পাঠকের পাতা

সর্বগ্রাসী, আত্মবিধ্বংসী, ক্ষতিকর সাতটি বিষয় থেকে বিরত থাকা আবশ্যক

সমস্ত প্রশংসা ও গুণকীর্তন একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তা‘য়ালার জন্য যিনি, নিখিল বিশ্বোর একচ্ছত্র উদ্ভাবক ও অধিপতি। দুরূদ, সালাম ‍ও শান্তি বর্ষিত হউক সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহানবী, মহামানব, উম্মতের কান্ডারি ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)’-এর প্রতি যিনি, উম্মতকে সর্বগ্রাসী, আত্মবিধ্বংসী, মহাক্ষতিকর  `সাতটি বিষয়’ থেকে বিরত থাকাতে দ্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন। সাহাবা, তাবিয়িন, তাবি-তাবিয়িনসহ আপামর সকল মুসলিগণের প্রতিও সালাম ‍ও শান্তি বর্ষিত হউক।

প্রতিটি মুসলিমই এব্যাপারে অবশ্যই অবগত আছেন যে, মরণব্যাধি ও বিষ যেমন শরীরের জন্য মারাত্মক ও অত্যন্ত ক্ষতিকর। তেমনিভাবে অন্যায়-অশ্লীল, গর্হিত কাজ-কর্ম, পাপাচার ও গুনাহ্ও অন্তরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমনকি দুনিয়া ও আখিরাতে যত অকল্যাণ ও ব্যাধি রয়েছে তার মূলে রয়েছে গুনাহ্ ও পাপাচার। তাই জীবন্ত কিংবদন্তি মহানবী ‘মুহাম্মাদ (সাঃ)’ উম্মতকে সতর্কতার ধ্বনি শুনিয়ে গেছেন। উম্মাহ যদি এসবের প্রতি গুরুত্বারোপ করে, তাহলে সুনিশ্চিতভাবে রচিত হবে নবদিগন্তের। স্থাপিত হবে অবিস্মরণীয় মাইল ফলক। সকল শাস্ত্রের দিকপালগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, যে বা যারা আল-কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন-যাপন করেব তারাই কালের সাক্ষী হয়ে থাকবেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। ফলশ্রুতিতে প্রশান্তি পাবে এপারে এবং ওপারে। তাই অদ্যকার প্রবাহমান এ প্রবন্ধে আমরা জানার চেষ্টা করব সর্বগ্রাসী, আত্মবিধ্বংসী, মহাক্ষতিকর ‘সাতটি বিষয়সমূহ’ যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক করেছেন রাসূল (সাঃ)।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ

اِجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوْبِقَاتِ (اَلْمُهْلِكَاتِ)، قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا هُنَّ؟ قَالَ : اَلشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيْمِ، وَالتَّوَلِّيْ يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلاَتِ ‏

তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় হতে বেঁচে থাক। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী? তিনি বললেন : আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, জাদু, যথার্থ কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের মাল খাওয়া, জিহাদের ময়দান থেকে পিঠ ফিরিয়ে নেয়া, সতী-সাধ্বী, বিশ্বাসী, সরলমনা নারীদের প্রতি (ব্যভিচারের মিথ্যা) অপবাদ দেয়া।[1]

হাদীসে উল্লেখিত مُوْبِقَةٌ / مُهْلِكَةٌ বা ধ্বংসাত্মক বিষয় দ্বারা কবীরা / বড় গুনাহ উদ্দেশ্য। যা আবু হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত অন্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন ইমাম বাযযার ও ইবনুল মুনযির আবু হুরায়রার সূত্রে বর্ণনা করেন :

اَلْكَبَائِرُ الشِّرْكُ بِاللهِ وَقَتْلُ النَّفْسِ‏

(কবীরা / বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা)। আর ইমাম নাসায়ী, ইমাম ত্ববরানী সুহাইবের সূত্রে আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন। ‘রাসূল (ﷺ) বলেছেন :

مَا مِنْ عَبْدٍ يُصَلِّي الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ وَيَجْتَنِبُ الْكَبَائِرَ السَّبْعَ إِلاَّ فُتِّحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ

যে বান্দা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, এবং সাতটি কবিরা গুনাহ পরিত্যাগ করে থাকে, অবশ্যই তার জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে।’[2] হাদীসটিকে ইবনু হিববান ও হাকিম সহীহ বলেছেন। কিন্তু উল্লেখিত হাদীসের সব ব্যাখ্যা করেননি। অন্যদিকে ইসমাঈল আল কাজী সহীহ সনদে সাঈদ ইবনু মুসায়্যিব হতে ১০টির কথা উল্লেখ করেন।

তিনি হাদীসে উল্লেখিত মূল ৭টির সাথে যা অতিরিক্ত বর্ণনা করেন তা হল :

وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَالْيَمِيْنُ الْغَمُوْسُ وَشُرْبُ الْخَمْرُ

‘পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা কসম করা এবং মদ্যপান করা’।

কবীরা গুনাহের সংখ্যা নিরুপণ নিয়ে রয়েছে বিশদ মতভেদ। ইমাম ত্ববারী ও ইসমাঈল ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, তাঁকে ৭টি কবীরা গুনাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন : কবীরা গুনাহ ৭৭টিরও অধিক। অন্য আরেক বর্ণনায় ওগুলো প্রায় ৭০টি, আবার আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, ওগুলোর সংখ্যা ৭শ’টি।[3]

হাদীসে বর্ণিত সাতটি বিষয় নিম্নরূপঃ

০১. আল্লাহর সাথে শিরক / শরীক করা ; অংশীদার স্থাপন করা।

০২. জাদু করা, জাদু বিদ্যার্জন করা, জাদুতে বিশ্বাস করা।

০৩. ইসলামী ও রাষ্ট্রীয় আইনী ব্যবস্থা ব্যতীত যথার্থ কারণ ছাড়া অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ্ হারাম করেছেন।

০৪. সুদ খাওয়া, সুদ প্রদান করা, সুদের সাক্ষ্য প্রদান করা।

০৫. ইয়াতীমের মাল খাওয়া, আত্মসাৎ করা, বিনষ্ট করা।

০৬. জিহাদের ময়দান থেকে পিঠ ফিরিয়ে নেয়া, পলায়ন করা।

০৭. সতী-সাধ্বী, বিশ্বাসী সরলমনা নারীদের প্রতি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয়া।

আলোচ্য প্রবন্ধ থেকে শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

ক. উপরোক্ত আলোচিত ও পঠিতব্য বিষয়গুলো সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ, হারাম ও কবীরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত।

খ. তাই সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে নিজের মন-মানসিকতা, মননশীলতাকে প্রস্তুত রাখতঃ সদা-সর্বদা, সতর্কতা ও জাগ্রত থাকতে হবে।

উপসংহারঃ

সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ও সুপ্রিয় মুসলিম বন্ধুপ্রবর! ব্যক্তি ও সমাজকে সর্বগ্রাসী, আত্মবিধ্বংসী বিপর্যয়, অধ্বঃপতন ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এর চেয়ে চমৎকার ফরমুলা আর কী হতে পারে? কিন্তু বাস্তবতা কী? আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘুণে ধরেছে। বিশৃঙ্খলা ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এর পেছনে মূল সমস্যা কোথায়? কে দায়ী? দায়ী আমরাই। ইসলাম, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দূরে থাকা এবং মানব জীবনে ইসলামের অনুশাসনের বাস্তব অনুশীলনের অভাবই দায়ী। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সুমতি, সুবুদ্ধি ও সদাজাগ্রত বিবেক দাও, ইসলামের পরিপূর্ণ জ্ঞান দান কর, ইসলামের উপর পরিপূর্ণভাবে পরিচালিত কর, আর রক্ষা কর অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে। আমীন।

– আব্দুস সালাম হুসাইন আলী

শিক্ষক, ইনসাইট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উত্তরা, ঢাকা।


[1] হাদীসের মান : সহিহ। সহিহ বুখারি  ৬৮৫৭ (শামিলা ও তা. পা), ২৫৭৮ ও ৬৩৯৩ (ই. ফা), ৬৩৮০ (আ. প্র) ; সহিহ মুসলিম ১৬৪ (ই. ফা), ১৬৩ (হা. এ) ; আবু দাউদ ২৮৬৪ (ই. ফা), ২৮৭৪ (তাহক্বীক্বকৃত) ; মিশকাতুল মাসাবীহ ৫২ (হা. এ)]।

[2] [নাসাঈ ২৪৩৮ ও ৪০ (ই. ফা)]

[3] [ফাতহুল বারী]

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button