পাঠকের পাতা

অলীক শপথ

পূর্ব গগনে নিত্যকার মতই সূর্যালোক আধার ধরণীকে আলোর ফোয়ারায় উদ্ভাসিত করেছিল। অনুভূতির দেয়ালে নতুন জীবন সঙ্গীতের শিহরণ মাখা তরঙ্গ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। দুচোখের অনিমেষ দৃষ্টি হৃদয় প্রকোষ্ঠের শুভ্র স্বপ্নবানকে উদ্বেলিত করেছিল। হ্যা, সেই দিনের কথাই বলছি যেদিন কিছুটা ভয়, কিছুটা শঙ্কা, কিছুটা রোমাঞ্চিত অনুভূতির মিশেলে জীবন স্রোতের নির্মল আঙিনা ‘বিদ্যাপীঠে’ পদার্পণ করেছিলাম।

শুভ্র জীবনের জয়গানে মুখরিত বিদ্যায়তনের নতুন আঙিনা মনের কোমল আঙিনায় অন্ধকারভেদী নব জীবনের শপথ করিয়েছিল। লাইনে দাড়িয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতকে সামনে রেখে দৃপ্তকন্ঠে সেদিন আমিও উচ্চারণ করেছিলাম , “আমি শপথ করিতেছি যে, মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত করিব। দেশের প্রতি অনুগত থাকিব।,……..।” দেশ, মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সেই দৃপ্ত শপথ অন্ধকারের অমানিশা ভেদ করে শিরা উপশিরায় নব আন্দোলনের ঢেউ তুলেছিল। সেই হলো শুরু। অতঃপর শিক্ষাজীবনের প্রতিনিয়ত চর্চা দেশ ও মানুষের কল্যানের ব্জ্র শপথ।

দেশ ও মানুষের জন্য ভালোবাসার উজ্জীবনী শপথ দেশের প্রায় প্রতিটি বিদ্যায়তনের বিদ্যার্থীই করে থাকেন। যে শপথ শিক্ষার্থীদের দেশাত্মবোধের অনুপ্রেরণাকে শাণিত করে, মানবসেবার অঙ্গিকারকে হৃদয়ে প্রোথিত করে, সততার ঝান্ডাবাহী হতে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে, ন্যায় ভ্রষ্ট চেতনাকে মূলোচ্ছেদের সাহস আনে। শিক্ষাজীবনের পরতে পরতে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের অগণন শব্দশৈলী ব্যাক্তি স্বার্থের সুতীব্র বাসনাকে অপনোদন করে তৃপ্তিমাখা নিঃস্বার্থ জীবনকে আলিঙ্গন করার অভিপ্রায় জাগ্রত করে!

আজ দিগ্বিদিক অনাচারের জয়জয়কার দেখে মনে হয় এ যেন উল্টো রথের সারথি হয়ে আমি আমরা ছুটে চলছি অবিরত। সমাজ জীবনের বাঁকে বাঁকে ধোকা আর প্রবঞ্চনার নাটক মঞ্চস্থ হয় ভদ্রবেশে। যে নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীর নান্দনিক ডায়ালগ শঙ্কিত হৃদয়কে শান্তি শীতলতায় ভরিয়ে দেয়। ছদ্মবেশী রক্তপিপাসু চাটুকারের আস্ফালনে সাধারনের রাতের ঘুম তিরোহিত হলেও প্রতিবাদী চেতনা ঘুমিয়ে আছে অজানা আশঙ্কায়।

রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে, মানবিক মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করে রক্ষক সেজে ভক্ষকগুলোর সম্পদের পাহাড়ের আড়ালে অত্যাচারিতের রোনাজারি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। দুর্নিতির কালো থাবা ভার্সিটির সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী থেকে শুরু করে কালি কলমে স্বজ্ঞ বা অজ্ঞ মানবহিতৈষী(!) নেতার মাঝেও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। মানবতার জয়গানের শপথ বাক্যে যতটা শিহরিত হয়েছিলাম আজ সমাজ বাস্তবতার নীতিবিবর্জিত বোদ্ধাদের শব্দমালায় আমি নির্বাক হয়ে যাই। জীবন স্রোতের সর্ব দিগন্তে দুর্নিতিবাজদের বিষাক্ত ছোবলে সর্বসাধারণ নীলে নীল হয়ে চোখের কোনায় জল গড়িয়ে গেলেও দুর্ভোগের আর্তনাদ শুন্যে  মিলিয়ে যায়।

কোটি কোটি টাকার দূর্নিতিকে আড়াল করতে শিল্পগোষ্ঠী তৈরি করছে মিডিয়া নামক ডিফেন্সিভ ইউনিট। যে মিডিয়ার  কাজ হচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে সত্যকে আড়াল করে অযাচিত বা সামান্য বিষয়ের হাইলাইট করা। মাঝে মাঝে কিছু দুর্নিতিবাজদের মুখোশ আমরা দেখতে পাই তার পেছনেও থাকে রাঘববোয়ালদের সর্বগ্রাসী দুর্নিতিকে আবডালে রেখে দেওয়ার অভিপ্রায়। দেশের টাকাকে বিদেশে পাচার করা আবার সীমাহীন দূর্নিতিকে ধামাচাপা দেওয়ার নিমিত্তে নিজেরাই বিদেশে পাচার হওয়ার ফিল্মি আয়োজন আমাদের কখনো কখনো বাকরুদ্ধ করে। জানিনা এদের শপথের অন্তরালে কোন জাদুকরী টিকা সংযোজিত ছিল যেখানে দেশসেবা আর মানব সেবার চিরায়ত সংজ্ঞায়নকেই পাল্টে দিল!

জীবন নদীর বহমান স্রোতে ক্রমে ক্রমে আমরা হারাচ্ছি সততার ঝান্ডা। কেনইবা হারাবো না? কবি হারিয়েছে তার বিদ্রোহী বুলি, শিল্পী হারিয়েছে তার প্রতিবাদের তুলি, নেতা হারিয়েছে স্বাধিকার আদায়ের বজ্র ধ্বনি, সাংবাদিক হারিয়েছে নৈতিকতার বাণী। স্বার্থপরতায় নিমগ্ন বুদ্ধিজীবী সমাজ অন্যায়ের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের বিপরীতে মিথ্যা স্তুতিবাক্যে নেতাদের তোষামোদিকেই বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাবসা হিসাবে নিয়েছেন।

চারদিকের ন্যায়ের আলোকরশ্মি ম্রিয়মান হয়ে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। শোষন, অবিচার আর অনৈতিকতার বিষবাষ্প আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে। মানব কাঠামোয় মনুষ্যত্বহীন হায়েনার দল চারদিকে ছড়িয়ে পরেছে। এরা ভদ্র বেশে ছদ্মবেশী। জনগনের সম্মুখে সুহাস্য বদনে আলিঙ্গন করলেও পেছন থেকে রাক্ষুসে থাবা নিয়ে এরা ওৎ পেতে থাকে।

অলীক শপথের ঝিলিক দেখে শৈশবের সুদূরপ্রসারী মনের মণিকোঠার  আলোকরশ্মি আজ স্তম্ভিত, হতভম্ব। জানিনা কি লিখবো আর কি লিখা উচিত। বোধ, বুদ্ধি আর বিবেকের তাড়নায় দেশের ভগ্নদশা আমাকেও তাড়িত করে। কখনো কখনো হাত কেপে ওঠে, কলম ছিটকে পড়ে,  লেখা মুখ থুবড়ে পড়ে।

লেখকঃ সাদেকুর রহমান সাদিক
সিড্যা, ডামুড্যা, শরীয়তপুর

মন্তব্য করুন

Back to top button