জীবনের বাঁকে বাঁকে

কিছু কথা…

জন্মের পর প্রথমেই আযানের সুমধুর সুরে আল্লাহ তা’য়ালার পবিত্র নামটি শুনেছি, তারপর পৃথিবীটাকে দেখেছি এবং আলো-বাতাস গায়ে মেখেছি। সুবহানাল্লাহ! দুনিয়ায় আসার শুরুটা কত সৌভাগ্যের ছিল…

 

কিন্তু তারপর কেউ আর অমন করে সৃষ্টিকর্তার নাম শোনায়নি কখনো। বর্ণমালার বই হাতে ধরিয়ে পড়িয়েছিল-

 

‘অ- তে অজগর, অজগর ঐ আসছে তেড়ে

আ- তে আম, আমটি আমি খাব পেড়ে’।

 

সবাই কোলে নিয়ে দাদা, নানা বলা শিখিয়েছে কিন্তু প্রিয়নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম কেউ আর উচ্চারন করেনি। ছোট থাকতে মা-বাবা ঘুম পাড়িয়েছে ভূতের ভয় দেখিয়ে। কাঁদলে বলেছে ঐ যে বাঘ আসছে চুপ করো। সবাই অনেক বড় হওয়ার কথা বলেছে কিন্তু পথ দেখায় নি। বুদ্ধিবৃত্তির কেবল অঙ্কুর প্রস্ফুটিত হওয়া শুরু করেছে, ঠিক তখনি শিক্ষকেরা শিখিয়েছিল-

 

“হাট্টিমাটিম টিম

তারা মাঠে পাড়ে ডিম

তাদের খাড়া দুটো শিং”।

 

অদ্ভূত সেই হাট্টিমাটিম জন্তু দেখার স্বপ্নে যখন বিভোর হয়ে আছি, তখন জানতে পারি এই নামে শিংঅলা কোন প্রাণী নেই যারা ডিম পাড়ে। কিশোর মনে অবিশ্বাসের সূচনা এভাবেই….। এরপর বড় হতে থাকলাম। দুনিয়ার প্রতারনার পরিমানও বাড়তে থাকল সমান অনুপাতে। স্কুলে শিখলাম টিচাররা ক্লাসে আসলে দাড়িয়ে সম্মান জানাতে হয়। অথচ যে মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সৃষ্টি করলেন, তাকে সম্মান জানাতে টিফিন পিরিয়ডে সালাহ আদায় করতে হয়; এটা শিখালেন না।

 

ক্লাসের প্রতিযোগীতায় ফার্স্ট হতে মা-বাবা বাড়িতে টিউটর রেখে সারা রাত-দিন পড়াশুনায় ব্যস্ত রাখলেন কিন্তু পরকালের পরীক্ষায় পাস করবো নাকি ফেল করব সেদিকে একবারও নজর দিলেন না। পবিত্র কুরআন শরীফ হাতে দিয়ে বললেন না- “ইক্বরা বিসমি রব্বিকাল্লাযি খ্বলাক্ব’। মক্তবে পাঠিয়ে কোনরকমে কুরআন শরীফ শেখালেন ঠিকই কিন্তু সেই কুরআনের অর্থ শেখানোর ব্যবস্থা করলেন না। পবিত্র কিতাবটির অর্থ যদি সেই ছেলেবেলাতেই শিখতে পারতাম তাহলে হয়ত দীর্ঘশ্বাসের লেখাটি আজ লিখতে হতোনা।

 

এরপর স্কুলের গন্ডি পেড়িয়ে কলেজের আঙ্গিনায় পা বাড়ালাম। তখনও কেউ বলল না “তোমার চরিত্রকে হেফাজত করার এখন সবচেয়ে কঠিন সময়। আল্লাহ তায়ালার হুকুম আহকাম ঠিকমত পালন করতে না পারলে তুমি বিপথে চলে যাবে, পরিনামে তোমার স্থান হবে জাহান্নাম”। বরং ভয় দেখিয়েছে এই বলে- ‘দুবছর খুব সিরিয়াস ভাবে পড়াশুনা না করলে তোমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে’।

 

মুরুব্বিরাও কোন মেয়ের সাথে হাঁটতে দেখে বলেননি- ‘এমন করে মেয়েদের সাথে মেশা ইসলাম সমর্থন করেনা। এটা গুনাহর কাজ। তোমার এটা করা উচিত্‍ নয়’। বরং বড় ভাইরা উত্‍সাহ যুগিয়েছে এই বলে- ‘জোশ একটা বান্ধবী জুটাইছো তো’!

 

এভাবেই। জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে পাপের সুখময়তায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি নিজের অজান্তেই। মনের ভিতর কুরআনের আলো ছিলনা বলে অনেক চরিত্রবান, সত্‍ ও ধার্মিক সঙ্গীকে হারিয়েছি আধুনিকতার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে, আর অনৈতিক চরিত্রের ছেলেদের আপন করে নিয়েছি দুনিয়ার মোহে পড়ে। আহা, তখন যদি এসব বুঝতাম!

 

একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় হাঁটার সুযোগ পেলাম। মনের ভিতর আনন্দের বেগ বিদ্যুতের গতিতে উঠানামা করতে লাগল। সামনে স্বপ্নময় দিনের হাতছানি। কত যে রূপরেখা আঁকতে থাকলাম মনের আলপনায়! কিন্তু তখনো বুঝিনি জীবন মানে শুধু সুখময় স্বপ্ন দেখা নয়, বিলাসী জীবন যাপন করার স্বপ্নে বিভোর থাকা নয়। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে একজন ঈমানদারের জন্য কঠিন সব পরীক্ষা। অনুধাবন করলাম আমাদের মাঝে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা না থাকার ভয়াবহতা।

 

স্বাধীন জীবন পেয়ে অনেক সাথীরা উশৃঙ্খল জীবন যাপন শুরু করে দিল। স্রষ্টাকে বিশ্বাস করলে মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশার একটা ভয় থাকে বলে অনেককে দেখলাম সৃষ্টিকর্তা আছেন কিনা এ নিয়ে সন্ধিহান প্রকাশ করতে (নাউযুবিল্লাহ)। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম তাদের নি:শেষ হয়ে যাওয়া। অথচ এদের অনেকের সাথেই ওয়াক্তের নামাজ পড়েছিলাম একসময়। এমনকি দারসেও বসেছি একসাথে। জীবনে যে ছেলেটি কোনদিন মেয়ের সাথে কথা বলেনি তার মুখেও এখন শুনি- ‘প্রেম না করলে হচ্ছেনা দেখি’।

 

আধুনিক সভ্যতার পরিবেশ আমাদের আর ভাল থাকতে দেয়না। এই পরিবেশ এখন শহর পেরিয়ে গ্রামগুলোতেও প্রবেশ করেছে। আজ পিচ্চি পিচ্চি মেয়েরাও আধুনিকতার ব্যাপারে অনেক সচেতন হয়েছে। অবিভাবকরা স্কুলে রেখে যাওয়ার পর মেয়েটিকে দেখা যায় রিকশার হুডের ভিতর বয়ফ্রেন্ডকে (?) নিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বেড়াতে। এ কারনেই বোধহয় রমনার গেটে লেখা ‘স্কুল কলেজের ড্রেস পড়ে উদ্যানে আপত্তিকর অবস্থায় থাকা নিষেধ’। এর মানে কি? সরকার কি সিভিল ড্রেসে আপত্তিকর অবস্থায় থাকার অনুমতি দিয়ে দিল? মুসলমান অধ্যুষিত একটি দেশের জাতীয় উদ্যানের সতর্কবার্তার নমুনা যদি এমন হয়; তাহলে ছেলে মেয়েরা তাদের চরিত্রকে কলুষিত করবেনা কেন? সাইনবোর্ডের লেখাটা কি এমন হওয়া উচিত্‍ ছিলনা- ‘ছেলেমেয়েদের উদ্যান থেকে শুরু করে রাস্তা,ঘাট,মাঠ সব জায়গায় একসাথে বিচরন করা নিষেধ’।

 

কিছু ইসলামী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের কথা বাদ দিলে দুনিয়ার পরিবেশ আজ দূষিত। কেউ আর ভাল হওয়ার কথা বলেনা, ধর্মীয় চেতনা লালন করতে শেখায়না, কাউকে চরিত্রবান রূপে গড়ে তুলতে উত্‍সাহ দেয়না। দুনিয়াবি জীবন নিয়ে মানুষ গুলো আজ এতটাই সচেতন যে, তাদের অবচেতন মনটাকে অচেতন করে রেখেছে পার্থিব ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে। একারনেই হয়ত তারা ভূল পথ দেখায়, ভূল ব্যাখ্যা শেখায়। সভ্যতার নামে করে প্রতারনা। সেই শিশু বেলা থেকে আজ অবধি দুনিয়া হতে পাওয়া শিক্ষাগুলো কে আমার বড়ই ধোঁকা মনে হয়…..”।।

 

“তারা আল্লাহ এবং ঈমানদার গণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না”। [আল বাক্বারা:০৯]

 

“অবশ্যই যেসব লোক আমার সাক্ষাৎ লাভের আশা রাখেনা এবং পার্থিব জীবন নিয়েই উৎফুল্ল রয়েছে, তাতেই প্রশান্তি অনুভব করেছে এবং যারা আমার নির্দশন সমূহ সম্পর্কে বেখবর, এমন লোকদের ঠিকানা হল আগুন; সেসবের বদলা হিসাবে যা তারা অর্জন করছিল”।[সূরা ইউনুছ:০৭-০৮]

 


From A Brother

মন্তব্য করুন

Back to top button