জীবনের বাঁকে বাঁকে

জিসিসি ভাবনা

আমরা যারা বসে কাজ করতে করতে চেয়ারের সাথে শেকড় গজিয়ে ফেলার জোগাড় তাদের সচল করে তোলার লক্ষ্যে ২০০৪ সাল থেকে একটি সংস্থা প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল কর্পোরেট চ্যালেঞ্জ বা জিসিসি নামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। এই প্রতিযোগিতার নিয়ম হোল বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা প্রতি সাতজন মিলে একটি দল গঠন করবে, প্রতিযোগীদের প্রত্যেকে গ্রীষ্মকালের ১০০ দিনব্যাপী প্রতিদিন অন্তত ১০,০০০ কদম হাঁটবে, বেশি হলে আরো ভাল। প্রত্যেক প্রতিযোগীকে দু’টি করে পিডোমিটার দেয়া হবে, ছোট্ট একটি মেশিন যা মোজা থেকে পকেট যেকোন জায়গায় চুপচাপ বসে প্রতিটি কদম গুনতে থাকবে। চব্বিশ ঘন্টা পার হলে প্রত্যেক প্রতিযোগী তাদের একদিনে কত কদম হাঁটা হোল তা জিসিসির ওয়েবসাইটে নিজের অ্যাকাউন্টে নথিবদ্ধ করবে, তারপর আবার পিডোমিটার রিসেট করে শূন্য থেকে গোণা শুরু করবে। ফলাফল নির্ধারিত হবে পুরো গ্রুপের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে। এই প্রতিযোগিতা পৃথিবীব্যাপী একই দিনে শুরু হয়, একই দিনে শেষ হয় এবং ফলাফল নির্ধারিত হয় আন্তর্জাতিকভাবে। তবে কেউ শুধু নিজের দেশে বা নিজের কোম্পানীর হিসেবে নিজের দলের অবস্থান দেখতে চাইলে তাও দেখতে পারেন। আবার এই প্রতিযোগিতায় যত কদম হাঁটা হোল তত কদম পৃথিবীব্যাপী হেঁটে বেড়ালে আমরা কোথা থেকে কোথায় পর্যন্ত যেতে পারতাম সেটার একটা চিত্র দেয়া হয়।

আমাদের গ্রুপের মেগান যখন বলল সে দল গঠন করতে চায় তখন আমি আগ্রহ দেখাইনি। কোম্পানীগুলো এই উদ্যোগ নিয়ে থাকে কর্মচারীদের দীর্ঘসময় বসে থাকার ফলে সঞ্চিত মেদ কমিয়ে অপেক্ষাকৃত সুস্বাস্থ্যবান করে তোলার লক্ষ্যে। আমি এমনিতেই আন্ডারওয়েট, আমার এখানে কি কাজ?! তারপরেও শেষপর্যন্ত তালে পড়ে নাম দিলাম, মানুষের মানসিকতাই হোল ঝাঁকের সাথে চলা। প্রথমদিকে সবারই উৎসাহ উদ্দীপনা, শক্তি, সামর্থ্য বেশি থাকে। পরের দিকে লোকজন ঝিমিয়ে পড়ে কিংবা যেমন আমার ক্ষেত্রে বলা যায় নেতিয়ে পড়ে। সম্পূর্ন একশ দিন পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে প্রতিদিন গড়ে ১৩,০০০ কদম হেঁটেছে আমাদের গ্রুপের ক্যারি। এবারের গ্রীষ্মকাল ছিলো চরমভাবাপন্ন – কখনো প্রচন্ড বৃষ্টিবাদল, কখনো অতিরিক্ত গরম। সুতরাং সে বেশিরভাগ হাঁটাহাঁটি করেছে মলের ভেতর এবং চোখের নেশায় প্রচুর কাপড় কিনেছে যেগুলো ওর কোন কাজেই লাগবেনা। আমার প্রথমদিকে গড় ছিলো সাড়ে সাত হাজারের বেশি, শেষে এসে পাঁচ হাজারের কিছু বেশিতে ঠেকে। বিল আর অ্যানা দেখা গেল দিনের পর দিন কোন এন্ট্রিই দেয়না, আবার আমরা কষে বকা দিলে তাড়াতাড়ি সবদিনের হিসেব জমা দেয়। মেগান বেচারী অনবরত নতুন নতুন টার্গেট সেট করে, উৎসাহব্যাঞ্জক মেসেজ দিয়ে আমাদের উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে শেষমূহূর্ত পর্যন্ত। ফলে পৃথিবীব্যাপী দলগুলোর তালিকা ২০০০ পৃষ্ঠার কিছু বেশি দীর্ঘ হলেও আমাদের অবস্থান ছিলো পাঁচশতম পৃষ্ঠায় যেটা খুব একটা খারাপ নয়। আর শুধু আমাদের কোম্পানীর দলগুলো ধরলে দশ পৃষ্ঠার তালিকায় আমরা ছিলাম দ্বিতীয় পৃষ্ঠার ওপরের দিকে। যারা ফিল্ডে কাজ করে তারাই প্রথম পেজ দখল করে ফেলেছে। আমরা যে পরিমাণ হেঁটেছি সে দূরত্ব প্যারিসের রাজপ্রাসাদ থেকে হিসেব করলে আমরা ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া, উত্তর অ্যামেরিকা ঘুরে দক্ষিণ অ্যামেরিকা পর্যন্ত পৌঁছেছি!

যেদিন প্রতিযোগিতা শেষ হোল তার পরদিনই শুরু হোল প্রচন্ড তুষারপাত। অসময়ের এই তুষার শীতকালীন তুষারের মত শুষ্ক বা গুঁড়ি গুঁড়ি নয় বরং ভেজা, ভারী এবং আঠালো। সাধারনত তুষারপাতের ভেতর দিয়ে নির্বিঘ্নে হাঁটা যায়, জামাকাপড় ভিজেনা, ঠান্ডা লাগেনা, বাতাসের সাথে বালিয়াড়ির মত ভেসে যায় তুষারকণা। কিন্তু এবারের তুষার দেখলাম চামড়ায় শুলের মত বিঁধে, বাড়ীঘর, গাছপালার ওপর তুষারের স্তুপ জমে সব একদিনেই শ্বেতশুভ্র বসন ধারণ করল। পরদিন দেখা গেল ভেজা তুষারের ভারে শত শত গাছের ডালপালা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে পুরো গাছই ম্যাচের কাঠির মত ভেঙ্গে পড়েছে, অনেক জায়গায় ইলেকট্রিসিটির লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে ট্রাফিক লাইট পর্যন্ত বন্ধ! গ্রীষ্মের প্রানবন্ত রঙ্গীন দিনগুলো এক নিমিষে কোথায় হারিয়ে গেল!

দৃষ্টিসীমা যখন আবদ্ধ হয় যায়, মনের দরজা তখন স্মৃতির আঙ্গিনায় খুলে যায়। প্রতিযোগিতার পর্যালোচনা করছিলাম মনে মনে। ভাবছিলাম, ‘আহা! অমুকদিন যদি আলসেমী করে না ঘুমাতাম বা অমুকদিন যদি কষ্ট করে আর মাত্র পাঁচশ কদম বেশি হাঁটতাম কিংবা অমুকদিন যদি গ্রীষ্মের গরম উপেক্ষা করে একটু হাঁটতে বেরোতাম, তাহলে হয়ত আজ আমরা দক্ষিণ অ্যামেরিকা অতিক্রম করে যেতে পারতাম!’ মানুষের মন স্বাভাবিকভাবেই কল্পনাপ্রবণ। ভাবনার ডালপালা বেয়ে মন যে কোথা থেকে কোথায় চলে যায় তাকে কোন ছকে ফেলা যায়না। প্রতিযোগিতাটা তখন আমার মনের স্ক্রিনে হয়ে গেল আমাদের এই জীবন। প্রতিটা মূহূর্ত এখানে সময় মাপা। বলাকওয়া ছাড়াই একদিন হুট করে বেজে উঠবে শেষের ঘন্টা। তখন ফলাফল পর্যালোচনা করতে গিয়ে তখন মনে হবে, ‘হায়! আমি যদি নামাজের ব্যাপারে গড়িমসি না করতাম, যদি প্রতিদিন ভোরে কুর’আন পড়ে নিজের কর্তব্যগুলো নির্ধারন করে নিতাম, যদি বাজে আড্ডা দিয়ে সময়টা নষ্ট না করতাম, যদি গরম উপেক্ষা করেও রোজাগুলো রাখতাম!’ কিন্তু সময় শেষ হয়ে গেলে পুরো পৃথিবীর বিনিময়েও সেই হিসেব এক কদম বাড়ানো বা কমানো যাবেনা! কি ভয়াবহ! অথচ আমরা এখনো ধরে বসে আছি, সময় আছে! জিসিসি তো প্রতিদিনই জানাত ক’দিন সময় বাকী আছে, তবু আমরা শেষ পর্যন্ত করব করছি করে সময় হারিয়ে ফেলেছি। আর যে সময়টার সীমারেখা আমাদের আদৌ জানা নেই সেটা তো পার করা উচিত এই আশংকায় যে হয়ত এটাই আমার শেষ মূহূর্ত! অথচ আমরা অস্থায়ী চাকচিক্যের পেছনে ছুটে কি নির্দ্বিধায় ধ্বংস করে ফেলছি সাফল্যের সকল সুযোগ!

ভাবছিলাম ক্যারীর কথা। পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায়ের প্রতিমূর্তি যেন! অথচ প্রতিযোগিতার শেষে ওর মন প্রচন্ড খারাপ, ‘কদমের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মলে মলে ঘুরতাম, এদিক সেদিক চোখ যেত, কত কিছু যে কিনে ফেলেছি! অথচ এখন দেখছি এর কোনটাই কাজের জিনিস নয়’। কত অসাধারন মানুষ দেখি আশেপাশে যাদের মেধা, শ্রম, অধ্যাবসায় আমাকে চমৎকৃত করে। তাদের জীবনে সব আছে, নেই শুধু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। কল্পনা করতেই গা শিউড়ে ওঠে, যদি শেষের ঘন্টা বাজার পর আবিষ্কার করি এক জীবনে যা সঞ্চয় করেছি তা কেবল গাদ আর আবর্জনা! অনেক কাজই আমরা করি যেগুলোর পেছনে কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকেনা, ফলে এর কোন দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল পাওয়া যায়না। আবার অনেক কাজই করা হয় উত্তম উদ্দেশ্য নিয়ে, তারপর হঠাৎ একটা বেসামাল কথা বা আচরন সব শেষ করে দেয়! সামাজিক সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে ‘সাবধানের মার নেই’ কথাটা ঠিক প্রযোজ্য নয়। কে কিসে আঘাত পেয়ে গেল সেটা সবসময় আমার ওপর নির্ভর করেনা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোলকিপারও সব গোল বাঁচাতে পারেনা। কিন্তু ফলাফলের দায়ভারটা তো যায় তার ঘাড়েই! আমার কাজের বোঝা আমি বহন করতে পারব তো? ভাবতেই শরীর কাঁপতে থাকে।

কিছু মানুষ আদতেই অলস, যেমন বিল আর অ্যানা। এরা হাঁটবে ঠিকই, কিন্তু এদের হাঁটানোর জন্য প্রয়োজন মেগানের মত একজন গাইড যে কখনো উৎসাহ দিয়ে, কখনো বকা দিয়ে তাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এজন্যই দলবদ্ধ জীবন এতটা গুরুত্বপূর্ন। কারণ ভুলোমন বার বার আমাদের বিপথে নিয়ে যেতে চায়। সে সময় প্রয়োজন এমন একটা হাত যে শক্ত করে আমাকে ধরে রাখবে, যেভাবে বাচ্চারা চলন্ত গাড়ীর মাঝে রাস্তায় ছুটে যেতে চাইলে মা তাদের দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে, কিছুতেই হাত ছাড়েনা। এজন্য উত্তম বন্ধু নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। হ্যাঁ, অনেক সময় তাদের ওপর রাগ হয়, সেটা হোক যৌক্তিক বা অযৌক্তিক, অনেক সময় তাদের আচরনে বিরক্তি আসে, অনেক সময় তাদের কীর্তিকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে যাই। কিন্তু দিন শেষে তাদের সাথেই যে হবে আমার পুণরুত্থান। সেক্ষেত্রে সেই বিরক্তিকর বন্ধুটির সাথেই আমি পুণরুত্থিত হওয়া শ্রেয় মনে করব যে আমাকে বার বার নামাজের তাগাদা দিত, তার সাথে নয় যার গান আমাকে নামাজের কথা ভুলিয়ে রাখত।

আসলে এই জীবনের রঙ রূপ গন্ধ স্পর্শের বাহার আমাদের এর আসল লক্ষ্য ভুলিয়ে রাখে। এরই মাঝে একদিন হুট করে বসন্ত শেষ হয়ে নামে মৃত্যুর হিমশীতল নীরবতা। ফের মৌসুমে আবার জেগে উঠে আমরা দেখতে পাব কি ফসল বুনেছি। কাঁটালতা গজিয়ে গেলে তখন আর নিড়ানো যাবেনা। তাই এখনই সচেতন হবার সময় আমরা কিসের বীজ বুনছি।

জানালা থেকে চোখ ফেরাতেই মনটা ফিরে আসে বাস্তবতায়। সংকল্প করি, এই ক্ষণিক বাস্তবতাকে আর কিছুতেই স্থায়ী বাস্তবতার ওপরে প্রাধান্য দেয়া যাবেনা। কিন্তু মন যে বড় দুর্বল! উপলব্ধি আর সংকল্প ক’দিন স্থায়ী হয় সেটাই দেখার বিষয়।

মন্তব্য করুন

Back to top button