জীবনের বাঁকে বাঁকে

এক অনন্য সম্পদের খোঁজে

আমি যেখানে কাজ করি তার জানালা দিয়ে গুলশানের একটা আলিশান বাড়ি দেখা যায়। বাড়ির মালিকের রুচিটা অদ্ভুত সুন্দর। তিনি কোটি কোটি টাকার ফ্ল্যাটের লোভকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটি দ্বোতলা বাড়ি দিব্যি অক্ষত রেখেছেন যার সামনে একটা বাগান আছে, ছোট্ট পুকুর আছে এমনকি সে পুকুরের উপর দিয়ে একটা বাঁকানো সেতুও আছে। নানান প্রজাতির গাছে হরেক রকম পাখি বসে যে গান শোনায় তা আমি বহুদূর থেকেও বেশ শুনতে পাই। সামনের মাঠটাতে প্রায়ই কতগুলো গুল্লু-গুল্লু চেহারার খরগোশ দৌড়ঝাপ করে। আমি নিজেকে মুনি-ঋষি বলে দাবী করিনা, কিন্তু সত্যি বলছি এ পৃথিবী আমাকে তেমন টানেনা। অনেক ঝকমকে সাজানো-গোছানো এপার্টমেন্ট দেখেও আমার মনে আহা-উহু বোধ জাগেনা। কিন্তু এই বাড়িটা আমার ছোট্টবেলার কল্পনার স্বপ্নের বাড়ির সাথে এতটাই মিলে যায় যে; অবচেতন মনের কোণে বোধহয় একটা ইচ্ছে উঁকি দিয়ে ওঠে – ইশ্‌, এমন একটা বাড়িতে যদি থাকতে পেতাম!

আল্লাহ যদি আমাকে ইসলামের জ্ঞান-বুঝ না দিতেন, তাহলে আমি কষ্ট পেতাম। বাড়ির মালিক আর তার ছেলেপুলেকে হিংসা করতাম – কেন ওরা এত সুন্দর সম্পত্তি পেল, আমি পেলামনা। আসলে সম্পত্তির ব্যাপারটা এমনই – কেউ পাবে, কেউ পাবেনা। কেউ বনানীর এসি ঘরে থাকবে, কেউ কমলাপুর স্টেশনে। এতে আমাদের মানুষদের, বিন্দুমাত্র হাত নেই – পুরোটাই আল্লাহর এখতিয়ারে। মানুষ তো আর জন্মের সময় ঠিক করে আসতে পারেনা সে কার ঘরে জন্মাবে। তাই আমি যে ঘরে জন্মেছি, তা নিয়েই আমি বেজায় খুশি – আলহামদুলিল্লাহ!

কার্লোস হেলু স্লিম বা ওয়ারেন বাফেটের সম্পত্তি অঢেল – তা মানি। কিন্তু এই সম্পদের স্থায়িত্ব কতটা? যিনি আজ শীর্ষ ধনী – তার কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়ে গেলে তিনি চলে যাবেন দশের বাইরে। আবার এই সম্পদের উপযোগীতাও বা কতটুকু? বিল গেটসও খায়, আমিও খাই – উনি কতটা মজার খাবার খান জানিনা, আমি তো প্রতিদিনই ভালো-মন্দ দিয়েই পেট ভরি, আলহামদুলিল্লাহ। মুকেশ আম্বানি রেশমের বিছানায় ঘুমান, কাওরানবাজারের দোকানদার ইলিয়াস একটা তেল চিটচিটে কাঁথায়। দু’জনই তো ঘুমান। ইলিয়াস নাহয় সালমান এফ রহমান হবার সুখস্বপ্ন দেখতে পারে, মুকেশ আম্বানি হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখে সবাই তার টাকা কেড়ে নিতে আসছে! বিছানা নরম হলেই যদি আরামের ঘুম হয় তাহলে বাজারে এত দামি দামি ঘুমের ওষুধ বিক্রি হতোনা। অনেক বেশি টাকার মালিক হয়ে বড়লোকেরা বড়জোর একটু ভাব বেশি মারতে পারেন – এছাড়া অন্য কোন ব্যাপারে তো তাদের সাথে আমজনতার কোন পার্থক্য দেখিনা। সম্পদের প্রাচুর্য হয়তো জৈবিক সুখ একটু বেশি দেয় তাদের, কিন্তু যে মানুষের মনে আত্মিক সুখ আছে তার কি কোন বিনিময় মূল্য হয়?

আজ বরং অন্য এক সম্পদের কথা শোনাই। এই নশ্বর পৃথিবীতেই আল্লাহ এমন একটা সম্পদ দিয়েছেন যা মানুষের হাতের নাগালে – সে ইচ্ছে করলেই ছুঁতে পারবে। ইচ্ছে করলেই সে মালিক হয়ে যেতে পারবে অঢেল বিত্তের। ইচ্ছে করলেই সে যত খুশি তার বৈভবকে বাড়িয়ে নিতে পারবে অথচ কাউকে ঠকানো লাগবেনা, কাউকে কষ্ট দেয়া লাগবেনা, কারো রক্ত চুষতে হবেনা।

এ সম্পত্তি চুরি যায়না, তার বীমা করে রাখা লাগেনা। এর মালিকেরা রাতারাতি কোটিপতি থেকে পথের ভিখারী বনে যাননা। এ এক অদ্ভুত সম্পদ! এর মালিকের মনে দুশ্চিন্তা থাকেনা, শান্তি থাকে। এ থেকে ইচ্ছে মত বিলানো যায় তবু তা কমেনা – কেবলি বেড়েই যায়। এ ধনভান্ডার মৃত্যুর পর সাথে করে নিয়ে যাওয়া যায় মাটির নিচে। এ ঐশ্বর্য যার আছে তাকে লোকে গালি দেয়না; উল্টো আকাশের পাখি, বনের পশু, পানির তলার মাছ তার জন্য দু’আ করতে থাকে আল্লাহর কাছে। এ সম্পদ আহরণ করতে যে পথ চলে তার পায়ের নিচে ফেরেশতারা পাখা বিছিয়ে দেয় – আহা, এমন মানুষের পা যেন মাটিতে না লাগে!

এ সম্পদ হল – ‘জ্ঞান’ যা আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন তার প্রেরিত নাবি-রসুলদের। সকল যুগের সব জ্ঞান একত্র করে আল্লাহ সংরক্ষণ করে রেখেছেন আল-ক্বুরানে। তিনি মুহাম্মদ(সাঃ)কে বেছে নিয়ে পাঠিয়েছেন এই সম্পদ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে। তাই রসুল(সাঃ) বলে গেলেন –

নিশ্চয়ই আলিমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী, আর নবীগণ দীনার কিংবা দিরহামের উত্তরাধিকার দিয়ে যাননি, বরং জ্ঞানের উত্তরাধিকার দিয়ে গিয়েছেন, অতএব যে তা গ্রহণ করল, সে এক বিরাট সৌভাগ্যের অধিকারী হল

এ বিত্ত অর্জন করা খুবই সহজ। এতে মাত্র চারটি করণীয় আছে –

১. আল-ক্বুর’আন, সহিহ হাদিস এবং এর উপর ভিত্তি করে নির্ভরযোগ্য আলিমদের লেখা বইগুলো পড়া।

২. একজন যোগ্য আলিম-শিক্ষকের কাছে পাঠ্যটি বুঝে নেয়া।

৩. পঠিত বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা।

৪. আল্লাহর কাছে চাওয়া।

মহান আল্লাহ আমাদের কাছে প্রথম যে আয়াতটি অবতীর্ণ করলেন তা হল –

ইক্বরা বিসমি রব্বিকাল্লাযি খলাক্ব।

পড় তোমার রবের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহর এই আদেশটুকুর কতটুকু মূল্য আমরা মুসলিম হিসেবে দেই তা চারপাশে তাকালে বেশ বোঝা যায়। আমাদের সব ভালো লাগে কিন্তু পড়তে একেবারেই ভালো লাগেনা। আর যদিও বা পড়ি, যা পড়ি সেটার সাথে আমাদের রব আল্লাহর সাথে কোন সম্পর্কই থাকেনা। পড়ার বই-গল্পের বই পড়ি, খবরের কাগজে সারা দুনিয়ার মানুষের আকাজ-কুকাজের বিবরণ পড়ি, ব্লগের ফালতু প্যাচাল পড়ি, ফেসবুকের মানুষজনের স্ট্যাটাস-কমেন্ট পড়ি – এমনকি রাস্তায় যেসব হ্যান্ডবিল বিলি করে তাও খুব মন দিয়ে পড়ি; পড়িনা কেবল আল্লাহ যা পড়তে বলেছিলেন সেটা।

দ্বিতীয়ত, শুধু পড়াই যথেষ্ট নয় – সেটা বোঝার দরকারও আছে। আর সেজন্য আল্লাহ মুহাম্মদ (সাঃ)কে শুধু বার্তাবাহক নয়, শিক্ষক হিসেবেও পাঠিয়েছেন। যেমন সুরা আল-ইমরানের ১৬৪ নম্বর আয়াতে রসুলুল্লাহ(সাঃ) এর কাজ সম্পর্কে বলা হচ্ছে –

… আয়াতসমূহ পড়েন, এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। …

অর্থাৎ শুধু পাঠ্যবস্তু নয়, একজন শিক্ষকের উপস্থিতিও জরুরী যিনি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবেন। এ আয়াতে লক্ষ্যনীয় যে, সম্পদ অর্জনের আগে আন্তরিক উদ্দেশ্যটাকে পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে। আমার অনেক সম্পদ আছে এমন অহংকার করার নিয়ত থাকলে ভয়াবহ ভুল হবে।

তৃতীয়ত, আমাদের কর্তব্য – যা পড়ছি, যা শিখছি আর চারপাশে যা দেখছি সেসব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। আল্লাহ পাক ক্বুরানে তাই বহুবার তার নিদর্শনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন – এসব থেকে তারাই আল্লাহর নিদর্শনকে খুঁজে পাবে যারা গভীরভাবে চিন্তা করে। একটা গরু সকালে মাঠে গেল ঘাস খেতে। সারাদিন খাওয়া, জাবর কাটা আর মল-মূত্র ত্যাগের পর সন্ধ্যায় এল গোয়ালে। পরের দিন আবার মাঠে। গরুর মত মানুষও যদি খাওয়া-ত্যাগ-ঘুম এর জৈবিক চক্র থেকে বেরোতে না পারে তবে তার সাথে গরুর কী পার্থক্য থাকলো? গরু তো তাও অনেক কাজে লাগে, কিন্তু যে মানুষটা মানুষের মাথা নিয়েও গরুর মত জীবন যাপন করে সে তো একদমই অপদার্থ!

সুরা মুহাম্মাদে আল্লাহ একদল অভিশপ্ত মানুষদের ব্যাপারে বলেন –

তারা কি ক্বুরআন নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করেনা, নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে গেছে?

আমরা যে সম্পদ পেতে চাইছি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি একজন মুসলিমকে পৃথিবীর অন্যান্য সব শিক্ষার্থী থেকে আলাদা করে দেয়। সেটা হল আল্লাহর কাছে চাওয়া। আল্লাহ আমাদের ক্বুরানে দু’আ শিখিয়ে দিচ্ছেন –

রব্বি যিদনি ইলমা

হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও

আমাদের শিক্ষক রসুলুল্লাহ(সাঃ) সম্পদের ভান্ডার দেয়ার সময় তার চাবিটাও দিয়ে দিলেন। তিনি শিখিয়ে দিলেন আমরা যেন আল্লাহকে বলি –

আল্লাহুম্মা ইন্নি আস্‌আলুকা ইলমান নাফি

হে আল্লাহ আমাকে উপকারী জ্ঞান দান কর

 যে সম্পদ নিজের কাজে লাগেনা, অন্য মানুষেরও কাজে লাগেনা তার কী মূল্য আছে? আমি অনেক ভাল ভাল জিনিস শিখলাম কিন্তু তা জীবনে প্রয়োগ করলামনা তাহলে সেই শিক্ষাটা উপকারী শিক্ষা হলোনা।

এবার একটা আত্মজিজ্ঞাসা। ধরুন আপনাকে যদি কেউ প্রথমে উল্লেখ করা বাড়িটা দিতে চেয়ে বলে “অমুক সময়ে এসে দলিলে সই করে যেও”, তবে কি আপনি তাকে চাকরির অজুহাত দেবেন? টিউশনির? সাংসারিক ব্যস্ততার? বলবেন – “আমার খুব ইচ্ছা ছিল নেয়ার, কিন্তু আপনার অফিস এত দূর যে যেতে পারছিনা?” আপনাকে যখন কেউ ইসলাম শেখার দাওয়াত দেয় তখন আপনি কি বিশ্বাস করেন যে ঐ বাড়ির চেয়ে অনেক মূল্যবান এক সম্পত্তির দিকে আপনাকে ডাকা হচ্ছে? সত্যি বিশ্বাস করেন? অন্য মানুষ কে কী করলো সে হিসাব নেয়ার আগে একটু নিজেকে জিজ্ঞেস করে নেই – রসুল(সাঃ) এর রেখে যাওয়া সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে আমরা পার্থিব বৈভব কতটুকু ব্যয় করেছি, সময়ও বা কতটুকু বরাদ্দ করেছি?

আছেন কি কেউ যারা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন নাবি-রসুলদের রেখে যাওয়া ঐশ্বর্যই শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য? আছেন কি কেউ যিনি সত্যি মনেপ্রাণে চান মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে জীবন উৎস্বর্গ করতে? তাহলে সব অজুহাত বাদ দিয়ে আজকে থেকেই শুরু হোক রসুলুল্লাহ(সাঃ) এর রেখে যাওয়া অমূল্য সম্পদের খোঁজে পথ চলা।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

মন্তব্য করুন

Back to top button