জীবনের বাঁকে বাঁকে

প্রতিশ্রুতি

একটি সত্য ঘটনা।
বাংলাদেশ নয়, ভিনদেশ।
গল্পটি একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের। পারিবারিকভাবে এঙ্গেজমেন্ট হল। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হল। অনুষ্ঠানের জন্য হল সাব্যস্ত করা হল। বিয়ের আগেই একদিন হঠাৎ মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ল। কিছুতেই তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মেয়েটির শরীরে একপ্রকার ইনফেকশন ধরা পড়ল। কিন্তু সমস্যা সেটি নয়। সমস্যা হল এই ইনফেকশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শরীর যে অ্যান্টিবডি উৎপাদন করেছে তা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে তার মস্তিষ্কের কোষগুলোকে আক্রমণ করে বসেছে। এমন সমস্যা তিন লাখে একজনের হয়। মেয়েটি সেই দুর্ভাগাদের একজন।
ডাক্তাররা ইনফেকশন সারালেন, কিন্তু অ্যান্টিবডিগুলো কিছুতেই মস্তিষ্ককে ছাড়বেনা। কবে মেয়েটির জ্ঞান ফিরবে, আদৌ ফিরবে কিনা কিছুই বলা যাচ্ছেনা। তবু ছেলেটি রোদবৃষ্টি মাড়িয়ে, দূর পথ পেরিয়ে প্রতিদিন আসে। হয়ত মেয়েটি আজ সুস্থ হয়ে উঠবে! তিনমাস চলে গেল চোখের পলকে। মেয়েটির কোন পরিবর্তন হলনা। তখন মেয়েটির বাবামা এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা ছেলেটিকে এঙ্গেজমেন্ট থেকে অব্যাহতি দিলেন। অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাকে আটকে রাখা তাঁদের বিবেকের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। তাঁরা তাকে শুভকামনা সহকারে বিদায় দিলেন যেন সে নতুন করে স্বপ্ন বোনা শুরু করতে পারে। কিন্তু দুদিন পরই সে ফিরে এলো।। কাকুতি মিনতি করে মেয়েটির বাবামায়ের পাশে থাকার অনুমতি চাইল।
একে একে তিনটি বছর গড়িয়ে গেল। তারপর একদিন মেয়েটি জেগে উঠল। কিন্তু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝা গেল তার মস্তিষ্কে সঞ্চিত সমস্ত তথ্যাদি উধাও হয়ে গিয়েছে। তাকে নবজাতক শিশুর মত বসা, দাঁড়ানো, কথা বলা, পড়া, লেখা সবই নতুন করে শেখাতে হবে। বাবামা ভাবলেন এবার হয়ত ছেলেটি হাল ছেড়ে দেবে। কিন্তু ছেলেটি পাশে রইল। মেয়েটিকে মোটামুটি সচল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চার বছর চলে গেল। তবু ওর স্মৃতিশক্তি ফিরে এলোনা। মেয়েটি স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়ল। অবশেষে তার ওপর মানসিক চাপ সরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে ছেলেটি মেয়েটিকে এঙ্গেজমেন্ট থেকে মুক্তি দিতে সম্মত হল।
পরবর্তীতে মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিল তার কিছু মনে না পড়লেও যে ব্যক্তি এত বছর চরম অসুস্থতার মাঝেও তার প্রতি আশা ছেড়ে দেয়নি তাকে বিয়ে করলে সে ভুল করবেনা। আট বছর অপেক্ষার পালা শেষে তাদের বিয়ে হল। সেই হলে যেখানে বিয়ে হবার কথা ছিল। মেয়েটি হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পায়নি। পুরনো স্মৃতি আর ফিরে আসেনি। মাঝে মাঝে মানুষ বা জিনিস চিনতে ভুল হয়। কিন্তু স্বামী সন্তান নিয়ে সে ভাল আছে। কারণ ছেলেটি তাকে সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একজন মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে।
পাশাপাশি ভাবছিলাম আমার দেখা সেসব নারীদের কথা যারা রূপবতী, গুণবতী, নিঃস্বার্থ এবং ত্যাগী। তবু তাঁরা মূল্যায়ন তো পান না বরং তাঁদের ত্রুটিগুলোকেই কেবল বড় করে দেখা হয়। অবিবাহিতা বোনগুলোকে রাজপুত্ররা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, তেত্রিশ বার পাল্লায় মেপে বাদ দিয়ে দেয় যদি কোন একটি বিষয়েও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের চেয়ে কিছু কম পাওয়া যায়। এটা হয়ত তাদের জন্য সহজ এজন্য যে বিয়েটাকে এখন তেমন কেউ ইবাদাত হিসেবে দেখেন না। হিসেব করেন না এটি সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরস্পরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। সুতরাং, বিয়ের সময় ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ নীতিটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। কোনদিকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা তো থাকেই না বরং আরো কি কি পাওয়া যেতে পারত সে হিসেব করে নিজেকে এবং বিবাহিত সঙ্গীকে অসুখী করার সমস্ত আয়োজন পাকাপোক্ত করা হয়। অথচ যদি একবার আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতাম, তাহলে হয়ত সঙ্গীর ব্যপারে ভেবে অবাক হতাম, সে আমাকে হজম করে কিভাবে? হৃদয় কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে যেত আমাদের প্রভু আমাদের এমন একজন বন্ধু মিলিয়ে দিয়েছেন বলে। পার্থিব স্বার্থগুলোকে অতিক্রম করে আমরা দেখতে পেতাম তার বন্ধুত্ব আমাকে কি এক অপূর্ব আলোকিত পথের দিকে আহ্বান করছে। কেন আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও নিজেকে দেখতে পাইনা সেটা অবশ্য এক বিরাট রহস্য।
– রেহনুমা বিনতে আনিস

মন্তব্য করুন

Back to top button