আমি কখনো দরিদ্র হব না
সন্ধ্যারাতের সড়কে হলুদ-লাল-নীল রঙিন আলো-আঁধারি পেরিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি। সারাদিনের কর্মক্লান্তি শেষে যানজটে ব্যস্ত সড়ক কিছুটা দম নিচ্ছে বোধহয়। হাল্কা যানজটে মাঝে মাঝে গাড়ির গতি কমিয়ে কয়েক মিনিট বিরতি নিয়ে পুনরায় ছুটে চলা। রৌদ্রপ্রখর দিনের তীব্র গরমে ভ্রমণের ক্লান্তিতে চোখ দু’টো মুদে আসছিল। তন্দ্রায় হেলে পড়লাম কিছুক্ষণের জন্য পাশের দ্বীনি ভাইয়ের উপরেই। শারীরিক ভারসাম্য ফিরে আসলে পুনরায় উঠে বসে গাড়ির চালকের সাথে দ্বীনি ভাইদের টুকটাক অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন শুনছিলাম। তাদের কথার ফাঁকে গাড়ির চালককে প্রশ্ন করলাম, গাড়ি কি আপনার নিজের, নাকি ভাড়ায় চালাচ্ছেন? কথাটা ধরতে তিনি কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন। পরক্ষণেই কিছুটা দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, এটা ভাড়ায় চালাই। কথার টানে কিছুটা আভিজাত্যবোধ অনুভব করলাম।
আপনি কোথায় থাকেন, আর পরিবার? থাকি খিলক্ষেতে (ঢাকা)। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আমার পরিবার। মেয়েটা তিতুমীর কলেজে মাষ্টার্সে, এক ছেলে কলেজে, অন্যজন স্কুলে পড়ে। গাড়ির মালিককে প্রতিদিনের জমা দিয়ে আপনার সংসার চলে? আল্লাহর রহমতে চলে যায়। যানজটের কারণে আয়টা কম হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে বহু কর্মঘণ্টা ও শ্রম নষ্ট হয়। জীবনের পুরো সময়টা কি গাড়ি চালিয়েই কাটাচ্ছেন? কিছুক্ষণ নীরবতা। ড্রাইভিং সিট থেকে পেছনে ফিরে সড়ক বাতির আব্ছা আলোয় আলোকিত গাড়ির পেছনের অংশে বসা দু’জনের মধ্যে প্রশ্নকারীকে এক ঝলক দেখে নিলেন। কিছুটা দম নিয়ে শুরু করলেন, আপনারা বিরক্ত হবেন নাতো? না না বিরক্তি কিসের? এখনও পথের অনেক বাকী। আপনি বলুন। আমার রেন্ট-এ-কার এর ব্যবসা ছিল। নিজেরই গাড়ি ছিল চারটা। প্রথম জীবনে আজকের মতই ভাড়ায় গাড়ি চালাতাম। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক এই গাড়ির মতো নয়। শুরুর সময়গুলোতে টেম্পু-লেগুনা ছিল। সময়ের পরিবর্তনে বাহনও পরিবর্তিত হয়েছে। এক সময় রেন্ট-এ কার এ কমিশন নিয়ে গাড়ি ভাড়ায় দিতাম। কেউ গাড়ি ভাড়া নিতে আসলে তাদের সাথে রেন্ট-এ কার এর চালক ও মালিকদের সাথে সমঝোতার মাধ্যম হিসাবে গাড়ি ভাড়ার একটা অংশ আমাকে দেওয়া হ’ত। এটাকে হেয় অর্থে দালালী, ভদ্র উচ্চারণে মধ্যস্বত্বভোগীও বলতে পারেন।
এভাবে একটা সময় পারিবারিক খরচের পরও উদ্বৃত্ত টাকা জমাতে থাকি। সময়ের পরিক্রমায় জমানো টাকা দিয়ে পুরোনো গাড়ি ক্রয় করে তা মেরামত ও রং করে বেশী দামে বিক্রয় করা শুরু করি। এতে লাভের পরিমাণ অতীতের তুলনায় আরো অধিক হারে বাড়তে থাকে। দিন-মাস-বছর গড়িয়ে আমার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন চারটি গাড়ি, আশিয়ান সিটিতে কয়েকটি প্লটও ক্রয় করি। নিজের ও পরিবারের ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি রেখে তিনটি রেন্ট-এ কার ব্যবসায় দিয়ে দেই, তা থেকেও আয় আসতে থাকে। নতুনভাবে কয়েকজন মিলে জমির ব্যবসাতেও বিনিয়োগ করি। এতেও প্রচুর লাভ হয়। গ্রামের বাড়িতে জায়গা ক্রয় করতে থাকি। গ্রামের লোকজন সম্মুখে সম্মান দেখালেও হঠাৎ করে নতুন নতুন জায়গা ক্রয় করায় অনেকেই আড়ালে-আবডালে মাদক ব্যবসায়ীও বলতো। আসলে সত্যটা তো আমিই অবগত। তখনকার হিসাবে আমি প্রায় ৭ কোটি টাকার মালিক। সে-ই সময়গুলোতে (অহংকারে) আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম আমি কখনোই দরিদ্র হব না।
সময়ের পরিক্রমায় আরও বেশী আয়ের আশায় ছোট ব্যবসাগুলো বন্ধ করে জমির ব্যবসাতেই সম্পদের বড় অংশ বিনিয়োগ করি। এক পর্যায়ে কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে জমি কিনতে গিয়ে একজন জনপ্রতিনিধি ও তার অনুচরদের ধোঁকায় পড়ে যাই। পরবর্তীতে জমি বুঝে নিতে গিয়ে দেখি পুরো সম্পত্তিই জাল দলীলের মাধ্যমে দখল করা। এত বড় ধোঁকা আর কয়েক কোটি টাকা চোখের সামনেই হারিয়ে যাওয়ার ধাক্কা তাৎক্ষণিকভাবে দেহ-মন সামলে নিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে চরম অসুস্থতা ও মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়। স্বজনদের কান্নাকে সঙ্গী করে কয়েক মাস একাধারে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকি। পরিবারের সবার তখন আমাকে নিয়ে চিন্তা। ৬ সদস্যের পরিবার পরিচালনা ও আমার চিকিৎসার ব্যয় সামলাতে গিয়ে যারপর নেই হিমশিম খেতে হয় পরিবারের সদস্যদের। গ্রামের জায়গাগুলো স্বল্পমূল্যেই বিক্রয় করতে হয়। সেই সাথে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ করতে করতে ঋণের পরিমাণও বিরাট আকার ধারণ করে। ক্ষমতার পালাবদলে আশিয়ান সিটিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন পত্রিকায় তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ প্রচারিত হয়। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও প্রশাসনিক তদন্তে তাদের সম্পদের বিশাল অংশ কাগজপত্রে সঠিক নয় বলে প্রমাণিত হয়। যার মধ্যে আমার ক্রয়কৃত প্লটগুলোও পড়ে যায়। চারপাশের এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠার পর দেখি অর্থ-সম্পদের কোন অংশই আর অবশিষ্ট নেই।
শুধু থাকার জন্য খিলক্ষেতে (ঢাকা) টিনশেড ছোট্ট বাড়িটা আছে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সবাই আমার পাশে থেকে সর্বক্ষণ সান্ত্বনা দিয়েছে, যা হারিয়েছি তার জন্য যেন দুঃখিত না হই। এত বড় বিপর্যয় শেষে সুস্থভাবে পরিবারের কাছে ফিরে এসেছি; এখনও বেঁচে আছি সেজন্য আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ, বলেই কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পরক্ষণেই মৃদু হেসে বলতে থাকলেন, একসময় বলেছি, আমি কখনোই আর দরিদ্র হব না। আর আজ সব হারিয়ে এখন আবার ভাড়ায় অন্যের গাড়ি চালাই। নিজের একটা আছে। তবে সেটা দিয়ে যাত্রী পরিবহন করি। সেটা ঠিক করতে ওয়ার্কশপে দিয়েছি। জীবনের গল্প শুনতে শুনতে ধানমন্ডি চলে এসেছি। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। মধ্যরাতে এখনও থেমে থেমে যানজট। সশব্দে চালকের ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করেই তিনি বলছেন, বাবা এখনও খাইনি, এইতো আর কিছুক্ষণ পর যাত্রীদের নামিয়েই খেয়ে নেব। আজ বাড়িতে আসতে একটু দেরি হবে বাবা, বলেই ফোন রাখলেন। বলতে লাগলেন, ছেলেটা ফোন দিয়েছে এখন একটা ঔষধ খাওয়ার সময়তো, তাই খেয়েছি কি-না জানতে চাইল। বললাম, আপনার বর্তমান অবস্থা সন্তানরা কিভাবে নিয়েছে? উত্তরে বললেন, সন্তানরা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। তাদের বাবা সুস্থভাবে এখনও বেঁচে আছেন, কর্ম করছেন সেটাই তাদের কাছে বড় পাওয়া। আপনাদের আমীর ছাহেব আমাকে একটা বই দিয়েছেন বলেই ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বইটা দেখালেন। বললাম, বইটা আপনি পড়বেন, পরিবারের সদস্যদেরও পড়তে বলবেন। অনেক কিছু শেখার আছে এতে।
ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা ‘আল-আওন’র সহ-সভাপতি জাহিদ বললেন, আজ সকালে আসার পথে উনি গোলাপ শাহ মাযারে সালাম দিয়েছেন! বললাম, তাই নাকি ভাই? আচ্ছা আপনার নামটা তো জানা হ’ল না? আমার নাম আব্দুল মজীদ ভান্ডারী। ভান্ডারী কেন? আমি ওখানকার মুরীদ।
তারপর তাওহীদ-শিরক, গোলাপ শাহ মাযার, পীর-মুরীদির অসারতা, আল্লাহর উপরই সর্বদা ভরসা করা, রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে আক্বীদা ইত্যাদি বিষয়ে যৎসামান্য জানি বললাম। তিনি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করে বললেন, এভাবে তো কেউ কখনও বুঝায়নি। আপনার কথাগুলোতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আজ ইফতারের পূর্বে আপনাদের আমীর ছাহেবের বক্তব্যও অনেক ভালো লেগেছে। আমি প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। এভাবে যদি সকলকে বুঝানো যেত আর সবাই সত্য বিষয়গুলো বুঝতে পারতো তাহ’লে সত্যিকারার্থে সমাজে জাগরণ সৃষ্টি হ’ত, সমাজটা আমূল পরিবর্তিত হ’ত। এখন থেকে আর খানকা-মাযারে যাব না। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করব। কথা বলতে বলতে ততক্ষণে বংশাল চৌরাস্তা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নামতেই হাসিমুখে ব্যাগগুলো নামাতে সাহায্য করলেন ড্রাইভার। ভালোভাবে চেহারার দিকে তাকিয়ে জীবনসংগ্রামে পোড় খাওয়া সদা হাস্যোজ্জ্বল পরিশ্রমী এক বাবাকে দেখলাম। যিনি তার তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পদ হারিয়ে পুনরায় পরিবার নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার ব্যয় ও পরিবারের খরচ যোগাতে আবার স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেছেন। দিন-রাত অতিবাহিত করছেন নতুন কোন স্বপ্ন ছোয়ার আশায়। বললেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে তিনি আমাকে ভালো রেখেছেন। আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহই আমাকে সম্পদ দিয়েছেন, তিনিই আবার নিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ!
ইফতার হিসাবে প্রাপ্য বিরানির কয়েকটি প্যাকেট ছিল। বললাম, এগুলো আপনি বাড়িতে নিয়ে যান (আমরা ইতিপূর্বে ইফতারসহ রাতের খাবার খেয়েছি)। তা নিতে হাসিমুখে কিছুটা অস্বীকৃতি জানালেও জোর আপত্তি করল না। সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে কয়েক মিনিটের পথ হাঁটছি আর ভাবছি জীবনের গতিটা কত বিচিত্র! সকাল বেলার ধনী যে ফকীর সন্ধ্যাবেলা। আলহামদুলিল্লাহ! যিনি আমাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক রেখেছেন। তাঁর অফুরন্ত নে‘মত দিয়ে আকন্ঠ নিমজ্জিত রেখছেন। সেই আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।
শিক্ষা: অহংকার সৃষ্টির জন্য শোভা পায় না। এই অধিকার শুধু স্রষ্টার জন্যই সংরক্ষিত।
– বেলাল বিন ক্বাসেম, তেজগাঁও, ঢাকা।