জীবনের বাঁকে বাঁকে

যে আলোয় দেখেছি তারে

চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। যা অনিন্দ্যসুন্দর স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ। বড় মনোহর তার আলো আর অবয়ব, চাই সেটি পূর্ণ থালার অবয়বে হোক অথবা খেজুর বৃক্ষের শাখার ন্যয়। এটি বিলিয়ে চলে তার মাধুর্য্য। সম্ভবত আঁধারের মাঝেও পৃথিবীর একমাত্র যে বস্তুটির উচ্চকিত প্রশংসা করা যায় তা হল চাঁদ। কবির কাছে তা কখনও ঝলসানো রুটি, ভালোবাসার মানুষের কাছে তা প্রেয়সির মুখ- “চাঁদ চেহারা তোমার প্রিয়া/আঁখি দুটি গড়া বিজলী দিয়া”; ছোটবেলায় মায়ের কোলে অবোধ শিশুর মামা- “আয় আয় চাঁদ মামা/টিপ দিয়ে যা”। কত শত উপমায় ভূষিত হয়েছে আবার কত কাব্য রচিত হয়েছে যার গণনা এ অধমের পক্ষে সত্যিই অসম্ভব কাজ। একজন মুসলিমের কাছে তার ধর্মেও চাঁদের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। চাঁদের সাথে সম্পর্কিত হিজরী সাল যা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অনেক ইবাদাতের সাথে। রাসূল সাঃ এর হাদীস থেকে জানি, তিনি প্রতি চাঁন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোযা রাখতেন। এছাড়া নতুন চাঁদ দেখে পড়ার দোয়াও রয়েছে।

যাহোক, আজ আমি কিছুটা আলাদা বিষয়ে বলতেই কলম ধরেছি। বাংলাদেশের আকাশে বছরের তৃতীয়বারের মত সুপার মুনের অপরূপ সৌন্দর্য্যে পরশু মুগ্ধ হয়েছে অনেকেই যার মাঝে আমি নিজেও। পুরো চাঁদ যেন জ্বলজ্বল করছিল, যেন ঠিকরে বের করে দিচ্ছিলো তার দীপ্তি। বলা চলে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর চাঁদ। এর কারন এই নয় যে তা ছিল জ্বলজ্বলে ও দৃশ্যত বড় বরং চাঁদের কিছু বিষয় আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে, নতুনভাবে চিন্তার খোরাক দিয়েছে নিজের মাঝে। যেন হারিয়েগিয়েছি আজ থেকেও চৌদ্দশত বছর আগের কোন ক্ষনে, আর অধরা কোন সত্ত্বার সৌন্দর্য্যের অবগাহনে। তিনটি সংক্ষিপ্ত শিরোনামে তা নিচে তুলে ধরছি-

সৌন্দর্য্যঃ গতানুগতিক বা শাব্দিকভাবে নয়, প্রকৃত এক অপার্থিব, চিত্তাকর্ষক ও শীতল সৌন্দর্য্যে সেদিন যেন চোখ দুটো হয়েছে প্রশান্ত। যার জ্যোৎস্না আমায় করেছে নির্বাক। আমি সেই সময়ে উপলব্ধি করেছি কেন শত শত সাহাবী রাঃ রাসূল; সাঃ এর সৌন্দর্য্যকে তুলনা করেছেন পূর্নিমার চাঁদের সাথে।

জাবির ইবন সামুরা রাঃ বলেন-

এক চাঁদনী রাতে আমি নবী সাঃ দেখেছিলাম। সে সময় উনার পরনে ছিল লাল পোশাক। আমি একবার তাঁর প্রতি এবং একবার চাঁদের প্রতি তাকাচ্ছিলাম। অবশেষে আমি এসিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, তিনি চাঁদের চেয়েও অধিক সুন্দর। (শামায়েলে তিরমিযি;দারেমী; মিশকাত, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১৭)

বারা ইবনে আযেব রাঃ কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নবী করীম সাঃ চেহারা কী তলোয়ারের মত ছিলো? তিনি বললেন, না; বরং তা চাঁদের মত। অপর বর্ণনায় আছে, নবী করীমসাঃ চেহারা ছিল গোলাকার। (সহীহ বুখারী, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৫০২; সহীহ মুসলিমদ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৫৯)

কাব ইবন মালিক মালেক রাঃ বলেন-

নবী করীম সাঃ যখন খুশি হতেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠতো। দেখে মনে হত যেন এক টুকরো চাঁদ। (সহীহ বুখারী প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৫০২)

রাসূল সাঃ এর দৌহিত্র হাসান রাঃ বলেন, নবী করীম সাঃ এর সন্তুষ্ট চেহারা ছিল পূর্ণ চাঁদের ন্যয়। আবু বকর সিদ্দীক রাঃ উনাকে (রাসূল সাঃ) দেখে যে কবিতা আবৃত্তি করতেন তার অর্থ হচ্ছে-

“ভালোর পথেদেন দাওয়াত, পূরন করেন অঙ্গীকার

চতুর্দশীর চাঁদ, লুকোচুরি খেলে যেন অন্ধকার।“

উমার রাঃ উনার (সাঃ) সম্পর্কে যোহায়র রাঃ এর কবিতা আবৃত্তি করতেন যা হরমইবন সেনান সম্পর্কে লিখা হয়েছিল- তার অর্থ হচ্ছে-

“মানুষ যদি না হতেন আল্লাহর এ প্রিয়জন

চতুর্দশীর রাত তিনি করতেন তবে রওশন”

রাসূল সাঃ এর সাহাবীগন উনাকে যত বেশি চাঁদের সৌন্দর্য্যের সাথে মিলিয়েছেন সেই তুলনায় সূর্য্যের সাথে নিতান্তই কম। সীরাত গবেষকণ এ ব্যাপারে একটি দারুন কথা তুলে ধরেছেন-

“সূর্য্যের সৌন্দর্য্য তার ক্ষমতা আর শক্তির কারনে; যা কখনও অস্বস্তি বা ভীতির উদ্রেক করে। কিন্তু চাঁদের মাঝে, তার আলোর মাঝে রয়েছে- শুচি, শুভ্র প্রশান্তির আলোকচ্ছটা। এর মাঝে দিয়ে আরও একটি বিষয় অনুমেয় যে, রাসূল সাঃ এর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকাটা ছিল সত্যিই মনোমুগ্ধকর যা হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দিত।

হিজরতের সময়ে যখন রাসূল সাঃ মদীনায় পৌঁছেন তখন অনেক মানুষ উনাকে দেখার জন্যকাল বিলম্ব না করে ভীড় করেন। এর মাঝে আব্দুল্লাহ বিন সালাম নামক এক ইয়াহুদী ছিল যিনি পরে ইসলাম গ্রহন করেন। আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাঃ কথানুযায়ী রাসূল সাঃ এর সৌন্দর্য্য ছিল এরূপ-

“আমি প্রথম যখন উনার উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম তখনএক নজরেই বুঝেছি যে, এইটি কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। আর তখনই আমি সত্য সম্পর্কে অবগত হই এবং ইসলাম গ্রহন করি”

এই দুনিয়ায় রাসূল সাঃ এর সৌন্দর্য্যের সাথে কোন কিছুই তুলনীয় নয়। কিন্তুপরবর্তী জীবনে এই সৌন্দর্য্যের অনেকটা ভাগ পেয়ে যাবে বিশ্বাসীগন যারা সেদিন হবেমহা সৌভাগ্যবান। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তার পালনকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। (সূরা আলক্বিয়ামাহঃ আয়াতঃ ২২-২৩)

রাসূল সাঃ বলেছেন-

আমার উম্মতের মাঝে থেকে সত্তর হাজার লোকের একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে যাদের চেহারা হবে পূর্ণ (পূর্ণিমার) চাঁদের ন্যয় উজ্জ্বল। (সহীহ মুসলিম)

অপ্রতিরোধ্য/অনিরুদ্ধ আলোকমালাঃ চাঁদের সৌন্দর্য্য আরতার স্নিগ্ধতা যেন অপ্রতিরোধ্য। কোন কিছু দিয়েই তা রোধ করবার নয়। এরকম এক মেঘমুক্তরাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রাসূল সাঃ সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-

“সন্দেহাতীতভাবে তোমরা তোমাদের রবকে দেখবে যেমন এই চাঁদ দেখছো এবং দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হবেনা” (মুত্তাফাকুন আলাইহি)

রাসূল সাঃ আরও এক বর্ণনায় বলেন-

পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে তোমাদের কি পরস্পর ভীড় কর? সূর্য্য দেখতে কি তোমরা পরস্পরের মাঝে ভীড় কর? সাহাবীরা জবাব দিয়েছিলেন, না। রাসূল সাঃ বললেন, তোমরা অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালককে দেখবে; যেমন দেখ পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ এবংতোমাদের জটলা (ভীড়) করতে হবেনা” (তিরমিজী)

পরশু সুপার মুনের দিকে তাকিয়ে সেই হাদীসটির কথা বারবার মনে হয়েছে। সুবহানআল্লাহ! কতই না সুন্দর হবে সেই সময় যখন আমি দেখবো আমার রবকে। জান্নাতী নিয়ামতগুলোর মাঝে বান্দার জন্য এইটি অনেক বড় একটি নিয়ামত যে বান্দা তার প্রতিপালককে সচক্ষে দেখবে যাকে এতদিন না দেখেই গোলামী করে এসেছে। তাই রাসূল সাঃ তার স্পষ্টতা বা জ্বাজল্যমানতা বুঝাতে সাহায্য নিয়েছেন পূর্ণিমার চাঁদের। যেন আমরা আগ্রহী হই আরওঅনেক বেশি। রাসূল সাঃ দুয়া করতেন এই  বলে-

“হে আমার প্রতিপালক আমি চাই তোমার চেহারার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আনন্দিত হব এবং তোমার সাথে সাক্ষাত করবো”

দীপ্তিময়তাঃ চাঁদের আলোর রয়েছে এক মোহনীয় ঔজ্জ্বল্য যা সূর্য্যের আলো থেকে, তার তীক্ষ্ণ রশ্মি থেকে আলাদা। চাঁদের আলোয় পরস্পরকে দেখা যায়, বই পড়া যায় কিন্তু তা কখনই চোখ ধাঁধিয়ে দেয়না বা কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায় না।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনুল কারীমে চাঁদের আলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন- “কল্যাণময় তিনি, যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবংতাতে রেখেছেন সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্র”- (সূরা আল ফুরক্বান-আয়াতঃ ৬১)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূর্য্য এবং চাঁদের আলোর তফাৎ করার জন্য দুইটি আলাদা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি সূর্য্যকে বলেছেন “সিরাজ” অর্থাৎ এমন আলোক উৎস যার জন্য জ্বালানী প্রয়োজন হয়। বর্তমানে বিজ্ঞানের কল্যানে আমরা জানি যে সূর্য্যের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস রয়েছে যা তার আলোকের তীক্ষ্মতার কারন।

অপরপক্ষে চাঁদকে বলেছেন “মুনীর” যার অর্থ প্রদীপ্ত ও উজ্জ্বল। মুনীর শব্দটি এসেছে মূল শব্দ নূর থেকে যার অর্থ প্রতিফলিত আলো। আর বর্তমানে আমরা জানি যে চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই বরং সূর্য্যের আলো তার উপর প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে পৌঁছায়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে রাসূল সাঃ কে অভিহিত করেছেন এই দুইটি আলোর সাথেই অর্থাৎ তিনি একাধারে সিরাজ ও মূনীর। মহান আল্লাহ বলেন-

“হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।“ (সূরা আলআহযাবঃ আয়াত- ৪৫-৪৬)

রাসূল সাঃ ছিলেন এক প্রদীপ্ত বাতি। তিনি ছিলেন এমন বাতি যিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক সরবরাহকৃত রসদের মাধমে প্রজ্জ্বলিত। আবার তিনি (সাঃ) নিজেই জ্ঞান বা আলোর উৎস ছিলেন না বরং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দেখানো হিকমাহ ছিল উনার অবলম্বন। এ যেন প্রতিফলিত আলোর ন্যয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনে বলেছেন-

“আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একটি কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত, কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ্য। তাতে পুতঃপবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈলপ্রজ্বলিত হয়, যা পূর্বমুখী নয় এবং পশ্চিমমুখীও নয়। অগ্নি স্পর্শ না করলেও তার তৈল যেন আলোকিত হওয়ার নিকটবর্তী। জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে। আল্লাহ মানুষের জন্যে দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত” (সূরা আন নূর- আয়াতঃ৩৫)

আজ এই রাতেও আমি অপলক নয়নে ঐ আকাশের চাঁদকে দেখছি আর ভাবছি এই সৌন্দর্য্য, এই রূপ আর এই মাধূর্য্যের সবটুকুই সেই সত্ত্বার যিনি আরশে সমাসীন, যিনি আমার-আপনার প্রতিপালক আর প্রতিপালক শেষ রাসূলের (সাঃ) যার সৌন্দর্য্য অতুলনীয়। জীবনে বহুবার চাঁদ দেখেছি, তবে আজ রাতের চাঁদ যেন আমায় ভাবালুতায় মিশিয়ে দিল যেন হারিয়ে গেলাম এক অন্য জগতে।

– আবু নাসের

মন্তব্য করুন

Back to top button