জীবনের বাঁকে বাঁকে

কিছু চাওয়া কিছু পাওয়া

To
The Headmaster
St. Joseph High School
Dhaka

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন একটা বেশ কড়া নিয়ম ছিল – কোনদিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে পরের দিন এ রকম একটা Leave prayer বা ছুটির দরখাস্ত নিয়ে আসতে হত। এখন কোনদিন যদি আমাদের স্কুলের কেউ নিচের মত

To
The Headmaster
Dhanmondi Gov. Boy’s School
Dhaka

লিখে ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েস স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে দিত তবে ঐ স্কুলের থেকে “সেন্ট যোসেফের ছেলেরা পাগল” এমন কিছু শুনে বের হয়ে আসতে হত। এমনকি যদি এমনটি লিখে আমাদের শ্রেণীশিক্ষকের কাছে দিলে তিনি ঐ ছেলেটিকে হয় বকা দিতেন নয়ত মাথার সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ করতেন। কিন্তু যাই হোক, দরখাস্তটি কখনো কবুল হতনা। আবার ঠিকভাবে লিখে জমা দেয়া লাগত।

যারা সত্যিকারের মুসলিম তাদেরকে আল্লাহর রসুল মুহাম্মাদ (তার উপর শান্তি ও আশীর্বাদ বর্ষিত হোক) এই শিক্ষাটা দিয়েছেন যে আমরা যখন কোন কিছু চাইবো তা শুধুমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবো। কারণ আল্লাহ ছাড়া বাকি সবকিছুই তার সৃষ্টি। আল্লাহ ভৌত ও রাসায়নিক কিছু আইন তৈরি করেছেন পৃথিবীটা চালানোর জন্য, তাই তিনি তাঁর সৃষ্ট এই আইনগুলোকে ব্যবহার করেই যে চাইছে তাকে কিছু দেন। কিন্তু দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই। যেমন যিশু (তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) অসুস্থকে ভালো করবার সময় ফিরিয়ে দেবার সময় বলতেন “আল্লাহর আদেশে তুমি ভাল হয়ে যাও”। সুতরাং সুস্থতা দান করলেন আল্লাহ, আর মাধ্যম এখানে যিশু। মাধ্যমের ব্যাপারটাই এরকম যে কোন কিছু হতে হলে মাধ্যম থাকতে হবে। এখন যিশু নেই, মাধ্যম বদলে হয়েছে – ডাক্তার বা ঔষধ। কিন্তু সুস্থতাদানকারী কিন্তু বদলাননি – আল্লাহই আদি এবং আসল সুস্থতাদানকারী, তাই তার গুণবাচক নামের মধ্যে একটি হল আশ-শাফি’ঈ। এখন আমরা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে আরোগ্য চেয়ে প্রার্থনা করি তবে তা হবে ভুল জায়গায় দরখাস্ত দেয়ার মত। আর আমরা আল্লাহর কাছেই চাই কিন্তু কারো মাধ্যম দিয়ে চাই যেমন – “হে মুহাম্মাদ, তোমার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সুস্থতা চাই” তবেও তা হবে ভুল দরখাস্ত করার মত। এটার নামই শিরক্‌ – ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় পাপ। আল্লাহ যেহেতু আমাদের শুধুমাত্র তাঁর ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন তাই কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করে তবে তা আল্লাহ ক্ষমা করেননা। শিরক্ অর্থাৎ আল্লাহর কোন সৃষ্টির কাছে দু’আ করলে সেটা কোন কাজের জিনিসও হয়না, কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ, কেউই কিছু দিতে পারেননা। মুহাম্মদ (সাঃ) বা ঈসা (আঃ) এর মত কোন প্রেরিত পুরুষ বা কোন মৃত সৎ ব্যক্তি বা পাথরের কোন প্রতিমা – কোন কিছুরই সাধ্য নেই মানুষকে কিছু দেয়। দেবার সাধ্য একমাত্র আল্লাহর কারণ তিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি নিত্য খাবার-পানি-বাতাস দিয়ে আমাদের লালন-পালন করছেন আর আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধানও তিনিই করেন।

এখন কেউ বলতে পারে যে সে আল্লাহর কাছে অনেক সাহায্য চেয়েছিল কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। পূর্ণাঙ্গভাবে মুসলিম হয়ে অর্থাৎ আল্লাহর সব আদেশ-নিষেধ মেনে চললে এবং কোন প্রার্থনার ফল পাবার জন্য অধৈর্য না হলে আল্লাহ অবশ্যই সেই প্রার্থনার সাড়া দেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহ যেভাবে সাড়া দেন তা অনেকেই ধরতে পারেনা। যেমন কেউ খুব দু’আ করলো যে “আল্লাহ আমার মাকে ভাল করে দাও” কিন্তু তার মা মারা গেল। তখন সে হয়ত ভাবতে শুরু করল আল্লাহ বলে কেউ নেই, থাকলেও আমার জন্য নেই। কিন্তু সে এটা বুঝতে পারলোনা যে আল্লাহ তার মায়ের মৃত্যু দিয়েছেন কারণ সেটাই তার জন্য মঙ্গল ছিল। বেঁচে থাকলে সে হয়ত অনেক কষ্ট পেত। হয়ত সে তার সন্তানদের অনেক ঝামেলায় ফেলত। হয়ত এমন অবস্থা আসত যখন সন্তানেরা মুখে না বললেও মনে মনে বলত “মা মরলেই বাঁচি”। এসব থেকে বাঁচানোর জন্যই আল্লাহ তাকে ঠিক যখন দরকার তখন তুলে নিয়েছেন।

আবার উল্টোটিও হতে পারে। কেউ বলতে পারে সে ‘মা মেরি’ বা খুব জাগ্রত কোন দেব-মূর্তির কাছে কিছু চেয়ে পেয়েছে। ব্যাপারটি হচ্ছে যদি তারা এসবের কাছে নাও চাইতো তাও তারা যা পেয়েছে ঠিক তাই পেত। কারণ দিয়েছেন আল্লাহ এবং তিনি ঠিক করেই রেখেছেন কাকে কি দেবেন। অন্য কারো কাছে চাওয়ার ফলে রাগ করে আল্লাহ কিছু দেবেননা এমনটি হবার নয়। যদি হত তবে যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে বা তার নিন্দা করে এমন মানুষগুলো খেতেই পেতোনা, নিঃশ্বাস নেবার অক্সিজেনই পেতোনা। একজন মানুষের কাছে একটা মাছির একটা ভাঙ্গা ডানার মূল্য যতটা আল্লাহর কাছে এই পুরো সৃষ্টিজগতের মূল্য যদি ততটুকুও হত তবেই হয়ত একজন কাফিরকে আল্লাহ না খাইয়ে রাখতেন। আল্লাহ আমাদের থেকে এতটাই অমুখাপেক্ষী।

দু’আ হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইবাদাত। নামায, যাকাত, রোজা, হাজ্ব এর মত দু’আ করাটাও একটা ইবাদাত। বরং তার চেয়ে আর বেশি কারণ মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন –

“দু’আ হল ইবাদাতের নির্যাস”

দু’আ জিনিসটিকে আমরা খুব হেলা-ফেলা করি। আমি যখন হাজ্বে যাচ্ছিলাম তখন পরিচিত অনেকেই তাদের জন্য “দু’আ-টু’আ” করতে বলেছিল। অথচ মাসজিদুল হারামে মরক্কোর এক ছেলের সাথে আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা আরবিতে কথা বলতে বলতে জানিয়েছিলাম যে আমি আরবি পারিনা তবে শিখছি। তারপর অনেকটা অভ্যাসবশতই বলেছিলাম যে আমার জন্য দু’আ করতে যেন ভাল আরবি শিখতে পারি। সে তখুনি উঠে গিয়ে দু’রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করে আসল যেন আমি ভালভাবে আরবি শিখে যাই। দু’আ চাওয়া এবং দু’আ করাটাকে ভাল মুসলিমরা এত গুরুত্ব দেয় যে আমরা তা কল্পনাও করতে পারিনা। আর দেবে নাই বা কেন? রসুল (সাঃ) এর শিক্ষা এই যে যখন কোন মুসলিম তার অন্য মুসলিম ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে কিছু চায় তখন কিছু ফেরেশতা সাথে সাথে বলে “তোমার জন্যও অনুরূপ” আর এজন্য সাহাবিরা যদি কোন জিনিসের অভাব বোধ করতেন তবে অন্য কোন ভাইয়ের জন্য সে জিনিসটা আল্লাহর কাছে চাইতেন। কারণ যে নিজের জন্য কিছু চায় সে একা শুধু নিজেরই জন্য চায়। আর যে অন্যের জন্য চায় অনেক ফেরেশতা তার পক্ষে সে দু’আ করে দেয়। আর ঠিক একই কারণে তারা ভুলেও কাউকে অভিশম্পাত করতেননা, কারো অমঙ্গল চাইতেননা।

এখন আমি যদি কোন অমুসলিমকে বলি নামায পড়তে বা হাজ্ব করতে ব্যাপারটা যতটা অযৌক্তিক ঠিক তেমন আমি যদি দু’আ করতে বলি সেটাও হবে অযৌক্তিক। শুধু অমুসলিম বলেই নয়, যারা নিজেরা মুসলিম বলে দাবী করে কিন্তু ইসলামের ন্যুনতম আচরণ-বিধি পালন না করে চলে তবে তাকে দু’আ করতে বলাটা নিছক সামাজিকতা যেটা আমি ধর্ম মানার ক্ষেত্রে পরিহার করি। দু’আ মানে মৌলভি/পাদ্রী/ পুরোহিত ডেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে বলা বাক্য নয়, সামাজিকতা রক্ষার্থে বলা কিছু অর্থহীন উচ্চারণ নয়। দু’আ মানে বিনীত ভাবে স্রষ্টার কাছে কিছু চাওয়া, মনের গভীর থেকে – আকুল ভাবে, সঠিক পদ্ধতিতে (রসুলের শেখানো উপায়ে)।

আমি যখন আমার বাসায় নিমন্ত্রণ করব তখন সবাইকে করব, কিন্তু যখন কোন ইবাদাত করতে বলব তখন তাদেরকেই বলব যারা আমার কথাটার মূল্য দেবে। যাদের কাছে আমার বক্তব্য সাম্প্রদায়িক মনে হয়েছে, আপত্তিকর লেগেছে তারা যদি এখন বুঝতে পারে কেন আমি এমন কথা লিখলাম তবে আল্লাহর কাছে অনেক ধন্যবাদ। আর এর পরেও যদি কেউ কিছু না বুঝে থাকে অর্থাৎ শিরক্‌ থেকে বেরিয়ে আসার গুরুত্ব অনুভব করতে না পারে তবে সেটা আমার দোষ। আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার দোষ, আমার লেখার ধরণের দোষ।

আল্লাহ আমাদের হ্রদয় খুলে দিন।

ধর্মকে নিছক সামাজিকতার গন্ডি থেকে বের করে সেটাকে সম্পূর্ণ জীবনদর্শন হিসেবে অনুভব করার ক্ষমতা দিন।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

মন্তব্য করুন

Back to top button