জীবনের বাঁকে বাঁকে

কেন তারা ঝরে পড়ে

১.

কেউ আমাকে পড়াশোনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে যখন উত্তর দেই যে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনলজি বিভাগ থেকে পাশ করেছি, তখন চোখে-মুখে যতই বিনয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলি না কেন, মনের ছাদে অহংকারের পতাকাটাকে পতপত করে উড়তে দেখি। আমি জানি যে আমাকে আল্লাহ যে সামান্য মেধাটুকু দান করেছেন তা নেহায়েতই দান, এতে আমার বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব নেই। তবুও কৃতজ্ঞতায় নিচু মাথাতে আমার একটা অব্যক্ত শ্লাঘাবোধ থেকেই যায় যে, আমি এমন একটা বিভাগে পড়েছি যেখানে প্রতিবছর মাত্র দশ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়ার সুযোগ পায়। ঢাবির ভর্তিপরীক্ষায় একদম সামনে থাকতে না পারলে এ সুযোগ মেলে না।

আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন আমাদের বিভাগটা ছিল নতুন। হাইটেক যন্ত্রপাতির অভাব ভুলিয়ে দিয়েছিল আমাদের শিক্ষকরা। তারা এমনভাবে পড়াতেন যেন আমরা কাজগুলো হাতে-কলমে না শিখলেও মনের চোখের সামনে দিব্যি দেখতে পেতাম। কিন্তু যত উপরের দিকে উঠতে থাকলাম, বিভাগ বড় হতে থাকল, নতুন নতুন শিক্ষক আসতে থাকলেন – ততই মন খারাপ হওয়া শুরু হল। সে মন খারাপ আজকের মত কখনও এত পূর্ণতা পায়নি।

২.

যারা একটু ভাল ছাত্র তাদের একটা সমস্যা হচ্ছে তারা বুঝতে পারে অন্য একজন কেমন ছাত্র। যখন আমরা দেখি একজন শিক্ষক একবারও বই না খুলে সারা ক্লাস পড়াচ্ছেন অথচ আরেকজন বই ফটোকপি গড়গড় করে রিডিং পড়ে চলেছেন, তখন কেউ না বলে দিলেও আমরা বুঝে যাই কোন শিক্ষকের মান কেমন। যিনি নিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে পড়ান আর যিনি অন্য বিজ্ঞানীর লেখা জার্নাল ভাল করে না বুঝেই পড়াতে চলে আসেন তাদের দুজনের ক্লাস কি সমান? শেষ বর্ষে এমন শিক্ষকও পেয়েছি যিনি ন’টার ক্লাস দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে মিস করেছেন। সিলেবাসের কঠিন অংশটুকু তিনি আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন – সেগুলো আমরা পড়িয়েছি, তিনি পেছনে বসে শুনেছেন। আমরা এমন সব মানুষদের শিক্ষক হিসেবে পেতে থাকলাম যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার উদ্দেশ্যই ছিল ‘বিদেশ গমন’।

ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘শিক্ষা ছুটি’ নামে একটা সুবিধা পান। কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় বিদেশে পড়তে যান তখনও বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বেতন দেয়। এখন পিএইচডি করতে তিন বছর লাগুক আর সাত – বেতন তিনি পেয়েই যাবেন, ছাত্র পড়ানো ছাড়াই! অথচ পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্তরে স্কলারশিপ ছাড়া কেউ বিদেশে যায় না, অন্তত সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যান না। সে স্কলারশিপে যে টাকা দেয় তাতে থাকা-খাওয়া-পড়ার খরচ দেবার পড়েও হাতে কিছু টাকা জমে। আর এদিকে দেশের ব্যাংকে মাসিক বেতনও জমতে থাকে।

ব্যাপারটা হয়ত শুরু হয়েছিল এ কারণে যে, শিক্ষকরা বিদেশ থেকে গবেষণা করে অনেক কিছু শিখে দেশে গিয়ে ছাত্রদের শেখাবেন। কিন্তু দেখা যায়, অনেক দিন বিদেশে থাকার ফলে শিক্ষকদের দেশের মাটিতে মন টেকে না; তারা পোস্ট-ডক করতে যান বা লিয়েন নিয়ে হয় কনসালটেন্সি নয়ত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেন। পুরো ব্যাপারটাতে শিক্ষকদের কতটুকু লাভ হয় জানি না, কিন্তু শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় অনেক। তাদের সিলেবাস ঠিকমত শেষ করার কেউ থাকে না। একজন শিক্ষক খুব জরুরী একটা কোর্স আমাদের শেষ করিয়েছিলেন তিন মাসে যেটা পড়ানোর কথা ছিল ১২ মাসে, কারণ বাকি সময়টুকু তিনি বিদেশে ছিলেন। ঐ বিষয়ে আমার ভিত্তিটা সেই যে টলে গেল, তার জের এখনও সামাল দিয়ে উঠতে পারিনি।আমি শিক্ষা ছুটির বিরোধীতা করছি না, কিন্তু কাজ না করে বেতন নেয়াটা আমার কাছে অনৈতিক লাগে।

শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বেতন/চাকরি কথাগুলো ব্যবহার করতে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু এটা তো সত্যি তাদের সম্মানী দেয়া হয় ছাত্রদের শেখানোর জন্য। আমাদেরই কোন শিক্ষককে দেখতাম সকাল থেকে বই নিয়ে পড়ে আছেন। আবার এমনও দেখেছি যার ন্যুনতম প্রস্তুতি নেয়ার মত ন্যুনতম সৌজন্যবোধ ছিল না। সব মানুষের বোঝানোর ক্ষমতা এক না, মানি – কিন্তু চেষ্টা বলে একটা ব্যাপার তো আছে! কারো যদি কম বেতন না ভাল লাগে তিনি তো অন্য কিছু করলেই পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে বেতন কম তাই কাজও করি কম, এ কথা বলে ক্লাস ফাঁকি দেবেন – এটা কেমন বিচার? পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাস আধ ঘন্টায় নেয়া, আর তাতেও ‘তা না না না’ করে হাজিরা খাতার লৌকিকতা রক্ষা করা – এটা কী ছাত্ররা বোঝে না? ছাত্ররা সবই বোঝে, কিন্তু ভদ্রতা করে কিছু বলে না। আর না বলার সুযোগটা এই প্রজাতির শিক্ষকরা আর বেশী করে নেন। আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়া সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে উদাসীনতা চলে আসে। বোঝার বা শেখার চেয়ে বই মুখস্থ করে কোনরকম পরীক্ষা পাস করাই আসল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানের আকাশে যাদের তারা হয়ে ঝিলমিল করার কথা ছিল তারা সবার অজান্তে খসে পড়তে থাকে ধীরে ধীরে। মেধার মৃত্যু হয়, স্বপ্নের মৃত্যু হয়।

৩.

এতক্ষণ যা বললাম তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে। সমস্যা প্রকট হয় যখন অনুচিত আচরণগুলো নিয়মে পরিণত হয়। একজন ভাল ছাত্রকে যখন শিক্ষকে হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তখন তার কাছ থেকে ছাত্ররা অনেক কিছু শেখে। আমাদের পরের ব্যাচে একটা খ্যাপাটে ছেলে ছিল যে ঘরে বসে চিন্তা করে সিনথেটিক বায়োলজির মডেল দাঁড় করিয়ে ফেলত। এ রকম একজন মানুষকে যদি শিক্ষক হিসেবে ছাত্ররা পায় তাহলে তারা শেখে কল্পনাশক্তির দরজা কিভাবে খুলতে হয়। ঐ ব্যাচেরই আরেকজন ছেলে এত সুন্দর করে গবেষণার পরিকল্পনা করত যে, সে অনুযায়ী কাজ করলে কিছু না কিছু পথ বের হতই। আমাদের সাথে এমন একজন ছিল যে গবেষণার প্রতি একাগ্রতাকে অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এই গুণগুলো সবার মধ্যে থাকে না; যাদের মধ্যে থাকে তাদের মাথায় করে রেখে দেয়া উচিত, যাতে তাদের কাছ থেকে অন্যেরা শিখতে পারে। কিন্তু যখন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা দাঁড়ায় কে ‘লীগ’ করে আর কে ‘দল’, তখন পুরো ব্যবস্থায় ধস নামে। ভাল ছাত্ররা সাধারণত রাজনীতি করে না, তাদের করার মত অনেক ভাল কাজ আছে। আমাদের দেশের স্বনামধন্য প্রথিতযশা লেখক-শিক্ষক, যিনি প্রতিদিন আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভাল ভাল কথা শেখান তিনিও আপন বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পেয়ে বেছে নেন উনিশতম ছাত্রটিকে! আগের আঠার জন কী দোষ করল?

হিসাবটা খুব সহজ – যখন দলের ছেলেটি শিক্ষক হিসেবে ঢুকবে তখন সে ভোট দেবে দলীয় শিক্ষককে। দলীয় শিক্ষক ডীন হবে, চেয়্যারম্যান হবে, প্রক্টর হবে। দলের জোর বাড়বে, আরো শিক্ষক, কর্মচারী নেবার পথ সুগম হবে। দলের ক্যাডারদের টেন্ডার দেয়া যাবে নির্বিঘ্নে, হলের দখল দিয়ে দেয়া যাবে। বিভিন্ন কমিটিতে নাম ঢুকবে দলীয় শিক্ষকদের – বাড়তি কামাই হবে অনেক। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সরকার বদলের সাথে সাথে বদলে যায় দল, কিন্তু ভাল ছাত্ররা উপেক্ষিত হয় সব আমলেই।

সবখানে থাকলেও আমাদের বিভাগে এই নোংরামি ছিল না শুরুতে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনও যারা আছেন তারা মেধার ভিত্তিতেই এসেছেন। কিন্তু গত সরকার প্রথম আমাদের বিভাগকে কলুষিত করেছিল। মাঝে তত্বাবধায়ক আমলে আমরা খুবই ভাল ছিলাম, কিন্তু এবার আবার শুরু হয়েছে আবর্জনা ঢোকানোর প্রচেষ্টা। শেষবার নিয়োগ দেবার সময় নিয়ম ছিল, এ বিভাগ থেকে মাস্টার্স করতে হবে। খুব যোগ্য কিছু ছাত্র যারা অনার্স করে সরাসরি বিদেশে পিএইচডি করতে চলে গিয়েছিল তারা এ নিয়মের ঘোরপ্যাঁচে বাদ পড়েছিল। বিশেষ একজন প্রার্থীকে সুযোগ দিতে এবার ঐ নিয়ম বাতিল করা হয়েছে। নিয়মটা ভাল ছিল না তাই বাতিল হয়েছে, ভাল কথা – কিন্তু যে বিদেশ থেকে পয়সা দিয়ে পড়েছে আর যে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেছে দু’জন কি এক? বিদেশ হলেই হবে, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মানটা দেখতে হবে না? যোগ্য প্রার্থীটি অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর পরে কেন সাক্ষাৎকারের তারিখ ঘোষণা করা হবে?

আমার যে শিক্ষকরা এই অন্যায়টির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছেন তাদেরকে আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই। আমার যে শিক্ষকরা সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, জীববিজ্ঞান অনুষদের বিরূপ পরিবেশের মধ্যে থেকেও নিরপেক্ষভাবে আছেন, গবেষণা করে যাচ্ছেন, বিনে পয়সায় আমার ছোট ভাইদের পড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। তারা যদি হাল ছেড়ে দেন – তাহলে কি অবস্থা হবে, মাস্টার্সের থিসিসের ছাত্ররা কোথায় যাবে সেটা ভাবতেই আমার ভয় লাগে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানুষ অনেক সম্মান করে। কিন্তু এই সম্মানটা কিছু শিক্ষক নিজের হাতে নষ্ট করে ফেলছেন। যে মানুষটা দুর্নীতি করে শিক্ষক হল, সে কি কখন একটা ছাত্রকে বলতে পারবে, “নকল কর না, নকল করা অন্যায়” ? কী নীতিবোধ শেখাবে সে যার নিজের নীতিবোধ নেই? তাই তো আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে, ছাত্রীদের গায়ে হাত দেয়। নৈতিকতার অধপতনের পাঠ ছাত্ররা পায় শিক্ষকদের কাছ থেকে। বুয়েটে সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রথম বর্ষে যারা বলেছে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ঘুষ খাবে না, তারাই শেষ বর্ষে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ঘুষ খেতে তাদের আপত্তি নেই। বুয়েটের মত জায়গায় যদি নৈতিক শিক্ষার এ হাল হয়, তাহলে বাকি সবখানে কী ত্রাহি ত্রাহি দশা!

স্পষ্ট করে নেয়া ভাল হবে যে, সবাই অনৈতিক আচরণ করেন না। সত্যি বলতে গেলে, বেশী ভাগ শিক্ষককেই ‘ভাল’ – এর পাল্লায় ফেলা যায়। অযোগ্য একজনকে শিক্ষক বানালে অন্য শিক্ষকদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সাদা কাপড়ে দাগ পড়লে দাগের মাহাত্ম্য বাড়ে না, কাপড়টার মূল্য কমে যায়। আর যখন অনেকগুলো কাল দাগ পড়ে, তখন মানুষ সেই সাদা কাপড়টাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দাগ দাগের মতই থাকে, মধ্যে থেকে কাপড়টা ঘরমোছার ন্যাকড়া হয়ে যায়।

৪.

দু’হাজার সালের কথা। তখন থেকে বুকে স্বপ্ন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার হব – নোনা মাটিতে ধান ফলাব, দুর্ভিক্ষপীড়িত ইথিওপিয়া আর সোমালিয়ার খরাতে ফসল। গ্রামে টনের পর টন টমেটো পঁচে যায় কৃষকরা আনার আগেই, আর শহরে দাম আশি টাকা কেজি। স্বপ্ন দেখতাম কিছু একটা করব যাতে শাক-সব্জি নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। যখন ঢাবিতে জেনেটিক আর মেডিকেল কলেজে দুটোতেই চান্স পেলাম তখন আত্মীয়-স্বজনকে বোঝালাম প্রোটিন ইঞ্জিনিয়ারিং দিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়। রিকম্বিনেন্ট ব্যাক্টেরিয়া থেকে ইনসুলিন আসে, ভ্যাকসিন আসে – সেগুলো দিয়ে অনেক বেশী মানুষের জীবন বাঁচান যায়। ডাক্তারির চেয়ে এটা অধিক মহতী পেশা – এমনটাই বুঝিয়েছিলাম সবাইকে।

যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরুলাম তখন মাথা ভর্তি বিদ্যা, কিন্তু করার মত কাজ নেই। হাতে কলমেও এমন কিছু শিখিনি যে নিজেই কিছু একটা খুলে বসব – পনিরের খামার বা টিস্যু কালচার ল্যাব। হন্যে হয়ে ঘুরলাম – কেউ কি আমাকে শেখাবে কিভাবে বায়োরিমেডিয়েশন করে কিভাবে আবর্জনাকে সম্পদ করা যায়? কেউ কি আমাকে কোথাও ছ’মাসের একটা ট্রেনিং দিয়ে শেখাবে কিভাবে বায়োফার্মেন্টশন দিয়ে মাংসের বিকল্প মাইকোপ্রোটিন জন্মাতে হয়? আপ্রাণ চেষ্টা করলাম এমন কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে যেখানে আমার জ্ঞান ব্যবহার করতে পারব, আমাকে আল্লাহ যে ক্ষমতা দিয়েছেন সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারব। পেলাম না এমন কিছু। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বিদেশে আবেদন করার। খুঁজতে লাগলাম কোথায় লাগসই প্রযুক্তি শেখা যাবে, যার প্রয়োগ আমার দেশে হবে।

নতুন কিছু শিখব এই আশায় দেশে ১৪ মাসের কোলের বাচ্চা আর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ফেলে রেখে আমি আজ পরবাসী। এমন এক জায়গায় এসে পড়েছি যেখানে আমি জীবনে প্রথম সজ্ঞানে জুম’আর নামায পড়তে যেতে পারিনি। যে আমি দিনে পাঁচবারের মধ্যে একবার জামাত না পেলে মন খারাপ করতাম, সেই আমি এক ওয়াক্ত নামায জামাতে পড়ার সাথী পেলে আনন্দে লাফ দেই। বাবা-মা-ভাই-স্ত্রী, সদ্য হাটতে শেখা ছেলেটার কথা যখন মনে হয় তখন কোথায় লুকিয়ে কাঁদব ভেবে পাই না। ঝকঝকে নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে বলি, “আল্লাহ, কিছু একটা যেন শিখতে পারি, কিছু একটা!”

৫.

আমার যদি ইসলামের বুঝটা না থাকত, তাহলে খুব কষ্ট লাগত। আমি জানি আমি যদি বিদেশ থেকে কিছু শিখিও, সেটা ছাত্রদের শেখাতে পারব না। কারণ দলের লেজুড় ধরা তো দূরের কথা, আমি কারো কাছে দয়া ভিক্ষা করতেও পারব না। ঠিক করে রেখেছি করার মত কোন কাজই যদি না পাই, তাহলে গ্রামে গিয়ে ক্ষেত চাষ করব। শহুরে যান্ত্রিক জীবন এমনিতেও আমাকে টানে না। মানুষের কথা আগের মত আর গায়ে লাগে না। কেউ যদি বলে ‘আমেরিকা ফেরত চাষা’, বলুক। আমার খারাপ লাগে যে, কোটি মানুষের করের টাকায় শেখা বিদ্যা কাজে লাগাতে পারলাম না সে জন্য। আমি তো শুধু দামী চাকরি করার জন্য পড়াশোনা করিনি, মানুষের জন্য কিছু করব সে জন্য পড়েছিলাম।

আমাদের নেতারা কাজ করার ব্যবস্থা তো করেই না, বরং কিছু করতে চাইলে বাধা দেয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্ষমতার লোভে সেই নেতাদের কদমবুসি করেন, অদৃশ্য ইশারায় সফেদ ইউনিকর্ন ছেড়ে নেড়ি কুকুর বেছে নেন। আমাদের শিল্পপতিরা গরীব-গুর্বো মানুষের একটু ভাল থাকা-একটু ভাল খাওয়ার জন্য কিছু করতে রাজি নন, বরং তাদের গলায় ফাঁস বেঁধে পয়সা কামাতে চান। আমি অতি তুচ্ছ, নগণ্য মানুষ আর কী করব? অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। মরতে তো একদিন হবেই। তোমরাও মরবে, আমিও মরব। তোমরা আজ যা করছ তার জবাবটা না হয় শেষ বিচারের দিনেই শুনে নেব।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

ফোর্ট ওয়েইন, ২০শে রমাদান, ১৪৩২ হিজরি।

মন্তব্য করুন

Back to top button