পাঠকের পাতা

সুখান্বেষণ

বিশ্বভূবনের নিয়ত সুখান্বেষী মানুষের অবিরাম ছুটে চলা নব নব উদ্ভাবনে। মনে ব্যাকুলতায় চেতনে অবচেতনে ভাবিত আমরা সুখ সাম্রাজ্যের উত্তম থেকে সর্বোত্তম সুখের পানে। আমাদের চপল হৃদয়ে বিশ্বাসিত, জ্ঞাত এবং কল্পিত জগতে সুখ বিহঙ্গের খোজ এক মিশ্রিত অনুভূতির আবেশ তৈরি করে। মানুষের অন্তহীন ছুটে চলা এবং চারদিকের ঘটনাপ্রবাহ সুখের রাজ্যে বিচরনের স্লোগানে মুখরিত। আমাদের অতৃপ্ত মনোজগৎ সুখপাখির সন্ধানে কখনো পরিশ্রান্ত হয় না। কল্পিত যাত্রায় সুখের সুশীতল ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়ার অভিলাষে আমাদের নিরন্তর কর্ম আয়োজন। কিন্তু হৃদয়তন্ত্রীতে কখনো কি প্রশ্নের ঢেউ খেলেছে, ধূলিধূসরিত জীবনে অবিমিশ্র সুখের আশায় নব উদ্ভাবন আমাদের সুখ বিনির্মানে কতটা সফল?

“চাই, চাই আরো চাই” অনুচ্চারিত মনে জীবন পথে উচ্চারিত এক কমন অভিপ্রায়। চাওয়ার জগতে নানাবিধ উপকরণ, উপলক্ষ কার্যকারণ হয়ে জড়ো হয়। টাকা, সম্পদ, ক্ষমতার মোহে অবিশ্রান্ত ছুটে চলা জীবনে সুখের বিচরণ কতটা দৃঢ় তা চারিপাশের দৃশ্যপট অবলোকনে স্পষ্ট। চাওয়া পাওয়ার অনিমেষ যাত্রায় উন্মত্ত পথিক সুখ হারিয়ে অভিশপ্ত জীবনের কয়েদখানায় নিজেকে খুজে পায়। ভুল পথে সুখ অন্বেষী চলমান জীবনে বিরহের ছোবল সমাজের প্রতিনিয়ত বাস্তবতা।

ব্যক্তি ভিন্নতায় সুখের অন্বেষণ বিচিত্র রূপায়নের বিচ্ছুরণ ঘটায়। দরিদ্রতার নির্মমতায় নিমজ্জিত পিতামাতা অনাহার ক্লিষ্ট সন্তানের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিয়ে সুখ খুজে পায়। সন্তানের তৃপ্তিমাখা হাসি পিতামাতার চোখের কোনে লুকায়িত টলোমলো জল মুক্তোর অবয়বে ধরা দেয়। সুখ অন্বেষা এ সংগ্রামী জিবনকে স্যালুট জানাতেও আমরা কার্পণ্য করতে দ্বিধা করি না। অথচ তাদের জীবনবোধ বা জীবনাচার উপলব্ধি করার মানসিকতা তৈরির অসংখ্যা গদ্য, পদ্য, বক্তব্য এবং  নীতিকথা আমাদের মানসপটে প্রোথিত।

দারিদ্রের কষাঘাতে পীষ্ট জীবনে কখনো কখনো খেই হারিয়ে কেউ অপরাধের অন্ধকার জগতে পদার্পণ করে নিয়তি পরিবর্তনের উচ্চাভিলাষে। জীবনের কালো অধ্যায়ে মানবিকতাকে ভূলুন্ঠিত করে শুরু হয় এক নতুন মিশন। সুখাবৃত হিরন্ময় জীবনকে বরন করতে কখন যেন স্বর্গীয় মানবিক গুনাবলী হরন হয়ে যায় তার হিতাহিত জ্ঞান তিরোহিত হয় মনের অজান্তেই।

সাদাকালো জীবনের বিপরীতে বিত্ত বৈভবে পরিপূর্ণ রাঘববোয়ালদের চাওয়ার পরিধির বিস্তৃতি সীমাহীন। সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের সুযোগে অঢেল সম্পদের পাহাড় থাকা সত্ত্বেও সাধারনের সর্বস্ব লুটে নিয়ে এরা এক খেয়ালি সুখ খোজে।

“আছে তবু আরো চায়
চায় ভুরি ভুরি
লালসার তাড়নায়
কেউ করে চুরি”

আমাদের কল্পনায় বিলাসী জীবনের ক্ষমতাধর সমাজপতিদের মনোজগতে কতটা সুখের বসবাস তা নিত্যকার চালচিত্র অবলোকনেই বুঝা যায়। “ছেলে/মেয়ের হাতে বাবা/মা/বন্ধু খুন” অহরহ শিরোনাম দেখে সাময়িক বিচলিত হলেও এর কারণ এবং মূলোৎপাটনের অনুভূতি আমাদের হৃদয় প্রকোষ্ঠে আলোড়িত হয় না। যেই সমাজপতিরা সমাজের নিপীড়িত জনগনের সুখ আনয়নের নিমিত্তে কাজ করবেন, তারাই রক্ষক সেজে ভক্ষক থেকে মহা ভক্ষক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত।

রঙ্গিন পর্দার আইকনিক তারকাদের অভিনয়ে বিমোহিত আমরাই আবার বিমর্ষিত হই  তাদেরই বাস্তব জীবনের বিচ্ছেদের সুরে। জীবনের নান্দনিক বিলাসিতায় তাদের জীবনবোধ অধুনা তরুনদের ফ্যাশন, স্টাইলে আবর্তিত হয়। অভিনয়ে, ডায়ালগে অসম্ভব মুগ্ধতায় আমাদের বিমোহিত করতে পারলেও বিদূরিত করতে পারে না নিজেদের জীবনের নোংরামি, নষ্টামি আর পংকিলতাকে। সুখময় জীবনের অন্বেষণে হাতরিয়ে মরে কেউ কেউ নিজের জীবনকে বিপন্ন করে আত্মাহুতি দিয়ে।

সভ্যতার উৎকর্ষতায় ক্ষুদ্র পরমানু থেকে মহা বিশ্বের অতিকায় গ্রহ নক্ষত্রের গবেষণার একটাই উত্তর আসবে ‘মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি’। সুদূর মহাশূন্যে রকেট যাত্রা, মহাসগরের তলদেশে ভয়ংকর সাবমেরিন , দেশে দেশে অস্ত্রের মহড়া,পারমানবিক বোমার প্রতিযোগিতা, দেশে দেশে মানুষ হত্যা, বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বেচাকেনা সবই নাকি বিশ্ব শান্তি তথা মানুষের সুখ সমৃদ্ধির জন্য!

পুজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা রাজতন্ত্রের ক্ষমতাবাদীদের অভিনব সুরে শান্তিসুখ আনয়নের মায়াবী সুর বিশ্বময় শান্তির বিপরীতে অশান্তির দাবানল তীব্রতর করছে সে দিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের থিউরিতে উষর মরুর ধূসর বুকে বিশাল বিশাল অট্টালিকা মাথা উচু করে দাড়ালেও মানুষের মৌলিক মানবিকতা অবনত মস্তকে হেলিয়ে পড়ছে। রকেটের গতিতে মহাশূন্য জয় করতে পারলেও; মানুষ মানবিকতা, বিশ্বাস এবং নৈতিকতা হারাচ্ছে আলোর গতিতে।

ব্যাক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বকে শান্তির ফোয়ারায় ভরিয়ে দিতে সুখের প্রকৃত সংজ্ঞায়ন এবং এর বুৎপত্তি জানার মাধ্যমে সময়োচিত উপলব্ধি অতীব জরুরী। ‘সুখ’ সে কি দূর মহাজগতে লুকিয়ে থাকা কোন ম্যাজিক নাকি নিজ অন্তরে লুকিয়ে থাকা সন্তুষ্টিতে? মনে পড়ে মনিষী আল ফারাবীর বাণী…

“বৃক্ষের সার্থকতা যেমন ফল ধারণে সেইরকম নৈতিক গুনাবলীর সার্থকতা শান্তি লাভে। চরম ও পরম শান্তি লাভের পথ হচ্ছে ক্রমাগত সৎ জীবনযাপন করা।”

সন্তুষ্টচিত্তে সৎ জীবন-যাপনের ভিত্তি আসবে কোথা থেকে যেথায় দাড়িয়ে সুখের রাজ্যে অবগাহন করা যাবে? কোন মানব মস্তিষ্ক নিঃসৃত থিউরি কি পারে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রলোভিত মনকে দমিয়ে রাখতে? শত আইন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিরলস প্রচেষ্টা কখনই নিবৃত্ত করতে পারছে না অনিয়ন্ত্রিত প্রলোভনকে এবং বিশ্বময় বিষাদের বিস্তৃতিকে।

সুশোভিত জীবনের পথে সন্তুষ্টচিত্তে  ধাবিত হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে মহামহিম স্রষ্টার নির্দেশিত পথে অনুগমন। যে পথ শিখাবে যা আছে তাই নিয়ে সর্বাবস্থায় উচ্চারিত হবে ‘আলহামদুলিল্লাহ’। পরীক্ষীত জীবনের সময়টা ক্রান্তিকাল হোক নতুবা ঐশ্বর্যময় হোক ‘আলহামদুলিল্লাহ’-ই হবে আমাদের সুখান্বেষণ।

লেখক: সাদেকুর রহমান সাদিক
সিড্যা, ডামুড্যা, শরীয়তপুর।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button