না, কাজ নাই। কেন?

রেদয়ানঃ  আমার এদিকে একটু আসিস। তোর সাথে কিছু কথা আছে। ছাদে কিছুক্ষন আড্ডা দিতাম,এই আরকি!

পর দিন বিকেল। ছাদে বসে আছে দুই বন্ধু…

রেদয়ানঃ  কিরে, মোবাইলটা তো ভালোই কাজ করছে বিক্রি করবি কেন?

সাইফঃ  কাল বললামই তো, তেমন কিছু না। এখন কত লেটেস্ট জিনিসপত্র বের হয়ে গেছে। তাই চিন্তা করছি এটা বিক্রি করে দিয়ে নতুন একটা কিনব।

রেদয়ানঃ  ফয়সালের মোবাইলটা দেখে তুই একটু কষ্ট পেয়েছিস মনে হচ্ছে? মানে একটু ঈর্ষান্বিত হয়েছিস তাই না?

রেদয়ানের এমন প্রশ্নে সাইফ হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

সাইফঃ   মানে? বুঝলাম না।

রেদয়ানঃ আমরা সবাই খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু তার মধ্যেও তুই আমার কাছে একটু বেশিই আপন। তোর চোখ দেখেও আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি বন্ধু।

রেদয়ানের এই এনালাইসিসের কাছে সাইফ এক প্রকার আত্মসমর্পণ করল। কিছুই বলল না।

রেদয়ানঃ  আসলে আমরা সকলেই এমন। সব সময় বেশি ভালো জিনিস কোথায় আছে তার পেছনে পেছনে ছুটে বেড়াই। এমন এক উচ্চতায় আরোহণ করতে চাই, যেখান থেকে আমি সবার উপরে থাকব। যেমন মনে কর এত দিন পর্যন্ত তোর মোবাইল ছিল আমাদের সবার চেয়ে আধুনিক, লেটেস্ট, সবচেয়ে বেশি সুবিধা সম্পন্ন। কিন্তু যখন ফয়সাল তার মোবাইল নিয়ে হাজির হল, তখন তোর মধ্যে একটা ব্যাপার কাজ করছে যে তুই তার চেয়ে উপরে উঠতে চাস। যতই সময় যাবে নতুন নতুন প্রযুক্তি পণ্য আসবে। আজ তুই যদি আবার একটা মোবাইল কিনিস, ৬ মাস পর আবার তার চেয়ে অনেক আধুনিক মোবাইল চলে আসবে। তারপর ধর আবার তুই নতুন আরেকটা কিনে নিলি। তাতেই কিন্তু সমস্যার সমাধান না।

চিন্তা করে দেখ, তোর বাবা যখন আমাদের মত সময়ে ছিল, তখন তার জেনারেশনের যা নিয়ে ক্রেজ ছিল, যা নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল এখন কিন্তু বিষয়গুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবার তোর পরবর্তী প্রজন্ম যখন আসবে তখন আবার বিষয়গুলো অন্য কিছু হয়ে যাবে। তাই বলে আমরা যদি সব সময় এর পেছনে পড়েই থাকি তাহলে ব্যাপারটা কেমন হল জানিস? আমরা এর দ্বাসত্ব শুরু করে দিলাম।

কিন্তু জীবনটা তো আসলে এসব কিছুতেই সীমাবদ্ধ না, তাই না? চিন্তা করেছিস কি, এমন প্রতিযোগিতা করার জন্যই কি আমরা পৃথিবীতে এসেছিলাম? এই প্রতিযোগিতা কখনই শেষ হবার নয়। এমনভাবে যদি আমরা ছুটতে থাকি, তাহলে মরণের আগ দিন পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে।

অথচ জীবন এখানেই শেষ না। বরং এই লেটেস্ট সম্পত্তি গুলো জীবনের খুব অল্প কিছুই মাত্র, কিংবা কিছুই না। কিন্তু এই অল্প কিছু বা কিছুই না কে আমরা এত বড় করতে থাকি, এত গুরুত্ব দিতে থাকি যে, এক সময় এই অল্প গুরুত্বপূর্ণ বা অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমাদের অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে বিরত রাখে।

সুরা তাকাসুর মনে আছে?

অধিক (পার্থিব) সুখ সম্ভোগ লাভের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে (অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে) ভুলিয়ে রেখেছে এমনকি ( অবস্থাতেই) তোমরা কবরে এসে পড় (তোমরা যে ভুল ধারনায় ডুবে আছ তা) মোটেই ঠিক নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে আবার বলি, মোটেই ঠিক নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে কক্ষনো না, তোমরা যদি নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে জানতে! (তাহলে সাবধান হয়ে যেতে)

(সুরা তাকাসুর )

 

সাইফঃ  আমার কাছে মনে হচ্ছে এই আয়াতটা যেন আমার এই অবস্থার প্রেক্ষিতেই নাজিল করেছেন আল্লাহ। সুরাটি অনেকবার পড়েছি, কিন্তু আসলেই আমি বিষয়টি এভাবে চিন্তা করে দেখিনি।

রেদয়ানঃ বন্ধু, আরেকটা কথা চিন্তা করে দেখ, আজ আমাদের সবার বিলাসিতা করার জন্য টাকা ব্যয় করতে কোন সমস্যা নেই। খুব কষ্ট করে হলেও বিলাসিতার বাসনাকে তৃপ্ত করার জন্য, সেই অর্থের ব্যবস্হা করেছি। অথচ এই পৃথিবীতে অনেক অনেক মানুষ আছে যারা কিনা এক বেলা খাবার পর, পরের বেলায় কি খাবে কিংবা আদৌ খেতে পারবে কিনা, না কি এটাই তার জীবনের শেষ খাবার – তারা জানে না। কেন যেন এমন মানুষদের কথা আমাদের মাথায় আসে না।

আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনই তো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য, তাই না? আমি একটা অনুরোধ করব তোকে, অতিরিক্ত টাকাটা না হয় আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই ব্যয় করলি। কিছু ইয়াতিম কে সাহায্য করে না হয় জীবনের আসল উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা করলি। তোকে কয়েকটা আয়াত বলি, শোন, আল্লাহ বলছেন,

তারা খাবারের প্রতি ভালবাসা থাকার সত্ত্বেও (অথবা, আল্লাহ্ প্রতি ভালোবাসার জন্য) ইয়াতীম, মিসকিন বন্দীকে খাদ্য দান করে (আর বলে,) “আমরা কেবল আল্লাহ্ সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদেরকে খাওয়াই, (এর জন্য) তোমাদের কাছ থেকে কোন প্রতিদান কিংবা কৃতজ্ঞতা চাই না আমরা আমাদের প্রভুর কাছে থেকে এক কঠোর বিপদময় দিনের ভয় করি

(সুরা আল ইনসান ১০)

দুনিয়ার জন্য প্রতিযোগিতা আমাদের কিছুই দেবে না, প্রতিযোগিতা করতে হবে আখিরাতের জন্য।

সাইফঃ    বন্ধু, তুমি আসলেই আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছ। আমি হয়ত কখনই এভাবে ভেবে দেখতাম না। চল, একটা প্ল্যান করি, কি করা যায় এই ব্যপারে।

পরবর্তী শুক্রবার, সাইফ ও রেদয়ান পাশের এলাকার একটা এতিমখানায় গেল। সাইফের সাথে রেদয়ান ও কিছু টাকা নিয়ে এল। এই টাকায় এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করল। সাথে কিছু জামা ও বই এর ব্যবস্থা করল।

এতকিছুর মাঝে প্রিয় বন্ধুর কাছে আনন্দাশ্রু লুকাতে পারেনি সাইফ।

সাইফঃ  বন্ধু, সত্যিই আমি কখনোই বিশ্বাস করতে পারতাম না নিজের চোখে না দেখলে। বিশ্বাস কর, একটা সস্তা নতুন জামা পেয়ে তাদের মধ্যে যেই পরিমাণ আনন্দ আমি দেখেছি, তা আমাদেরকে হাজার টাকা দিয়ে পাওয়া যাবে না।

বন্ধু, তোকে ধন্যবাদ। আমি বলে বুঝাতে পারব না- যখন বাচ্চাগুলো নতুন জামা পেয়ে বন্ধুদের দেখাতে নিয়ে গেল, যখন সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাচ্ছিল, আমি আর আবেগ ধরে রাখতে পারি নি। অভাব বিষয়টা খুব বেশি আসেনি আমার জীবনে। তাই কখনই জানতাম না মুদ্রার অন্যপিঠটা কেমন। আজ দেখলাম। কত অল্পই তাদের তুষ্ট করে। অথচ দেখ, কত প্রাচুর্যও আমাদের তেমন সুখ দিতে পারে না, যতটা একটা সস্তা জামা তাদের দিয়েছে।

তোকে অনেক ধন্যবাদ বন্ধু। এই আনন্দ হাজার বার লেটেস্ট মোবাইল কেনার আনন্দ থেকে অনেক বেশি।

রেদয়ানঃ আল্লাহ আসলে তোকে কবুল করেছেন। এখানে আমার কোন কৃতিত্ব নেই। এমন অনেকে আছে যারা এই কথাগুলো শুনেও কিছুই অনুভব করে না। অনেকে আবার অনুভব করেন কিন্তু বাস্তবে করে দেখান না। আল্লাহর প্রশংসা, তিনিই আমাদের কবুল করেছেন। আমার দ্বায়িত্ব ছিল প্রচার করা, আমি তাই করেছি।

তোকে একটা প্রশ্ন করি, কেন করেছিস এই কাজ?

সাইফঃ  শুধুমাত্র, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য…

রেদয়ানঃ এই জিনিসটাই আল্লাহ চান। আর যখনই আল্লাহ্‌র স্মরণের জন্য কিছু করা হয়, তার মধ্যে শান্তি আসবেই। বাহ্যিকভাবে তা যতই অনাড়ম্বর হোক। মানুষ তার মধ্যে যতই অসারতা খুঁজে পাক, প্রকৃত শান্তি এখানেই। জীবনভর উচ্চতায় উঠার দাসত্ব কখনোই এই শান্তি দেবে না। দেবে বুকভরা অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস।

যারা ইমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহ্ স্মরণে প্রশান্ত হয়, জেনে রাখ, আল্লাহ্ স্মরনেই অন্তরসমুহ প্রশান্ত হয়ে থাকে (সুরা রা ২৮)

(Ahobaan.com)

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button