জীবনের বাঁকে বাঁকে

বছরের সেরা সময় রামাযান

-আমাতুল্লাহ
সিডনী, অষ্ট্রেলিয়া।

একটি সামাজিক ওয়েবসাইটে ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান নিয়ে   যেভাবে কনফ্রন্টেড হয়েছিলাম সেখানে রেজিস্ট্রেশনের একেবারে দ্বিতীয় দিন, সেরকম আগে কোথাও হইনি। এক সময় খুঁজে খুঁজে যখন ইসলাম নিয়ে কিছু বলা হলেই জবাব দেয়া শুরু করলাম, তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম, আমি কত কম জানি!

একদিন তর্কাতর্কির মাঝেই হঠাৎ থমকে গেলাম এক অদ্ভূত উপলব্ধিতে…কুরআনটা আমার তখনও পর্যন্ত নিজের ভাষায় আগাগোড়া পুরাটা একবার পড়া হয়নি! খতম করেছি তো   ছোটবেলা, সে তো আছে। এখান থেকে সেখান থেকে দারস পড়েছি, ব্যাখ্যা শুনেছি, অনুবাদ পড়েছি, কিন্তু কি আশ্চর্য, যেই আমি হাজার পৃষ্ঠার সুনীলের উপন্যাস কিংবা তার চেয়েও মোটা ‘গন উইথ দ্যা উইন্ড’ পড়ে ফেলতে পারি এক সপ্তাহে, সেই আমি জীবনের প্রায় দুই দশক পার করে  ফেলেছিলাম কুরআনের মাত্র ছয় হাজার শব্দ আগা   থেকে গোড়া রিডিং না পড়েই! অদ্ভূত লজ্জা নিয়ে কুরআনের অনুবাদ পড়া শুরু করেছিলাম সেই রমযানে, কয়েক বছর আগে। শুরু  থেকে একটু একটু আরবীর সাথে অনেক বেশি করে অনুবাদ পড়া শুরু করলাম প্রতিদিন। আর সে কি বিস্ময়! কুরআনে অনেক কিছু এত সুন্দরভাবে বলা আছে, যেটা আমি আগে কখনও শুনিনি! যেমন-সূরা বাকারায় আল্লাহ যখন মুসলিমদের কাবার দিকে ফিরে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন কি সুন্দর করে বললেন, ‘অবশ্যই নির্বোধ লোকেরা বলবে, ‘এদের কি হয়েছে, প্রথমে এরা যে কিব্‌লার দিকে মুখ করে ছালাত পড়ত, তা থেকে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? হে নবী! ওদেরকে বলে দাও, ‘পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর৷ আল্লাহ যাকে চান তাকে সোজা পথ দেখান।’… প্রথমে যে দিকে মুখ করে তুমি ছালাত পড়তে, তাকে তো আমি কে রাসূলের অনুসরণ করে এবং কে উল্টো দিকে ফিরে যায়, শুধু তা দেখার জন্য কিব্‌লাহ নির্দিষ্ট করেছিলাম (সূরা বাকারা: ১৪২ ও ১৪৩ এর কিছু অংশ)

ব্লগে কত তর্ক করেছি যখন কাবার দিকে মুখ করে ছালাত পড়া নিয়ে   লেখাগুলো আসতো, কিন্তু আমি যত কিছু বলেছি তার কিছু না বলে যদি এই দুইটা আয়াত বলে দিতাম, তাহলে সব বলা হয়ে যেত! আল্লাহ তো নিজেই বলছেন যে, তিনি সবদিকে আছেন, কিন্তু তবু তিনি চান আমরা কাবার দিকে ফিরে ছালাত পড়ি, শুধুমাত্র পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তাঁর কথার আনুগত্য করে!

গত রমযানে মোবাইলেই আস্ত কুরআনটা ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। খুব ব্যস্ত ছিলাম তখন অনার্স ফাইনাল নিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পথে ট্রেনে কিংবা ল্যাবে এক্সপেরিমেন্টের ফাঁকে ফাঁকে আইপডে আরবী কুরআন শুনতাম আর সাথে সাথে ইংরেজি অনুবাদ পড়ে নিতাম  মোবাইল থেকে। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কাছে কুরআন লিখিত ভাবে আসেনি, তাই কানে শোনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল আমার। ঠিক যেভাবে তিনি শুনেছিলেন চৌদ্দ’শ বছর আগে,   সেভাবে শুনতে চাচ্ছিলাম! তেলাওয়াত শুনছিলাম মিশারী রাশিদ আল আফাসীর, সুবহানাল্লাহ! তাঁর তেলাওয়াত শোনার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। কুরআন পড়ার সময় তিনি সুর বদলান, যেখানে শুভ সংবাদের কথা সেখানে একরকম, যেখানে ভীতির কথা, সেখানে আরেক রকম। ছয় বছর আগে প্রথম তাঁর তেলাওয়াত শোনার আগ পর্যন্ত আমাকে কুরআন তেলাওয়াত তেমন টানতো না!

গত রমযানে পড়া একটা আয়াতের কথা এখনও মনে আছে… কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, কোন মেয়ের সতীত্বের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শাস্তি হচ্ছে আশি দোররা এবং অপবাদদানকারীকে সারাজীবনের জন্য মিথ্যাবাদী  ঘোষণা দেয়া (নূর ৪)। শুধু তাই না, যারা শুধু অন্যজনের মুখে শুনে এই কথা আরেকজনকে বলে, তার ব্যাপারেও ভীষণ কঠিন সব কথা! ভীষণ রকমের অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আয়াতটা পড়ে! বার বার পড়লাম! একটা মেয়ের ব্যাপারে একটা কথা উঠলেই হয়েছে, সত্য হোক মিথ্যা হোক,   মেয়েটার সারাজীবন ধ্বংস হয়ে যায়..এরকম ৮০% মুসলিমদের   দেশে, প্রায় প্রতি বাড়িতে একটা করে কুরআন থাকা সত্ত্বেও! কি আশ্চর্য! মেয়েদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ আয়াত আমি প্রথম শুনেছি/উপলব্ধি করেছি জীবনের দুই যুগ পার হয়ে যাওয়ার পরে!!! কি ভয়াবহ লজ্জা!!! তাও আমার হাতের কাছেই কুরআন থাকে, জ্ঞানার্জনের পথ-পন্থা এত বেশি, তবুও! বাংলাদেশের যেই নিরপরাধ মেয়েগুলো মুখ বুজে দোর্রা খেয়ে যাচ্ছে, তাদের হাতে কি কেউ একটা করে কুরআন তুলে দিতে পারে না যুদ্ধ করার জন্য!

রমযানে, বছরের সেরা দিনগুলোতে আল্লাহ কুরআন পাঠিয়েছিলেন আমাদের জন্য। প্রতি রমযানে তাই একটু একটু চেষ্টা করি কুরআন সম্পর্কে আরেকটু জানার। যত জানি, তত মুগ্ধ হই।

এবার এক বন্ধুর কাছ থেকে দারুণ একটা আইডিয়া পেলাম। সে কুরআন পড়বে কুরআন ঠিক যেভাবে এসেছে, সেভাবে। আমাদের কাছে এখন যেভাবে কুরআন আছে, সেভাবে কুরআন রাসুল (ছাঃ)- এর কাছে আসেনি। অনেক সূরাই আগে পিছে, রাসূল (ছাঃ) সেটা পরে সাজিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর নির্দেশে। সূরা ফাতিহা এসেছে অনেক পরে, কিন্তু একেবারে প্রথম সূরা এখন। সূরা আলাক এসেছে একেবারে প্রথমে, কিন্তু এখন একেবারে শেষের দিকে। কুরআন   যেই ধারাতে এসেছে, সেই ধারাতে কুরআন পড়লে ঠিক কিভাবে ইসলাম রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসেছিল, সেই ধারণাটা পরিষ্কার হতে পারে অনেক।

অনেক সময় কুরআন পড়তে গেলে খুব রিপিটিটিভ ঠেকে, মনে হয় একই কথা তো পড়ে এসেছি দশ পাতা আগেও! কিন্তু সেই কথাটা   কেন আল্লাহ আরেকবার বলছেন দশ পাতা আগে, সেটা যদি জানা যায় কুরআনের ব্যাখ্যা পড়ে, তাহলে নিজেরই মাথায় বাড়ি দিতে ইচ্ছা করে স্রেফ পুনরাবৃত্তি ভাবার জন্য! ইবনে কাছীরের তাফসীরের বাংলা অনুবাদ কেমন আমি জানি না। আপাতত: আমি ইবনে কাছীরের ইংরেজি অনুবাদ পড়ছি। যত পড়ছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি!

আরেকটা জিনিস আমার হয়ত এই রমযানে ধরা হবে না, কিন্তু খুব ইচ্ছা আছে কখনও শুরু এবং শেষ করার! সম্প্রতি এক বই   পেয়েছি যেখানে মাত্র কয়েকশ শব্দ আছে, যেগুলো শিখলে কুরআনের ৮০% শব্দ শেখা হয়ে যাবে (কারণ কুরআনে একই শব্দ অনেকবার এসেছে)! আমি ভাবতেও পারি না, যেই কুরআন যুগ যুগ ধরে আমরা মাটিতে ছুঁতে দেইনি, সবচেয়ে উঁচু শেলফে রেখে দিয়েছি, ওযূ ছাড়া ছুঁয়েও দেখিনি, সেই কুরআনের ৮০% অনুবাদ ছাড়া শুধুমাত্র পড়েই বুঝে ফেলার অনুভূতি কেমন হবে! কিন্তু সত্যি, খুব ইচ্ছা করে সেই অভিজ্ঞতা লাভের।

বছরের সেরা দিনগুলো এসে গেছে… যখন ছোট ছিলাম, তখন ছিয়াম আসত আর যেতো, না খেয়ে থাকার উপলব্ধি আর ঈদের নতুন জামার আনন্দের চেয়ে বড় কিছু ‘রামাযান’ থেকে আমি পাইনি। আস্তে আস্তে যখন জানলাম, এটা শুধু ‘রামাযান’ মাস না, বছরের সেরা দিনগুলো…তখন দিনগুলো চলে গেলে ভীষণ বিষণ্ণতায় ভুগতাম। কেন জানেন? এই দিনগুলোতে শয়তানগুলো বন্দী থাকে সব। কিন্তু কি আশ্চর্য, শয়তানের অনুপস্থিতিতেও আমার কাজে, চিন্তায়, মেজাজে বড় সড় ধরনের কোন পরিবর্তন আসত না! যখন ভিতরে চোরা ভয়টা ঢুকে যাওয়া শুরু করলো, শয়তানটা আসলেই হয়তো আমার মনটাকে ইচ্ছে মত বাগিয়ে নিয়েছে, তখন থেকেই ঈদের দিন যত আগাতো তত বেশি বিষণ্ণতায় ভুগতাম! এবার ভীষণ ইচ্ছা ঈদের দিন জোরেসোরে একটা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা… এই সুন্দর মাসের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তারপরে। পারব কি না জানি না!!!

বন্ধুর কাছ থেকে আরেকটা আইডিয়া পেয়েছি, এটা বলে শেষ করছি। রমযানে দোআ কবুলের সময়ের ছড়াছড়ি। ছিয়াম রাখলে ইফতারের সময়, তারাবীর পরে, সেহেরীর আগে, শেষ দশদিনের রাতগুলোতে। এই সময়গুলোতে আল্লাহর কাছে হাত তুলে কিছু চাইলে সত্যি মনে হয় আল্লাহ শুনছেন! অসংখ্য প্রমাণ আছে আমার নিজের জীবনে। অসম্ভব সব কিছু চেয়ে দিব্যি পেয়ে গিয়েছি…এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না কিন্তু…। যারা ওই সময়গুলো মিস করছেন, তারা সত্যিই মিস করছেন…।

বন্ধুটি এবার বললো, যত যা কিছু আছে, একটা লিস্ট করে প্রতিদিন চেয়ে যাও। আল্লাহ যদি একদিন  দো‘আ কবুল করেন, তাহলে বাকি ঊনত্রিশ দিনে কোন কারণে তোমার ছিয়াম আল্লাহ পছন্দ না করলেও   কোন অসুবিধা নেই, ওই একদিনে তো দোআগুলো সব কবুল হয়ে যাবে! আইডিয়াটা সত্যিই ভালো! আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!

মন্তব্য করুন

Back to top button