জীবনের বাঁকে বাঁকে

তুমি ছিলে গো আমার প্রার্থনায়

ক্যান্সেরী ডাউনটাউন মূলত ক্ষুদ্র একটি বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক এলাকা। এই অল্প জায়গাতেই বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে। প্রত্যেকটিতে প্রাত্যহিক ও জুমার নামায হয়। মসজিদগুলাে বেশ প্রশস্ত হলেও ডাউনটাউনে কর্মরত মুসলিমদের সংখ্যাধিক্যের কারণে প্রতি শুক্রবার মসজিদগুলােতে অন্তত দুটো করে জামায়াত হয়। এক জামায়াত শেষ হবার আগেই পরবর্তী জামায়াতের জন্য রাস্তায় মুসল্লীদের লাইন লেগে যায়। আমার অফিসের পাশের বিল্ডিংয়েই মসজিদ। এই মসজিদের খুতবা বেশ ভালাে হয়ে থাকে। একদিন দোয়ার তাৎপর্য বুঝাতে খতিব সাহেব জুমার খুতবায় একটি গল্প বলছিলেন। বিয়ের গল্প। জীবন থেকে নেয়া গল্পটি অসম্ভব ভালাে লেগেছিল। আরও ভালাে লেগেছিল কারণ পরে এই গল্পের পাত্র-পাত্রীর সাথে দেখা হয়েছিল।

ইমাম সাহেব বললেন, একবার একজন শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ান ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের মূলনীতি এবং চর্চার ওপর মসজিদে সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেন। বিদায়বেলায় ইমাম সাহেব নও মুসলিম ভাইকে আশ্বাস দিলেন, এরপরে আর কোনাে সাহায্য লাগলে তিনি সহযােগিতা করতে চেষ্টা করবেন।

তখন নতুন ভাইটি বললেন, আপনি আমাকে একটি বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন।

ইমাম সাহেব উসুক হয়ে বললেন, ‘বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?

নতুন ভাই বললেন, আমার একজন স্ত্রীর প্রয়োজন।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমাদের অনেক অবিবাহিতা মুসলিমা বােন আছেন। সুতরাং সমস্যা হবে না, ইনশাআল্লাহ। আপনি স্ত্রী হিসেবে কোন ধরনের মেয়ে পছন্দ করেন?

ভাইটি বললেন, আমি একজন কুরআনে হাফজাকে বিয়ে করতে চাই; যেন তিনি আমাকে বিশুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে সহযােগিতা করতে পারেন। ইমাম সাহেব মনে মনে ভাবলেন, ‘একজন শ্বেতাঙ্গ নওমুসলিমকে এমন মেয়ে কেন বিয়ে করবে, যে কুরআনে হাফেজা?’ কিন্তু তিনি সেটা প্রকাশ না করে বললেন, আপনার আর কোনাে পছন্দ-অপছন্দ আছে কী?

তখন ভাইটি জানালেন তিনি একজন আরবি মেয়ে বিয়ে করতে ইচ্ছুক যেন স্ত্রীর কাছে আরবি শিখে তিনি কুরআনকে এর মূল ভাষায় বুঝতে পারেন।

ইমাম সাহেব মুখে কিছু না বললেও মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। একজন শ্বেতাঙ্গ নওমুসলিমের জন্য এমন মেয়ে জোগাড় করা খুব সহজ ব্যাপার। নয়। কিন্তু তিনি ভাইটিকে নিরাশ করতে চাইলেন না। তাই খুঁজবেন বলে আশ্বাস দিয়ে বিদায় জানালেন।

এর এক সপ্তাহ পর ভাইটির সাথে ইমাম সাহেবের দেখা হলাে। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন তাঁকে কী বলা যায়। কিন্তু ইমাম সাহেব এ বিষয়ে কথা বলার আগেই ভাইটি সুখবর জানালেন, তিনি বিয়ে করেছেন। ইমাম সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, কার সাথে বিয়ে হলাে, মেয়ে কেমন ইত্যাদি। নতুন ভাইটির জবাব শুনে ইমাম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি বিয়ে করেছেন যাকে, তিনি কুরআনে হাফেযা, আরবিভাষী। ইমাম সাহেব তাঁকে ধরলেন, এই অসাধ্য কিভাবে সাধন হলাে? তখন তিনি জানালেন, ইসলাম গ্রহণ করার আগে থেকেই তিনি শয়নে-স্বপনে, জাগরণে আল্লাহর কাছে এমন একজন সঙ্গিনীর জন্য দোয়া করতেন, যে আল্লাহর পথে তাঁর সাথি হবে। তখনই তিনি অনুভব করেন এমন মেয়েই তাঁর প্রয়ােজন, যে তাঁকে কুরআনের অর্থ বুঝতে সহায়তা করবে।

যেন তিনি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারেন। দিনের ব্যস্ততায়, অবসরে, রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে, প্রতিটি মুহূর্তে তিনি মহান আল্লাহর কাছে এমন একজন সঙ্গিনীর জন্য প্রার্থনা করতেন। ইসলাম কবুল করার দিন কয়েকের ভেতর আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই দোয়া কবুল করেন। এমন একজন মেয়ে পাওয়া গেল, যে একজন নওমুসলিমকে পথ দেখাতে আগ্রহী। এমন পরিবারও পাওয়া গেল, যারা একজন সাধারণ নওমুসলিমকে নিজেদের পরিবারের অংশ হিসেবে কবুল করে নিতে ইচ্ছুক।

এর কিছুদিন পর ওয়ান উম্মাহ কনফারেন্সে এই দম্পতির সাথে আমাদের পরিচয় হয়। ভাইটি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন, নও মুসলিমদের ইসলাম শিক্ষার জন্য কতখানি সাহায্য প্রয়োজন। এই উপলব্ধি থেকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিলে একটি সংস্থা গড়ে তােলেন যার মাধ্যমে নও-মুসলিমদের প্রশিক্ষণ, মানসিক ও আর্থিক সহযােগিতা প্রদান করা হয়। যারা নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করে, তারা অধিকাংশই সামাজিক, পারিবারিক এবং অন্যান্য অনেক দিক থেকে নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। আমরা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সংস্থাকে যেকোনাে প্রকার সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি বলে জানালাম। তখন আমরা বাচ্চাদের একটি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করছিলাম। তাঁদের অনুরােধ করলাম সেখানে ভাইটির ইসলাম গ্রহণের কাহিনি বর্ণনা করতে।

এর একমাস পর তাঁরা আমাদের বাসায় আসেন। ষাটজন বাচ্চার সামনে ভাইটি তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী, কার্যকারণ, ফলাফল ও অনুভূতি তুলে ধরেন। একপর্যায়ে উঠতি ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন, তিনি যখন অমুসলিম ছিলেন তখনাে তিনি সামাজিক গড্ডালিকা প্রবাহে না ভেসে নিজের সততা ও নৈতিকতা বজায় রেখে পথ চলতেন। তাঁর কখনােই কোনাে গার্লফ্রেন্ড ছিল না; বরং তিনি নানাবিধ সমাজসেবা ও সচেতনতামূলক কাজের সাথে নিজেকে জড়িত রাখতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশােনা এবং কল্যাণকর উদ্যোগসমূহে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং সত্য পথ অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। আল্লাহ তায়ালা হয়তাে এ জন্যেই তাকে আলাের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।

ইসলাম গ্রহণের পূর্বের ভালাে অভ্যাসগুলাের সুফল তিনি ইসলামে প্রবেশের পর হাতেনাতে পেতে শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী নিজেকে সৌভাগ্যবর্তী মনে করেন। পরিতৃপ্তির সাথে তিনি উপস্থিত শিশু কিশোর দের বলেন, তাঁর স্বামী পূর্বে অন্য কোনাে মেয়ের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন না। তিনি এমন একজনের স্ত্রী, যিনি বিয়ের আগে ও পরে উভয় অবস্থাতেই তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা এই সমাজে নিজেদের সততা বজায় রাখতে হিমশিম খায়, তারা এই বক্তব্যে উজ্জীবিত হলাে। বুঝতে পারল, সবুরে মেওয়া ফলে; অতীব মিষ্ট এবং প্রাচুর্যময় মেওয়া।

সুতরাং যারা উত্তম সঙ্গী চান, তাঁদের অব্যাহত দোয়া করার কোনাে বিকল্প নেই। কারণ শ্রেষ্ঠ নির্বাচক তাে তিনিই, যিনি আমাদের পরস্পরকে সৃষ্টি করেছেন জুটি হিসেবে। পাশাপাশি বিশ্বস্ততা কেবল বিয়ের পরেই নয়, বিয়ের আগেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। মানসিক, শারীরিক, চারিত্রিক সকল দিক থেকেই নিজেকে সংরক্ষণ করতে হবে। নইলে আমরা এমন একজনের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারি, যে আদতেই আমাদের উপযুক্ত সঙ্গী নয়। ফলশ্রুতিতে বিয়ের পর বাকি জীবন কেটে যেতে পারে হা-হুতাশ এবং না পাওয়ার বেদনা নিয়ে। বিয়ের ব্যাপারে এমন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অগ্রসর হলে আমরাও পেতে পারি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই উত্তম সঙ্গী। তবে আমাদের প্রাপ্তি নির্ভর করে আমাদের প্রচেষ্টা, সততা ও নিয়তের শুদ্ধতার ওপর।

– রেহনুমা বিনতে আনিস

মন্তব্য করুন

Back to top button