জীবনের বাঁকে বাঁকে

ওরা ৮ জন : ৫ জন ছেলে, ৩ জন মেয়ে

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি রাস্তার পাশ ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা ঘাসের উপরে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। ভার্সিটি পড়ুয়া সবাই –দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মাঝে একটি ছেলে হাঁটু ভেঙে শুয়ে আছে পাশের মেয়েটির কোলে মাথা রেখে। মেয়েটি ধরে আছে ছেলেটির হাত। আর থেকে থেকে ছেলেটির কপালে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে মেয়েটি। এককথায় – অশ্লীল লাগছে দৃশ্যটি।

আমি অফিস থেকে ফিরছি। ঢাউস সাইজের একটি খাম হাতে দাঁড়িয়ে পাক্কা ২ মিনিট ভাবলাম। তারপর “বিসমিল্লাহ” বলে এগোতে লাগলাম তাঁদের দিকে। নিজের বুকের ভেতরের দুপদুপানি শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছি।

সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকালেন ৩/৪ জন। বাকীরা আড্ডায় ব্যস্ত। বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম তাঁরা মুসলিম কিনা। হ্যাঁ-সূচক উত্তর পেয়ে মেয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা ছেলেটিকে তাঁদের সম্পর্ক জানতে চাইলাম। উঠে বসতে বসতে জানালো, “আমরা সবাই ফ্রেন্ডস।” .

আমি বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম। বললাম, “মহান আল্লাহকে ভয় করুন। আপনি যে আপনার মেয়ে বন্ধুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন, এটি স্পষ্ট হারাম কাজ। জাহান্নামের আগুনকে আমাদের সবার ভয় করা উচিৎ।“

“হোয়াট দ্যা **?”

আমি থামলাম না। ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলতে থাকলাম, “হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ ‘তোমাদের জন্য হালাল নয় এমন কোন নারীর হাত স্পর্শ করার চেয়ে কেউ যদি লোহার পেরেক দিয়ে নিজ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়, সেটিও তার জন্য উত্তম।’ লোহার পেরেক আপনার মাথায় ঢুকে যাচ্ছে – এই বিষয়টি চিন্তা করতে পারেন কি?”

“ওই মিয়া, মাথার নাটবল্টু লুজ নাকি?”

“ভাই আমার, আমি পাগল না। যা বললাম, নিশ্চয়ই আপনার ভালোর জন্যই বলেছি।”

এই পর্যায়ে প্রায় অনুমিতভাবেই উঠে এসে কলার চেপে ধরলেন ভাইদের একজন। অশ্রাব্য ভাষায় গালি ভেসে আসছে কানে। পাগল, মোল্লা, মাথায় গন্ডগোল, তারছেঁড়া, গাঞ্জাখোর, ধান্ধাবাজ – এগুলো সবচে’ ভদ্রোচিত সম্ভাষন। ৫ জন ছেলের মধ্যে ১ জন আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছেন। বাকী ৪ ভাই আমাকে ধরতে চাইছেন। বোনেরা ভাইদের পেছন থেকে টেনে ধরছেন। আমি শুধু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, “আমি ভুল বা খারাপ কোন কথা বলি নি।”

আশেপাশের মানুষজন ততক্ষণে জমা হয়ে গেছে। কী হয়েছে কেউ ঠাহর করতে পারছে না। উদ্যত ৪ ভাইয়ের একজন এসে গলা ধাক্কা দিয়ে ঘাস থেকে রাস্তায় পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। হাতের খামটি ধাক্কাধাক্কিতে মাটিতে পড়ে গেছে। সেটি তুলে নিয়ে দুমড়ে যাওয়া শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বললাম, “আপনারা আমাকে মনে হয় অসুস্থ ভাবছেন। আমি অসুস্থ না। হারাম একটি বিষয় চোখের সামনে পড়াতে ভুলটি ধরিয়ে দিতে চাইছিলাম শুধু। আমার কথাগুলো আপনাদের কাছে বেমানান-অপরিচিত লেগেছে, আমি জানি। মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে, নাবী মুহাম্মাদ ﷺ বলেছেনঃ ‘ইসলাম শুরু হয়েছে অপরিচিত অবস্থায়, পুনরায় অপরিচিত অবস্থায়ই ফিরে যাবে। সুতরাং সুসংবাদ সেই অপরিচিতদের জন্য।’

পেছন থেকে গালির তুবড়ি ফোটাতে ফোটাতে তেড়ে আসতে নিলেন ২ ভাই। বাকীদের বাধার জন্য পৌঁছতে পারলেন না আমার কাছে। বাধা দেয়া ভাইদের একজন এসে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বিদায় জানালেন আমাকে, “যা ব্যাটা, ভাগ। নিজের রাস্তায় চল।”

ভাইদের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে ঘটনা বুঝার চেষ্টারত জড়ো হওয়া ৮/১০ জন পথচারীদের মাঝখান দিয়ে আমি নিজের রাস্তায় চলা শুরু করলাম।

আমার কথা:

১। অনলাইনে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কিছুটা চেষ্টা করে আসছি বছর কয়েক। অফলাইনে দাওয়াত তুলনামূলকভাবে কঠিন – এইটুকু জানতাম। “ঠিক কতটুকু কঠিন” – আজকে যেচে জানার চেষ্টা করলাম। এবং জানলাম।

২। এই ইয়ং ভাইবোনদের দিকে হাঁটতে শুরু করার আগেই মাথায় এসেছিল যে এঁদেরকে দিয়ে বোধহয় আমার অফলাইন দাওয়াত শুরু করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভয় যে পাচ্ছিলাম – সেটি অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। তারপরেও আগে বেড়েছি। শাইত্বানের ওয়াসওয়াসাকে আমি দুরে সরাতে পেরেছিলাম – আল’হামদুলিল্লাহ।

৩। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য। এই লেখাটি লিখছি আর ভাবছি – রাসুলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর সাহাবাদের উপর দ্বীন ইসলাম প্রচারের জন্য কী ধরণের অত্যাচার হয়েছিল। আমার উপরে যা হয়েছে তা অত্যন্ত নগন্য। তাতেই আমার মন ভয়ংকর খারাপ হয়ে আছে। ভাবতেই পারছিনা – তাঁদের কাছে কেমন লাগত!

৪। আমার গায়ের চামড়া মোটা না। অবশ্যই অপমানিত বোধ করেছি। লজ্জা পেয়েছি জড়ো হওয়া মানুষদের সামনে। কলার চেপে ধরার পরে এবং বুকে ধাক্কা দেয়ার সময়ে আমার হাত উঠে যাচ্ছিল রিফ্লেক্সনের কারণে। মাথা ঠান্ডা রাখা একজন দা’ঈর জন্য অত্যন্ত জরুরী। আল’হামদুলিল্লাহ – সামলাতে পেরেছি নিজেকে। আমার সম্মানের চেয়ে দ্বীনের সম্মান জরুরী।

৫। আমি কিন্তু সেই ভাইবোনদের খারাপ মনে করছি না। তাঁদের এই বয়সে পুরো পৃথিবীকে রঙিন লাগে। এখন থেকে বছর খানেক আগে আমাকেও যদি কেউ এভাবে দাওয়াত দিতেন, আমিও হয়তো রিআ্যক্ট করতাম (হয়তো এত বাজেভাবে করতাম না)। সমস্যা হচ্ছে – আমাদের মধ্যে এইভাবে দাওয়াত দেয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে নি। সেই কারণেই আমাকে “অসুস্থ” মনে হয়েছে তাঁদের। এইভাবে প্রকাশ্যে যদি সব ভাইবোনেরা আশেপাশের অশ্লীলতার বিপরীতে নম্র ভাষায় দ্বীনের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন, খুব শীঘ্রই ভালো ফল মিলবে ইন-শা-আল্লাহ।

৬। হারাম বিষয়গুলো সমাজের ভেতর এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, “স্বাভাবিক বিষয়” এর সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। কুরআনের আয়াত কিংবা রাসুলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস পর্যন্ত কোন ভাবান্তর সৃষ্টি করে না আমাদের মনে। আমাদের সবার উচিত – নিজ পরিবার থেকে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো আলোচনা করা। অবস্থার উন্নতি অবশ্যই হবে একটা সময়ে – বিইজনিল্লাহ।

সবশেষে আমার সেই ভাইবোনদের হিদায়াতের জন্য দু’আ করছি মহান আল্লাহর কাছে। আমি জানি যে কোন ভুল করিনি আমি। এইভাবে যখনি সম্ভব হয়, সত্য বলার তাওফীক যেন মহান আল্লাহ দেন আমাকে। দু’আ করছি – আমাদের সবার সকল দাওয়াতগুলো যেন কবুল করে নেন মহান আল্লাহ।

আমাদের কাজ – দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো। আর হিদায়াত তো একমাত্র তাঁর হাতে।”

______________________
লেখাঃ মুহাম্মদ জাভেদ কায়সার (রহি)
(আল্লাহ্‌ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন!)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button