তোমরা তোমাদের আক্রোশে মরতে থাকো…
শাহরিয়ার স্যার আগের দিনের সাডেন টেস্টের খাতাগুলো হাতে নিয়ে রুমে ঢোকা মাত্র ক্লাসের সকল ছাত্রী খুশি হয়ে উঠলো। এই একজন স্যারকে সবাইই খুব পছন্দ করে। এমন না যে বাকিদেরও অপছন্দ করে। কিন্তু শাহরিয়ার স্যার পড়ার মাঝে অন্যরকম একটা মজা এনে দেন। সবকিছুকে নতুন করে ভাবতে শেখান। বইয়ের গৎবাঁধা রচনার বাইরে লিখতে শেখান।
যেমন গত ক্লাসের ‘এইম ইন লাইফ’ প্যারাগ্রাফ লিখতে দেওয়ার ঘটনাটাই ধরা যাক। লিখা শুরু করার আগেই স্যার কয়েকটা ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিলেন, “আচ্ছা, টেক্সট বুকে লিখা আছে আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই’। তো এখন সব পরীক্ষায় কি এটাই লিখতে হবে? তোমাদের কারো কি মুরগির খামার করতে ইচ্ছা হয় না? সেলাই, বুটিক, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ইচ্ছা হয় না? ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা বা পাইলট হতে ইচ্ছা হয় না? মনকে প্রশ্ন করে দেখো। তারপর মনের কথা লিখতে থাকো। আমি প্রমিস করলাম, এই শাহরিয়ার চৌধুরির কলম থেকে তোমার জন্য প্রশংসা ছাড়া কিছুই বের হবে না।”
কথাটার শুরুর অংশ শুনে কেউ ফিক করে হেসে দিলেও শেষ দিকে এসে জাদুটা ধরতে পারলো। স্যারের কথা অনুযায়ীই কাজ করলো। খাতা জমা দিলো। পাশ হোক, ফেল হোক, পরীক্ষার খাতায় নিজের মনকে উজাড় করে দিতে পারার এই আনন্দের কোনো বিনিময় হয় না।
স্বভাবতই আজ স্যারকে সকল খাতা বগলদাবা করে ক্লাসে আসতে দেখে সব ছাত্রীই খুব এক্সাইটেড। প্রত্যেকেই ভাবছে তার ইউনিক আইডিয়াকে স্যার কীভাবে মূল্যায়ন করেন।
স্বভাবসুলভ আন্তরিক হাসি আর কুশল বিনিময় দিয়ে স্যার ক্লাস শুরু করলেন। তারপর একটা একটা করে খাতা ফেরত দেওয়ার আগে তাদের ভাবনাগুলোকে মূল্যায়ন করে কিছু উৎসাহমূলক কথা বললেন।
যেমন শাহনাজ হতে চায় সাংবাদিক। হলুদ সাংবাদিকতার লোভ আর হুমকির ভয় এড়িয়ে কীভাবে পরিচ্ছন্ন সাংবাদিকতা করা যায়, এ নিয়ে স্যার নাতিদীর্ঘ বয়ান দিলেন।
সিদ্দীকার ইচ্ছা শিক্ষক হওয়া। চলতে ফিরতে অক্ষম শিশু কিশোরদের ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় শিক্ষা দেওয়া যা তারা ঘরে বসেই শুনতে পারে। শারীরিকভাবে অক্ষম এই জনগোষ্ঠীকে কী কী কাজে লাগানো যায়, তা নিয়েও স্যার খুব চমৎকার কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন।
দীপার ইচ্ছা বন বিভাগে কাজ করার। পশু পাখি আর গাছকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রক্ষা করা মানুষের অস্তিত্বের জন্য কেন জরুরী, এ নিয়ে দেড় মিনিটে অসাধারণ কিছু কথা বললেন স্যার।
এভাবে করেই সকলের খাতা আস্তে আস্তে দেওয়া হতে লাগলো আর মাবরুরার টেনশন বাড়তে লাগলো। হঠাৎ মনে হয় পরেরটাই বুঝি তার খাতা। আবার মনে হয় তার খাতা বোধহয় স্যার হারিয়েই ফেলেছেন। নাকি ভুলে জমা না দিয়ে ব্যাগে করে নিয়ে গেছে সে? ব্যাগ হাতিয়ে দেখলো নেই।
অবশেষে স্যারের সামনে যখন আর একটা খাতা বাকি, তখন স্যার বললেন, “মাবরুরা?” ক্লাসের দিকে তাকালেন। শেষ বেঞ্চ থেকে কার্ফ পরা মেয়েটা হাত তুললো, “স্যার, আমি।” কিছুদিন ধরে সে অভ্যাস করছে আপাদের ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চে আর স্যারদের ক্লাসে শেষ বেঞ্চে বসা।
স্যার চশমাটা একটু নেড়েচেড়ে নিয়ে মুখের উপর নার্ভাস ভঙ্গিতে হাত বোলালেন। তারপর বললেন, “মাবরুরা, তুমি কি আসলেই গৃহিণী হতে চাও?” ক্লাসের মধ্যে একটা হাসির রোল উঠলো। কিন্তু পুরো ক্লাস হাসলো না, যারা হাসলো তাদের মধ্যেও অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত। যেই স্যার শেখালেন সবার মতামতকে সম্মান করতে, তাঁর সামনে একজন সহপাঠীর মতামত নিয়ে হাসাহাসি ঠিক হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
মাবরুরা দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বললো, “জ-জ্বি, স্যার।” স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে হাতের খাতাটার দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁর শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের কথা ভেবে সাহস সঞ্চয় করে মাবরুরা যোগ করলো, “আসলে স্যার আমাদের এইম ইন লাইফ তো হওয়া উচিত জান্নাতে যাওয়া। কিন্তু পরে মনে হলো এখানে যেহেতু এইম বলতে পেশার কথা বোঝানো হচ্ছে, তাই গৃহিনী হওয়ার বিষয়টা লেখলাম।”
ক্লাসরুমে একটা কনফিউজড অবস্থা চলছে। স্যার বললেন, “কিন্তু গৃহিনী তো কোনো পেশা না। তুমি দিনে কয়বার ড্রয়িং রুমের পর্দা বদল করবে?” মাবরুরা একটা শকের মত খেলো। চোখের সামনে দেখলো তার নিজের মায়ের ঘুম থেকে ওঠা হতে শুরু করে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সকল হাড়ভাঙা খাটুনি সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো জানালার পর্দা বদল করার ভেতরে।
মাবরুরা কাঁপা গলায় বললো, “স্যার, টাকা না কামালে কি সেটা কাজ না? পরিবারের জন্য আমার মা রান্না করেন। হোটেলের বাবুর্চি কাস্টোমারদের জন্য রান্না করে। দুটোই তো কাজ।” স্যার এবার একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “সেটাই তো কথা। তুমি কি কেবল ঘরের বুয়া আর বাবুর্চি হয়ে থাকতে চাও?”
খাদিজা আস্তে করে হাত তুললো। স্যার সাধারণত মানুষের কথা শুনতে খুব আগ্রহী। তিনি খাদিজাকে সুযোগ দিলেন। খাদিজা দাঁড়িয়ে বললো, “স্যার, আপনিই তো আমাদের শেখালেন কোনো পেশাই অসম্মানের নয়। তাহলে এখন বুয়া বা বাবুর্চি শব্দগুলো এভাবে উচ্চারণ করছেন কেন?”
স্যার দ্রুত বললেন, “দেখো তোমরা বিষয়টা ধরতে পারছো না। বুয়াগিরি বাবুর্চিগিরি বাদ দাও। শুধু হাজবেন্ডের ভোগের বস্তু হয়ে বেঁচে থাকার অপমানটা বুঝতে পারছো তোমরা?” সিদ্দীকা হাত না তুলেই দাঁড়িয়ে বললো, “স্যার, উর্বশী যখন মডেলিংয়ের কথা লিখলো, আপনি তো খুব এপ্রিশিয়েট করলেন।” উর্বশী দ্রুত কিছু বলতে নিলো। স্যার ঝগড়ার আভাস পেয়ে হাত তুলে থামালেন, “স্কিউজ মি। আচ্ছা, সবাই বোসো। প্লিজ।”
দাঁড়ানো সকলেই বসলো। স্যার বললেন, “শোনো, বিষয়টা হচ্ছে হাউজওয়াইফই যদি হতে চাও, তাহলে পড়ালেখা করে লাভ কী? আমি জানি স্কুল শুধু টাকার মেশিন বানানোর কারখানা নয়। এখানে নীতি নৈতিকতাও শেখানো হয়। কিন্তু আল্টিমেটলি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারা একটা জনগোষ্ঠী তৈরি করাই কিন্তু মূল উদ্দেশ্য, তাই না? কী বলো, মাবরুরা?”
মাবরুরা আবার দাঁড়ালো, “জ্বি স্যার, ঠিক। সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তো আমার পড়ালেখা করা লাগতেই পারে। আর আমি তো হোমমেকিংয়ের পাশাপাশি ছোটখাটো টিউশনি আর আরবি পড়ানোর ইচ্ছার কথাও প্যারাগ্রাফে লিখেছি।”
স্যার বললেন, “ব্যাস, এটুকুই? ছোটখাটো টিউশনি আর আরবি পড়ানো? তার উপর সবাইকে তো তুমি পড়াবে না। খালি মেয়ে আর বাচ্চা ছেলেদের পড়াবে। তুমি কি মনে করো এটাতে অর্থনীতির চাকায় তোমার দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালিত হবে?”
মাবরুরা উত্তরটা গোছাতে পারছিলো না। মনীষা হাত তুললো। স্যার সুযোগ দিলেন। অন্যান্য ছাত্রীদের মতই বিনয় সহকারে মনীষা বললো (বিনয়ের সাথে দ্বিমত করার এই কায়দাটাও স্যারেরই শেখানো), “স্যার আমরা আসলে যেভাবে ভাবছি সবাইকে শিক্ষিত করে কাজে ঢুকিয়ে দিলেই হলো, বাস্তবতা কিন্তু আরেকটু কঠিন। কর্মক্ষম জনশক্তির সাথে কাজের ক্ষেত্র কি আসলেই সেভাবে বাড়ছে, স্যার? অলরেডি এক্সিসটিং কর্মক্ষম লোকেরা তাহলে বেকার সমস্যায় ভুগছে কেন?”
শাহরিয়ার স্যারকে কেমন অসহায় লাগছে। কথা বলতে চাইছেন কিন্তু যেন কথা বের হচ্ছে না। খালি চোয়ালটা ঝুলে আছে। টংংংংংং করে ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই স্যার কেমন চমকে উঠলেন। তারপর মাবরুরার খাতাটা তার কাছে পাস করে দিয়ে কিছু না বলে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেলেন ক্লাসরুম থেকে।
পুরো রুম ভরে গেলো কথার আওয়াজে। অনেকেই মাবরুরার চারপাশে জড়ো হয়ে তাকে বাহবা দিলো। এমন না যে তাদের সবাইই তার গৃহিনী হওয়ার সিদ্ধান্তের সাথে একমত। কিন্তু তার চিন্তার প্রশস্ততা অনেকেরই ভালো লেগেছে।
দূর থেকে উর্বশী আর আরো কিছু মেয়ে কেবল টিটকারি মারলো, “ঘরকুনো বুয়া, বাবুর্চি আর বে*।” মাবরুরা জবাব দিলো, “তোমরা তোমাদের আক্রোশে মরতে থাকো।” (সূরা আলে ইমরান ৩:১১৯)