পাঠকের পাতা

নৈতিকতা বনাম বাস্তবতা

বিশ্বময় চিরন্তন নীতি বন্ধনের অস্তিত্ব বিরাজমান। ক্ষুদ্র পরমাণু থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের প্রতিটি বিশাল বিস্তৃত বস্তু পারস্পরিক নীতির বন্ধনে আবদ্ধ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা চিন্তা চেতনা বস্তুগত বন্ধন নীতির অভূতপূর্ব (unprecedented) অগ্রগতি সাধন করলেও নৈতিকতার বন্ধন ম্রিয়মাণ (disconsolat) হওয়ার সামান্যতম ব্যাখ্যাও দিতে পারছে না।

আমি গর্ববোধ করি কারণ আমি সেই দেশে আছি যে দেশ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা। কিন্তু কখনো কি মনে হয়েছে আমাদের নৈতিকতার বিশাল উদ্যানে নির্জলা নিষ্ফলা এক মরুমালার প্রান্তর। দোদুল্যমান (swinging) মানসিকতায় নৈতিকতার বুলি আওড়াতে আওড়াতে গর্বিত হৃদয়ে অনৈতিকতার চাকচিক্যময়তায় পরাজিত হই। লোভ প্রলোভনের বিস্তৃত বিচরণে হৃদয়তন্ত্রীতে কখনো প্রতিবাদী অনুরণন (vibration) অনুভূত হয় না। বছরের পর বছর পড়াশুনা শিক্ষাদীক্ষায় তৈরি হয় বিদ্যার সাগর। বিদ্যার এই টলোমলো সাগরে জন্ম নেওয়ার কথা ‘সততা’ নামক আলো-ঝলমলে পদ্মফুলের। কিন্তু বাস্তবতার নির্মম পরিহাস শিক্ষা জীবনের পরতে পরতে মানব ধর্ম আর নৈতিকতার গল্প কবিতার জাবড় কাটার বিপরীতে বাস্তবতায় অনৈতিক দুনিয়ার রঙিন অবয়বে নিজেদেরকে খুঁজে পাই।

সমাজ বাস্তবতায় নেতাদের সুহাস্য বদনে মোহময়ী (mind blowin) কথার ফুলঝুরিতে আমাদের অবিশ্রান্ত মন ক্লিষ্টতা (complexity) ভুলে এক অজানা প্রশান্তিতে আবেশিত হয়। ছলনার চাতুর্যতায় প্রলুব্ধ (allured) হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি অনৈতিকতার বিষবাষ্প সুবিস্তৃত করার মিশনে। নৈতিকতার গুণাবলীতে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন না করে বরং ব্যক্তিকে আদর্শ ধরে অন্ধ অনুগমন (obeyin) করে নৈতিকতার চরম বিসর্জন (abandonmemt) সর্বত্র বিরাজমান। স্বপ্নের তৃতীয় নয়নে অন্ধকার জগতের মানুষ নামের অমানুষগুলো-কে নিষ্কলুষ (clean) ভাবা আমরা মন মানসিকতায় কতটা পরিশুদ্ধ? দুই ধরনের প্রলোভন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নীতি-নৈতিকতার সমস্ত দ্বার রুদ্ধ (block) করে কেউ ছুটে অর্থের দিকে আবার কেউ ছোটে জৌলুসময় ক্ষমতার দিকে আবার কেউ দুটোর দিকেই। কেউ ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার জন্য অবৈধ উপার্জনকারীদের সাপোর্ট দেয়। বিপরীতভাবে অবৈধ উপার্জনকারী ইনকামের আশায় ক্ষমতালিপ্সুদের সাপোর্ট দেয়। সমাজ বিচ্যুতির (deviation) এই ধারায় আমি আমরা অবচেতনভাবে (subconsciously)  নীতিবিবর্জিতদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এবং অভিযোজিত হয়ে (adapted) আমরাও ছুটে চলি অর্থ ও ক্ষমতার পেছনে।

বক্তৃতার মঞ্চে প্রতাপশালী যখন বুক ফুলিয়ে অবহেলিত মানুষের জয়গানে মুখরিত, করুন বাস্তবতার নির্মম অবয়ব দেখে সেই অবহেলিতের বুকটা কেঁপে উঠে অজানা আশঙ্কায়। অবহেলিত, অপমানিত, দুঃখভারাক্রান্ত জীবনের অসীম সমুদ্র পাড়ি দিতে সেও খুঁজে ফেরে রঙিন ঢেউ খেলানো অর্থ-বিত্তের জৌলুসময় জীবন।

আলো ঝলমলে বৈচিত্র্যময় এই ধরায় সন্তান পদার্পণের আগেই পিতা-মাতার অজস্র স্বপ্নমাখা কাব্য রচিত হয়। শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বময় আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবে তার সোনার টুকরা সন্তানটি। অফুরন্ত স্বপ্নের অনাগত ভবিষ্যৎ যখন আগত, ঝলমলে এক ক্যারিয়ারে আরোহীত ছেলের অবস্থান সত্ত্বেও পিতামাতার মুখায়বে ক্রন্দনরোল অন্তিম সময় পর্যন্ত অবিরত। ব্যথাতুর মনে খুঁজে ফেরে সন্তানের সুখের জন্য কোন কিছুই তো অভাব রাখেনি। তবে কেন এমন হলো?

দুর্নিবার চাওয়া এবং পাওয়ার অসীম ইচ্ছাশক্তি মানব মনের চিরায়ত সঙ্গী। নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে জাপ্টে থাকা দুর্নীতিকে নীতি মনে করা এ জাতিকে পরিত্রাণের কোন ভ্যাকসিন আছে কি? অবিরাম চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্রণোদিত ইচ্ছাশক্তিকে দমিত রাখার অলৌকিক শক্তির উৎস কি আমাদের জানা আছে?

ওহে নীতি-নৈতিকতা হারানো মানবকূল,শান্তি ছায়া পাওয়ার জন্য বিভোর অভিযাত্রী দল, শুনতে কি পাও নি জাহেলি সম্প্রদায়ের বর্বর মানুষগুলোর সোনালী মানুষ হওয়ার কীর্তিগাথা? কি এমন শক্তি ছিল যা কদর্য মন-মানসিকতার মানুষগুলোকে সর্বশ্রেষ্ট জাতিতে রূপান্তরিত করেছিল? হা সেই মহামানবের দেখানো মহান সৃষ্টিকর্তার মত এবং পথ নৈতিকতাহীন সমাজকে জাগ্রত করার একমাত্র পথ। কদর্য মন মানসিকতা কে শুভ্রতায় ভরিয়ে দিতে মনের বদ্ধ বাতায়ন খুলে পড়ি এবং অনুসরণ করি তাই যা সৃষ্টিকর্তা বলেছেন। ইনশাআল্লাহ পৌঁছে যাবো দীপ্তিময় মুক্তির মোহনায়। যেখানে থাকবে না অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন। সে এক নতুন ভোর, নতুন দিন। বিষময় জীবন ছাড়িয়ে নতুন করে বাঁচার এক অমলিন হাসি।

সেই সোনালী ঊষার প্রত্যাশায় মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

লেখক: সাদেকুর রহমান সাদিক

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button