জীবনের বাঁকে বাঁকে

ওদের দেওয়া পরিচয় অনুযায়ী আমি একজন ‘জারজ!’ – রুম নাম্বার ৫০৬

নিরাপত্তার স্বার্থেই আমার কিংবা ওদের পরিচয় আমি দিতে পারছি না। এজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

তারিখটা ছিল : ১১-০২-২০১৯

মাগরিবের নামাজ পড়বো বলে অজু করে রুমে আসলাম, হঠাৎ চার-পাঁচজন ছেলে আমার রুমে এসে আমাকে শিবির সন্দেহে জেরা করতে থাকে। আমি বারবার বলছিলাম, আমি শিবিরের সাথে জড়িত নই। তবুও তারা মানলো না। আমি বললাম, সন্দেহ করছেন! ঠিক আছে, আমি হল ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এই বলে আমার জিনিসপত্র গোছাতে থাকি।

কিন্তু বিধিবাম হলে যা হয়, ঠিক রাত বারোটার সময় ১০-১২ জন ছাত্রলীগের ছেলে আমার রুমে এসে হাজির। তাদের কারো কাছে ব্যাট, স্ট্যাম্প, লাঠি, বিদ্যুতের তারসহ অন্যান্য উপকরণ, যা দিয়ে তারা তাদের খায়েশ মেটায়! তাদের আগমন দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার উপর বিপদ চলে আসছে। তারা আমাকে বলল, আপনি চলে যাচ্ছেন ভালো কথা, যাওয়ার আগে শিবির যারা করে তাদের নামগুলো দিয়ে যান। আমি চিন্তা করলাম আমার কারণে যেন কারো উপর বিপদ না আসে। তাই আমি জানলেও কারো নাম বলতে চাইছিলাম না। তখন কোন ভাবেই আমাকে দিয়ে নাম না লেখাতে পেরে জোর করে আমাকে তাদের রুমে (৫০৬, আবু বকর রাঃ হল) নিয়ে গেল।

এরপর রাত ১২ টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত একটানা আমার উপর চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। এমন কোন নির্যাতন নাই যেটা আমার উপর করা হয়নি। চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, ব্যাট-স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো, বিদ্যুতের তার দিয়ে পেটানো, দুই হাত দিয়ে গলা টিপে ধরা, গামছা পেচিয়ে শ্বাসরোধ করা, এছাড়া বিভিন্ন ধরনের বহুজাতিক অত্যাচার চলতে লাগল।

একজন আমার আঙ্গুল কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কিন্তু অন্যজন তাকে এই বলে থামাল যে, ঐটা করিস না, প্রমাণ থেকে যাবে। যে রুমে নিয়ে আমাকে পেটানো হচ্ছিল, সেটার অবস্থান ছিল পাঁচতলায়, মারতে মারতে কয়েকজন আমাকে পাঁচতলা থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য নিয়ে গেল। অন্য কয়েকজন এসে তাদের বাধা দেওয়ায় ওরা দমে গেল। যারা আমাকে ফেলে দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, তারা বলল, আমি যদি পড়ে গিয়ে মারা যাই, তবে তা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবে।

যাই হোক, অবশেষে আমাকে ভোর চারটার পরে রুমে পাঠিয়ে দিলো। আমার মোবাইলের ডাটা অন করে ওরা মোবাইলটা রেখে দিল। ফজরের নামাজ পড়ে অন্য একটি মোবাইলের সাহায্যে আব্বুকে (নাম্বার মুখস্ত থাকায়) ফোন দিলাম। এছাড়া আমার তিনজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলাম। এর মধ্যে একজনের ছোটভাই ছিল ওদের দলের লিডার।

আমার আব্বু-আম্মু, বড় ভাই (যিনি আইআইইউসি ঢাকা ক্যাম্পাস থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করছে ২০১২ সালে) এবং ছোট ভাই আমার নাম্বারে ফোন দিতে থাকে। সকাল ৯ টার দিকে আবার আমাকে তাদের রুমে (টর্চার সেল) আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। মোবাইলে অনেকগুলো মিসকল দেখে আমাকে প্রশ্ন করলো, এতগুলো মিসকল কেন? তোরর বাড়ির লোকে কেমনে জানল? এই বলে আমার ব্যাগ এবং জিনিসপত্র চেক করতে থাকে।

এক পর্যায়ে আমার মেমোরি কার্ড, পেন-ড্রাইভ, সিম সহ আরো অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস তারা নিয়ে নেয়।

যারা যারা আমাকে ফোন দিল তাদেরকে লাউড স্পিকার দিয়ে ফোন দেওয়ার জন্য বলল।

প্রথমে আব্বুকে ফোন দিলাম।আব্বু ওদেরকে খুব অনুরোধ করল আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা খুব খারাপ ব্যবহার করল আব্বুর সাথে। আর বললো, তুই জারজ সন্তান জন্ম দিয়েছিস (অর্থাৎ আমি জারজ সন্তান)।

এরপর আম্মুকে ফোন দিলাম। আমার মা ছোট্ট শিশুর মত কান্না করতে করতে তাদের কাছে মিনতি করে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইল! কিন্তু আমার মায়ের কান্নায় ওই হিংস্র পশুগুলোর হৃদয় একটুও গলে নাই।
ওরা আমার মায়ের ফোনটা কেটে দিলো। এরপর বড় ভাইকে ফোন দিলাম। তাকেও শিবির বলে অকাট্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। যে ভাষা একমাত্র পিতৃপরিচয়হীন নষ্ট সন্তানরাই বলতে পারে।

আলহামদুলিল্লাহ! আমি একজন কোরআনের হাফেজ। শরীয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ পড়তেই আই আই ইউ সি’তে আসা। আমি সব হজম করছিলাম। তারা বড় ভাইয়ের সাথে কথা শেষ হওয়ার পরপরই একজন আমার বুকে এমন ভাবে লাথি মারলো আমি খাটে বসা ছিলাম, সেখান থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যাই। এরপর পালাক্রমে ১৪-১৫ জন আমার শরীরের উপর দাঁড়িয়ে লাথি মারতে থাকে। যে ব্যথা আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। সেখান থেকে দ্বিতীয় দফায় আবার অমানুষিক নির্যাতন শুরু হলো আমার উপর।

এখানে একটা কথা বলে রাখি, রাতে আমাকে যারা পিটিয়ে ছিল তারা ছিল হলের ছাত্র। এবার দিনের বেলায় দায়িত্বটা যারা পালন করছে তারা ছিল বহিরাগত!

মোবাইলে ফেভারেট লিস্টে আমার পরিবারের নাম্বার সহ কয়েকটি বন্ধুদের নাম্বার ছিল তাদেরকেও একে একে ফোন দিতে বলল।

দুঃখের বিষয় হল, আমি মার খেয়েছি এটা নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই কিন্তু যে বিষয়টা আজও মনে পড়লে নিজেকে অপরাধী মনে হয় সেটা হল, ওই নরপশুদের নীল নকশায় আমার প্রিয় বন্ধু আটকে যায়। আমার কল লিস্ট থেকে নাম্বার নিয়ে, আমার মাধ্যমে ফোন করিয়ে আনিয়ে, তাকেও ওরা শিবির বলে প্রচন্ড টর্চার করে আমার সামনেই।

এভাবে দুপুর দুইটা পর্যন্ত আমার উপর অকথ্য নির্যাতন চলতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের একজন আমার পেটের নাভি বরাবর এমন জোরে লাথি মারছে যে আমি সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে যাই। আমার অবস্থা তখন বেগতিক দেখে আমাকে নিয়ে দ্রুত হল থেকে চলে যাওয়ার জন্য আমার বন্ধুকে নির্দেশ দিয়ে তারা সেখান থেকে সটকে পড়ে।

আমার মুখে, মাথায় পানির ঝাপটা দিলে পরে কিছুটা সুস্থ হই তখন আমার ঐ বন্ধু এবং ডাইনিং এর স্টাফদের সাহায্যে তখনই আমি ক্যাম্পাস ত্যাগ করি।

কষ্টের জায়গা হল –

  • ঐদিন আমার রুমমেট এবং ফ্লোরের অনেকেই টর্চারিংয়ের বিষয়টা জানতো,
  • কয়েকজন বন্ধুকেও জানিয়েছিলাম,
  • একদিন অথবা দুইদিন পর হলের প্রভোস্ট স্যার জেনেছিলেন। কিন্তু তারা কেউই এ ব্যাপারে কোন কিছুই করেননি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর আমাকে বাড়িতে চলে যেতে সহযোগিতা করেন।

আমি দুনিয়ার কারো কাছে বিচার দেই নি আর কখনো দেবও না। বিচার দিয়েছি একমাত্র আমার রবের কাছে, যিনি বিচার দিনের মালিক।

#stop_BCL_torture

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button