মাস’আলা বর্ণনার ক্ষেত্রে একজন আলেমের কেমন কল্পনাশক্তি থাকা চাই
একজন আলেম মানে নায়েবে নবী, হাদিসের ভাষায় যাকে ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া বলা হয়। মুসলমান হিসেবে আলেম বা সাধারন মানুষ প্রত্যেকেরই রাসুল (সা) এর অনুসরণ অনুকরণ ফরজ। একজন আলেমর জন্য সেটা তো আরও উপরে। রাসুল (সা) এর হাদিসের ভাষ্য হচ্ছে “আবেদের অপেক্ষা আলেমের মর্যাদা তেমন যেমন তোমাদের সর্বাপেক্ষা ছোট ব্যক্তির তুলনায় আমার মর্যাদা” (তিরমিজি)।
কাজেই আলেম হিসেবে দ্বীনি কোন বিষয় খোলাসা করার আগে রাসুল (সা) এর কনসেপশন রাখা চাই। কারন আপনার বিশ্লেষণ একটি সমাজে দুটি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
এক. হয়ত মানুষের আমল করার প্রতি উৎসাহ অথবা আমল ছেড়ে দেয়ার প্রতি নিরুৎসাহ সৃষ্টি হতে পারে। মানুষ হচ্ছে স্বভাবগত সুযোগ সন্ধানী।
দ্বীনের ফরজ কোন বিষয় কিছু হাল্কা করে বিশ্লেষণ করলে সেই সুবাদে, বিষয়টাকে মানুষ নফলের পর্যায়ে নামিয়ে দিতে চায়। নফলের পর্যায়ের হলে নূন্যতম গুরুত্ব না দিয়ে ছেড়ে দিতে চায়।
আবার হারামের প্রর্যায়ের কোন বিষয় হাল্কা বিশ্লেষণ করলে তা মকরূহের পর্যায়ে নামিয়ে দিতে চায়। মকরূহ পর্যায়ের বিষয় হলে অভ্যাসে পরিনত করে নিতে চায়।
কাজেই মাস’আলা বয়ানের ক্ষেত্রে এমন উপস্থাপনা বা বিশ্লেষণ করা চাই। বিষয়টি নফল হলেও এভাবে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা। মানুষ ফরজ বুঝে নিক, সেটা বলব না। কিন্তু ফরজের মতো গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি যেন আমলে নেয়ে। অন্যদিকে মকরূহ বিষয়কে এমন ভাবে উপস্থাপন করা যে মানুষ হারাম বুঝে নিক, সেটা বলব না। কিন্তু হারামের সমপর্যায়ের গুরুত্ব যেন দিলে চলে আসে। যার দরুন বিষয়টাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এমন প্রমান রাসুল। সা এর জীবদ্দশায় পাওয়া যায়। “একদা মু‘আয (রাঃ) নবী (সা) এর পিছনে সওয়ারীতে ছিলেন, তখন তিনি তাকে ডাকলেন, হে মু‘আয ইব্নু জাবাল! মু‘আয (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল আমি খেদমতে হাযির আছি। এরূপ তিনবার করলেন। অতঃপর রাসুল (সা) বললেনঃ যে কোন বান্দা আন্তরিকতার সাথে এ সাক্ষ্য দেবে যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’-তার জন্য আল্লাহ তা’আলা জাহান্নাম হারাম করে দিবেন। মু‘আয বললেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসুল! আমি কি মানুষকে এ খবর দেব না, যাতে তারা সুসংবাদ পেতে পারে?’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তারা এর উপরই ভরসা করবে।’ মু‘আয (রাঃ) (জীবন ভর এ হাদীসটি বর্ণনা করেননি) মৃত্যুর সময় এ হাদীসটি বর্ণনা করে গেছেন যাতে (‘ইলম গোপন রাখার) গুনাহ না হয়”। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
এখানে রাসুল নিজেই মু’আয (রা) কে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে অন্যের নিকট সংবাদ পৌঁছাতে নিষেধ করলেন। কারন মানুষ জান্নাতে যেতে শুধু ঈমান নির্ভর যেন না হয়। অন্য আমল সমূহ যেন ছেড়ে না দেয়ে। রাসুল (সা) আশঙ্কা ছিল এমন সংবাদ শুনে মানুষ শুধু ঈমান নির্ভর হয়ে বাকি আমাল ছেড়ে দিবে। কতই না চমৎকার ছিল রাসুল (সা) এর কল্পনাশক্তি?
দুই. আবার কোন কোন সময় আপনার বিশ্লেষণ সমাজে আরও বিতর্ক, বিভ্রান্তি ও ফেতনাহ সৃষ্টি করতে পারে অথবা বিভ্রান্তিকর একটি সমাজের ভ্রান্তি বন্ধ করতে পারে।
এখন একজন আলেমর উচিত না, দ্বীনের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি করা বা বিতর্ক জিইয়ে রাখা। বরং বিশৃঙ্খল একটি সমাজের কন্ট্রোল ধরে স্থিতিশীল করাই দায়িত্ববানের পরিচয়। আবার স্থিতিশীল একটি সমাজে অপরিচিত, আনকমন মাস’আলা বয়ান করে বিশৃঙ্খলা বা বিতর্ক সৃষ্টিও ইসলামি আদর্শ বহির্ভূত।
বিতর্ক নিরসনে প্রয়োজনে মুস্তাহব বা মুবাহ প্রর্যায়ের বিষয় খোলাসা না করা, মাকরূহ পর্যায়ের বিষয়ের প্রতি প্রমোট না করা। একজন আলেমের শান বা জ্ঞান গাম্ভির্যের পরিচয়।
সমাজে ফেতনার সৃষ্টি হবে আশঙ্কা করে রাসুল (সা) স্বয়ং মুস্তাহাব পর্যায়ের কাজ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন। রাসুল (সা) এর মন চাইলো কোরাইশদের বিনির্মান করা কা’বা ঘরে কিছু পরিবর্তন আনতে। কিন্তু সমাজে ফেতনা ছড়াবে, বিতর্ক সৃষ্টি হবে এই মনে করে কাজটি সময়িক ছেড়ে দিলেন।
সাঈদ ইবনে মিনা (রাহ) বলেন। আমি ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ আমার খালা ‘আয়িশা (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, নবী (সা) বললেনঃ হে ‘আয়িশাহ্! তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা নিকট অতীতে শির্ক পরিত্যাগ না করলে আমি কা’বাহ্ ঘর ভেঙ্গে এর ভিত ভূমির সমতলে স্থাপন করতাম। এর দু’টি দরজা করতাম-একটি পূর্বদিকে, অপরটি পশ্চিমদিকে এবং আল হাজার (হাতীম)-এর ছয় গজ স্থান কা’বার অন্তর্ভুক্ত করতাম। কেননা কুরায়শরা কা’বাহ্ ঘর নির্মাণকালে এর ভিত ছোট করে দেয়। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
তাহলে একজন আলেমের কি উচিত নয় বিতর্ক এড়িয়ে চলা? সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি হবে মনে করলে, কোন মুবাহ পর্যায়ের মাস’আলা বয়ান না করা। মাকরূহ পর্যায়ের কাজের প্রতি উৎসাহিত না করা। সমাজের প্রসিদ্ধ চলে আসা মুবাহ রীতির বিপরীত মত পেশ না করা। নির্দিষ্ট এলাকায় বেশির ভাগ মানুষের মাজহাবের বিপরীত মাস’আলা বিশ্লেষণ না করা!
কিন্তু বিতর্ক জিইয়ে রাখা যেন আজ কারও কারও ফ্যাশন হয়েগেছে। অপরিচিত, তুলনামূলক অপ্রয়জনীয় বিষয় বলে বিতর্ক সৃষ্টি করা যেন স্বভাব হেয়ে গেছে।
আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞানের অধিকারী করেন। আমিন।
জাজাকাল্লাহ খাইরান