পাঠকের পাতা

আবেগ বনাম চিন্তাশক্তি

☞ সম্মুখপানে বসা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কোন একদিন  জিজ্ঞেস করেছিলাম, “জল ভরা কলস নাকি কলস ভরা জল?” কিছুটা বিলম্বিত না করেই কেউ বলেছিল, “জল ভরা কলস” কারো উত্তর,”কলস ভরা জল”। কেউবা আবার ভাবলেশহীন দৃঢ়তায় বলেছিল,”দুটোই ঠিক”। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বিশাল একটা অংশ লা জওয়াব ছিল ‘না জানি ভুল’ হওয়ার ভয়ে। মত, দ্বিমত আবার কখনো কখনো দ্বৈতমতে বিশ্বাসী আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম বিশ্ব চরাচরের বৈচিত্র্যময় মানুষের ভাব, ভাষা এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশমান অভিব্যক্তিকে চিন্তাশক্তির বিচারে উপলব্ধি করা।

☞ “ওরে প্রানের বাসনা প্রানের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি”।  হ্যা, কেউইতো রুদ্ধ করে রাখতে চায় না নিয়ত পরিবর্তনশীল আবেগকে। কিন্তু সে আবেগ যদি অন্যের ভাবাবেগে অনিয়ন্ত্রিত বেগে হানা দেয় তাহলে সেখানে মুক্তবুদ্ধি অবমুক্ত হতে পারে না। নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক  স্বকীয়তার পরাজয় মেনে নেওয়ার জন্য মানব মন কখনই প্রস্তুত থাকে না যদি না যৌক্তিক কোন থিওরি আসে। আলোচনা,পর্যালোচনা কিংবা সমালোচনার প্রতিটি  পরতে পরতে আলোচিত জনের দর্শনে উপলব্ধি করার মানসিকতা থাকাটাও বাঞ্চনীয়। ব্যাক্তি ভিন্নতায় সাদৃশ্য বৈশাদৃশ্যের  চিন্তাধারা থাকাটাই স্বাভাবিক। নিজের আইডিয়লজির বৈপরীত্য সবকিছুই যে অগ্রহনযোগ্য হবে এমনটা ভাবা ব্যাক্তিগণ সমাজ বা মানবিকতার বন্ধন থেকে ক্রমশ দূরে যেতে থাকলেও অস্থিমজ্জায় মিশে থাকা নিজেদের আবেগ তাড়িত স্ববিরোধী চিন্তাধারা বাস্তবায়নের জন্য তাদের শব্দশৈলীর অন্তহীন যাত্রা অপরাপর মানুষের অনুভূতির মূল্য বুঝে না।

☞ আবেগ বা অনুভূতিকে যদি চিন্তাশক্তি দ্বারা পরিচালিত করা না যায় সেখানে সৃজনশীলতার দ্বার রুদ্ধ হয়ে অন্ধ অনুকরনের পথ প্রশস্ত হয় । এই সুযোগে বুদ্ধিজীবী নামের ভোগবাদী সুযোগসন্ধানীরা আমাদের আবেগকে আবেশিত করে তাদের কার্যসিদ্ধির নিয়ামকে পরিনত করে। আবেশিত মস্তিষ্কের কোষগুলো হারিয়ে ফেলে স্বতঃস্ফূর্ত সত্য মিথ্যার পার্থক্য নিরুপণে। ভুলে যাই নিজস্ব চিন্তাধারা , মেনে নেই অযাচিত কূটকৌশল।

☞ “টলার, স্ট্রংগার এবং সার্পার” জিংগেল শুনতে শুনতে বিশ্বাসিত হয়ে হরলিক্স খেয়ে বেড়ে ওঠা এ জাতির চিন্তাশক্তি কতটা টলার, স্ট্রংগার এবং সার্পার হলো তার বিবেচনা বোধটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। জীবনের আলো আধারিতে নিজস্ব অন্ধ অনুকরনে যা শুনি তাই নির্বিবাদে মেনে নেওয়ার প্রবনতা সর্বত্র বিরাজমান। হাজারো উপদেশের ভীড়ে সদুপদেশ খুজে ফিরে আমাদের আবেগ হারিয়ে যায় দৃশ্যমান নির্ভুল কিন্তু কার্যত ভুলের দিকে।

☞ জমিদারি প্রথার পরম্পরায় বেড়ে উঠা এ জাতির মননে আজো প্রোথিত “জি হুজুর, আজ্ঞে হুজুর, ঠিক বলেছেন, জনাব।” করজোড়ে অবনত মস্তকে কম্পমান স্বরে শোষক মহাজনের দ্বারে অনুনয় বিনয়ের রেপ্লিকা আমারা জিইয়ে রেখেছি চেতনে অবচেতনে। হয়ত তখন এক তল্লাটে এক মহাজন শোষন করত হাজার জনকে। আজ শত শোষক মহাজন হয়ে বসে আছে জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

☞ আমরা ইতিহাস পড়ি, ইতিহাসের আদি অন্ত রোমন্থন করি কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার ভাবোদ্দীপনা তৈরি হয় না। পলাশীর যুদ্ধ শেষে ইংরেজ শোষকরা যখন  মুল্যবান সম্পদ নিয়ে  নৌযান করে যাচ্ছিল, নদীর দুই প্রান্তের জনমানুষের চোখ কৌতুহলী উদ্দীপনায় শুধুই তাকিয়েছিল অজানা রহস্যে। একটি করে ঢিল ছুড়লেও হয়তো সম্পদগুলো সুদূর বিলেতে না গিয়ে অন্তত নদীর তলদেশে শায়িত হত। আজও “ওটা আমাদের কম্ম নয়, নেতারাই করবে, নেতারাই বুঝবে, ন জানি কোন ভুল হয়” এই থিওরিতে নিশ্চুপ জনগন কাল কালান্তরে শোষিত হতেই থাকবে যতদিন না শুদ্ধ চিন্তার পরিস্ফুটন হয়।

☞ জনগনকে নির্বুদ্ধিতায় আবেশিত করতে এদেশীয় কিছু বুদ্ধিজীবি নিজেদের স্বকীয়তা পদদলিত করে বিশ্ব ও আঞ্চলিক মোড়লদের শিখানো বুলি আওড়াতে কুন্ঠিত হন না। ‘বিশ্বাসের ভাইরাসে’ বিশ্বাসী অবিশ্বাসের ক্যান্সারগুলো আমাদের মননে প্রতিনিয়ত আঘাত করে গেলেও তারাই আমাদের বুদ্ধিজীবী, তারাই আমাদের জাতীয় বীর। নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দাবীদার এরাই আবার সময়ে সময়ে ইসলাম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতার ঘোর পৃষ্ঠপোষক। যে চেতনাধারীরা ইসলামের গন্ধ পেলে মহা বিপদ সংকেতের সাইরেন বাজাতে বাজাতে টকশো টেবিলে কম্পন তোলে তারাই আবার গ্রিক দেবী মূর্তি স্থাপনের স্বপক্ষে চেতনাধারী যোদ্ধা হয়ে আবির্ভূত হন। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার নামে ধর্ম এবং ধর্মীয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে বিষোদগার করা এরাই আবার পহেলা বৈশাখে ঝাড়ু, সর্পমুখ, পেচাসহ কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসিত একধর্মের রীতিনীতির ধারক বাহক হয়ে দেশময় ঢেউয়ের ফোয়ারা প্রবাহিত করে। আবেগ তাড়িত হয়ে ঢেউয়ের ফেনিল জলের বিজাতীয় সংস্কৃতিতে  আমি, আমরা নিজেদেরকে মেলে ধরি কারন “আমি অহিংসবাদী”। বাস্তবধর্মী জ্ঞানচর্চার অভাবে আপনার আমার বিশ্বাসে এরা সুকৌশলে অপসংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ছন্দোবদ্ধ উপমা আর যুক্তির ফুলঝুড়িতে আমারা হারিয়ে ফেলি চেতনাবোধ, ভাবতে শুরু করি তারাই আমাদের বিপদসংকুল যাত্রাপথের আলোকবর্তিকা। আক্ষেপ হয় নিজেদের নিয়ে কারন  জ্ঞানরাজ্যে বিচরনের অভাব হেতু চিনতে পারলাম না স্ববিরোধী বুদ্ধিজীবীদের, এদের মিশন এবং ভিশনকে। বরং কখনো কখনো এদেরই সুরে আমরা সুর মিলিয়ে নিজেদের অপচেতনার উন্মাদনাকে প্রকাশ করি স্বচেতনায় আবির্ভূত ভাইয়ের বিরুদ্ধে যে কি না কলম ধরে সাম্রাজ্যবাদের থাবা রুখতে।

☞ “পাপীকে নয় পাপকে ঘৃনা কর” ভাবসম্প্রসারন মুখস্থ করতে হয়েছিল অবুঝ হৃদয়ের সবুজ প্রান্তরে। দোদুল্যমান ভাবনায় বুঝিনি ভাবার্থ। আজো বুঝতে গিয়ে প্রশ্নবান ঘিরে ধরে চারদিক থেকে। এখনো বুঝি না এই চেতনা লালিত সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর শত শত মুক্তমনায় বিশ্বাসী শিক্ষার্থীরা যখন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে,

“একটা একটা….(যার যার উপযুক্ত শব্দ) ধর

ধইরা ধইরা জবাই কর”।

শিক্ষা যদি অন্ধ আবেগকে প্রশমিত করতে না পারে তাহলে চিন্তাশক্তির বিকাশ সেখানে রুদ্ধ। আমাদের জ্ঞানজ্যের বিস্তৃতে সমাজের রূঢ় বাস্তবতার অবসানে কোনকালে  হয়তো পাপ আর পাপীর কোনটি ঘৃনিত তা বুঝতে পারবো।

আশা নিরাশার দ্বন্দ্ব দোলায় ভঙ্গুর সমাজের অবলোকনে চেয়ে আছি সুদূর পানে।

“দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,

ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?”

 

– সাদেকুর রহমান সাদিক

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button