জীবনের বাঁকে বাঁকে

অন্ধকার যতো গভীর হয়, ভোর ততোই কাছে চলে আসে

তীব্র রোদের মধ্যে হনহন করে হাঁটছে ছেলেটি। গন্তব্য ওয়ারী।

টিউশনি আছে দুপুর তিনটায়। পৌনে তিনটার মধ্যে পৌঁছতেই হবে। যেই স্টুডেন্টকে পড়ায় ছেলেটি- তার মা অতি ভয়ংকর প্রকৃতির। ভয়ংকর প্রকৃতির না হলে নেহায়েত দুপুর তিনটার সময় পড়ানোর কথা বলতেন না।

দুপুর তিনটা একটা অদ্ভুত সময়। এই সময়ে ভাত না খেয়ে কারো বাসায় যাওয়াটা রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। উপায় ছিল না ছেলেটির। কলেজ শেষ করে বাসায় ভাত খেয়ে টিউশনিতে গেলে দুপুর তিনটা পার হয়ে যায়। গত মাসে বাসায় ভাত খেতে টিউশনিতে আসতে আসতে চার দিন লেট। মাসের শেষে হিসেব করে চার দিনের বেতন কেটে নিলেন সেই মহিলা! যৎসামান্য টাকার ভেতরে সেই চার দিনের বেতনও অনেক কিছু।

এক রকম বাধ্য হয়েই দুপুরে না খেয়ে টিউশনিতে চলে যেতে হতো তাকে। স্টুডেন্টের বাসায় পৌছালো যখন সে – ঘড়িতে বিকাল তিনটা দুই মিনিট। শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে কলিংবেল টিপতে গিয়ে থেমে গেলো ছেলেটি।

দরজায় বিশাল তালা ঝুলছে। নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও বেড়াতে চলে গেছেন তাঁরা। এটা নতুন কিছু না। এর আগেও বেশ কয়দিন এসে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে। কষ্টের বিষয় হলো- আজকের দিনেও তাকে লেট হিসেবে ধরা হবে! যদিও সে প্রায় নিশ্চিত – তিনটা বাজার আগেই বের হয়ে গেছেন তাঁরা।

ক্লান্ত পায়ে রাস্তায় নামলো ছেলেটি। বাইরে প্রচন্ড গরম। এদিকে সকালের নাস্তা ছাড়া পেটে কিছু পড়ে নি। খিদের আগুন জ্বলছে পেটে। অন্যান্য দিন এতোটা ক্লান্ত লাগে না তার। কিন্তু আজ পা দুটো যেন চলছে না আর। পাশের “বিসমিল্লাহ কনফেকশনারী” নামের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। পকেটে যেই টাকা আছে, তাতে একটা ঠান্ডা ড্রিংকস মিলবে না। তারপরেও সাহস করে একটা ড্রিংকস চাইলো সে। কী মনে হতে দোকানদারকে টাকার অভাবের কথাটিও বলে ফেললো।

মাঝ বয়সের দোকানদার স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বাস করলো না ঘামে-নেয়ে ওঠা ছেলেটিকে। বাকীতে একটা ঠান্ডা ড্রিংকস কপালে জুটলো না তার। তীব্র কষ্ট আর অভিমান বুকে করে রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই ছেলেটির চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসলো। দীর্ঘ সময়ের খালি পেট, তীব্র গরমে অনেকক্ষণ হাঁটা, টাকার অভাবে একটা ঠান্ডা ড্রিংকস না খেতে পারার কষ্ট — এতো কিছুর ভার তার ছোট্ট শরীর বয়ে নিতে পারলো না আর। দোকানের সামনেই জ্ঞান হারালো ছেলেটি।

১৮ বছর পরে সেই ছেলেটি আজকে এসি রুমের ভেতর বসে রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে একটানে এই স্ট্যাটাসটি লিখে ফেললো।

জীবন এখন অনেক আনন্দময় তার। আল’হামদুলিল্লাহ! বাসায়-অফিসে–গাড়িতে এসির ভেতর সময় কাটে। গরম-ঠান্ডা যে কোন সময়েই ইচ্ছে করলে বরফের কুঁচি দেয়া হিম শীতল পানি খেতে পারে সে। শুধু সেই পানিতে চুমুক দিলেই ১৮ বছর আগের এক তপ্ত দুপুরের জ্ঞান হারানোর নিদারুণ স্মৃতি মনে পড়ে যায় তার।
______________________________

আমার ফ্রেন্ডলিষ্ট-ফলোয়ারদের মাঝে অনেকের জীবনের ভয়ংকর কষ্টের কাহিনী জানি আমি। সেই কষ্টগুলো সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার উপায়ও নেই কোনো। জীবন সংগ্রামের তীব্র কষ্টের সেই পথে বারবার বাধা পান তাঁরা। মাঝে মাঝে অতি আপনজন ভেবে সেই কষ্টের অণু পরিমান অংশ আমার সাথে শেয়ার করেন।

আমি সাহস কিংবা আশার কথা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না তাঁদের জন্য। আমার এই লেখাটি শুধু আপনাদের জন্য। কষ্টের দিন পেছনে ফেলে এসে যেই আনন্দের দেখা আপনারা পাবেন – তার স্বাদ অসম্ভব মধুর। দয়া করে হাল ছেড়ে দিবেন না। কষ্টের এই সমুদ্র পেরিয়ে যাবেন আপনারা একটা সময় — ইন-শা-আল্লাহ।

অন্ধকার যতো গভীর হয়, ভোর ততোই কাছে চলে আসে।

“অতএব কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।
নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।”
[সুরা আল-ইনশিরাহ, ৫-৬]

– Mohammad Javed Kaisar

মন্তব্য করুন

Back to top button