জীবনের বাঁকে বাঁকে

চোখশোক

[ক]

মিডটার্ম শেষ হয়েছে। কয়েকদিন নিঃশ্বাস নেওয়া যাবে। ভরদুপুরে কী যেন ভেবে ডুব দিলাম নীললোহিতে। নির্জন মেঠোপথ ধরে একলা হেঁটে যাওয়ার মতো অনুভূতি। কোনো এক কবিতায় বলেছিলাম, ‘একা হ’তে ইচ্ছে হ’লে আমি একাকি হাঁটি / সঙ্গ পেতে ইচ্ছে হ’লে আমি আমার সাথে হাঁটি’। এই দ্ব্যর্থ অনুভবকে ঠিকমত আসন পেতে দিতে পারি যাদের কবিতা পড়ে, সুনীল তাদের একজন। আজকেও তা-ই হচ্ছে। একটা কবিতার প্রেমে পড়ে গেলাম। কী আছে তাতে? সুনীলের আর দশটা কবিতার মত এটাও সাদামাটা ও প্রমত্ত। কবিতার মাঝামাঝি এসে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। মুগ্ধতা, নাকি মোহাবেশ, কোনটা ঠিক জানি না; তবে শব্দগুলো যে আমাকে মোহিত করেছে, তা বেশ ভালো করেই জানি। একটু থেমে ফ্ল্যাশব্যাকেও চলে গেলাম। কবিতা পাঠের মাঝপথে হঠাৎ এভাবে থমকে গেলাম কেন? সেই গল্পটাই শোনাবো।

সুনীলের প্রথমদিকের কবিতাগুলোয় নীরার উপস্থিতি অনিবার্য। এই ধরনের চরিত্রগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব খুব কমই থাকে; কখনো ছদ্মনাম হিসেবে, কখনো খোশখেয়ালের বশেই কবিরা গড়ে তোলেন সুনির্দিষ্ট কাল্পনিক অবয়ব। নীরাও কবিতামোদী ও গবেষকদের কাছে এক হিসাবে অমীমাংসিত; কেউ কেউ বলেন, নামটা তাঁর স্ত্রীকেই উদ্দেশ্য, কেউ বলেন, এটা নিছক ফিকশনাল চরিত্র। যেমনই হোক না কেন, এই চরিত্রটি কা’ব বিন যুহাইরের (রাঃ)  সু’আদ-এর মতো বিশ্বাসঘাতকী নয়, জীবনানন্দের বনলতা কিংবা নিযার কাববানির সায়্যিদার মতো অবগুণ্ঠিতও নয়। একটু আলাদা। একটু না, অনেক।

অনুভবের সবটুকু জুড়ে তার বসবাস। যেন ভালোবাসার সহজাত দ্রবণে গলে যাওয়া কোনো ফসফরাস।

কবির ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু নীরা। এই কেন্দ্রবিন্দু থেকে অঙ্কিত হয় কবিতার বৃত্ত। আবার এই বৃত্তেই বন্দী হয় পৌণঃপুণিক কবিজীবন। এই অসামান্য ভালোবাসা ও সর্বনিমগ্ন প্রেম নানা বরন ও ধরনে বারবার এসেছে তার বিভিন্ন কবিতায়। আজকের কবিতাটা পড়ার পর মনে হচ্ছে, বাকি কবিতাগুলো সাধারণ কিছু তারা, আর এটা অনেক তারার মাঝে জাজ্বল্যমান পঞ্চদশী চাঁদ। যেন পোষাকী প্রেমের খোসা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে পূর্ণব্রত ভালোবাসার অঙ্গীকার; যেন শরীরবৃত্তীয় অনুরাগ কেন্দ্রীভূত হ’তে শুরু করেছে একটি জীবনমুখী প্রতিজ্ঞার কাছে।

‘কী অসাধারণ সেই অনুভবের স্বয়ংপ্রকাশ!

…এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ

আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন

পাপ করতে পারি?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি-

এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?’

নীরার প্রতি ভালোবাসা-কে বিশুদ্ধতায় আবৃত রাখতে কবি প্রতিজ্ঞ। নীরার প্রেম আর মিথ্যা – দুটো সহাবস্থানের উপযুক্ত না; নীরার ভালোবাসা আর কদর্যতা একসাথে চলে না। এই আবেগ-অনুভবকে এতটাই যত্ন করে রাখেন তিনি, এর সাথে কোনো খাদ মিশতে দেন না।

[খ]

কবিতার গল্প তো করলাম। অনেকের কাছে কবিতা বিরক্তিকর জিনিস। এতক্ষণ যারা আমার ওপর চটেছেন, তাদের জন্যে কথাসাহিত্য থেকে একটু গল্প করি।

শৈলেন ঘোষ। ওপার বাঙলার প্রয়াত সাহিত্যিক। শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে আমার পসন্দের একজন। তাঁর একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, দুঃসাহসী দুই বুড়ো। তো, সেই গল্পে একজনকে অযথাই চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। তার অভিব্যক্তি ছিলো অনেকটা এরকম,  ‘বিশ্বাস করো, আমি চুরি করিনি। এই যে হাত দেখছো, এই হাত দিয়ে আমি পুতুল বানাই। এই দুটো হাত দিয়ে আমি আমার ছেলে-মেয়েদের আদর করি। এই হাতে আমি চুরি কীভাবে করবো?’

[গ]

গল্প-কবিতা দুইটাই বাদ। এবার বাস্তব জীবনের গল্প করি। মাসকয়েক আগে গিয়েছিলাম পেট্রোনাস টাওয়ারের দেশে। এই সফরে বন্ধুত্ব হয়েছিলো একটা অসাধারণ মানুষের সাথে, নাম তাঁর সুলায়মান। কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সুপার-ডুপার রেজাল্টের অধিকারী। জানলেওয়ালা, বিনয়ী মানুষ। কিছুটা স্পর্শকাতর। পুরো কনফারেন্সে আন্ডারর্গ্যাড স্টুডেন্ট

ছিলাম আমরা দু’জনই, বাকি সবাই বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক; এঁদের ভীড়ে আমাদের অস্তিত্ব ছিলো সাগরের মাঝখানে উঁকি দেওয়া দ্বীপের মতো। একটা জিনিস খেয়াল করলাম। কনফারেন্সে একজন মহিলা প্রফেসর মাহমুদ দারওয়িশের কবিতা নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করলেন। সুলায়মান তাঁকে একটা প্রশ্ন করার সুযোগ পেলো। প্রশ্নটা করতে তিন মিনিটের বেশী সময় নিয়েছে সে, কিন্তু একবারও প্রেজেন্টারের দিকে তাকায়নি। লাঞ্চব্রেকের সময় কথায় কথায় প্রশ্ন করলাম, আরবি মুভি দেখো?

না, কেন? মুভি দেখলেই পর্দাহীনা গায়রে মাহরাম চোখে পড়ে। এরপরে আর কথা আগায়নি। খাওয়া শেষ করে সোজা হোটেলের প্রেয়াররুমে।

যোহরের পর দ’ুজনে কফি নিয়ে বসেছি। ইচ্ছে জাগলো, নিজের ঈমান নিয়ে এত কনসার্ন কিভাবে তার মধ্যে জন্ম নিলো, আমি জানতে চাইবো। প্রশ্ন করেও ফেললাম। সুলায়মান উত্তর দিলো একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে,

ইবনে মাহমুদ! তুমি কি কুরআনের আয়াত পড়েছো? وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٌ  ইয়েস! কী বলা হচ্ছে এখানে? ইন শা-আল্লাহ, আমরা যখন জান্নাতে যাবো, তখন আল্লাহকে দেখতে পাবো।

[আয়াত দুটোর সরল অনুবাদ হচ্ছে:  ‘সেদিন কিছু চেহারা খুব উজ্জ্বল দেখাবে। তারা তাদের রবব-এর দিকে তাকিয়ে থাকবে’। সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত ২২-২৩।]

জান্নাতের সবচেয়ে বড় চমক হলো জান্নাতী মানুষেরা আল্লাহ তা’আলাকে দেখতে পাবে। মু’তাযিলাগণ এটা অস্বীকার করে, তবে আহলুস সুন্নাহর কাছে এটি একটি প্রামাণ্য আক্বীদা। যা-ই হোক, এই ব্যাপারটার দিকেই সুলায়মান ইঙ্গিত করতে চেয়েছে। তারপর বললো, ‘এই আয়াত ছোটবেলায় আববা আমাকে বলতেন। তারপর বলতেন, দেখো সুলায়মান! আল্লাহকে দেখতে পাওয়ার মতো বড়ো কোনো সৌভাগ্য আর নেই। জান্নাতে সেই সুযোগটা দেওয়া হবে। এই চোখ দিয়ে কিন্তু আল্লাহকে দেখতে হবে, এই চোখে হারাম কিছু দেখো না!’

আমি যেভাবে সাজিয়ে বললাম, সে ওভাবে বলেনি। কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে বলেছে। মূল সুর মোটামুটি এমনই ছিলো। এইটুকু বলতে বলতে ওর চোখ চিকচিক করছিলো। আমার অন্তর খুব নরম হয়ে আসছিলো।

পরবর্তী সেশনের সময় অত্যাসন্ন। সোফা ছেড়ে উঠলাম দ’ুজনে। হলরুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সুলায়মান বলছিলো,

‘যেই চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখার স্বপ্ন দেখি, সেই চোখ দিয়ে হারাম কিছু দেখা যায়, বলো ভাই?’

[ঘ]

তিনটা গল্পকে আমি এক সুতোয় গেঁথে সামনে রাখি। সুনীল নীরা’র ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নীরাকে ছোঁয়া হাত দিয়ে গর্হিত কিছু করবেন না। নীরাকে যেই মুখে ভালোবাসার কথা বলেছেন, সেই মুখে মিথ্যা বলবেন না। কেন বলবেন না? কেউ কি এসে বাধা দেবে তাকে? দেবে না। কিন্তু তার ভালোবাসার অনুভূতি এতটাই প্রখর ও তীব্র যে, সেটা নিজেই বেষ্টন করে রাখে সমস্ত ইচ্ছা ও সাধ; আরব্ধ অভিলিপ্সা সঁপে দেয় আরাধ্য প্রেমের কাছে। কবি বুঝতে পেরেছিলেন, এই স্বয়ংক্রিয় বাধ্যতাতেই হৃদয়ের স্থিতি। এই স্বেচ্ছা-আত্মসমর্পণেই ভালোবাসার সুখ।

সেই নির্দোষ লোকটার অভিব্যক্তি খেয়াল করেছেন? তিনি মনের সব অনুরাগ ঢেলে পুতুল বানান। এই শিল্প তার ধ্যান, এই শিল্পই তার ভালোবাসা। এই ছোট্ট জিনিসের ভালোবাসাও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, এই অনুরাগের অসম্মান তার কাছে অকল্পনীয়। যেই হাত দিয়ে আমি পুতুল বানাই, সেই হাত দিয়ে চুরি করবো, এ তো অসম্ভব! শুধু তাই না, শিল্পচর্চা করি যাদের অন্নসংস্থানের জন্যে, সেই সন্তানদের গায়ে মমতার পরশ বুলিয়ে দেই এই হাত দিয়েই। একজন বাবা জানেন, সন্তানের প্রতি অনুরাগটা কত গভীর, কত আবেগমেশানো। এই স্নেহ-মমতা একেবারেই বিমূর্ত, এই ভালোবাসা পুরোপুরি অপার্থিব। এই ব্যাখ্যাতীত ভালোবাসার সাথে যেই হাত জড়িয়ে আছে, সেই হাত দিয়ে অন্যের অনিষ্ট করতে যাবেন, এ তো তার কাছে স্বপ্নাতীত বিষয়!

সুলায়মানের ভাবাবেগ অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি মনে হবে। কিন্তু ভালোবাসার দর্শন যে বোঝে, হৃদয়ের ব্যাকরণ যে জানে, তার কাছে মনে হবে, এ-ই তো জীবনের সাঙ্গীতিক সৌন্দর্য! ভালোবাসার অপার্থিব আবেদন তো অনুভব করতে হয় এভাবেই! ভালোবাসার সাথে যে হৃদয়ের সংযোগ, সেখানে জীবনের বাইনারি হিসাব অচল। যে মাধ্যম ও উপকরণ ভালোবাসার সাথে সংশ্লিষ্ট, সেখানে আয়েশ ও খায়েশের জায়গা নেই, জায়গা শুধু বিশুদ্ধ অনুভবের, পরিশিলীত হৃদয়াবেগের। কবি তার হাত-জিহবা সংযত রাখছেন, কারণ এর সাথে তার ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। লোকটা হাত দিয়ে গর্হিত কাজের কল্পনা করতে পারছেন না, কারণ এর সাথে তার ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। সুলায়মানের চোখ দুটোও তার রব-এর সীমারেখা অতিক্রমের কথা ভাবছে না, কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে এক আরাধ্য অনন্ত ভালোবাসাকে মুঠোয় পুরার স্বপ্ন।

এই চোখ দিয়ে সে এমন সত্তাকে দেখার স্বপ্ন লালন করে, যার সন্তুষ্টির জন্যেই তার প্রাত্যহিক নিবেদন।

এই চোখ দিয়ে এমন একজন প্রভুকে দেখবে, যার ভালোবাসা ছিলো জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, পরম আরাধ্য।

এই অবলোকনের সৌভাগ্য সবার হয়না, সে এই সৌভাগ্যের অংশীদার হ’তে চায়।

এই ভালোবাসা অনুভব করার শক্তি সবার থাকে না, সে এই অনুভবে ঋদ্ধ হ’তে চায়।

তার হৃদয় যে ভালোবাসাতে দ্রবীভূত হয়ে থাকার দাবী করে, সেই ভালোবাসার সম্মানই যদি রাখতে না পারে, জীবনের অর্থটা কোথায়? এখানে এসেই সুলায়মানের ভাবাবেগ স্থিতি পায়। অপার্থিব সঙ্গীতে জীবনটা মুখর হয়ে ওঠে। হৃদয়ের পলিদ্বীপে আছড়ে পড়ে প্রশান্তির ঢেউ। দৃষ্টির হেফাযত হয়ে ওঠে সহজ, হারাম তৃপ্তির ইচ্ছেটা হেরে যায় আসমানি ভালোবাসার কাছে।

ক্যাম্পাসের অসুস্থ পরিবেশে প্রতিনিয়তই সুলায়মানের কথা মনে হয়। রুম থেকে বেরোলেই কে যেন কানে কানে বলে যায়, ‘এই চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখতে হবে, এই চোখে কি হারাম কিছু দেখা যায়?’

– আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button