জীবনের বাঁকে বাঁকে

যারা সত্যিকারের ভালো মানুষ তারা সত্যিই অনেক বিনয়ী

“আপা আমার মাকে যদি একটু আগে বাথরুমে যাবার সুযোগ দিতেন ! বয়স্কা মানুষ বাথরুম ধরে রাখতে পারেনা”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমাকে উদ্দেশ্য করেই একজন কথাগুলো বলেছে , লাইনে অন্যরা মহিলাদের লাইনে পুরুষ এসেছে বলে বিভিন্ন কটু মন্তব্য করছে কিন্তু কেউই জায়গা ছাড়তে রাজি নয় বলেই হয়ত এই আবেদন ।

“আচ্ছা আপনি বাহিরে গিয়ে দাঁড়ান , আমি উনাকে বাথরুম করিয়ে আপনার কাছেই দিয়ে আসবো”
উনারা আমার পরিচিত নয় আবার অপরিচিত সেটাও বলা যাবে না , হজ্বে এসেছি – একই হোটেলেই উঠেছি তবে ফ্লোর আলাদা , লিফটে মাঝেমধ্যে দেখে হয়েছে মাত্র !

খালাম্মাকে বাথরুম সারিয়ে অজুখানায় নিয়ে গেলাম—
“আপনি অজু করে নিন খালাম্মা”

“মাগো মাথার হিজাবের ফিতাটা খুইলা দিয়া যাও ,ব্যাটা ছেলে বুঝে না টাইট কইরা বানছে”

ছেলের কাছে মাকে দিয়ে আসার সময় ছেলেটি বললো—
“আপা , অনেক শুকরিয়া”

“এটা কেনো বলছেন ভাই ? আপনি এতো অসুস্থ্য মানুষকে একা নিয়ে এলেন কেনো ? কোনো মহিলা সাথে এলে ভালো হতো”

“উপায় ছিলো না বোন , মা এতোটা সিক ছিলেন না , প্লেনে উঠার পরেই ভয় পেয়ে অসুস্থ্য হয়ে গেছেন আর আমার বাচ্চারা খুবই ছোট , স্ত্রীকে আনা সম্ভব ছিলোনা”

“বদলী হজ্ব করাতে পারতেন , খালাম্মা ঠিকমতো হাঁটতেও পারছেন না , আপনি হুইল চেয়ারে করেই সব জায়গায় নিতে হচ্ছে”

“সারাজীবনে মা কখনো কিছু চায়নি , এই একটা জিনিসই চাইছে , আমি সামান্য স্কুলশিক্ষক এতদিন সামর্থ্য হয়নি তাই পারিনি”

আমরা এখন মুল হজ্বের কাজে মিনায় এসেছি তাঁবু তে আছি , ছেলেটি গলা খাঁকারি দিয়ে দুই /তিন ঘন্টা পর পর মায়ের খোঁজ খবর নেয় , আরাফাতের ময়দানে প্রচণ্ড গরমে তাঁবু থেকে কখন যেনো বৃদ্ধা একাই বের হয়ে গেলো—কেউই খেয়াল করেনি , ছেলে এসে না পেয়েই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো – কিছুক্ষণ পরে দেখি মাকে নিয়ে এসে চেয়ারে বসিয়ে মায়ের হাত, পা ,গা মুছিয়ে দিচ্ছিলো , দুজনের কথোপকথন কানে ভেসে এলো –
“আম্মা আপনি একা , একা আর বাইরে যাবেন না , আপনি হারাইয়া গেলে আমি আপনারে কই খুইজা পামু ? এখানে লক্ষ, লক্ষ মানুষ!”

“পুত আমি তোমারে খুঁজতেই গেছিলাম”

“আমি একটু পর ,পর আইসা আপনারে দেইখা যামু তবুও আপনি তাঁবু থেকে একা বাইর হইবেন না ,কথা দেন আমারে —বলেই ঝরঝর করে ছেলেটি কাঁদতে লাগলো , উপস্থিত সবাইর চোখ আপনা আপনি ভিজে উঠলো সে কান্নায় ।

“এখানে যারা উপস্থিত আছেন সবাই আমার বোন লাগেন , সবাইর কাছে অনুরোধ একটু মাকে দেখে রাখবেন আর আমিও একটু পর , পর এসে মাকে দেখে যাবো”

সবাই কথা দিলো খেয়াল রাখবে আর সত্যি সত্যি ছেলেটি আধা ঘণ্টা পর পর এসে তাঁবুর বাহিরে আওয়াজ দিতো –যেহেতু মহিলাদের তাঁবু সরাসরি ঢুকতো না । রাতে ওয়াশরুমে যাবার জন্যে তাঁবুর সামনের রাস্তায় বৃদ্ধার ছেলেকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলাম—
“আপনি আপনার তাঁবুতে গিয়ে বিশ্রাম নিন , উনিতো এখন ঘুমাচ্ছেন”

“সমস্যা নেই বোন , আমি ঠিক আছি , মা যদি আবারও একা বেরিয়ে যায়! তাই এখানেই বসে আছি”

আমি আর আমার সঙ্গী আরেকজনের চোখ অজান্তেই ভিজে গেলো , ছেলেবেলায় পড়া বায়েজিত বোস্তামীর গল্প মনে পড়ে গেলো , এই যুগেও এমন সন্তান হয় নাকি ?

পুরো হজ্বের সময়ে ছেলেটি হুইল চেয়ারে করে মাকে নিয়ে সব করেছে –কখনো সামান্য বিরক্তি বা উঁহু শব্দ করেনি – ছোট বাচ্চা মেয়েদের নিয়ে বাবারা যেমন করে ঠিক তেমন । মাকে খাইয়ে দিতো , চুলে বিনুনি করে দিতো , গরমের জন্যে একটু পর পর এসে হাত,মুখ পানি দিয়ে মুছে দিতো, জুস খাওয়াতো — একজন ছেলের পক্ষে যা করা সম্ভবপর সব ই করতো। সব মায়েরাই দোয়া করতাম –

  • ” আল্লাহপাক সবাইকে এমন সন্তানই দিও “

হজ্ব শেষে জেদ্দা বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছি , এমন সময় আবারো উনাদের সাথে দেখা , সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম– “কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি , আপনাদের সবার দোয়ায় আমি মায়ের ইচ্ছেটা পুরণ করতে পেরেছি, মায়ের ইচ্ছে ই ছিলো নিজেই হজ্ব করবে”

“মারে আমারে একটু বাথরুমে নিয়া যাবা ? প্লেনের বাথরুমে যাইতে ভয় করে”

বাথরুমে যাবার সময় খালাম্মাকে বলেই ফেললাম —–
“খালাম্মা আপনি বড়ো ভাগ্যবতী, এই যুগে এমন সন্তান দেখিনি”

“মারে আমার মাইয়া নাই , খুব দুখ করতাম , শ্বশুর দোয়া দিছিলো অনেক”

কি সরল স্কীকারোত্তি একজন মায়ের! আধুনিক হয়ে আমরা কেবল জটিলতর হচ্ছি!

“ভাই আপনাকে স্যালুট , দোয়া করি আপনার মতো সুসন্তান যেনো সব মায়ের হয়”

“নারে বোন এটা বলবেন না , চিন্তা করুন ছোটবেলা আমরা মাদের কতো জ্বালাইছি , এখন মা এখন ছোট হয়ে গেছেন – আমাদের কপাল ভালো যে আমরা মায়ের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি , কতোজনের কত কি আছে কিন্তু মা-বাবা ই নাই”

যেমন গাছ তেমনই তার ফল! ছেলেটি ও মায়ের মতই চিন্তাভাবনা করে।

অবক্ষয়ের এই যুগে এসে কতো শিক্ষিত –অশিক্ষিত মানুষকে দেখছি মা- বাবাকে অবহেলা করতে , বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসতে । সামান্য একজন শিক্ষক বলে নিজেকে বললেও আমরা যারা একই সাথে ছিলাম তারা প্রত্যেকেই দেখেছি কি অসাধারণ মানুষ উনি ।

যারা সত্যিকারের ভালো মানুষ তারা সত্যিই অনেক বিনয়ী । আমরা সন্তান দের কতো কি বানাতে চেস্টা করি! অথচ ভালো মানুষ বানাতে চেষ্টা করি না । মানুষ একা আসে , একাই যায় – নিজ কর্ম আর সুসন্তান ছাড়া কিছু রেখে যেতে পারে কি ?


(লিখেছেনঃ ফাহমিদা খানম, ৩০/৮/১৯।)

মন্তব্য করুন

Back to top button