জীবনের বাঁকে বাঁকে

কিন্তু আমি ওকে ক্ষমা করবো না…

আমার বেতন ২২০০০ টাকা,কিন্তু আমি যে বাসায় থাকি ওটা বাড়িধারাতে (ওল্ড ডি ও এস এইচ) । এয়ারপোর্ট এর পূর্ব দিকে একটা বিশাল ফ্লাট।

লোকে শুনে হাসে, পিছে লোক ঘুষখোর বলে। আমি হাসি, গ্রাম থেকে এসেছিলাম একটা কাজ জুটাবো বলে। কিন্তু আমাকে খুঁজে নিয়েছে বিশাল কোম্পানি। বছর খানেক পর আমার কাজের উপর খুশি হয়ে এই বাড়িধারাতে ট্রান্সফার করে দেয়। সাথে এই অফিসিয়াল ফ্লাট। পুরো ঘটনা অনেককে বলা হয়, যারা শুনে তারা ভ্রু কুঁচকায়। বাকিরা ঘুষখোর বলে। যেদিন এই বাসায় এসেছিলাম সেদিন শায়লা কে কোলে তুলে ঘুরিয়েছিলাম, চুমু খেয়েছিলাম, মাঝরাতে দুজনে একসাথে নেচেছি… খিক খিক।

——–

রিহানের জন্ম হয়েছিল বাড়িধারা লেক ভিউ ক্লিনিকে। সবচেয়ে উন্নত সেবার এই ক্লিনিকে রিহান সোনার চামুচ মুখে জন্মেছিল। মধ্যবিত্তের কাছে সোনার চামুচ অধরা, বড্ড আদিক্ষেতা। আমার কাছে তা ছিল না। পুরো ১২ আনা সোনা দিয়ে বানিয়ে নিয়েছি সোনার চামুচ। জন্মের পর সেই চামুচে সামান্য মধু নিয়ে রিহানের মুখে দিয়েছিলাম। আমার সন্তান, সোনার চামুচ না হলে চলবেই না। হুম রিহানের মা কখনো ওর ছবি তুলতে দিত না। কারন অজুহাতের সমান। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, জন্মের প্রথম দিন থেকে রিহানের প্রথম বসা, হামাগুড়ি দেওয়া, প্রথম দাঁত নিয়ে হাসি, নিজের পায়ে দাড়ানো, প্রথম মুখে ভাত, প্রথম স্কুল, কলেজ সব সব আমার ক্যামেরায় বন্দি করেছি। অহহ হ্যাঁ শায়লা একদিন নিজেই একটা ছবি তুলেছিল রিহানের। যেদিন রিহান আমার পিঠে বসেছিল আর আমি গরুর মত হয়ে হাম্বা হাম্বা করে ওকে নিয়ে ঘুরছিলাম। উফফফ! আমার দেখা সেরা ছবি ওটা। শায়লা বলতো ধুর ছাই, আমাকে খুশি করতে মিথ্যা বলছো।

—–

রিহান যখন ২৬ শে পা দিল তখন আমার ৫২ বছর। এটা নিয়ে বেশ একটা হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। বাবা ছেলে বয়সে দ্বিগুন। সেই ক্লাস ফোরের অঙ্কের মত। শায়লা সে বছর বেশ ক্ষেপিয়েছিল আমায়, তবে বেশি দিন পারে নি। রিহান হঠাৎ একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। শায়লা প্রচন্ড রেগে গিয়েছিল সেদিন। পারলে রিহানকে জ্যান্ত পুতে ফেলবে। মনে খুব আপসেট হয়ে গেল শায়লা, কিছুদিন তো খাওয়া, ঘুম ছেড়েই দিল। আমি বোঝালাম, ছেলে মানুষ, পছন্দ হয়েছে, বিয়ে করেছে। কেন আমরাও তো এই ভাবেই বিয়ে করেছি তাই না? কিন্তু শায়লা বুঝলো না। তার উপর রিহানের বউয়ের অবাধ্য আচরন বাসার ভিতর বেশ খিটমিট পরিবেশের সৃষ্টি করলো। রিহান একদিন প্রচন্ড রেগে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, সে এ বাসায় থাকবে না। অহহ! হ্যাঁ একটু বলেই দেই- পরে আমি কিস্তিতে অফিস থেকে বাসাটা ৮ বছরে কিনে নিয়েছিলাম। সেই স্বপ্নের বাসায় রিহান থাকবে না, যার স্মৃতি ঘিরে এ বাসা সেই থাকবে না। আমি ওর পিঠ চেপে দিয়ে বললাম, রাগ করিস না। তোরা এ বাসায় থাক, আমাদের বরং বৃদ্ধাশ্রম এ দিয়ে আয়। এটাই তো চাচ্ছিস তাই না?

রিহান আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলো। আমি হেসে বললাম, কোথাকার বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে? ও বলল, গুলশানে। অনেক ভাল একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। তোমরা ওখানে অনেক ভাল থাকবে। আমি হেসে আমার রুমে আসলাম,শায়লা আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঠিক একই কান্না কেঁদেছিল রিহান যখন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছিল। কি কান্না টাই করেছে, “আমার রিহান কে ফিরিয়ে দাও বলে ”

—–

বসুন্ধরার এই বৃদ্ধাশ্রমে মোট ৬৩ জন আশ্রিতা। যার মধ্যে আমরা দুজন কমবয়েসি। এই ব্যাপার টা খুব মজা লাগতো, শায়লা কে বলতাম দেখ কি কপাল এত জোয়ান বয়সে আমরা ঘর ছাড়া! শায়লা মুখ কালো করে নিত। কিন্তু একটা মেয়ে হাসতো। ওর নাম সাবিহা। এখানে থাকে। সবার দেখাশুনা করে। কার কি লাগবে সেই দেখাশুনা করে। যখন থেকে আমরা এসেছি এই মেয়েটাই আমাদের পরম কাছের হয়ে গেছে। প্রায় দেখি সাবিহা শায়লার মাথায় তেল দিয়ে দেয়। আমি ওর মাথায় গুতা দিয়ে বলি কিরে “তোর এই মাকে আবার আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবি না তো? বুঝিস এই একটাই আমার সম্পদ”। ও আমার পেটে গুতা দিয়ে বলতো, ইহহহ! আমার কি সেই সাধ্য আছে? বলে খিল খিল করে হাসতো।

———-

গুনে গুনে ফের ২৮ বছর পেড়িয়েছি। ৮০ এর বুড়া আমি , বৃদ্ধাশ্রমের গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছি। বসুন্ধরার সেই বৃদ্ধাশ্রম থেকে ৫ মাস পড়েই পালিয়েছি। তারপর এখানে এসেছি, এখন যেখানে আছি সেখানে নাম বলবো না। পালিয়েছি কারন রিহান মাঝে মাঝে ন্যাকামি দেখাতো, হারামীর ন্যাকামো আমার পছন্দ হতো না। ওর মায়ের সাথে কথা বলে চলে যেত। পালিয়ে আসার পর ওরা আমাকে খুজেঁছিল কিনা জানি না, তবে খুজেঁ নি এটা সিওর। এই ২৮ বছরে আমার কাছে কিছু বাকী নেই। ৯ বছর আগে হঠাৎ শায়লা ঘুমিয়ে গেল, এতো ডাকলাম শুনলোই না, ঘুমোনোর আগে শুধু রিহান কে ডাকলো। আমার বুক টা কেঁপে উঠলো, চোখে ঝাপসা দেখলাম, সাবিহা রোজ আসতো আমাদের দেখতে। রোদ বৃষ্টি, ঝড়, এমন কোন দিন নেই যে সে আসেনি। একদিন খুব জ্বর নিয়েও এসেছিল, শায়লা খুব বকেছিল সেদিন।

নিজের সন্তান যেখানে এত বড় বেঈমান সেখানে পর সন্তানের মায়ায় শায়লা কেঁদে দিত। যেদিন শায়লা ঘুমিয়ে গেল, সাবিহা ২ বার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল।চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছিলো, মাটিতে বসে পা দাপিয়ে আম্মা আম্মা বলে চেঁচাচ্ছিলো। সব কিছু ছেড়ে কবরে শুইয়ে দিলাম শায়লা কে। এরপর মাঝে মাঝে আসতো সাবিহা, গম্ভীর ভাবে কথা বলতো, শায়লার সব কাপর ও নিয়ে গিয়েছিল, আমার কাছে ছিল শুধু রিহানের ফটো এলবাম। বছর দুয়েক পরে টানা ১ মাস আসলো না সাবিহা, খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। একদিন এক ছোকড়া গোছের ছেলে এসে একটা চিঠি দিল। আর বলল, সাবিহা বুবু দিয়েছে। আমি বললাম ও কই? আসে না যে? ছেলেটা মাথা নিচু করে বলল, বুবু ২৫ দিন আগে রোড এক্সিডেন্ট মারা গেছে। ওর জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার সময় এই চিঠি পাওয়া গেছে, আর এই ঠিকানা। বলেই ছেলেটা চলে গেল, আমি বুকে হাত দিয়ে ঠোট চেপে ধরলাম….. বাহ সাবিত্রি বাহ শায়লা। বাহ!! তোরাও আমায় ছেড়ে চলে গেলি!

————-

হঠাৎ একটা গাড়ির হর্নে সেদিকে তাকালাম। মার্সিডিজ বেঞ্জ। এই গাড়িটা আমার সবচেয়ে পছন্দ, কখনো কেনার সামর্থ্য হয়নি, তবে একে দুর থেকেই দেখলেই চিনে ফেলি। গাড়ির সামনের সিট থেকে একটা ২৫/২৬ এর ছোকড়া নামলো। চোখে সিওর গুচ্ছি এর সানগ্লাস,বড় বিরক্তিকর আমার কাছে, তাই দেখলেই বুঝতে পারি।

ছেলেটা গাড়ির দরজা খুলে দিল। একটা মাঝ বয়েসি লোক,পাঞ্জাবি পড়া আর মহিলা বের হলো। একটু কাছে আসতেই খুব চিনলাম লোকটা কে… গ্রিলে ছেড়ে হাটা দিলাম তার দিকে, সামনে গিয়ে পাঞ্জাবির কলার চিপে ধরে দুটো থাপ্পর দিব, যেটা আমাকে আরো ২৮ বছর আগে দেওয়া উচিত ছিল। আর প্রশ্ন করবো “আজ কেমন লাগছে রে রিহান ?”। আমি জানি ও আমার থাপ্পর খেয়ে কান্না করবে না, ও কাঁদবে আমার প্রশ্ন শুনে। কিন্তু আমি ওকে ক্ষমা করবো না…

মন্তব্য করুন

Back to top button