জীবনের বাঁকে বাঁকে

একটু আলোর খোঁজে

একটি মানুষ কি ভাবে বড় হয় আমরা কি তা জানি? এই বড় হওয়া তাকে কোন দিকে টেনে নেয় তা কি আমরা কি তা বুঝি? তা কি একটু আলোর খোঁজে! নাকি অথৈ আধারে ডুবে! ২০১৯ সালে দাড়িয়ে এই প্রশ্ন করা বোকামি কারন কে কি ভাবে কি নিয়ে বড় হচ্ছে তা আমাদের কাছে আজ অনেকটাই দৃশ্যমান। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সময় আর আসেনি যখন একজন মানুষ ঘরে বসেই জেনে যায় তার আশপাশের মানুষ গুলো কি করে বেড়াচ্ছে। তার সাথে কথা বলতে চান তাহলে ফোনের কয়েকটি বাটন প্রেস করুন, তাকে দেখতে চান তাহলে প্রফাইলে ঢুকে পরুন। তার পছন্দ, অপছন্দ, আনন্দ, ঘুরে বেড়ানো, ফিরে আসা, চিন্তা চেতনা, মনের বাসনা পর্যন্ত আপনি ঘরে বসেই জেনে যান। টেকনোলজি আসলে আমাদের আজ এমন একটা অবস্থানেই দাড় করিয়েছে।

গহীন কোন গ্রামের লোকালয়ে যেখানে শিশুকিশোররা পায়ে হেটে স্কুল বা মক্তবে যায়, মরীচে পরা যে চাল গুলোর ফুটো বেয়ে আসা বৃষ্টি পানি ঝরায়, কিংবা ভোরের আলো ফুটলে যে বৃদ্ধ জমিতে মই লাগায়, চারা গাছে পানি ছিটায়, দূর থেকে ভেসে আসা আজানের শব্দে দিগন্তজোরা মাঠে গামছা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায় তাদের চোখে দূরবীন লাগিয়ে আমাদের জগতে কি ঘটছে তার স্বাদ নিতে দিলে হয়তোবা তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে যেন এ কোন জগতরে বাবা বের কর আমায় জলদি করে।

মাঝে মাঝে একই জগতে বাস করেও আমরা উপরের উধাহরনের মত একজন আরেকজন থেকে ভিন্ন জগতের হয়ে যাই বুঝতেই পারিনা প্রতিদিন দেখা হওয়া এই মানুষ গুলো, নিয়মিত শব্দ বিনিময় করা এই প্রান গুলো কত কাছে থেকেও ভিন্ন একটি জগতে, যেন আমাদের জগতে তার আর তাদের জগতে আমরা বড়ই বেমানান। যখন তীব্র বাসনা, ইচ্ছে পুরন খেলা, কিছু পাওয়ার প্রতিযোগিতা আমাদের ভুল কোন লক্ষ্যে দাড় করিয়ে দেয় তখন সে লক্ষ্যে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত না হলে বা জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর প্রতি ফিরে না তাকালে আমরা বুঝতেই পারিনা জীবন আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর কেনই বা নিয়ে যাচ্ছে, কেন এত কাছে থেকেও কারও জগত এত দূরে আবার দুরত্ব অনেক হলেও কারও জগতের আমরা কেন এত কাছে। আসলে কারন একটাই, জীবনের মুল লক্ষ আমরা ফেলে এসেছি দূরে। তাইতো বুঝতে পারিনা আমাদের লক্ষ্য, স্বপ্ন আসলে কোথায় আর তাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি কোথায়। তেমন কিছু ঘটনাই আজ বলতে চাই, বলতে চাই আমাদের জীবনের মুল লক্ষ্যের দেয়ালের এক পাশে রঙ এমন আর আরেক পাশে সে কেমন।

উধাহরন টানার আগে একটি প্রশ্ন করি। আমাদের জীবনে মুল স্বপ্ন আসলে কি? জীবনের কোন লক্ষ্যকে আমরা সফলতার উচ্চ শেখর মনে করি? চাকরীর চেয়ার? ব্যাবসার মুনাফা? একটু একটু করে জমানো সম্পদ দিয়ে গড়ে তোলা নীড়? যেখানে বাকি জীবনটা শুখে শান্তিতে পার করে দেয়া যায়? এমনিতো হওয়ার কথা আমাদের স্বপ্ন গুলো তাই নয়কি? আমাদের অধিকাংশই হয়তো এক কথায় বলবে হু আমাদের স্বপ্ন গুলো এমনি। এই স্বপ্ন পুরনে আমরা প্রাই সকলেই যথেষ্ট উদার। এমনকি এই স্বপ্ন পুরনে যদি নিয়মিত আড্ডা থেকে দশ পার্সেনট সময় কমিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে হয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং থেকে পাঁচ পার্সেনট সময় কমিয়ে যদি বাড়ির কাজে সাহায্য করতে হয় অথবা গান শোনা বা সিনেমা দেখা একটু কমিয়ে দিতেও হয় দিতে হয় তবুও আমরা স্বপ্ন পুরন রাস্তায় পারি জমাই যেন এতো কোন শর্তই না, এর চেয়ে কষ্ট হলেও সপ্ন পুরন আমার চাই ই চাই। এমন একজন মানুষকে যদি আপনি জীবনের আরও একটি উদ্দেশ্যর কথা স্মরণ করিয়ে দিন যে উদ্দেশ্য জীবনের সেই স্বপ্নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, যার বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষকে বার বার মনে করিয়ে দেয়া হয় তখন এই মানুষগুলোই নিয়মিত আড্ডা থেকে দশ পার্সেনট কেন দু পার্সেনটও ছাড় দিতে রাজি নয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং বা ফেসবুকিং যাই বলিনা কেন সেখানে জীবনের মুল উদ্দেশ্যে নিয়ে নিয়মিত কিছু বলার আঁচ পর্যন্ত নেই। আর যদি বলা হয় আড্ডা, গান শোনা বা সিনেমা দেখা একটু কমিয়ে একটু সময় বের জীবনের অন্তিম লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে তখন দেখাযায় কত নিখুঁত এবং অসাধারনভাবে সে মানুষটি আপনাকে এড়িয়ে যায় যেন এড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তটি সেরা কোন অভিনয়কেও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এই যুগান্তকারী অভিনয়কেও ছাপিয়ে যায় যখন দেখাযায় সে বলছে হুম খুব শীঘ্রই শুরু করব, একটু গুছিয়ে ফ্রী হয়ে নামাজটা ধরব, কুরআনটা বুঝব বা হু আমি পরিতো মাঝে মাঝে একটু আকটু মিস যায় আর কি। এক সময় কুরআন এত খতম দিয়েছি পড়াটা আবার ঠিক করতে হবে ইত্যাদি। তাদের কাছে ইসলাম মানে সর্বচ্চ এইই যে সময় হলে একদিন নামাজী হব, সামনে কোন একদিন হয়তো কুরআন পড়ব, আর যদি তাদের কেউ নিয়মিত পাঁচবার নামাজ পড়ার মত ভাগ্যবান হয়েও যায় তাহলে তাকে রীতিমত ধার্মিক লোক হিসেবে গন্য করা হতে থাকে। মনে হয় যেন বাহ! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী? সাধারন কোন ব্যাপার?

হা এটা স্বীকার করতে হবে যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার, অবশ্যই আজকাল পাঁচবার নামাযে যাওয়া চোখে পরার মত ঘটনা। আশপাশ যখন ইংরেজিতে যাকে বলে ফ্রাইডে মুসলিম অথবা বেশী হলে প্রতিদিন কয়েক ওয়াক্ত সেখানে আমি পাঁচ ওয়াক্ত! এটাকি কোন সাধারন ঘটনা? নিজেকে তাই মনে হয় ধার্মিক এক মুসলিম। নামাজতো পরছিই, মাঝে মাঝে তেলোয়াতও করছি, আর বেশী দরকার কি,ওসবতো আলেমদের কাজ। আমি সাধারন এক মানুষ কুরআন হাদিসের আমি কি বুঝি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে ঠিকইতো এর বেশী দরকার কি। একজন সাধারন মানুষের আর বেশী যেনে দরকার কি। কিন্তু সমস্যা তখন যখন আপনি দেখবেন এই অজুহাত পুরো সমাজকেই পেয়ে বসেছে। যে মানুষটিকে আমরা সাধারন বলে পার পেয়ে যেতে চাই তাকেই দেখবেন লাভলোকসানের ক্ষেত্রে সে যথেষ্ট বিচক্ষন। বাজারে গেলে সে যথেষ্ট চেষ্টা করে যেন ঠকে না আসে, কর্মস্থলে সে বসকে খুশি রাখার চেষ্টা করে যেন রাতারাতি প্রমোশন মেলে, ব্যাবসায় মুনাফা পেতে জোঁকের মত লেগে থাকে। টিভি পর্দার সামনে সে রীতি মত বিশেষজ্ঞ। অভিনয়ের কোন জায়গাটা প্রশংশা পাওয়ার দাবীদার, কোন খেলোয়াড়ের দক্ষতা দৃষ্টি কেড়ে নেয়, কোন সেলেব্রিটি সুপার হিট এমনকি কোন দেশের টেকনোলজি বেশী উন্নত এসবের খবরও সে রাখে। কিন্তু রাজ্যের যত সংশয় আর অলসতা এসে ভর করে যখন বলা হয় ভাই এই ব্যাস্ত জীবনের ভীরে আপনি কি পারেন না নিয়মিত ২০-৩০ মিনিট সময় বের করতে ইসলামকে জানতে? তখন আপনি দেখবেন পরিস্কার মেঘমুক্ত আকাশে যেমন একটু একটু করে অন্ধকার ছেয়ে যায় তেমনি করে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এত অভাবনীয় যুক্তি, কারন বা অজুহাত যাই বলি সে প্রকাশ করতে থাকে। সাধারনত সর্বশেষ বাক্যটি থাকে এমন; ইনশা আল্লাহ, হু দোয়া করবেন, শয়তান ধরেছে ইত্যাদি। কিছুতেই তার মুখ দিয়ে বের হতে চাইবেনা যে হা ভাই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বেশী সময় নষ্ট করেছি ইসলামকে না যেনে। না মেনে, জানিনা আল্লাহর সামনে কি নিয়ে দাঁড়াবো, ইনশা আল্লাহ আজ থেকেই শুরু করছি, অল্প হলেও নিয়মিত একটা সময় আমি বের করবই। সে কিছুতেই চাইবেনা প্রতিদিনের স্বাদআহ্লাদের, আনন্দের, রোজগারের, পার্থিব ফায়দা লাভ হয় এমন জায়গা থেকে মাত্র কিছুটা সময় আল্লাহর মনোনীত ধর্মকে দিতে। ইসলাম কতটুকো জানতে বলেছে, বুঝতে বলেছে তা হারিয়ে যাক ক্ষতি কি, নামাজী হতে পেরেছি এটাই বড় কথা। এ ধরনের মুহূর্ত গুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় সুরা আল-আ’রাফের ১৭ নম্বর আয়াতটি যেখানে শয়তান আল্লাহকে বলছেঃ

“(শয়তান বলল) আমি মানুষের কাছে আসবো ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না”

শয়তান আমাদের ভালই ধোঁকায় ফেলতে পেরেছে। আমাদের অজুহাত আমাদের বোঝাতে পেরেছে ইসলাম মানে শুধু নামাজী হলেই যথেষ্ট, সঙ্গে একটু তেলয়াত আর কি চাই। আমরা জানতে চাইনা কোন নামাজীর উপর আল্লাহ ধিক্কার দিয়েছেন, কোন ধরনের ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবেনা। কেনইবা জানতে চাইব, জানতে গেলে, পড়তে গেলে যে সেই কাঙ্খিত আনন্দের জায়গাগুলো থেকে একটুখানি ছাড় দিতে হবে। এর ফলাফল দাঁড়ায় এমন এক ইসলাম যা আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেনি, কখনও শির্ক মিশ্রিত, কখনও কুফুরি বা বিদআত মিশ্রিত। কখনও এমন হয় জীবনের কোন এক প্রান্তে এসে যদি ভাগ্য ভাল হয় তবে হয়তো কারও কারও ক্ষেত্রে জানা সম্ভব হয় শির্ক, বিদআত, কুফুরি আসলে কি আর সে এতদিন যেনে এসেছে কি।

এ ভাবে আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে থাকে অনেক কাল আগে মুহাম্মাদ (সাঃ) নামে এক নবীর কাছে এই বিশ্বজগতের পালনকর্তা কুরআন নামক একটি কিতাব পাঠিয়েছিলেন যে অনুযায়ী আমাদের জীবন ব্যাবস্থা সাজানোর কথা ছিল। হাদিস নামে পৃথিবীর বুকে হেটে বেড়ানো সর্বজুগের শ্রেষ্ঠ মানুষটির (সাঃ) বানি জানার কথা ছিল। তার জীবনী পড়ার কথা ছিল, বোঝার কথাছিল কি আমরা পেয়েও হারিয়েছি, কি আমরা জেনেও এড়িয়েছি আর কি আমরা অবজ্ঞাভরে ফেলে রেখেছি। আর এই চরম অবজ্ঞাভরে ফেলে রাখা না জানাদের দলে ভীর করে শত সহস্র মানুষ যার ফলে জন্ম নেয় ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারনা যে ভুল ভাঙ্গিয়ে দেয়াতো দুরের কথা বরং আমাদের নিজেদের অনেকেই সেই ভুলের শ্রতে ভেসে যায়। শ্রতে ভেসে যাওয়া সেই শুন্যস্থান আল্লাহ ঠিকই পুরন করে নেয়, পৃথিবীর কত শত শহরে অমুসলিম মুসলিম হয় কুরআনের ভালবাসায়, এর সত্যিকারের শিক্ষায়। যেন একদিকে শুকনো পাতা ঝরে যায় আরেকদিকে সূর্যপানে উকি দিয়ে নতুন চারাগাছের জন্ম হয়। মনে পরে যায় ১১০ নম্বর সুরা নাসরের প্রথম দুই আয়াতের কথা যেখানে আল্লাহ আগেই বলে রেখেছিলেনঃ

“যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন,”

এমন গজিয়ে উঠা নতুন যে প্রানগুলোতে আল্লাহ ইসলামের ভালবাসা প্রবেশ করিয়ে দেয়, যেমন প্রবেশ করিয়ে দিয়েছলেন মক্কার মুশ্রিকদের মধ্যে তেমনি আজও বিভিন্ন ধর্ম থেকে উঠে আসা যে মানুষগুলো জীবনে কুরআনকে জড়িয়ে নেয় তাদের ইসলামের প্রতি ভালবাসা দেখে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়, যেন মুসলিম ঘরে জন্মেও আমি যা করতে পারিনি, চাইনি তাই কিনা করে দেখাচ্ছে দূর দেশের কোন যুবক, অচেনা কোন মানব, খোলামেলা সমাজের কোন মানবী। যে দেশে ধর্মকে থোরাই পাত্তা দেয়া হয় সে দেশে সে যুবকগুলো কুরআন হাদিসের জ্ঞানে দিন কাটায়, যে দেশে নারীরা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় হুমড়ি খায় সেই দেশেই ফিরে আসা মানবীগুলো আল্লাহকে খুশি করতে নিজেকে হিজাবে জড়ায়। এ ভাবে বিশ্বজুড়ে শত, সহস্র হৃদয় ইসলামের পানে পা বাড়ায়। অচেনা যুবক এসব যেনে অবাক হয়। সেও ইসলামকে ভালবাসতে চায়, জানতে চায়। সে বলে বন্ধুকে চলনা একটু জানি, চল না একটু মানি। না যেনে, না মেনে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মত ছড়িয়েছে মিডিয়ার মিথ্যে অপবাদ, পার্থিব লোভে পরে, সম্পদমুখী দৌড়ে, আনন্দ বিনোদনের টানে ইসলামকে না জানতে আমাদেরও আছে কতশত অজুহাত। নাহয় একটু জানি, একটু সময় করি। অচেনা যুবক আশাবাদী হয়। কাছের মানুষদের প্রতি পা বাড়ায়…

কোন এক দুপুরে অচেনা যুবক এক বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সঙ্গে নেয় ভাল একটি কুরআনের আরবী সহ অনুবাদ। বন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে তাকে নতুন করে ইসলাম নিয়ে জানতে আমন্ত্রণ জানায়। বন্ধুটি তার বিলেত ফেরত, ঘরে সাজানো ওয়াইড স্ক্রিনের টিভি, ল্যাপটপ কম্পিউটার আর দামী ব্র্যান্ডের ফোন তার হাতে সোভা পায়। কোন এক ব্যাঙ্কে সম্মানিত পোস্টে তার চাকরী যেখানে খুব ভদ্র স্টাইলে, সামাজিকতা বজায় রেখে সুদের কারবার হয়। তাতে কি আসে যায় আজকাল এসবই যেন সম্মান, ছেড়ে দেয়া মানে মূর্খতা, সেকেলে, জুগের সাথে বেমানান। অবসর কাটে তার বক্স অফিস হিট করা সিনেমায়, ইন্টারনেটে ঘুরে ফেরায়, দামী রেস্তরার স্বাদ নেয়ায়, পয়সা ওয়ালাদের সাথে আড্ডায়। এর সাথে কুরআন কতটা খাপ খায়? বন্ধু তাকে আশ্বাস দেয়, দিন যায় মাস যায়, অচেনা যুবক আবার যায় অন্তত কোন এক ছুটির দিনে অন্তত আধবেলা এ নিয়ে আলোচনা, জানার প্রস্তাব দেয়। বন্ধু তাকে আশ্বাস দেয়। তার পর পার হয় কয়েক বছর তার পর আরও কতদিন কেই বা জানে আধ বেলা কেন এক ঘণ্টাও সময় ইসলামের জন্য বরাদ্ধ নয়। কেন যেন বন্ধুটি তার দুরত্ব তৈরি করে। এসবে তার আগ্রহের কোন চিহ্ন মাত্র নেই। দেখা হলে শুধু খোঁজ নেয়া। এ ভাবেই দিন যেতে থাকে যায়। যেন ইসলাম মানে সুদের কারবার ছেড়ে দেয়া নয়, ইসলাম মানে হলিউডের অশ্লীল দৃশ্য বাদ দেয়া নয়, ইসলাম মানে সেলেব্রিটিদের জীবন যাত্রা ভুলে থাকা নয়, এসব একটু কমিয়ে কিছুটা সময় ইসলামকে জানতেও নয়, ইসলাম মানে মাঝে মাঝে বড়জোর মসজিদে যাওয়া, রমাজান এলে একটু ভাল হয়ে যাওয়া। আরও একটু বয়স বারুক না এত তারা কিসে। অচেনা যুবক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, সবকিছু ছেড়ে দিতেতো কেউ বলেনি, যে কাজ গুলো আল্লাহ বাধ্যতামূলক করেছে সেগুলো সম্পর্কে জানা, মানার চেষ্টা করা। সে পাপ গুলো সম্পর্কে জানা যেগুলো জীবনের সকল ইবাদত নষ্ট করে দেয়, তওবার রাস্তা বন্ধ করে দেয়, অমুসলিম হিসেবে মৃত্যু দেয়। অন্তত এটুকো জানতেও মানুষের এত কষ্ট, এত দ্বিধা? অথচ মানুষ কত নির্দ্বিধায় অজান্তেই সেগুলো করেই যাচ্ছে আর ভাবছে সে হয়তো এসব পাপ করছেই না। অচেনা যুবক অবাক হয়। যে মানুষটির আল্লাহর ব্যাপারে জানতে এত অনীহা সে মানুষটি কি ভেবে বসে আছে যে সে এসব পাপকে ভাল করে যেনে ফেলেছে? জানতে হলেওতো তার ভাল কোন স্কলারের লেখা বা লেকচার খেয়াল করতে হবে। আর কি করেই জানবে যদি চেষ্টার সাথে মন থেকে আল্লাহর কাছে সাহায্যর আবেদন না করে? অচেনা যুবক ভাবে কত কাছে থেকেও কিছু মানুষ কত দূরে, আল্লাহর ব্যাপারে না জানার অনীহা মানুষকে কাছে থেকেও ভিন্ন এক জগতে বাসিন্দা করে ফেলেছে। একেই কি হেদায়েত পাওয়া বলে? চেষ্টা করেও তাদের ফিরিয়ে আনা যায়না যদিনা আল্লাহ আনে। কুরআনের ভাষায়ঃ

“আপনি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারেন, যারা উপদেশ অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখে ভয় করে। অতএব আপনি তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দিন ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের।” [ সুরা ইয়াসিন, আয়াতঃ ১১]

কোন এক দিনে, কখনও বা রাতে অচেনা যুবক হাটে, গাড়িতে চরে, থমকে দাঁড়ায় কোন এক লোকালয়ে, বাজারের ধারে, নদীর পার ঘেসে কিংবা ব্যাস্ত শপিং মলে। যুবক, যুবতির খিলখিল হাসির শব্দ আসে, উঠতি যুবক রাজপথে সহপাঠী নিয়ে দাঁড়ায়, চুলের সাঁজ, পোশাকের ভাঁজ, আলোচনার বিষয় ভেসে আসে। অচেনা যুবক কষ্ট পায়। কাকে বোঝাবে সে? অথচ আল্লাহ দেখছে, এক এক করে পাপ গুলো জমছে, ভ্রুক্ষেপ নেই। সিগারেটের ধোঁয়া চায়ের টঙে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে। স্কুলগামী ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুনের কানে হেডফোন যেন সঙ্গীত তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। যুবতীদের পোশাক স্বচ্ছ হয়েছে অনেক আগেই, আজকাল পাল্লা দিয়েছে ছোট হওয়ায়। চলচিত্র জগত মনে হয় তাদের ভালই নাড়া দিয়েছে, বোঝাতে পেরেছে এই হল পোশাক, এই হল স্ট্যাটাস, এমন তোমাকে হতে হবেই। এক দিকে হু হু করে বন্যার পানির মত ভেসে আসা স্যাটেলাইট চ্যানেলের বেশভূষা অন্যদিকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানকে শুন্যের কোঠায় নিয়ে আসা বুঝতেই দেয়না আল্লাহ নারীদের কত উচ্চে সম্মান দিয়েছে। তারা কখনও বুঝেনা এমন সাঁজসজ্জা পুরুষেরা কি ভাবে গ্রহন করে। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী প্রসাধনী বিক্রি হয়, শপিংমল গুলো দুহাতে টাকা কামায়। এটা আধুনিক যুগ নিজ বিবেগ থাকতে নেই, যা দেখানো হবে তাই বিবেগ, যা বলা হবে তাই আবেগ। এর মধ্যে ইসলাম জানতে শুরু করা! শিখতে শুরু করা! যেন শখের বিষয় ধ্বংস হয়ে যাওয়া যেমন করে মহা সাগরে জাহাজডুবি হয়, একটু একটু করে পানি উঠে, তলিয়ে যায় অথৈ জলে। না এসব পরে ভাবা যাবে, আজ রাতেইতো জনপ্রিয় সিরিয়াল যার জন্য সপ্তাহ ভরে অপেক্ষা, খুব দ্রুতই প্রকাশ পাচ্ছে প্রিয় অভিনেতার নতুন সিনেমা, গান গুলো আগেই বাজিমাত করেছে, নানা অনুষ্ঠানে আজকাল সে সুরও ভেসে আসে, ইন্টারনেট কত শত ঘণ্টা নিয়ে নেয় হিসেব কে রাখে। জীবন যাচ্ছেতো যাচ্ছেই, চাকা ঘুরছেতো ঘুরছেই, ইসলাম মানে নামাজী হওয়া, এর বেশী তেমন নয়। কুরআনে বাকি আয়াত গুলো আসলে কি শিখিয়েছে? আপাতত সে খবর না হলেও যেন চলে। শয়তান তার ইবাদত এভাবেই করিয়ে চলে আর অদৃশ্যে হাসে, যেন তৃপ্তির ঢেকুর তার হৃদয়ে। ওয়াদাতো সে করেই এসেছে, আল্লাহর সাথে। এই উম্মতকে নষ্ট সে করবেই। আর আল্লাহও একদিন শয়তানের ফাঁদে পা দেয়া মানুষগুলোকে বলবেঃ

“হে বনী-আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং আমার এবাদত কর। এটাই সরল পথ। শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বুঝনি? এই সে জাহান্নাম, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হতো। ” [সূরা ইয়াসিন, আয়াতঃ ৬০-৬৩]

অচেনা যুবক কম্পিত হয়। কেমন হবে সে দিনটি, মুহূর্তটি যখন একজন জানবে একটু পরেই সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে? তারপরেও ভ্রূক্ষেপ নেই, মানুষ হয়েও যন্ত্র মানব সে কি করে হয়। কি করে বিবেকের পতন হয়, আত্মার মরন হয়। বাজারের ভেতরে দোকান গুলোতে টিভি চলছেই, গানের শব্দে তাল মিলছেই। সেখানে অশ্লীলতা থাকলেই কি আসে আর না থাকলেই কি কি যায়। তালতো মেলাতেই হয়। জল কিংবা স্থল ঘেঁষে লোকালয়, ব্যাবসা, বিক্রি, অফিস, আদালত, ফেরিওয়ালা, ঝালমুড়ি, চটপটি, আইস্ক্রিম যে যার ব্যাস্ততায়, তবুও আযানের শব্দ পৌছায়, তবুও কুরআন থাকে অপেক্ষায়। কাজের ফাঁকে মাত্র ২০ মিনিট কিংবা ১০ মিনিট নিয়মিত কখনই নয়, সময় থাকলেও নয়, সময় না থাকলে অবসর পাবার চেষ্টাও নয়। মাঝে মধ্যে নামাজ পরে নেব ক্ষতি কি, কুরআন না বুঝলেই যায় আসে কি। যেমন আল্লাহ বলেছেন সূরা তাকাসুরের ১ ও ২ আয়াতেঃ

বেশি-বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা তোমারদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও।

আর নবী (সাঃ) বলেছেনঃ কা’ব ইবনে মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ধন-সম্পদ ও আভিজাত্যের প্রতি মানুষের লোভ তার দ্বীনের যতটা ক্ষতি করতে পারে, একটি ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দেয়া দু’টো ক্ষুধার্ত নেকড়েও ততটা ক্ষতি করতে পারেনা। (তিরমিযি ২৩৭৬)

অচেনা যুবকের মনে পরে যায় সংস্কৃতিকমনা কিছু বন্ধুর কথা। একজন ক্যামেরা নিয়ে ব্যাস্ত, একজন সাহিত্য গল্প নিয়ে ব্যাস্ত। কেউ জ্ঞান-গভীর লেখায় ডুবে, কেউ আবার কাজের ফাঁকে সৃষ্টিশীলতায় ডুবে। তাদের কারও কাছে সেই লেখাই জীবনের ব্রত। কেউ কেউ এতটাই উদ্বেলিত যে জীবন ব্যাবস্থা ঐ সাহিত্যের মত হওয়া উচিৎ, দেশের অবস্থা ঐ লেখকের চিন্তার মত হওয়া উচিৎ। তাদের একজনকে অচেনা যুবক আমন্ত্রণ করেছিল যেন সে ইসলামকে যানে, ইসলাম বিদ্বেষীদের বই পরে মাথার ১২টা যার অনেক আগেই বেজেছে। ভুল গুলো দেখিয়ে দেবার পরেও সে মানতে পারেনি, কি করে পারবে পছন্দের লেখক বলে কথা। অচেনা যুবক অবাক না হয়ে পারে? কি অদ্ভুত এক পৃথিবী এত শিক্ষা, এত সংস্কৃতিকমনা হয়ে লাভ কি হল তাতে যদিনা সঠিক জিনিসটা মানার মত মানসিকতা না থাকে। মনে পরে আবারো মানুষ কতটাই না নিজ পছন্দে আসক্ত। মানলে যে কুরআনের কিছুটা কাছে আসতে হবে, এখনও সময় হয়নি যে, বয়সতো পরেই রয়েছে। পরে না হয় যেনে নেব একটু একটু করে। এত গল্প, এত সাহিত্য, এত ব্যাক্তিত্ব, সুনামের হাতছানি। এসব থেকে সময় বের করতে হবে? তাও আবার কুরআন জানতে, হাদিস বুঝতে? না না এখন নয় বাবা, পরে এক সাথে সময় বের করে… কতটা অবহেলা মানুষ দেখায় কুরআনের তরে, যে তাকে সৃষ্টি করেছে তার পথের দিকে।

অচেনা যুবকের মনে পরে ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে জনপ্রিয় হওয়ার কত চেষ্টাই না মানুষ করে, রঙঢঙ মিশ্রিত ছবি, গভীর জ্ঞানের লেখা, হাসিঠাট্টা, তামাশা সবি চলে। ভাল মানুষ সাজার এখানে উপায় হল মাঝে মাঝে ইসলামিক কিছু পোস্ট শেয়ার করা। পরক্ষনেই আবার রোমান্টিক কোন গান পোস্ট, কখনও প্রেম নিবেদনের দৃশ্য শ্যেয়ার ইত্যাদি। এভাবে মুসলিম হিসেবে নিজেকে শান্তনা দেবার কি সুন্দর উপায় মানুষ বের করে। যে আয়াত একজন শেয়ার করছে দেখাযায় একটু পরেই সে আয়াত বিরোধীই কোন দৃশ্য শেয়ার করে বসে আছে, যে বানী সে মানুষকে দিতে চাইছে একটু পরে সে নিজেই ভঙ্গ করছে। এ জগত সম্পর্কে অচেনা যুবকের বেজায় কৌতূহল, সে চেষ্টা করে দেখা যাক না যদি কয়েকজন ফিরে। পরিচিত কয়েকজনকে সে বলে, আশ্বাস পায়। দিন গিয়ে মাস, বছর গড়িয়ে যায়। হাঁসি, ঠাট্টা, তামাশার মাঝে তেমনি তাদের শান্তনা পাবার ইসলামিক পোস্টও ঘোরে, অচেনা যুবক অবাক হয়, বিনোদন, হাঁসি ঠাট্টা, তামাশার মাঝে কিছু ইসলামিক পোস্ট ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষ জান্নাত কিণে ফেলবে? আর যারা তাও দেয়না তাদের অনেকেই আচার, আচরণে, কথা বার্তায় যেন ভিনদেশী হয়ে উঠেছে, শুধু গায়ের রঙ দেশীয় বলে, যদি ঘষেমেজে উঠাবার ব্যাবস্থা থাকত, তাহলে কি তাও উঠিয়ে দিত? কে জানে, পশ্চিমাদের মত হতে, গল্পের চরিত্রের মতে থাকতে, আচরণে ভিন্নতা আনতে মানুষ কত কিছুই যে আজ করে। শুধু ইসলাম নিয়ে জানতে বললেই তারা ইদুরের গর্তে ঢোকে, সাপের ফণা তোলে বা হাই তুলে, জেগেও ঘুমিয়ে পরে। এভাবেই আমাদের থেকে ইসলাম এক অতল অন্ধকারে হারিয়েছে, অথচ আল্লাহ সূরা ফাত্বিরের ৫-৬ আয়াতে জানিয়ে রেখেছেঃ

“হে মানুষ, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং, পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারণা না করে। এবং সেই প্রবঞ্চক যেন কিছুতেই তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে। শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়।”

অচেনা যুবকের সাথে দেখা হয় আরও কত মানুষের, কুরআনে হাফেজ কিন্তু সঠিক আকিদা সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই, মসজিদ কমিটির লোক বাচ্চার শব্দে বিরক্ত হয়ে বাবা সহ সন্তানকে মসজিদ থেকে বের করে দিতে চায়, এলাকার সম্মানিত নামাজী অথচ সন্তান ফজরে ঘুমিয়ে থাকে যেন এত তাড়া কোথায়। দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবীতে এক ভাই অথচ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেরই খবর নাই। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান গুলো আজকাল সাউনড সিস্টেমে রমরমা, রাতভর তরুন তরুনীর কথোপকথনেরও সমাপ্তি হয়না, বাবা মায়েরা ভোর হলেই বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলের দৌড়ে, পারলে এখনি সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে ফেলে। পড়াশোনার চাপ কম হলে কিংবা সামনে পরীক্ষার প্রস্তুতি না হলে কেউ কেউ আরবী শিক্ষক রাখে, তাদের কাছে ইসলাম মানে একদিকে কুরআন পড়তে পারা, কিছু সুরা, দোয়া মুখস্ত করা, পার্টটাইম নামাজী হওয়া অন্যদিকে দুপরে বা রাতে এক সঙ্গে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসা, জন্মদিনে ধুমধাম করে পার্টির আয়োজন করা। সন্তানকে নাচ, গান, অভিনয় বা কিছু একটাতে পটু বানিয়ে তৃপ্তি পাওয়া। অচেনা যুবকের মনে পরে অনলাইনে পাওয়া এক ভাইএর কথা, কত সুন্দর করেই না সে ইসলাম শিক্ষা দেয় ছোট্ট দুই মেয়েকে, তারাই এখন তাকে ডেকে তোলে এখন ফজর নামাজে। অচেনা যুবকের বলতে ইচ্ছে করে যে বাবা মা সে শিক্ষা দেয়না তার সন্তানের কি হবে। মনে পড়ে “মুক্ত বাতাসের খোঁজে” বইটির কথা। যেখানে লেখক একটি আতকে উঠার মত পরিসংখ্যাণ দিয়ে বলেছেঃ

“২০১২ সালে কয়েকটি স্কুলের অষ্টম শ্রেনির ছাত্রছাত্রীদের উপর চালানো যমুনা টিভির জরিপ অনুযায়ী শতকরা ৭৬ জন শিক্ষার্থীর নিজের ফোন আছে। বাকিরা বাবা-মার ফোন ব্যাবহার করে। ৮২% সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্ণ দেখে, ক্লাসে বসে পর্ণ দেখে ৬২%। বেসরকারি এক হিসেবে দেখা গেছে ফটোকপি আর মোবাইল ফোনে গান/রিংটোন “লোড” করে দেয়ার দোকান গুলো থেকে দেশে দৈনিক ২.৫ কোটি টাকার পর্ণ বিক্রি হয়। এগুলো আজ থেকে প্রায় ছ-বছর আগের তথ্য, যখন অ্যান্ডরয়েড ফোন এবং মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটা ব্যাপক ছিলনা। বর্তমানে অবস্থা কি হতে পারে, কল্পনা করুন।”

“আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন যে, কিয়ামতের কিছু নিদর্শন হলঃ ইলম লোপ পাবে, অজ্ঞাতার বিস্তৃতি ঘটবে, মদপান ব্যাপক হবে এবং ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে।” [ সহিহ বুখারী :: খন্ড ১ :: অধ্যায় ৩ :: হাদিস ৭৭]

নবী (সাঃ) এ হাদিস আমাদের জানিয়ে দিল ব্যাভিচার ছড়িয়ে যাবে,আজকে নগ্নতা, অশ্লীলতা বা ব্যভিচারের দৃশ্য মানুষ পয়সা দিয়ে দেখে, কতটা দুঃখজনক স্কুলের বাচ্চারাও, বলা হয়েছে ইল্ম লোপ পাবে অর্থাৎ ইসলামিক জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে, আজকে ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করে জ্ঞান অর্জন করা আধুনিক মানুষের কাছে প্রায় দুর্লভ হয়ে গেছে। মদ্যপান ব্যাপাক হবে। মদ্যপান কতটা ব্যাপক হয়েছে তার ব্যাখ্যার আর প্রয়জন কি আছে?

কত টুকো ভাবে বাবা মারা এ নিয়ে, অথবা আদৌ কি তারা সে খবর রাখে? পরীক্ষায় ফল ভাল তো সন্তান আমার ভাল, ফলাফল খারাপ তো সন্তান আমার খারাপ, মনে হয় যেন তারা এ নীতিতে গেঁথে গেছে। মানুষ হিসেবে সন্তান কি হবে তা কি আদৌ তাদের ভাবনায় আসে? তারা কি জানে ইসলাম কত সুন্দর করে মানুষ হওয়ার কথা বলে? কতটা ভাবে আমাদের তরুনরা এ নিয়ে, ফিরে কি আসবেনা তারা এত কিছুরও পরে?

অচেনা যুবক ভাবে, সমাজের কি অবস্থা। একি মানব হয়েও যন্ত্র মানবের মত হওয়া? অচেনা যুবক বিলেত ফেরত বন্ধুর কথা ভাবে। তার সন্তানও কি তার ছোঁয়া পাবে? শিশুরাতো প্রথম শিক্ষা নিজ ঘর থেকেই নেবে? সংস্কৃতিমনা বন্ধুর কথা ভাবে, সেও কি সন্তানকে নাট্যশালার পথ দেখাবে? ভুরি ভুরি সাহিত্য কবিতায় ডোবাবে? এক ভাইকে সিগারেট ছাড়ার বার্তা দেয় উত্তরে সে না ছাড়ার সুন্দর যুক্তি দেয়। হজ থেকে আসা মাঝ বয়সি কয়েকজন, তারা ইসলাম জানতে চাইবে কি, মসজিদেই কি ঠিক মত যায়? কিছু যুবক গেমসে আসক্ত, যুবতি প্রনয়ে ডুবন্ত, উৎসব, মেলায় উপচে পড়া ভীর, রেস্তরাগুলো এত সরগম কখনও হয়নি। পার্কে, ভ্রমণে, আনন্দ বিনোদনে মানুষের ব্যাস্ততার শেষ নেই। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য পয়সা কামানো, জীবনের উদ্দেশ্য যেন সম্পদ জমানো। লক্ষ্য টাকা খরচ করে মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়, ইসলামকে জানতে ২শ টাকাও খরচ করতে নেই, সিনেমার জন্য ঘণ্টার পর নষ্ট হয় কিন্তু ইসলামিক ভিডিও দেখার ইচ্ছে কই। কোন মা হিজাব করে রাস্তায় বের হয় সঙ্গে যুবতি মেয়ের টাইট ফিটিং পোশাকে আকর্ষণের কমতি নেই। যেন মা হওয়ার আগে হিজাব পরতেই নেই। কোন বাবা সন্তানের পেছনে টাকা ঢালে, খোঁজ নেই মুসলিম হিসেবে ছেলের পরিবর্তন হওয়া হয়তো যাচ্ছে জলে। অচেনা যুবক ভাবে পঙ্গপালের মত ছুটেছি আমরা খবর নেই কোথায় কেন এসব কাকে দেখাতে।

অচেনা যুবক তাদের কথাও ভাবে যারা ফিরে আসে, আমাদের চেয়েও বহুগুন ছন্নছারা সেই সমাজ থেকে। কি করে পি.এইচ.ডি করছে ছেলে গুলো বিদেশে রাস্তায় নেমে যায়, প্রকৌশলী পড়া হৃদয় গুলো কলম তুলে নেয়, ডাক্তার, শিক্ষক, কলামিস্ট পেশার একটা অংশই বেছে নেয়, মুসলিম হওয়া খ্রিস্টান মেয়ে গুলো, ইসলামে ফিরে আসা অন্য ধর্মের ছেলে গুলো কত কষ্টই না করে যায়। উদ্দেশ্য একটাই প্রকৃত ইসলাম যেন প্রকাশ পায়। ব্রাজিলের মত রাস্তায়, আফ্রিকার মত দুর্গত এলাকায়, জাপানের মত ব্যাস্ত এলাকায়, ইউরোপ, আমেরিকায় কোন না কোন জায়গায় অমুসলিমকে মুসলিম করে না হয় মুসলিমের হৃদয় বদলে দিয়ে আল্লাহ ইসলামকে পূর্ণ রাখছেই। আর আমরা? সিনেমার অশালীন দৃশ্য আমাদের লজ্জিত করেনা, পয়সা কামানোই ধ্যানজ্ঞান হয় মনের বাসনা, আড্ডায় সময় অপচয়ে কিছুই যায় আসেনা। জগতের সকল লজ্জা আমাদের নামাজী হতে, সকল সাধনা কুরআন এড়িয়ে যেতে আর অন্যকে কুরআনের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা? ইসলাম নিয়ে একটু পড়াশোনা, মেনে চলা? এ যেন মহা সমুদ্রে শিকলে বেঁধে নিক্ষিপ্ত হওয়া। তাই আল্লাহ যাদের চান তার জন্য তারাই যথেষ্ট। যেই লজ্জা, অনীহা, অলসতা আমাদের পেয়ে বসেছে সেই লজ্জা, অনীহা, অলসতা একটা কিছুতো ফেরত দেবেই তবে এখন নয় যখন দাড় করানো হবে মহা বিশ্বের পালনকর্তা আল্লাহর সামনে। সূরা আস সাজদার ১২ নং আয়াতের ভাষায়ঃ

তুমি যদি দেখতে পেতে, যখন অপরাধীরা মাথা নত করে বলবে, “ও আমাদের প্রভু, আমরা দেখলাম এবং শুনলাম। আমাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিন। এবার আমরা ভালো কাজ করবো। আমরা এবার নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছি। ”

আফসোস তাদের আর কখনও ফিরে আসার সে সুযোগ দেয়া হবেনা।

অচেনা যুবক ভাবে, ঠিক আছে মানলাম, অনেক কাল ধরে অনেক এসেছি সরে, সঠিক ইসলাম না হয় হারিয়েছে অনেক দূরে। কিন্তু বলতে কি পারিনা আমরা আল্লাহকে? বলতে পারিনা আল্লাহ তুমি আমাকে সঠিক পথ দেখাও? একটু না হয় অপেক্ষা, একটু না হয় ধৈর্য ধরা, না হলে কিসের মুসলিম হওয়া। তারপর যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য মনে হবে আফসোস হায়! যদি সবাই জানত জেমনি আল্লাহ আমাকে জানিয়েছে, হায় যদি বুঝত তারা যেমন আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছে বুঝতে। তখন দুনিয়ার সকল সিনেমা, ফ্যাশন, পার্থিব জনপ্রিয়তা, লোক দেখানো মিথ্যের পেছনে ছোটা কিছুই পারবেনা ভুলিয়ে দিতে, দাঁড়াতে হবেতো আমায় সেই মহান মালিকের সামনে যিনি তৈরি করেছে আমাকে, মাকে, বাবাকে। আমার ভাইকে, বোনটিকে, বন্ধুকে। মনে পরে সুরা আলে-ইমরানের ৮ আয়াতের কথাঃ

“হে আমাদের প্রতিপালক! সৎ পথ প্রদর্শনের পরে তুমি আমাদের অন্তরগুলোকে বক্র করে দিও না, আমাদেরকে তোমার নিকট হতে রহমত প্রদান কর, মুলতঃ তুমিই মহান দাতা।”

মনে পরে ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান আয়িরার কথা। iera.org এ গেলে পাওয়া যাবে বিস্তারিত। এক ঝাক তরুনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল তাদের খুদ্র প্রচেষ্টার ফসল। খ্রিস্টান বিশ্বাস থেকে উঠে আসা হামজা জরজিস ছিল বয়সে এক তরুন। মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। এরই মধ্যে হয়ে উঠেছে সে অসংখ্য মুসলিমের মধ্যমনি। চিন্তা করুন একজন সাবেক খ্রিস্টান এখন ইসলামের জন্য কতই না নিবেদিত। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কত জায়গায়ই না তিনি ভ্রমন করেন মানুষকে ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনতে, ভুল ভাঙ্গাতে। সম্প্রতি তার লেখা বই The Divine Reality যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন যারা বিভিন্ন দর্শন, বিজ্ঞান বা যে কোন তথাকথিত জিবন ব্যাবস্থাই গ্রহন করুকনা কেন সেখানে যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। একমাত্র ইসলামই হচ্ছে একটি পরিপূরণ জীবন ব্যাবস্থা। এই হামজা জরজিসের লেখা পড়েই অচেনা যুবক প্রথম জানতে পেরেছিল বিজ্ঞান নিজেই কি ভাবে ত্রুটিপূর্ণ। আর iera মাধ্যমেই কতশত মানুষকে আল্লাহ ইসলামে ফিরিয়ে এনেছে সেই গল্প না হয় আরেকদিন।

মনে পরে Georgetown University এর প্রফেসর ড. জনাথন ব্রাউনের কথা। ইসলামকে গ্রহন করার পর শক্ত হাতে কলম ধরেছেন। দেখতে মনে হয় একজন আধুনিক পোশাকে পশ্চিমা বিশ্বের কেউ হবে অথচ তাকে দিয়ে আল্লাহ লিখিয়েছেন কত বই, কত আর্টিকেল, দিয়েছেন কত লেকচার এবং তা চালিয়ে যাচ্ছেন। কে বলবে এই আমেরিকান ইসলামকে এত ভালবাসে?

মনে পরে আমেরিকান আব্দুল্লা হাকিম কুইকের কথা। ইসলাম গ্রহন করেছিলেন কানাডাতে সেই ১৯৭০ সালে। তার পর আর বসে থাকেনি। ইসলামকে জানতে এর জ্ঞান বাড়াতে রীতিমত মদিনায় পারি জমিয়েছিলেন। পিএইচডি করা এই মানুষটি আমেরিকার নামকরা ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আল মাগরিবের ইতিহাস বিভাগের প্রধান। অচেনা যুবক প্রথমবার যখন আব্দুল হাকিম কুইকের ইসলামিক ইতিহাসের উপর লেকচার শুনেছিল, হতবাক হয়েছিল। এই লোক এত কিছু জানে। ইসলাম বিশ্বের জন্য এত কিছু করেছে? এত এত অবদান? অথচ বইপত্রে তার ছিটেফোঁটাতো নেইই বরং কি ভাবে কিছু মিডিয়া ইসলামকে ভুল বুঝিয়ে মানুষকে দূরে সরাতে চায় তাই যেন হাতের কাছে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

স্মৃতিপটে ভেসে আসে ইংল্যান্ডের ইসলামিক স্কলার টিম হাম্বেলের কথা। ছোট বেলায় দুষ্টমির মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন এমনকি বাবা মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ধূমপান করতেন। ইসলামের ভুল বের করার চেষ্টা করে মুসলিমদের সাথে আলোচনায় নেমেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ যাকে পথ দেখায় তার হৃদয়ে সততা ফিরে আসতেই পারে। এখন সেই টিম হাম্বেল শুধু একজন মুসলিমই নন বরং মদিনায় পড়াশোনা করে এখন রীতিমত একজন আলেম।

অচেনা যুবক ভাবে কত জনের গল্প করবে সে? শুধু নাম করাদের গল্প করলেইতো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পার হয়ে যাবে। অবশ্য তাতে কার কি যায় আসে। নিজ ক্যারিয়ারের পেছণে ছোটাতো আমাদের পেয়ে বসেছে। যদিও আল্লাহর তাতে কিছুই যায় আসেনা তিনিতো কথা দিয়েছেনই যদি কেউ আল্লাহর ধর্ম থেকে ফিরে যায় তাহলে তিনি এমনদের দিয়ে পূর্ণ করে নেবেন যারা ফিরে যাওয়াদের চেয়ে আরও বেশী উৎকৃষ্ট মনের হবে। তাই অচেনা যুবক দেখে যারা অন্যধর্ম থেকে ইসলামে এসেছে তারা ইসলাম সম্পর্কে কতটা উদার মনের, কতটা ভালবাসে একে। আমরা তার কতটুকোই জানতে চেয়েছি। তাইতো মিডিয়ার উপর আমাদের হুমড়ি খেয়ে পরা, ডিজিটাল ডিভাইসের আসক্তিতে জর্জরিত হয়ে যাওয়া, আধুনিকতার নামে অবাধ মেলামেশায় উন্মুখ হয়ে থাকা যেন এটা এমনই এক যুগ। তাই ইসলাম কি জিনিস তা যেন না জানলেও চলে, ভদ্রতা দেখাতে কিছুটা মানলেও চলে সেটা সত্যিই ইসলাম কিনা তা যাচাই করার এত কি আছে। আমরাতো আর হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডা। হ্যানিম্যান নই যে একেবারে পূর্বের জীবন ব্যাবস্থা বদলে ইসলাম কবুল করে ফেলব, আমরাতো মারগারেট মারকাস নই যিনি ইহুদী হয়েও ইসলাম গ্রহন করেছিলেন, নাম বদল করে মরিয়ম জামিলা রেখেছিলেন, লিখিছেন ক্ষুরধার এমন লেখা যা ইসলাম সম্পর্কে মিথ্যে অভিযোগের জবাব দেয়।

আমরা ব্রিটিশ লেখক মারটিং লিংসের মতওনা। এই দার্শনিক, লেখক তাই পেরেছিলেন ইসলাম গ্রহন করতে, শুধু তাই নয়, লিখেছেন নবী (সাঃ) এর জীবনও। যেখানে আমরা নবী (সাঃ) এর দশটি হাদিসও ঠিক ভাবে পড়ে দেখিনি। আর পশ্চিমা বিশ্বের মত দূরে কেন আমাদের এখানেইতো খ্রিস্টান ধর্ম থেকে উঠে আসা দুবোন সিহিন্তা শরীফা ও নায়লাহ আমাতুল্লাহ রীতি মত তাদের জীবন বদলে যাবার কাহিনী নিয়ে বইই লিখেছেন, বইয়ের নাম দিয়েছেন ফেরা। কত অসাধারন দুটি কাহিনী। অনলাইনে বুক রিভিউ লিখতে গিয়ে একজন লেখিকা সিহিন্তার কথা দিয়েই শেষ করেছেন এভাবেঃ

“মুসলিম নামধারী মানুষদেরও কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে। আল্লাহ মানুষকে যা কিছু দিয়েছেন তা একদিক থেকে দেখলে আশির্বাদ অন্যদিক থেকে দেখলে পরীক্ষা। আমি অনেক খুজে ফিরে ইসলাম পেয়েছি। যারা মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহন করে সহজেই ইসলাম পেয়েছেন, তারপরও ইসলাম সম্পর্কে জানেন না, জানার চেষ্টা করেন না, ইসলাম মানেন না-তারা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কী জবাব দেবেন?”

ইয়াসমিন মজাহিদ নামে আরেক বোন আমেরিকার এক প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক লেকচারার হিসেবে কাজ করছে। তার লেখা বই রিক্লেইম ইউর হার্টের দারুন ভাবে মানুষের আল্লাহর পানে ফিরিয়ে আনতে আকর্ষণ করে । ইংল্যান্ডে আইরা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছে আরেক বোন ফাতিমা বরকতউল্লাহ যার লেখা মাঝে মাঝে ব্রিটিশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অচেনা যুবকের মনে পরে এই ফাতিমা বরকতুল্লাহরই Does Islam Need Feminism নামে একটি লেকচার শুনে বুঝতে পেরেছিল এ যুগ যে ভাবে নারীদের প্রকাশ করতে চায় তার সুত্রপাত কোথা থেকে শুরু হয়েছে। মনে পরে অচেনা যুবকের এক সময়ের কথা যখন ভাবত ইশ এদেশে এমন দেখা নেই কেন! এ দেশেতো ইসলাম নিয়ে কত অজ্ঞতা। এমনই সময়ে সে অনলাইনে পেয়ে যায় quranerkotha.com এর মত ওয়েব সাইট। ওমর আল জাবির যার প্রতিষ্ঠাতা। রয়েছে কুরআনেরআলো ডট কম এর মত সাইট, যেখানে অনেক সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে ইসলামিক জ্ঞান। আরেক দিকে জানা হয় তরুন লেখক আরিফ আজাদের কথা যিনি অবিশ্বাসীদের মনে ইসলাম সম্পর্কে যে ভুল ধারনা রয়েছে তার চমকপ্রদ সব জবাব নিয়ে হাজির হন, সম্প্রতি বই মেলায় তার বই প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ বেস্ট সেলিং লিস্টে ছিল। বলে রাখা ভাল তিনি তার প্যারাডক্সিক্যাল সাজিজ ২ বই এ বিজ্ঞানী নিউটন সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ

স্যার আইজ্যাক নিউটনকে আমরা বিজ্ঞানী হিশেবেই চিনি তার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডগুলোর জন্য। কিন্তু বিজ্ঞানী পরিচয়ের বাইরেও তার বিশাল একটি পরিচয় আছে। সেটি হল তিনি ছিলেন একজন ধর্মীয় পণ্ডিত। সারাজীবন তিনি বিজ্ঞান নিয়ে যত কাজ করেছেন, ধর্ম নিয়ে কাজ করেছেন তার তিন গুন। বিজ্ঞানের জন্য সারা জীবনে তিনি যত শব্দ লিখেছেন, ধর্মের জন্য লিখেছেন তার পাঁচ গুন; কিন্তু কোন এক আশ্চর্য কারনে নিউটনের ধার্মিকতা আর ধর্ম নিয়ে তার গবেষণার ব্যাপারটি আমাদের কাছে গোপন রাখা হয়। “

নিউটনের ধর্মের ব্যাপারে যা তিনি তুলে ধরেছেন তার প্রায় সবই যেন ইসলাম ধর্মের সাথে মিলে যায়। অপরদিকে ওমর আল জাবিরের কুরআনের কথা ডট কম সাইটে গেলে মনে হয় আল্লাহ কত প্রজ্ঞা তাকে দান করেছেন। আর এদের সকলেরই রয়েছে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা। কিন্তু ইসলামকে ফুটিয়ে তোলার বেলায় তারা কতটা উদার, অমায়িক। কে জানে আরও কত ভাই, কত বোনে ভালবাসতে শুরু করেছে, কলম ধরেছে, কষ্ট করছে, কথায়, কাজে নিরবে নিভৃতে, শুধু ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে।

আর আমাদের শিক্ষা? কে কাকে কার ক্যারিয়াএর সাক্সেস স্টোরি শোনাবে, কার পার্থিব অর্জন কত উপরে সেই গল্পে অস্থির। একটি বার কেন যেন আমাদের ভাবার সময় হয়না যে আমরা মরবই, তখন কে আমাদের বাঁচাবে, কে আমাদের সাহায্য করবে। আসলেই কি আছে আমাদের কপালে। অবশ্য এগুলো ভাবনায় আসতে অন্তত একটি সময়ের যেমন দরকার তেমনি সেসব মানুষদের সঙ্গও দরকার। আপনার আমার পাশে যদি ক্রিকেট লিগ, ইউরোপিয়ান ফুটবল বা বলিউড, হলিউডের আনাগোনা চলতে থাকে, আর আমাদের চলাফেরা করা সঙ্গীরাও যদি দিনের পর দিন সেই গল্পই করে যেতে থাকে তখন কার মনে থাকে ইহাকাল আর কার মনে থাকে পরকাল। সমস্যা নেই পার পেয়ে যাব যেন এই হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস। কতটা অযৌক্তিক। আসলে কিছু মানুষ থাকবেই যারা খেলার ছলে কথা শোনে আসলে যা ছিল মগ্ন হয়ে শোনার, আবার মগ্ন হয়েও শোনে যা আসলেই ছিল পরিত্যাগ করার । আল্লাহতো সুরা আম্বিয়ার ১-২ আয়াতে জানিয়েই দিয়েছেনঃ

“মানুষের হিসাব-কিতাবের সময় নিকটবর্তী; অথচ তারা বেখবর হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের কাছে তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে যখনই কোন নতুন উপদেশ আসে, তারা তা খেলার ছলে শ্রবণ করে।”

অচেনা যুবক ভাবে যে শিক্ষা আজকাল আমরা গ্রহন করছি, যে ক্যারিয়াএর পেছনে আমরা ছুটছি তার মাঝে কেন আমাদের ইসলামের জন্য সময় নেই। প্রসঙ্গক্রমে মনে পরে সেই ৮৫৯ সালে, যিনি পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল তিনি ছিল একজন মুসলিম নারী, যার নাম ফাতিমা আল ফিহ্রি। লেখা পড়া করে জ্ঞান অর্জন করা মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক সে পুরুষ বা নারী যেই হোক। সেই কথাই হয়তো উৎসাহিত করেছিল ফাতিমা আল ফিহ্রিকে। যেহেতু তার বাবা ছিল একজন সফল ব্যবসায়ী তাই তিনি আর তান বোন প্রচুর সম্পদের মালিকানা পান। যা দিয়ে নির্মাণ করেন ঐতিহাসিক আল কারাভাইন বিশ্ববিদ্যালয়। এটি এখনকার দিনে মরক্কোর ফেজ শহর। এখনকার দিনে লন্ডন, নিউইয়র্ক যেমন বিখ্যাত ফেজ ছিল তেমন। এই বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম, অমুসলিম সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এখানে বলে রাখা ভাল মাত্র বিগত শতকের সুরুর দিকেও ইউরোপীয় নারীরা উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, ভোট দেয়া, এমনকি চাকরি করা যখন তারও হাজার বছর পূর্বেই মুসলিম নারীদের শিক্ষা ব্যবস্থা উচ্চ শিখোরে পৌঁছে গিয়েছিল।

অচেনা যুবকের বলতে ইচ্ছে করে পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানীর কথা। কারন বিজ্ঞান হল এমন এক জিনিস যাকে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট উপায়ে প্রমান করতে হয় আর ইবনে আল হাইথামই হলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি বিজ্ঞানকে প্রমান করার নীতি প্রনয়ন করেন যা আজ বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীরা অনুসরন করে। আলো কি ভাবে কাজ করে, প্রথম ক্যামেরা, আরও বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এমনকি নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তির যে নীতি তা ইবনে হাইথাম তার ৬০০ বছর আগেই টের পেয়েছিলেন। এমনকি ইবনে হাইথামও তার আবিষ্কার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন

“I decided to discover what is that brings us closer to God, what pleases Him most, and what makes us submissive to His ineluctable will.”

“আমি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম কি আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি নিয়ে আসে, কি তাকে সব চেয়ে বেশি খুশি করে এবং কি আমাদের তার অপরিবর্তনীয় ইচ্ছার প্রতি অনুগত করে।”

অচেনা যুবকের মনে পরে বিজ্ঞানী ইবনে ফিরনাসের কথা। চাঁদের বুকের একটি বিশালাকার জ্বালানী মুখের নামও তার নামানুসারে করা হয়েছে। সেই ৮৫২ সালে তিনি প্রথম আকাশযান আবিস্কার করেন। যদিও সেটি এত আধুনিক ছিলনা কিন্তু সেটি ছিল যাত্রার সুচনা। মনে পরে দক্ষিন ইথিওপিয়ার কাফা নামক স্থানে বসবাস করা খালিদের কথা যিনি প্রথম কফি আবিস্কার করেন। ১৫ শতকের শেষের দিকে এটি মক্কা ও তুর্কিতে পৌঁছে আর সেখান থেকে ১৬৪৫ এ ভেনিসে।

বলতে ইচ্ছে করে ৮০০ শতকের দিকে Jabir ibn Hayyan এর কথা যিনি রসায়নের জনক। কত শত আবিস্কারই এই রসয়ানের উপর ভিত্তি করে।

চিকিৎসাবিদ al-Zahrawi সেই ১০ম শতাব্দীতেই সার্জারির ২০০ রকমের প্রায় এমন সব সব যন্ত্র আবিষ্কার করেন যে আজ অবধি আধুনিক সার্জারিয়ানরা তা ব্যবহার করেন। আর রক্ত চলাচলের জন্য William Harvey বহুল পরিচিত, কিন্তু William Harvey এর আরও ৩০০ বছর আগেই Ibn Nafis রক্ত চলাচল আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। Ibn Nafis এর নাম তবুও খুব কম শোনা যায়।

ভ্যাকসিন আবিস্কারের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেয়া হয় Jenner এবং Pasteur এর মত ইউরোপিয়ানদের অথচ প্রথম ভ্যাকসিন মুসলিম বিজ্ঞানীরাই তৈরি করে এবং তা Jenner এবং Pasteur এর ও প্রায় বহু আগেই। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বে ভ্যাকসিন আবিস্কারেরও ৫০ বছর আগে তুর্কিতে শিশুদের ভ্যাকসিন দেয়া হত। ১৭২৪ সালে তুর্কির ইস্তাম্বুলে অবস্থান কালে ইংলিশ রাষ্ট্রদুতের স্ত্রী এই ভ্যাকসিন ইউরোপে নিয়ে আসেন।

পুরো বীজগণিত এবং ত্রিকোণমিতির প্রায় অধিকাংশই মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান। বীজগণিত কিংবা Algebra এর জনক al-Khwarizmi এর লিখে যাওয়া বই Al-Jabr wa-al-Muqabilah এর অনেক বীজগণিত আমরা আজও ব্যবহার করি। ইটালিয়ান গণিতবিদ Fibonacci এর নাম বিশ্বজোড়া কিন্তু মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিস্কারের ৩০০ বছর পর Fibonacci গনিতের কাজ ইউরোপে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য যে বর্তমান বিশ্বে বিপ্লপ ঘটিয়ে দেয়া কম্পিউটার প্রযুক্তির আবিষ্কারই হয়েছিল গনিতের উপর ভিত্তি করে, যেমন Algorithm। এটাও ছিল মুসলিম বিজ্ঞানীদেরই আবিষ্কার।

মনে পরে ১৬০০ শতকের দিকে বিজ্ঞানী গ্যালেলিও বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবী গোল। সম্ভবত পৃথিবীতে এমন কোনো বিজ্ঞানের ছাত্র নেই যে গ্যালেলিওকে চেনেনা আর বই পত্রে তো আছেই। কিন্তু গ্যালেলিওর পাঁচশো বছর আগেই একজন নয় বরং অনেক ইসলামিক বিজ্ঞানীরা বের করে ফেলেছিলেন যে পৃথিবী গোল। কোনো রকম আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই সেই জুগে Ibn Hazm এর মত বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ব্যাস বের করেছিলেন এবং তা ছিল আধুনিক নিখুঁত হিসেবের চেয়ে মাত্র ২০০ কিলোমিটার কম। উল্লেখ্য যে ১১৩৯ সালে al-Idrisi পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র আকেন। অর্থাৎ মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাত ধরেই আজকের আধুনিক পৃথিবীর মানচিত্রের সূত্রপাত ঘটেছিল।

মনে পরে আমেরিকা আবিস্কারের কথা, কলম্বাসের কথা?অথচ কলম্বাস তার ঐতিহাসিক যাত্রা শুরুর কালে যে ভূগোল বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন এবং যে মানচিত্রের উপর নির্ভর করে সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন তা ছিল ১২শ শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম Scholar Al-Idrisi এর তৈরি। অথচ বই পত্রে কলম্বাসের নাম দুনিয়া জোড়া কিন্ত আল ইদ্রিসির নাম নেই বললেই চলে।

মধ্য জুগে ইউরোপে ফুলের বাগানের প্রচলন ছিলনা কিন্তু আরবরা ভাবতে শিখেছিল বাগান সৌন্দর্যের প্রতিক এবং Meditation এরও জায়গা। সেখান থেকেই ইউরোপে ফুলের বাগানের প্রচলন ঘটে। প্রথম রাজকীয় ভাবে ফুলের বাগানের উদ্ভদন হয় স্পেইনে মুসলিম শাসনের আমলে সেই ১১ শতকে।

যখন স্পেইনের কর্ডভায় ইসলাম প্রবেশ করেছিল তখন বাকি ইউরোপ অজ্ঞতার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ইতিহাসবিদ Victor Robinson সে সময়কার স্পেইন এবং ইউরোপের মধ্যে তুলনা খুব সুন্দর ভাবেই করেছেনঃ

“ইউরোপ ছিল অস্ত যাওয়া সূর্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন, কর্ডভার মানুষের জীবন আলকিত প্রদীপের মত ছিল, ইউরোপ ছিল নোংরা, কর্ডভা হাজারো স্নানাগার তৈরি করেছিল, ইউরোপ পোকামাকড়ে পূর্ণ ছিল, কর্ডভা প্রত্যাহ তার পোশাক বদল করত, ইউরোপ কর্দমাক্ত ছিল, কর্ডভার রাস্তা তক্তকে ছিল, ইউরোপের ছাদ গুলোতে ধুয়ার কুঞ্চী ছিল, কর্ডভার ছিল সুসজ্জিত নকশা মণ্ডিত, ইউরোপ তার নামও স্বাক্ষর করতে জানেনি,কর্ডভার শিশুরা বিদ্যালয় মুখি ছিল, ইউরোপের যাজকেরা পবিত্র হওয়ার আধ্যাতিক নীতি পড়তেও জানতোনা, কর্ডভার শিক্ষকেরা আলেকজান্দ্রিয়ার আদলে পাঠাগার তৈরি করেছিল। “

কলোম্বিয়া ইউনিভারসিটির প্রফেসর George Saliba বলেন:

“Islamic civilization অথবা General history of science এর উপর এমন কোনো বই নেই বললেই চলে যেখানে ইসলামের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যর গুরুত্বের উপর পরিচয় ঘটানো হয়নি এবং সাধারন ভাবে এই ঐতিহ্যর ভুমিকা ছিল মানব সভ্যতার উন্নতি ঘটানো”

E. J. Holmyard তার বই Maker of Chemistry তে উল্লেখ করেন যে ইউরোপিয়ান রসায়নের প্রায় পুরোটাই মুসলিমদের উপর নির্ভর ছিল, আরবদের কাজের পরিস্কার ধারনা ছাড়া তৎকালীন Latin alchemy বুঝতে পারা প্রায় অসম্ভব ছিল। অন্যদিকে জনাব Gunther খুব ফলপ্রসূভাবেই স্বীকার করেছেন যে Oxford University তে সর্বপ্রথম প্রথম মহাকাশ বিজ্ঞানের উপর যে বিষয় পরানো হয়েছিল তার উৎস ছিল আরবদের কাছ থেকে নেয়া। কত প্রমান বলে যাবে অচেনা যুবক? অচেনা যুবক তাই এসব আবিস্কারের কথা শেষ করতে চায় ২০০১ সালের The corporation’s worldwide manager সম্মেলনে HP Computers এর CEO Ms Carleton Fiorina এর সাহসী ভাষণ দিয়ে যেখানে তিনি বলেছিলেনঃ

“একদা এক সভ্যতা ছিল, যা ছিল পৃথিবীর সব চেয়ে মহান। এটি মহাদেশীয় রাজ্য গঠন করতে পেরেছিল যা বিস্তৃতি হয়েছিল মহা সাগর থেকে মহা সাগরে এবং দক্ষিন আবহাওয়া অঞ্চল থেকে উর্বর ভুমি তথা মরুভূমি পর্যন্ত। এই অঞ্ছলের মাঝে বসবাস করতো নানান বিশ্বাসের এবং শত লক্ষ্য মানুষ। এদের একটি ভাষা বিশ্বের অধিকাংশ স্থানেই চিরন্তন একটি ভাষা হয়ে উঠেছিল, যা শত শত স্থানের সাথে সেতুবন্ধন গড়ে দিয়েছিল। এর সামরিক বাহিনি ছিল নানান জাতীয়তার, এবং এই সামরিক বাহিনি শান্তি এবং সাফল্যের দিকে এক ধাপ অগ্রগামী ছিল যা কখনই আমাদের জানা হয়নি। এই সভ্যতার বানিজ্য ল্যাটিন আমেরিকা থেকে চায়না পর্যন্ত বিরাজমান ছিল এবং এর মধ্যবর্তী সর্ব স্থানেও। এবং আবিস্কারের দিক থেকে এই সভ্যতাকে সবকিছুর চেয়ে বেশি পরিচালনা করা হয়েছিল। এর নির্মাতারা দালানের নকশা করেছিল যা মধ্যাকর্ষণকে রোধ করতো। এর গণিতবিদরা বিজগনিত ও এলগরিদমের জন্ম দিয়েছিল যা কম্পিউটারের মুল নকশা এবং এনক্রিপশনকে কার্যকর করেছিল। এর চিকিৎসকরা মানবদেহ পরীক্ষা করতো এবং নানান রোগের নতুন প্রতিষেধক খুঁজে পেত। এর আকাশ গবেষকরা আকাশপানে তাকাতো, তাঁরার নাম করন করতো এবং আবিস্কারের সন্ধানে মহাকাশে পাড়ি জমাবার পথকে সুগম করে দিয়েছিল। এর গল্পাকাররা হাজারো গল্পের জন্ম দিয়েছিল। উৎসাহের গল্প, ভালবাসার সম্পর্কের এবং অলৌকিকতার গল্প। এর কবিরা ভালবাসা নিয়ে লিখল যখন তাদের পূর্বে অন্যরা এমন বিষয় ভাবতেই আঁতকে উঠত। যখন অন্য জাতীরা নতুন কিছু ভাবার ব্যাপারে ভীত হত তখন এই জাতি তাদের দৃঢ় রাখত এবং সতেজ রাখতো। যখন আমাদের অতীত সভ্যতার জ্ঞান বিলুপ্তির মুখে পড়ল তখন এই জাতিই তাদের বাঁচিয়ে তুললো এবং অন্যদের নিকট তা পৌঁছে দিল। যখন আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ভাগাভাগিতে রত তখন আমি যা নিয়ে কথা বলছি তা হলো ৮০০ থেকে ১৬০০ সালের ইসলামিক জগত, যা যুক্ত করেছিল Ottoman Empire এবং courts of Baghdad, Damascus এবং Sulayman the Magnificent এর রোমাঞ্চিত শাসন ব্যবস্থা পর্যন্ত। যদিও এই জাতির প্রতি আমাদের ঋণ সম্পর্কে আমরা প্রায়ই অচেতন তথাপি এর দান আমাদের ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আরব গণিতবিদের অবদান ছাড়া Technology Industry জগতের অস্তিত্বই থাকতোনা।”

আর মুসলিম রাষ্ট্র ব্যাবস্থার প্রশংসায় বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ডেভিডসনের মতেঃ

প্রুসিয়ানরা যেমন পলসদের প্রতি, ইংলিশরা আইরিশদের প্রতি আর আমেরিকানরা নিগ্রদের প্রতি যতটা অত্যাচারী ছিল তার চেয়ে অনেক সহনশীল ছিল তুর্কিস অর্থাৎ অটোম্যান আম্পায়ার। এটা প্রমাণিত যে উনিশ শতকের কোন এক সময়ে নিজদের দেশ গ্রীস ত্যাগ করে মানুষ অটোম্যান আম্পায়ার রাজত্বে চলে আসত তাদের সহনশীলতার জন্য।

ভারতীয় জার্নালিস্ট, ইতিহাসবিদ Dr. Khuswant Singh তার A History of the Sikhs বইতে বলেনঃ

“Islam was spread in India not by the Muslim rulers but by the Muslim spiritual masters and missionaries” “ভারতে ইসলাম প্রচার কোন মুসলিম শাসকের দ্বারা হয়নি বরং তা হয়েছিল মুসলিম আধ্যাত্মিক আলেম ও ইসলাম প্রচারকারীদের দ্বারা।“

এমনকি বিখ্যাত ইস্রায়েলী জার্নালিস্ট Uri Avnery পর্যন্ত স্বীকার করেছেন স্পেইন শাসনামলে মুসলিমরা অমুসলিম বিশেষ করে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের প্রতি কতটা সহনশীল ছিল। তিনি বলেনঃ

ইহুদিদের জন্য মুসলিম স্পেইন ছিল স্বর্গের, সেখানে কখনও ইহুদী নিধন চলেনি। এসকল কাজ একেবারেই দুর্লভ ছিল। নবী (সাঃ) জানিয়েছিলেন যে ইহুদী এবং খ্রিস্টানরা হচ্ছে কিতাবধারী যাদের সাথে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যা ছিল তৎকালীন ইউরোপিয়ানদের চেয়ে বহুগুন স্বাধীনতাপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন: “The muslims never imposed their religion by force on Jews and Christians, as shown by the fact that almost all the Jews expelled from Catholic Spain settled in the Muslims countries and flourished there.” “মুসলিমরা কখনও ইহুদী ইংবা খ্রিস্টানদের উপর তাদের ধর্ম চাপিয়ে দেয়নি। বরং ক্যাথলিক স্পেইন থেকে বের করে দেয়া সকল ইহুদী মুসলিম দেশে এসে বসবাস করে সেখানে স্থায়ী ভাবে বেড়ে উঠে ছিল।“

হা হতে পারে অতীতে কোন মুসলিম দেশে বা কোন স্থানে কিছু মুসলিম অজ্ঞতাবশত বা কোন শাসক ক্ষমতার লোভে পরে কখনও কারও সাথে অন্যায় করেছে, অবিচার করেছে। সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে কি ইসলামকে বিচার করা যাবে? কতটা অযৌক্তিক হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারন ইসলাম অন্যায় ভাবে কারও ক্ষতি করবেতো দুরের কথা হিংসে করতেও নিষেধ করেছেঃ

হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, “তোমরা হিংসা হতে দূরে থেকো। কেননা হিংসা মানবের উত্তম গুণসমূহকে এমনিভাবে ধংস করে দেয়, যেমনিভাবে আগুন শুকনা কাঠ জ্বালিয়ে দেয়। অথবা তিনি (নবী করীম (স)) কাঠের বদলে শুকনো ঘাসের কথা বলেছিলেন।” [ রিয়াযুস স্বা-লিহীন :: বই ১৮ :: হাদিস ১৫৬৯ ]

তিনি (সাঃ) আরও বলেনঃ হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ ‘যে ব্যক্তি মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহও তাকে দয়া করেন না।’ রিয়াযুস স্বা-লিহীন :: বই ১ :: হাদিস ২২৭

এত সব কিছুর পরেও কিছু মানুষ থাকে যারা ইসলামকে হিংসে করে, অপপ্রচার করে আনন্দ লাভ করে এমনকি ইসলাম প্রচার হয়েছে তলোয়ারের জোরে এমন কথাও বলে, কিছু অসাধু মানুষ মিথ্যে ঝরা আচরণে, লেখায় তা ফুটিয়ে তোলে। অথচ আমরা মুসলিমরা তাদের ভদ্র ভাবে ভুল ভাঙ্গিয়ে দিবতো দুরের কথা এমনকি সঠিক ইসলাম কি, কি ভাবে পালন করতে হয় আমরা তাও আজকাল ঠিক ভাবে বলতে পারবনা। অথচ বিখ্যাত ইতিহাসবিদ De Lacy O’ Leary মনে করিয়ে দিয়েছেন যে পৃথিবীতে কিছু অসাধু মানুষ কি ভাবে বার বার মিথ্যে বলেছে ইসলামের নামে। তিনি বলেনঃ

“History makes it clear, however, that the legend of fanatical Muslims sweeping through the world and forcing Islam at the point of the sword upon conquered races is one of the most fantastically absurd myths that historians have ever repeated.”

“ইতিহাস এটা পরিস্কার করে যে উগ্রবাদী মুসলিম বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং তলোয়ারের অগ্রভাগের শাসনের প্রতিযোগিতার জোরে ইসলাম গ্রহনে বাধ্য করছে একটি অন্যতম অযৌক্তিক গল্প যা ইতিহাসবিদগণ পুনরাবৃত্তি করেছে।”
আর বিখ্যাত কবি জর্জ বারনাড শো, বিখ্যাত মাহাত্তা গান্ধী, ডি,জে, হগারট , লেও তলস্তয়, এমনকি ভারতীয় বিখ্যাত কবি সারজনি নাইদু, সহ কত কত বিখ্যাতরা রাসুল (সাঃ) এর গুনে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম সম্পর্কে গুণগান করেছেন তা লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর লেগে যাবে। এবং এদের কত কত জন মুসলিম হয়েছিলেন সেই খবর আমরা কয়জন রাখি। এদিকে যুগ বিখ্যাত নেপোলিয়নকেতো প্রায় সবাই চেনে, তিনি শুধু কুরআন আর নবী (সাঃ) জিবনী পড়েই ক্ষান্ত হননি, মুসলিমতো হয়েছিলেনই এমনকি স্বপ্ন দেখতেন সকল শিক্ষিত আর বিজ্ঞদের নিয়ে এমন একটি রাষ্ট্র গঠনের যা কিনা কুরআনের উপর নির্ভর করে চলবে, তিনি বিশ্বাস করতেন তাহলেই মানুষের জীবনে সুখ আসবে। তিনি বলেনঃ

“I hope the time is not far off when I shall be able to unite all the wise and educated men of all the countries and eastablish a uniform regime based on the principal of Quran which alone are true and which alone can lead men to happiness”

অন্যদিকে পশ্চিমারা ইসলাম সম্পর্কে যত অপবাদ ও মিথ্যে বলে তার সম্পর্কে ইতিহাস বিদ থমাস কারলাইল একটি সুন্দর কথা বলেছেন, তিনি স্বীকার করেন যে নবী (সাঃ) সম্পর্কে পশ্চিমারা যে মিথ্যে বলে তা আসলে তাদের জন্য লজ্জা বয়ে আনে। তিনি নবী (সাঃ) সম্পর্কে পশ্চিমাদের বরাত দিয়ে বলেনঃ

“The lies (western slander) which well-meaning zeal has heaped round this man (Muhammad) are disgraceful to ourselves only.”

আর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মাইকেল এইচ হার্ট তার গ্রন্থ The 100: A ranking of the most influential persons in history তে নবী (সাঃ) কে সর্বকালের সেরা ১০০ জনের তালিকার প্রথম স্থানে বসিয়েছেন।

আর এদিকে কতটা আফসোস আমরা মুসলিমরা সেই নবী (সাঃ) সম্পর্কে জানতে চাইনা, তার জীবনী পড়িনা, তার উপর আরপিত হওয়া কুরআন আর হাদিস শেখার জন্য ভাল একজন স্কলারের কাছেও জাইনা, এমনকি অন্যকে ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনতেও আমার লজ্জার পাহাড় যেন জেকে বসে। কি জবাব দেব আমরা আল্লাহকে? কই আমাদের মোবাইল ফোনতো ঠিকই চলে, বন্ধুদের আড্ডাও ঠিকই বসে, নিজের শখের জন্য কত চেষ্টাই না চলে কিন্তু মসজিদ, কুরআন, ইসলাম এগুলো নাম শুনলে আমাদের মাঝে ভালবাসার পরিবর্তে অলসতা জাগে, জড়িয়ে ধরার বদলে এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে। আফসোস কি জবাব দেব আমরা আল্লাহকে যখন তিনি বলেছেনঃ

” মনে করে দেখো, তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হয়, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হয়…, আমার শাস্তি বড়ই কঠিন। ” [সূরা ইব্রাহিমঃ আয়াত ৭]

আসলে যুগ যখন বদলায় আর সমাজ যখন ভুল জিনিস শিখে বড় হতে থাকে তখন সেই ভুলটাই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে বসে আর সঠিক জিনিসটা শ্রীহীন হয়ে পড়ে। আমরা আসলে অনুকরন প্রীতিতে এতটাই ডুবে গিয়েছি যে কি কখন কোন কালচার থেকে দেখার দরকার নেই, সবাই করছে করে যাও। পশ্চিমাদের কালচার আজ এতটাই প্রিয় আমাদের মাঝে, এ ব্যাপারে আমেরিকান লেখক, পলিটিক্যাল সাইন্টিস্ট, প্রফেসর নরমেন ফিঙ্কেলষ্টেইন একটি চমৎকার বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ “যখন ইউরোপিয়ানরা উত্তর আমেরিকায় এসেছিল তখন তারা আমেরিকান আদিবাসীদের সম্পর্কে বলত যে তারা অসভ্য কারন আশপাশে তারা নগ্ন থাকতো। ইউরোপিয়ান মহিলারা সে সময় তিন স্তর বিশিষ্ট পোশাক পরিধান করত। তারপর তারা আবার উত্তর আমেরিকায় আসল এবং সিদ্ধান্ত নিল যে আমেরিকান আদিবাসীরা হল গেঁয়ো কারন তারা আশপাশে নগ্ন হয়ে হাঁটত। আর এখন আমরাই নগ্ন হয়ে হাটি এবং বলিযে মুসলিমরা হচ্ছে গেঁয়ো কারন তারা অনেক কাপর পরিধান করে। আপনি কি এর চেয়ে বেশী অসভ্য কিছু কল্পনা করতে পারেন? মহিলাদের হেডস্কার্ফ ব্যান করার ব্যাপারে?”

অন্তত বুঝার বিবেগ যাদের আছে তারা সত্য ব্যাপারটা ধরতে পারে, হোক সে মুসলিম, অমুসলিম বা পশ্চিমা বিশ্বের কেউ। নারী অধিকারের কথাই ধরা যাক। আজকাল নারীবাদীরা নারী অধিকার নিয়ে দুনিয়া এক করে ফেলে। কেউ ভাবে ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম মনে হয় নারীদের স্বাধীনতা হরণ করে। আফসোস, ইসলামের সঠিক জিনিসটা প্রকাশ করার জন্য যদি শুধু মাত্র অমুসলিম বিখ্যাতদের রিসার্চের ফলাফল দেয়া হয় তাহলেই আশা করি তা যথেষ্টর চেয়ে বেশী হবে। উধাহরন সরূপ বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ Pierre Carbites ইসলামে নারী অধিকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে নবী (সাঃ) এর প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যিনি নারী অধিকার সম্পর্কে চ্যাম্পিয়ন সে হল আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ)। তিনি বলেনঃ

“Muhammad (PBUH) was probably greatest champion of women’s rights the world has ever seen.”

আসলে এতসব আবিস্কারের কথা ব্যাখ্যা দেয়া অচেনা যুবকের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহ যে জন্য তৈরি করেছেন তা মনে করিয়ে দেয়া, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পরিনতির দিন সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়া, কিছু উধাহরনতো শুধু এই জন্য বলা হল যা না বললে হয়তো অনেকে জানতেও পারবেনা যে মুসলিম সমাজ ব্যাবস্থায় থেকে ইসলামকে জানার পাশাপাশি গবেষণা বা আবিস্কার কত বেশী হয়েছে এবং তা পৃথিবীকে কতটা উচু শিখরে পৌঁছে দিয়েছে, অন্তত পক্ষে এটা যেন বুঝতে সুবিধা হয় ইসলাম কত মানুষের মন জয় করেছে আর সেই ইসলাম সম্পর্কে, ইসলামের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কতটাই না অজ্ঞ আর সেই অজ্ঞতা তৈরি করেছে ইসলাম সম্পর্কেই কত মতভেদ। তাই চলুন ইসলাম শেখার আগে সঠিক ভাবে শিখছি কিনা জানি, বিশেষ করে মদিনায় ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করে আলেম হয়েছে এমন কারও খোঁজ করে শেখার চেষ্টা করি। কারন মদিনার ব্যাপারে রাসুল (সাঃ) স্বয়ং দোয়া করে গেছেন। অন্তত নিজের ভাবনার ইসলামকে বাদ দিয়ে প্রকৃত সিলেবাসটা থেকে সঠিক নিয়মে, সঠিক স্কলারদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করি। তাহলে ইনশাআল্লাহ একজন বাধ্য হবে ইসলামকে ভালবাসতে। কারন কিছু ভালবাসা তৈরি করা যায়না তা আসলে হয়ে যায়।

আফসোসের বিষয় শুধু এটাই কেন যেন আমাদের খেয়াল থাকেনা প্রত্যেকটা জিনিস আল্লাহ দেখছে, যেদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো হবে আমাদের সেদিন আমাদের এইসব কালচারার ভালবাসা কোথায় থাকবে? কোন জিনিসটার ব্যাপারে আমরা সিরিয়াস? পাঁচ ওয়াক্তই নামাজ? অন্যকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস? কুরআন বুঝার ইচ্ছে? কোনটি? আবার আমরা নাকি আল্লাহকে বাবা মার চেয়ে বেশী ভালবাসি। ভালই আমাদের ভালবাসা। কবে ফিরে আমাদের নিথর হওয়া বিবেগ?

“আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন:অন্ধকার রাতের মত ফিতনা আসার আগেই তোমরা নেক আমলের প্রভি অগ্রসর হও । সে সময় সকালে একজন মুমিন হলে বিকালে কাফির হয়ে যাবে । বিকালে মুমিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে । দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে তার দীন বিক্রি করে বসবে ।“ [সহিহ মুসলিম :: খন্ড ১ :: হাদিস ২১৩]

আজ আমরা ঠিক ভাবে বলতেও পারবোনা কি কি শর্ত ভঙ্গ হলে একজন ইসলাম ধর্ম থেকে বের হয়ে যায়, আজকে মানুষ পার্থিব লোভে যা ইচ্ছে করে যাচ্ছে জানতেও পারছেনা আদৌ সে মুসলিম হিসেবে টিকে আছে কিনা। আর সে জানতেও চায়না, অথচ রাসুল (সা:) আমাদের সতর্ক করে গেছেন সেই সময়টা আসবে যখন সকালে একজন মুমিন হলে বিকালে কাফির হয়ে যাবে । বিকালে মুমিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। অবস্থা এতটা খারাপ হবে যে দিনের ফুটফুটে আলোকে যেমন ঘুটঘুটে রাতের অন্ধকার ঢেকে ফেলে তেমনি অন্ধকার রাতের মত ফিতনা আসবে। আফসোস যেখানে আমাদের উচিৎ ছিল সঠিক ইসলামকে জানার,ইসলাম কতটা উচ্চের, শান্তির তা আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার সেখানে আমাদের সময় কেটেছে নষ্ট হয়ে যাওয়া আধুনিক জীবন ধারায়, ক্যারিয়ার যাত্রায় দৌড় প্রতিযোগিতায়। কেন যেন আমাদের এ সমাজ খুব ভাল ভাবেই বুঝাতে পেরেছে জীবন একটাই একে উপভোগ কর, হালাল হারাম ভাবার কার এত দায়। যখনি ইসলাম এসে বাঁধ সেজেছে অশ্লীলতার কাছেও যেওনা তখনি শয়তান ভেতর থেকে বলেছে তুমি এতো সেকেলে কেন, এটা একবিংশ শতাব্দী। যখনি ইসলাম বলেছে পোশাকে শোভন হও, তখনি বখে যাওয়া মন বলেছে কট্টরতা করোনা, ইসলাম যখন নারীকে বসিয়েছে সম্মানের সিংহাসনে, রানীর মত মাধুর্যে, পোশাকে আবৃত করে, শরির দেখিয়ে বাহবা না পেতে তখন সভ্যতার নামে গিজগিজ করা মাথা গুলো ডুবেছে অশালীন নৃত্যের তালে, অবিবাহিত পুরুষের কোলে জড়িয়ে, অভিনয়ের নামে স্বাধীনতা প্রকাশ করে নারীদের প্রসাধনীর মত ব্যাবহার করতে। প্রসাধনীর এক্সপায়ার ডেটের মত সে নারীদেরও নৃত্যের বয়স শেষ হয়, পুরুষকে কোলে জড়াতে নতুন নারীর সন্ধান হয়, পুরনোকে ঝেড়ে ফেলা হয়। এর নাম তাদের কাছে স্বাধীনতা, মুক্ত বিহঙ্গ হওয়া। হায় স্বাধীনতা। অথচ কত সময় ব্যায় হয় আমাদের এসব চিত্র দেখে। শুধু সময় নেই ইসলামকে জানতে। যেসব দেশকে তোমরা আধুনিকতার নামে স্বাধীন হওয়ার নামে বাহবা দাও সেসব দেশের ভেতের স্বাধীনতা আসলেই কেমন? কুরআনের কথার লেখক ওমর আল জাবিরের ভাষায়ঃ

“যে দেশে প্রতি ঘন্টায় ৭৮ টা ধর্ষণ হয়, সেই দেশের চেয়ে পশ্চাদপদ দেশ কোনটা আছে পৃথিবীতে? যে দেশে ৬০% দম্পতি তালাক দেয়, তাদের চেয়ে দুর্বল জাতি কোনটা? যে জাতি বছরে৬.৪ বিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট করে এলকোহল জনিত অর্থনৈতিক ক্ষতিতে, ৭.৩ বিলিয়ন পাউন্ড এলকোহল জনিত অপরাধ দমনে, ২.৭ বিলিয়ন পাউন্ড এলকোহল আসক্ত মানুষদের চিকিৎসায়, এবং বছরে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় এলকোহল জনিত অসুস্থতা ও অপরাধের কারণে – তাদের চেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি কোনটা? চিন্তা করতে পারেন কত বড় সময় এবং সম্পদের অপচয় এগুলো? এক ব্রিটেনের ১৫ বিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে সাড়া পৃথিবীর ১.৬ বিলিয়ন গরিব মানুষের অভাব দূর করে ফেলা যেত।”

তিনি আরও বলেনঃ

“বিংশ শতাব্দীর আগে যত হত্যা হয়েছে, তার মধ্যে ৩% হত্যা ধর্মীয় ঘটনার সাথে জড়িত। বাকি ৯৭% হত্যা যুদ্ধ, রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক কারণে।“

এই হল বাস্তবতা। শুধু অর্থনীতি বা প্রযুক্তি দিয়ে একটি দেশকে মাপা উচিৎ না সেদেশের মানুষের মানসিকতা, পরস্পর শ্রদ্ধা, সম্মান দিয়ে মাপা উচিৎ? বলতে পার এর সাথে ইসলামের সম্পর্ক কি, ইসলামে ধর্ষণতো দুরের কথা একটি মেয়ের দিকে অশুভ দৃষ্টি পর্যন্ত দেয়া পাপ। মদ্য পানতো দুরের কথা এমনকি মদের পাত্রটি পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া নিষেধ।

কতটা দুঃখজনক আজকে ইসলামকে সুন্দর করে তুলে ধরতে কত শত অমুসলিমরা মুসলিম হয়ে কলম ধরেছে, নিবেদিত হয়েছে। আর আমরা জীবনে একবারও পুরো কুরআনটাতো দূরে থাক অন্তত পক্ষে বাধ্যতামুলক ব্যাপারগুলো জানতেও একজন প্রথম শ্রেনীর আলেম বা স্কলারের খোঁজ করতে পারিনা।

পরিশেষে বলবো এ জুগে আসলে ইসলামকে নিবেদিত ভাবে গ্রহন করার সবচেয়ে বড় একটি বাধা মনে হয় “ইগো সেন্ট্রিক” মানসিকতা। কারন মানুষ বড় হচ্ছে তথাকথিত শিক্ষা এবং জীবন যাত্রার মধ্য দিয়ে। এই শিক্ষা আর জীবন যাত্রা এমন এক ইগো প্রবলেম তৈরি করে যে নিবেদিত ভাবে ইসলামে ফিরে আসতে চাইলেও মন বিভিন্ন যুক্তি তৈরি করা শুরু করে। যেমনঃ এখনও অনেক সময় পরে আছে, আমিতো মুসলিমই এত সিরিয়াস হওয়ার কি আছে, হঠাৎ পরিবর্তন আশপাশ কি ভাবে নেবে ইত্যাদি। এটা আসলে নিজের মনকে যুক্তি দিয়ে হালাল করে নেয়া। আমরা আসলে মন থেকে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র রব হিসবে মেনে নিতে শিখিনি। সেই রবের স্থানে জায়গা করে দিয়েছি আধুনিকতা নামের এক শিক্ষাকে, জীবনযাত্রাকে, আর বদলে গেলে পাছে লোকে কি বলে এই মানসিকতাকে। যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে নিজের মনকে প্রশ্ন করি কেন আমি পারছিনা, কেন সিনেমার বদলে ইসলামিক লেকচার হলে আমি এড়িয়ে যাই, কেন আধুনিকে উপন্যাসের জায়গায় ইসলামিক বই হলে আমি ফিরিয়ে দেই, কেন অন্যকে ইসলামিক বার্তা দিতে আমি লজ্জা পাই। কোথায় আমার সমস্যা। শেষ পর্যন্ত যেটা খুঁজে পাব ভাল করে লক্ষ্য করুন সেটা আমাদের “ইগো সেন্ট্রিক” মানসিকতা নয়তো? আল্লাহর তরফ থেকে একটি বড় পাওয়া হল এই সমস্যা ভাঙতে পারার যোগ্যতা। আল্লাহ যদি কাউকে এই যোগ্যতার কিছুটা দান করেন তখন তার ফেসবুক পোস্ট থেকে শুরু করে আচার আচরণ,কথা বার্তায় টের পাওয়া যাবে যে সে আল্লাহকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসতে শুরু করেছে।

শেষ করার আগে সুরা বায়্যিনাহর একটি আয়াত যেখানে আল্লাহ বলেছেনঃ

“এক অনন্ত স্বর্গ যার ভেতর দিয়ে পানির ধারা বয়ে যায়, যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর তারাও তাঁকে পেয়ে সন্তুষ্ট। -এসব কিছুই হচ্ছে জীবনভর আল্লাহকে ভয় করে চলার প্রতিদান।”

আল্লাহ আমাদের প্রত্যেকের মনে ইসলামের ভালবাসাই তৈরি করুক। আমাদের হৃদয়ে তাকে ভালবাসার দরজা খুলে দিক, মনের সংকীর্ণতা দূর করে ইসলামকে জানার পথ উন্মুক্ত করে দিক, যে পথ বিরাজমান থাকে একটু আলোর খোঁজে, অথৈ আধারে না ডুবে!

মন্তব্য করুন

Back to top button