জীবনের বাঁকে বাঁকে

বিয়ে না হলে নাইবা হলাে

ছােটবেলায় আমাদের কাছে বিয়ে মানেই ছিল শামিয়ানা টাঙ্গানাে বিয়েবাড়ি, লাল শাড়ি পরা কাঁদোকাঁদো বউ, লজ্জা লজ্জা চেহারায় চুপটি করে মুখে রুমাল দিয়ে বসে থাকা বর, মজার মজার খাবার আর ছুটোছুটি করার অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু বড় হতে হতে, বড়দের অদ্ভুত আচরণ দেখতে দেখতে, পৃথিবীটা একটু একটু করে বিস্বাদ লাগতে লাগতে একসময় মনে হলাে, এখানে কোনােকিছুই দেখতে যেমন, আসলে তেমন নয়। ছােটবেলায় বিয়েটাকে যেমন সহজ আর সুন্দর মনে হতাে, বড় হয়ে দেখি এটা অনেকের কাছে একটা ভালাে লাভজনক ব্যবসা।

তখন থেকে বিয়ের ওপর আস্থাই উঠে গেল। আমার সেলফ রিয়ালাইজেশন খুব ভালাে। তাই আমার জন্য যখন প্রস্তাব আসা শুরু করল, তখন আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম, ‘আচ্ছা, ওরা কেন আমার ব্যাপারে আগ্রহী হবে? আমি এখনও একজন ছাত্রী যার তেমন কোনাে যােগ্যতা নেই, দেখতেও ভালাে না, তেমন কাজকর্মও পারি না। তাহলে ওরা কী দেখে আমার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে? আমাকে দেখে? নিশ্চয় নয়!

সিদ্ধান্ত নিলাম, বিয়ে করব না। বাবাকে বললাম, আমার সাথে থাকার জন্য যে টাকাটা তুমি আরেকটা ছেলেকে দেবে, সে টাকাটা দিয়ে বরং আমাকে একটা ফ্ল্যাট আর একটা দোকান কিনে দাও। আরেকজনকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ; বরং আমি নিজেই এগুলাে দিয়ে চলতে পারব।

যখন সেই আমিই একটা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম, তখন সবাই খুব অবাক হয়ে গেল। অবশ্য পরে ওরা বুঝতে পরল, যখন দেখা গেল সেই ভদ্রলোক শুধু বলেই ক্ষান্ত দেননি, আমি কিছু চাই না; বরং সত্যি সত্যি উনি কোনাে কিছু না নিয়ে প্রমাণ করলেন যে, আসলেই উনি কিছু চান না। অনেক ছেলেই বলে, আমি কিছুই চাই না, দোয়াই কাম্য। কিন্তু কার্যত যারা কিছু চায় তাদের চাহিদা তাে পূরণ করা যায়; যারা কিছু চায় না, অনেক সময় দেখা যায়, তাদের যাই দেয়া হােক না কেন, আগ্রহের সাথে নিতে থাকে। তারা কখনাে একটিবারের জন্যও বলে না, ব্যাস, এতেই চলবে।

আমার পরিচিতাদের মাঝে কাউকে কাউকে দেখে খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি তারা বিয়ের ব্যাপারে এত অন্ধভাবে এগিয়ে যায় যে, লক্ষ্যবস্তু ব্যতীত আর কিছুই তাদের নজরে আসে না। আমাদের এক বান্ধবী, অসম্ভব সুন্দরী, বহু প্রস্তাব যাচাই বাছাই করার পরে এক ইউনিভার্সিটির লেকচারারকে পছন্দ করল। আমরা সবাই ওর জন্য উৎফুল্ল হলাম। কিন্তু কদিন পর শুনলাম ওর বাবা উনার একমাত্র প্রপার্টিটা বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। আমরা সবাই ওকে বললাম, তােমার তাে ছেলের সাথে কথা হয়, কথায় কথায় একদিন তাকে বলাে কীভাবে তােমার বাবা তােমাকে বিয়ে দিচ্ছেন। উনার প্রপার্টিতে তাে তােমার ভাইদেরও হক আছে। তুমি কেন নিজের স্বার্থে তাদের বঞ্চিত করবে? তুমি তােমার হবু বরকে বুঝাও যে, তুমি একজন চাকরিজীবী মেয়ে। নিজেই ভালাে ইনকাম কর। তাছাড়া উনিও একজন শিক্ষিত লােক, ভালাে চাকরি করেন। তােমার বাবার ব্যাপারে কন্সিডার করলে আল্লাহ তােমাদের বরকত দেবেন।

সে ভীষণ গাল ফুলিয়ে অভিমান করে বলল, ‘আমি এখন কিছুই বলব না, বিয়ের পর আমি সব বলব।

আমরা সবাই ওর কথা শুনে হতবাক! বিয়ের পর বললে লাভ কী? তখন ওর বাবার প্রপার্টি কি ফেরত আসবে, না ওরা যা যা নিয়েছে তা ফিরিয়ে দেবে? আরেক বান্ধবীর বিয়ে হয়েছিল জয়েন্ট ফ্যামিলিতে। সে একদিন অহঙ্কার করে বুঝাচ্ছিলাে ওর বিয়ের সময় ওর মা-বাবা কিছুই দেননি। কিন্তু যখন কয়েক বছর পর সে শ্বশুরবাড়ি থেকে আলাদা হয়ে গেল, তখন ওঁরা ওর বাসার ফার্নিচার থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু দিয়েছেন। আমি আমার স্বল্পজ্ঞানে বুঝতে পারলাম না, এর মাধ্যমে ওর মা-বাবা কী বুঝালেন? উনারা কি এটাই বুঝালেন যে, শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ায় খুব খুশি হয়েছেন? নাকি চাকরিজীবী মেয়ে আর জামাইকে তেলা মাথায় তেল দিয়ে প্রমাণ করলেন ওনাদের কত টাকা আছে?

আমার এক ভাই আমাকে এক বিয়ের কাহিনি বলেছিল। শুনে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। এক বৌদ্ধ বিয়েতে দাওয়াত খেতে গিয়ে সে দেখল, বরপক্ষ আর কনেপক্ষের মধ্যে তুমুল বিতর্ক চলছে। ঘটনা কী? খোজ নিয়ে জানা গেল, বিতর্কের বিষয় হলাে যৌতুকের কতটুকু নগদ দেয়া হবে, আর কতটুকু পরে দিলে বরপক্ষ কন্সিডার করবে। বর নিজেও রয়েছে তার্কিকদের মধ্যে। কনে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে আছে তার বাবার লাঞ্ছনার গ্লানি দৃশ্যের দিকে। অনেকক্ষণ পর ঠিক হলাে যেভাবেই হােক অর্ধেক টাকা তখনই নগদ দেয়া হলে বিয়ে হবে নতুবা নয়। কনের বাবা ভাবছেন কী করে এই অনুষ্ঠানের মধ্যেই এতগুলাে যৌতুকের টাকা তিনি সংগ্রহ করবেন।

বর গিয়ে কনেকে বলল, আমি দয়া করে তােমাকে বিয়ে করতে রাজি হলাম। সবাই স্তম্ভিত হয়ে শুনল, কনে বলল, আমি রাজি হলাম না।

মেয়ের বাবাসহ সবাই কনেকে বুঝাতে চেষ্টা করল, এই বিয়ে ভেঙ্গে গেলে বদনাম হয়ে যাবে, হয়তাে আর কখনাে মেয়ের বিয়ে হবে না। কিন্তু মেয়ে বলল, “বিয়ে না হলে নাই বা হলাে। বিয়ে হতেই হবে এমন তাে কোনাে কথা নেই! ওরা বিয়ের আসরেই এরকম আচরণ করছেন, তাহলে বিয়ের পর কেমন আচরণ করবেন তা অনুমেয়। বরপক্ষের লােকজন হম্বিতম্বি করে চলে গেল, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই রাজি হলাে না। মেয়ের বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, কনেপক্ষের লােকজন বিমর্ষ। এমন সময় আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন যুবক এসে বলল, ‘আমার খুব একটা টাকাপয়সা নেই। কিন্তু লেখাপড়া জানি, একটা ছােটখাটো চাকরি আছে। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি বিনা যৌতুকে ওকে বিয়ে করতে চাই। ব্যাস, হয়ে গেল বিয়ে! আমরা মহান আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের কথা বলি; কিন্তু কার্যত এতটুকু বিশ্বাসের পরিচয় আমরা অনেকেই দিতে পারি না। পারলে হয়তাে আমাদের জীবন গুলো অন্যরকম হতাে।

আমাদের বিয়ের পর অনেক বন্ধুবান্ধব অনুপ্রাণিত হয়ে যৌতুকবিহীন বিয়ে করলেন। তাদের মধ্যে এক ভাইয়ের কাহিনি খুব মজার। উনি গােড়া থেকে বলে আসছেন যৌতুক নেবেন না। উনার বন্ধু আমাদের বলে চলেছেন, ‘আপনারা ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। বিয়ের দিন গিয়ে দেখি উনার শ্বশুর উনার চাহিদার তালিকায় অতিষ্ঠ হয়ে সব দিয়েছেন। কমিউনিটি সেন্টারে পুরুষ আর মহিলাদের খাবারের জায়গার ঠিক মধ্যখানে বিশাল জায়গা জুড়ে গাড়ি থেকে শুরু করে ছুরি-বটি পর্যন্ত যা যা দিয়েছেন সব সাজিয়ে রেখেছেন; যাতে সবাই বুঝতে পারে ছেলে কী রকম যৌতুকবিহীন বিবাহ করছে। এহেন ঘটনায় বর লজ্জায় মাথাই তুলতে পারল না সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে!

ছেলেমেয়েদের বিয়েতে মা-বাবা খুশি হয়ে কিছু দিলে তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু অনেক ছেলেমেয়েরাই আশু আনন্দের ঝোঁকে ভুলে যায় তাদের মা-বাবার সমাজের কথা। তাদের খুশির কথা ভেবে মুখ বুজে অনেক দুঃখকষ্ট চেপে যাওয়ার কথা। সারাজীবন এত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার পর, এই কি হওয়া উচিত তার প্রতিদান?

মানলাম, অনেকের মা-বাবাই সামর্থ্যবান। কিন্তু তারা তাদের ছেলে মেয়ের বিয়েতে যা করতে পারছেন, তা অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের জন্য করতে পারেন না। তখন সেটা পরিবারের অবুঝ সদস্যদের জন্য মর্মবেদনা আর সামর্থ্যহীন মাতা-পিতাদের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তার চেয়েও যারা দরিদ্র তারা যৌতুকের জন্য হয় মেয়ে বিয়ে দিতে পারেন না, নয়তাে যৌতুকের ওয়াদা পূরণ করতে গিয়ে ধারকর্জ করে দেউলিয়া হােন। নতুবা তাদের মেয়েরা এই ওয়াদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কষ্ট পেতেই থাকে। আর কপাল খারাপ হলে ঘরে আসে মেয়ের লাশ অথবা তার আত্মহত্যার খবর।

ভালাে করে ভেবে দেখলে বুঝা যায়, এর দায়ভার আমাদেরও। আমরা আমাদের অর্থসম্পদের জৌলুস দেখাতে গিয়ে অনেক অনেক মানুষকে হতাশা, গ্লানি এমনকি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের শুধু ভালােবেসেই কিছু দেই, তাহলে কী দিচ্ছি, না দিচ্ছি তা লােকের জানার দরকার কী? আর সব ভালােবাসা বিয়ের দিনই দিয়ে দিতে হবে- এমন কি কোনাে কথা আছে? তার শ্বশুরবাড়ির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তার সুবিধা-অসুবিধা দেখা, তার যেকোনাে প্রয়ােজনে হাত বাড়িয়ে দেয়া, এভাবে কি ভালােবাসার প্রকাশ ঘটানাে যায় না?

এর উল্টোটাও আমাদের সমাজে খুব কমন। ইসলামে তো যৌতুক প্রথা নেই। তবুও এর কথা সব বিয়েতেই একটা প্রধান আলােচ্য বিষয়। অথচ মোহরানা নির্ধারণ করার সময়ও ছেলের সামর্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে ঠিক করা হয় না। ফলে, কার্যত খুব কম মেয়েই তাদের মােহরানা বুঝে পায় । অথচ রাসুল বলেন, অল্প মোহরানার বিয়ে অধিক বরকতপূর্ণ! মােহরানা যথাসম্ভব দ্রুত আদায় করার মধ্যেই মেয়ের সম্মান।

আমাদের এক ভাইয়ের কাহিনি শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম। বিয়ের আসরে বসে পকেট থেকে ৫০,০০০ টাকা বের করে তিনি বললেন, আমি এতটুকুই নগদ মোহরানা দিতে পারব, এখন আপনারা মেয়ে দিতে রাজি থাকলে দেন, নইলে আমি চলি। কনেপক্ষ আর কী বলবে? একসাথে মােহরানা আদায়ে উনার বিয়ে হয়ে গেল! অনেকে হয়তাে বলবেন, তিনি কনেপক্ষকে বেকায়দায় ফেলে বিয়ে করেছেন। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, সুন্দর সংখ্যা সম্বলিত অনেক মােহরানা অনাদায়ী রয়ে যায় বউ কবরে চলে যাবার পরেও।

আমার এক বান্ধবীর বাসায় গেলে খুব ভালাে লাগত। প্রথম যেদিন উনার বাসায় গেলাম, তিনি বললেন, ‘আমার বাসায় কোনাে দুটো জিনিস এক রকম দেখবেন না। আমরা বিয়ের পর একটা পাটি কিনে জীবন শুরু করেছিলাম। তারপর যখন যেভাবে প্রয়ােজন হয়েছে, সামর্থ্য অনুযায়ী কিনেছি। আজ আমরা দুজনেই অনেক ভালাে আয় করি, আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের এখন যা ইচ্ছা তাই কেনার সামর্থ্য আছে।

কিন্তু আমার ঘরের প্রতিটি জিনিসের সাথে অর্জনের যে সুখ আর মর্যাদা জড়িয়ে আছে তার সাথে কি কোনাে কিছুর তুলনা হয়? উনার ঘরে ঢুকলেই যে শাস্তির পরশ পাওয়া যায় সেটা আরও অতুলনীয়।

আমাদের বিয়েতে কোনাে গানবাজনা লাইটিং হয়নি, আমরা চাইনি। কারণ এসব দিয়ে আমাদের বৈবাহিক জীবনে সুখ নিশ্চিত করা যাবে না। কিন্তু ঐ টাকাটা দিয়ে যদি একটা গরিব মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তার বরকতের ছোঁয়া আমাদের জীবনে আনন্দ বয়ে আনতে পারে।

জীবনে অনেক সময় অল্প ছাড় দিলে আরও অনেক ভালাে কিছু পাওয়া যায়। প্রতিদিন দুজনে মিলে তিল তিল করে একটা সংসার গড়ে তােলার, সমস্ত সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়ার যে আনন্দ, দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার যে সুযােগ, রেডিমেড সংসারে তার স্থান কোথায়? যে বিয়ে পরস্পরের প্রতি সম্মানবােধ ও দায়িত্বের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আর যে বিয়ে লােভ ও ভীতির ওপর স্থাপিত, দুটোর মধ্যে কি কোনাে তুলনা হয়? আমাদের মা-বাবারা তখনই সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার সুযােগ পাবেন, যখন আমরা তাদের ধৈর্য ও স্থিরতার সাথে সাহস দেব, “বিয়ে না হলে নাই বা হলাে, বিয়ে হতেই হবে বলে তাে কোনাে কথা নেই। আর বিয়ে হলে যেন সম্মানের সাথেই হয়। এতটুকু আত্মসম্মান কি আমরা অর্জন করতে পারি না?

– রেহনুমা বিনতে আনিস

মন্তব্য করুন

Back to top button