জীবনের বাঁকে বাঁকে

ওজন বিড়ম্বনা

ক’দিন ধরেই হাফিজ সাহেব আমাকে ক্ষ্যপাচ্ছেন, কে যেন ওনাকে বলেছে, ‘হাফিজ ভাই, আপনার বৌটা বেশি শুকনা, একদম বেশি, বেএএএএএএএশি শুকনা!

সমস্ত দোষ সেই দীঘলদেহী ক্ষীণকায় ভদ্রলোকের যিনি কয়েকশ’ বছর আগে পৃথিবীর এত এত জায়গা থাকতে মাতৃভূমি ইরাক ছেড়ে এসে পৌঁছেছিলেন এই সুগোল, সুডৌল, সুস্বাস্থ্যবান মানুষের দেশেযখন তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে অবতরণ করেন তখন তাঁর উদ্দেশ্য একটি সম্মানজনক জীবিকা উপার্জন ছাড়া তেমন খারাপ কিছু ছিলোনাকিন্তু অন্যায়টা করে বসলেন যখন তিনি ভবিষ্যৎ বংশধরদের বিড়ম্বনার কথা না ভেবে এই দেশে বিয়েশাদী করে শেকড় গেঁড়ে বসলেনএই বিড়ম্বনা হতে মুক্তির উপায়ের অন্বেষনে আমার প্রয়াত চতুর্থ চাচা পটিয়ায় সংরক্ষিত বংশতালিকা নিয়ে গবেষনায় বসেছিলতবে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিশ্চিত হয়ে ফিরে আসে যে সেই ভদ্রলোক নিজে ‘চিকন কাজী’ হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং পরবর্তী বংশধরদের gene এর ভেতর দিয়ে তাঁর এই অসাধারন বৈশিষ্ট্য স্থায়ী হবার ব্যাবস্থা করে দিয়ে যানপিতামাতা উভয় দিক থেকে এই ভদ্রলোকের বংশধর হবার কারণে উক্ত বৈশিষ্ট্য আমার মাঝে প্রকটিত হয়তাহলে এখানে আমার কি দোষ থাকতে পারে?

আমি জন্মেছিলাম অত্যন্ত ভাল স্বাস্থ্য নিয়ে, জীবনে একসময়ই আমার সুস্বাস্থ্যের গৌরবগাঁথা রচনা করার সুযোগ ছিল, কিন্তু তখনও লিখতে শিখিনি, ‘অ্যাঁ অ্যাঁ’ ছাড়া বোধগম্য কিছু বলতেও পারতাম না, আফসোস! যতদিনে মোটামুটি বলতে, পড়তে, লিখতে পারার উপযোগী হয়েছি ততদিনে বড়দাদাজান আমার ওপর ভর করে বসেছেনএই অবস্থা প্রথম টের পাই ডেমরা গিয়েওখানে এককালে বাপজানের জমি ছিল, চাষী না হয়েও চাষাবাদের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহের কারণে কেনাতা একবার বাবা আমাকে নিয়ে ডেমরা গেল জমি দেখতেতখন আমার বয়স সাত বা আটওখানে পৌঁছে কাকে যেন খুঁজতে গেল বাবাআমাকে বলে গেল ছাতাটা নিয়ে দাঁড়াতেচারপাশে ধানক্ষেতবাতাস বইছে হু হু করেপুরো শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে বাতাসেমনে হোল উড়ে গিয়ে জমির মধ্যখানে পড়বছাতার ডান্ডাটা মাটিতে গেঁড়ে প্রাণপণে ধরে দাঁড়িয়ে রইলামসত্যি সত্যি যদি উড়ে গিয়ে জমিতে পড়ি, এই ভয়ে!

আমার বয়স যখন দশ এগার তখন ইথিয়োপিয়াতে চরম দুর্ভিক্ষ চলছেপ্রতিদিন হাজার হাজার শিশুসহ অসংখ্য লোক না খেয়ে মারা যাচ্ছেবাহরাইনের বান্ধবী সারা উইকহাম অক্সফামের নিলামে বিক্রি করে টাকা সংগ্রহের জন্য স্ট্যাম্প সংগ্রহ করছেআমি ওর বিশিষ্ট সহযোগীআবুধাবী বসে শত শত স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে প্রসেস করে পাঠাই ওকেএই পরিস্থিতিতে একদিন এক দাওয়াতে বরাবরের মতই আমি খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাবার সাথে ঝামেলা করছি, একজন আমাকে দেখে মন্তব্য করে বসল, ‘কিরে ভাই, আপনার মেয়েকে দেখে তো মনে হচ্ছে ইথিয়োপিয়া থেকে এনেছেন! ব্যাস, আমার নাম হয়ে গেল ইথিয়োপিয়া! দুর্ভিক্ষ শেষ হোল একসময়, কিন্তু নাম আর পিছু ছাড়েনা

ক্লাস নাইনে আমাদের ক্লাসে এক নতুন বান্ধবী এলো, নাম শায়লাক্লাসে সবাই ওকে ক্ষ্যাপাতাম ওর সুস্বাস্থ্যের জন্যএকদিন বিকেলে শায়লা আমাকে ফোন করল, ‘শোন, আজ অনেক লোকজন বাইরে যাচ্ছেতবে তুমি কিন্তু যেওনাগেলে আমাকে খবর দিও, আমিও তোমার সাথে যাব’

বললাম, ‘কি সুন্দর বাতাস আজকে! জানাল দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সাগরপাড়ে অনেক লোকজন হাওয়া খেতে আসছেআমরাও একটু পর যাবআমাদের তো বাসার সামনে রাস্তাটা পার হলেই সমুদ্র, তুমি আবার এতদুর থেকে কষ্ট করে আসতে যাবে কেন?

‘তোমার জন্যতুমি যদি বাতাসে উড়ে যাও! তোমাকে আমার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাব’

মাদ্রাজ ছিলাম চারবছরওখানকার লোকজনের মাশাল্লাহ পিলারের মত স্বাস্থ্য, আগাগোড়া সব সমানসারাজীবন কোনপ্রকার আমিষ স্পর্শ না করে যে ওরা কি করে এমন বিশাল স্বাস্থ্যের অধিকারী হয় কে জানে! প্রতিদিন প্রতিবেশীরা হা হুতাশ করতেন, ‘আহারে তুমি শুকিয়ে যাচ্ছ! আর আমি মনে মনে ভাবতাম, ‘এমনই তো ছিলাম, শুকালাম কবে? তবে একবার এক ঘটনায় খুব মজা পেয়েছিলাম

একদিন রাতে, আনুমানিক সাড়ে দশটা এগারটায়, নীচতলায় প্রচন্ড শব্দ শুনে কোন অঘটন ভেবে আমরা সবাই দৌড়ে গেলামগিয়ে দেখি আশেপাশের প্রতিবেশীরাও উঁকিঝুঁকি করছেআঙ্কেল আন্টি নির্বিকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেনজিজ্ঞেস করলাম কিসের শব্দ হোল, তাঁরা নিষ্পাপ চেহারা করে বললেন, ‘কই, আমরা তো কোন শব্দ শুনিনি!

কেমন যেন রহস্যময় মনে হোল ব্যাপারটাপরদিন সকালে আন্টিকে তরকারী দিতে গেলে তিনি বললেন, ‘শোন, কাল রাতে এত মানুষের সামনে আর বলিনি ঘটনাটাছেলে ঘুমিয়ে পড়লে বারান্দায় এসে দেখি তোমার আঙ্কেল দোলনায় বসে হাওয়া খাচ্ছেভাবলাম দু’জনে একটু রোমান্টিক সময় কাটাই, পাশে এসে বসলাম একটু গল্প করার জন্যতুমি তো দেখেছ আমরা সবাই একটু স্বাস্থ্যবানতা আমি বসতেই দোলনা দড়ি ছিঁড়ে সশব্দে পড়লআমরা ব্যাথা পেয়েছি কি না পেয়েছি সব ভুলে গিয়ে তড়িঘড়ি করে দোলনা লুকালাম কেউ দেখে ফেলার আগেবিশ্বাস কর, কোমরের ব্যাথায় ঘুমাতে পারিনি সারারাতকিন্তু শুধু লোকজন বুঝতে পারবে বলে দু’জনে বেশ ভাল মানুষের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম যখন সবাই ছুটে এলে’

বাহ! এর চেয়ে আমরাই কি ভাল নেই?

সৃষ্টিকর্তার বড় অদ্ভুত সেন্স অফ হিউমারআমার বিয়ে হোল ঠিক আমার দ্বিগুন ওজনের অধিকারী ব্যাক্তির সাথেভাবলাম, ‘আহা, এমন মোটা একটা লোক আমার বর! তারপর উনি আমাকে ঢাকা নিয়ে গেলেন আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতেওনার বিভিন্ন সম্পর্কের ভাইবোনদের দেখে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, ‘না, আমার বর বেশ শুকনা! তা একদিন কাজ শেষে দু’জনে রিক্সায় করে বাসায় আসছি, দিক থেকে দেখলাম বড় আপা রিক্সায় চড়ে কোথায় যেন যাচ্ছেনখানিকক্ষন পর বড় আপা ফিরে এসে আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘যাবার সময় দেখলাম হাফিজ বাসায় আসছে, তুমি কখন এলে? দু’জন একসাথে এলেই তো পারতে!

বললাম, ‘একসাথেই তো এলাম!

উনি বললেন, ‘কি বল? আমি তো রিক্সায় শুধু ওকে দেখলাম!

আমি আস্তে করে বললাম, ‘পাশে আমি ছিলাম, কিন্তু ওনার সাইজের কারণে আপনি আমাকে দেখতে পাননি

একবার ইন্ডিয়া বেড়াতে গেলামমেজ ননদও একই সময় গিয়েছেকলকাতা নিউ মার্কেটে যাব বলল, ‘ভাবী, কলকাতার রাস্তাঘাট ভাল না, আপনি রাদিয়াকে আমার কাছে দিয়ে যান’যেহেতু সাথে বাচ্চা নেই, পয়সা বাঁচানোর জন্য বাসে উঠলামএকটু পর বাস সামান্য ঝাঁকি দিল, সবাই আলুর বস্তার মত সামান্য একটু ঝাঁকি খেয়ে আবার জায়গামত বসে পড়লকিন্তু আমি চলে গেলাম মধ্যাকর্ষন শক্তির আওতার বাইরেযদি বাসে ছাদ না থাকত তবে সেদিন আমি পাখির মত উড়ে যেতে পারতামপুরো বাসের যাত্রীরা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেনকি যে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা!

ইউনিভার্সিটিতে চাকরী করতে গিয়ে কয়েকবার ধরা খেয়ে বলেকয়ে অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে শুরু করলামকোন নতুন ব্যাচ এলে প্রথমদিন ক্লাস নিতে যাবার আগে আতঙ্কে ভুগতামশেষে একদিন বিরক্ত হয়ে হেড স্যারকে বললাম, ‘স্যার, স্টুডেন্টদের মত শিক্ষকদের আই ডি কার্ডের ব্যাবস্থা করা হলে ভাল হয়’

স্যার বললেন, ‘কেন?

জানাতে বাধ্য হলাম, ‘স্যার, দুই বাচ্চার মা হলাম, এখনও যদি স্টুডেন্টরা জিজ্ঞেস করে, ‘অ্যাই, তুমি কোন সেমেস্টারে পড়?, মেজাজটা ভীষণ খারাপ হয়’

স্যার বললেন, ‘রেহনুমার জন্য আই ডি কার্ড তৈরীর ব্যাবস্থা করা হোক, ‘রেহনুমা বিনত আনিস, দুই বাচ্চার মা’!

কি আর বলব দুঃখের কথা!

ক্যানাডা এসে হাফিজ সাহেব আরো স্বাস্থ্যবান হলেন, আমার মেয়ে আমাকে ওজনে ছাড়িয়ে গেল, আমি অপরিবর্তিতই আছিকন্যা আমাকে দেখে হাসে, ‘আম্মু, তুমি যাই পর মনে হয় হ্যাঙ্গারে ঝুলছে! কি করব? পৃথিবীর তাবত পোশাক মনে হয় স্বাস্থ্যবানদের মাপে বানানো হয়যতগুলো অ্যাড দেয়া হয় স্বাস্থ্য কমানোর জন্য তাতে মনে হয় আমি এবং আমাদের মত লোকজন এখন একটি বিলীয়মান প্রজাতিসে যাই হোক, আমরাও কম যাইনাআমরা যেকোন জায়গায় বসতে পারি, যেকোন পোশাক পরতে পারি, যেকোন খাবার খেতে পারি এবং তারপরও রোগমুক্ত থাকতে পারি!

আমার অনেক ছাত্রী আফসোস করত পৃথিবী, বিশেষ করে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এবং মিডিয়া, মানুষকে অসহায় করে ফেলছেতারা একটি standard বেঁধে দিচ্ছে আমাদের ওজন কত হওয়া উচিত, প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাপ কেমন হওয়া উচিত, আমাদের কেমন পোশাক পড়া উচিত, চেহারার মেকাপ কেমন হওয়া উচিতসব, সবকিছু তারা নিয়ন্ত্রণ করছেঅথচ প্রতিটি মানুষের গঠনশৈলী আলাদা, রুচিপছন্দ আলাদা, শারিরীক এবং মানসিক প্রয়োজনগুলো ভিন্ন এবং এই পার্থক্যগুলোই পৃথিবীকে এত রঙ্গিন করে তোলেআমার ওজনে আমি দিব্যি চলে ফিরে বেড়াচ্ছি অথচ আমার প্রায়ই ক্লাস ফেলে দৌড়াতে হত কারণ slim and beautiful হবার চেষ্টায় দিনের পর দিন না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে চলা ছাত্রীরা ফিট (faint) হয়ে পড়তকারো শরীর যদি অধিক ওজন ছাড়া অচল হয়ে পড়ে তবে তাকে ওজন বেঁধে দেয়ার অধিকার কি কারো আছে নাকি থাকা উচিত? প্রতিটি মানুষের চেহারা যদি মেকাপের আস্তর দিয়ে ঢেকে একাকার করে দেয়া হয় তাহলে সৃষ্টির এই অবাধ বৈচিত্র, এই অপার সৌন্দর্য আমরা appreciate করব কি করে? সুতরাং, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই অপশক্তিকে না বলিআমি যেমন সেভাবেই যারা আমাকে গ্রহণ করবে তাদের ভালবাসি এবং অন্যদের আলাদাভাবে ভাবতে শেখাই যেন তারা খোলসের পরিবর্তে আসল মানুষটাকে মূল্যায়ন করতে শেখেন

মন্তব্য করুন

Back to top button