জীবনের বাঁকে বাঁকে

এভারেস্ট বিজয়

১.

বেড়াতে যাওয়া ব্যাপারটা আমার রক্তে মিশে আছে। বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাওয়ার সময় ‘কোথায় যাওয়া যায়’ – এ মর্মে যখন তর্ক উঠত – আমার ভোট সব সময় পাহাড়ের পক্ষে ছিল। বান্দরবান, রাঙামাটির বা টেকনাফের পিচ্চি পিচ্চি পাহাড়, কিংবা সিলেটের টিলাগুলো – মাটি থেকে আকাশপানে উঠে গেছে এমন কিছু দেখলেই আমার তাতে উঠতে ইচ্ছে করত। মাধবকুন্ডে এমনিভাবে পাহাড় বাইতে গিয়ে একবার আবিষ্কার করেছিলাম আর নামতে পারছিনা। সেদিন সচেতনভাবে মৃত্যুভয় উপলব্ধি করার পরেও পাহাড়ের প্রতি টান আমার একটুও কমেনি। সম্প্রতি আমার মতই পাহাড়-প্রাণ কিছু বাঙালী পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছে – ব্যাপারটাতে আমার তীব্র আনন্দ হওয়ার কথা ছিল। হল তার পুরো উলটো। মিডিয়া এবং মধ্যবিত্তের উচ্ছাস দেখে গভীর একটা মন খারাপ করা বোধ গ্রাস করল।

বেশ টানাপোড়েনের সংসারে বড় হওয়ায় কোন কাজ করার আগে সেটার অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বিবেচনা করা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। মাকে দেখতাম বিশাল টেবুলেশন খাতায় ডিগ্রী পরীক্ষার্থীদের নম্বর উঠাচ্ছেন। সীমিত বেতনের বাইরে এ অতিরিক্ত কামাইটুকু দিয়ে আমাদের নিয়ে যাবেন কক্সবাজারে বেড়াতে। আবার কখনও ভাগ্য তত সুপ্রসন্ন হয়নি, স্কুল থেকে জাম্বুরিতে যাচ্ছে স্কাউট দল, ক্যাম্প ফি ৫০০ টাকা। জানি মা দিতে পারবেন না, তাই তাকে বলেছি – ধুর জাম্বুরিতে গিয়ে কি হবে? সন্ধ্যায় গোধূলী আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্যাম্পফায়ারের আগুনটা কল্পনা করে নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে যতবার বেড়াতে গিয়েছি, ছাত্র পড়ানোর জমানো টাকার উপরে চলেছি – মার কাছে হাত পাতিনি কখনও। মাউন্ট এভারেস্টে উঠতে নিদেনপক্ষে খরচ হয় ৪০,০০০ হাজার ডলার, ৩২ লক্ষ টাকা। যারা ‘পর্বত বিজয়’ করছেন তাদের নিজেদের এত টাকা নেই; তারা হাত পেতেছেন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর কাছে – ভদ্রভাষায় বললে ‘স্পন্সর’।

খবরের কাগজ জুড়ে ছবি আসবে, প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী দলীয় নেত্রী ঐক্যমত্যে শুভেচ্ছা বাণী দেবেন, সুশীল সমাজ সম্বর্ধনা দেবে। স্পন্সর মেলাটা অস্বাভাবিক না, এত বড় অর্জনকে ছোট করে দেখাও ঠিক না। আমার খালি বুকে খচখচ করতে থাকে যে নাজমুল ইসলাম অপু তার বোনের গিলিয়ান-ব্যেরি সিনড্রোম রোগের চিকিৎসার জন্য ১৩ লক্ষ টাকা জোগাড় করতে পারছে না। সারাদিন বুয়েটে ক্লাস করে, বিকেলে ছাত্র পড়িয়ে, যখন সে বাংলাদেশ মেডিকেলে গিয়ে ভাগ্নে-ভাগ্নীকে কোলে নিচ্ছে তখনও তার গলায় বিশাল একটা কষ্টের দলা। আমার নিজেরও জিবিএস হয়েছিল ছোটবেলায়। মাহফুজা আক্তারের মত আমারও সারা শরীর অবশ ছিল। আমার মা গলার হার নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের কাছে গিয়েছিলেন – বন্ধক রেখে টাকা ধার করার জন্য।

মাহফুজা আক্তার মরলে বা বাঁচলে কি যায় আসে? তার ছোট দু’টো বাচ্চা মা-হারা হলে কি যায় আসে? অপুর কান্না তো কোন জাতীয় সমস্যা না। টাকা নেই, তাই চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এটা তো কোন জাতীয় অপমান না। বোধহয় একানব্বুই সালের রোগটা আমার মস্তিষ্কের সেই জায়গাটা এখনও অবশ করে রেখেছে যেটা ৪৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এভারেস্ট বিজয়ের সম্মান বুঝতে পারত।

২.

যেহেতু আমি নিম্ন-মধ্যবিত্তের সন্তান, নিম্নবিত্তের মানুষদের কখনও পর মনে হয়নি। নিঝুম দ্বীপ কি সেন্টমার্টিন বেড়াতে গেলে কথা বলেছি জেলেদের সাথে। সিরাজগঞ্জের নদীভাঙা মানুষ কিংবা লালমনিরহাটের চরের বাসিন্দা – প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার শিকার শত মানুষের সাথে কথা বলেও কখন যে পদটি শুনতে পাইনি তা হল – ‘প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ’; এটি নিতান্তই সেসব বাবুদের আবিষ্কার যারা এনজিওর নামে এদেশের দারিদ্র্য বিপণন করে ভোগবাদী পশ্চিমাদের কাছে। তাইতো ব্র্যাকের মত বহুজাতিক এবং বহুমাত্রিক ব্যবসা পরিচালনাকারী ধনকুবের সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গেলে জ্বলজ্বল করে দানের বাক্স – Donate Now!

আচ্ছা প্রকৃতি বলে কি কেউ আছে? সাগরের কি মন আছে যে সে ঠিক করল আজ রাতে জলোচ্ছাস করবে উপকূলে? বাতাসের কি মস্তিষ্ক আছে যে সে ঘূর্ণিঝড়ে সব কিছু লন্ডভন্ড করার পরিকল্পনা করবে? ভূমিকম্প কি মাটির ইচ্ছেয় হয়? আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি – মাটি, পানি, বাতাস, আগুন ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদানগুলো আল্লাহর হুকুমাধীন। যখন কোন জনপদ তার অবাধ্যতায় সীমালঙ্ঘন করে তখন তিনি তাদের সাবধান করার জন্য এই উপাদানগুলো ব্যবহার করেন। প্রকৃতির সাথে তাই যুদ্ধ করা চলেনা। আল্লাহর সাথে কেউ যুদ্ধ করতে পারেনা। এই পৃথিবীর সাথে মানুষের সহাবস্থান চলতে পারে কারণ পার্থিব উপাদানগুলোকে অপচয় ছাড়া ব্যবহার করার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন।

বিংশ শতাব্দীতে অধর্মের বাণী যখন থেকে জোরেশোরে প্রচার হতে লাগল, তখন থেকে মানুষকে বোঝানো শুরু হল যে আমরা প্রকৃতিকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখি। সিনেমাগুলোতে দেখান শুরু হল কিভাবে ঝড়, আগ্নেয়গিরি, ভূমিধ্বস, সুনামি ইত্যাদির সাথে যুদ্ধ করে দিব্যি মানুষ জিতে যাচ্ছে। পৃথিবী ধ্বংসকারী কিয়ামাতকে হলিউড বিকৃত করল এবং বিক্রি করল। কখন এলিয়েনের ছদ্মবেশে মহাজাগতিক শক্তি, কখনও বিশাল কোন ধূমকেতু – সবাই চায় ধরিত্রী ধ্বংস করতে। আর পৃথিবীর মানুষেরা একজন বুদ্ধিমান সাহসী পুরুষ এবং একজন সুদর্শনা নারীর বদৌলতে সে বিপদ ঠেকিয়ে দেয় শেষমেশ। মানুষকে বুঝিয়ে দেয়া হল – এখন আমরা অনেক উন্নত, সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখি। পৃথিবী ধ্বংসের যেসব বর্ণনা ধর্মগ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায় সবই অলীক কেচ্ছা। যে এই পৃথিবী ধ্বংস করতে চায় সে হচ্ছে চরম অশুভ শক্তি – আমাদের মানুষদের কাজ সর্বশক্তিতে এই অশুভ শক্তির বিরোধীতা করা, তাকে ঘৃণা করা। এভাবে যে পৃথিবী আল্লাহর সৃষ্টি করলেন একদিন ধ্বংস করে দেবেন বলে, সে পৃথিবীকে অমরত্ব দেয়া হল। শত্রু ভাবতে শেখানো হল আল্লাহকে, যিনি এ জগত থেকে অনেকগুণে উত্তম বাসস্থান তৈরী করে রেখেছিলেন আমাদের জন্য।

শিল্প বিপ্লবোত্তর বস্তুবাদী পশ্চিমা দর্শন যখন মানুষের মনে গেঁথে গেল তখন সে প্রকৃতিকে ভুল বোঝা শুরু করল। নদীতে বাঁধ দিয়ে তাকে শাসন করাকে আরাধনা হিসেবে বিবেচনা করল। যে পর্বতের সামনে দাঁড়িয়ে তার নিজের ক্ষুদ্রতার কথা মনে হওয়ার কথা ছিল – সেই পর্বতের চূড়ায় ওঠাকে সে বিজয় বলে মনে করল। কোন পাহাড় তৈরী করা দূরে থাক, সেটার গায়ে গর্ত খুঁড়ে একটা সুড়ঙ্গ তৈরী করতে মানুষের কত প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। আর দিনের পর দিন পরিশ্রম করে, কত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে, কত সময় ব্যয় করে – শুধুমাত্র চূড়ায় উঠে পতাকা দোলানোর নাম নাকি বিজয়! ভূমন্ডলের সর্বোচ্চ স্থানটাকে পদাবনত করার নাম নাকি বিশ্বজয়! এটা নাকি মানুষের সাহসিকতার বিজয়, তার শারীরিক সামর্থ্যের বিজয়!

এ পৃথিবীতে ৮ কিলোমিটারের অধিক উচ্চতার ১৪টি পর্বতচূড়া আছে, সবগুলোই হিমালয়-কারাকোরাম রেঞ্জে অবস্থিত। এদের মধ্যে ১৯৫০ সালে প্রথম মানুষ অন্নপূর্ণার চূড়ায় ওঠে। কারা উঠেছিল? ফরাসী এক অভিযাত্রী দল। আচ্ছা, এত বছর ধরে পাক-ভারত-নেপালের যে মানুষেরা এই পাহাড়গুলোতে থাকত, তাদের কি শারীরিক সামর্থ্যের অভাব ছিল? যে শেরপাদের সাহায্য নিয়ে হিলারি প্রথম এভারেস্টে উঠলেন সেই শেরপাদের কি ক্ষমতা ছিল না চূড়াগুলো জয় করার? বাংলাতে শয়ে শয়ে কবিতা আর গান রচিত হল যে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে নিয়ে সেটাতে চড়ার শখ কেন হল না বাঙালীদের? হয়ত, আমরা উপমহাদেশের মানুষেরা শান্তশিষ্ট প্রকৃতির – ডানপিটেমো একেবারেই ভালবাসিনা।

অথবা হয়ত পাহাড়ে চড়া মানে পাহাড় বিজয়, এবং এটা না করতে পারলে মানবজন্ম বৃথা যাবে, জাতি হিসেবে আমরা খুবই তুচ্ছ, নগণ্য, ছোট হয়ে যাব – এই বোধ কখনও আমাদের মননে আসেনি। যবে থেকে পশ্চিমারা এসে আমাদের পাহাড়ে চড়ে ‘পর্বত জয়’ করে গিয়েছে তবে থেকে আমাদের বোধোদয় হয়েছে – পাহাড়ে না উঠলে যে জাতে ওঠা যাচ্ছে না। যখন হিমালয়কে পদানত করে দেবালয়ের অস্তিত্বহীনতাকে প্রমাণ করে দিল ম্লেচ্ছ সাহেবরা, তখন মান বাঁচানোর জন্য তো পর্বতবিজয় অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল।

আমাদের আদর্শ সাদা চামড়ার মানুষেরা, তাদের মত হওয়ার জন্য আমরা ফেয়ার এন্ড লাভলি ঘষে গায়ের রঙ অবধি বদলে ফেলতে চাই – পেশীশক্তি প্রমাণের জন্য যে পাহাড় বাইব সেটাও ভারী যুক্তিযুক্ত। বঙ্গবাজারে দু’শ টাকায় নাইকির ‘আসল’ জুতা পাওয়া যায়। আমরা যখন কোন কিছুকে নকল করব, তখন যত ভালভাবে নকল করা যায় ততই ভাল। পশ্চিমারা দুর্গমগিরি লঙ্ঘন করে জাতি হিসেবে গর্বিত হয়েছে। আমরা সেই গর্ববোধ নকল করার প্রচেষ্টায় ৪৭তম হয়েছি। এ প্রাপ্তি কম কিসের?

পুরনোদিনে সরিষা ভাঙা হত ঘানিতে। সেখানে যে বলদটি দিনমান একই অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরে ফিরত তার চোখে পরিয়ে দেয়া হত ঠুলি। বলদ নিশ্চিন্তমনে, আনন্দচিত্তে ঘুরপাক খেতে থাকত। আধুনিক সমাজের শোষণকাঠামোতে বলদের বদলে মানুষ জুড়ে দেয়া হয়েছে। এদের চোখে ঠুলি হিসেবে পরানো হয়েছে মিথ্যা গর্ববোধ। বাংলাদেশী মেয়ে নিশাত এভারেস্ট বিজয় করেছে –আহা কি আনন্দ! বাংলাদেশী সাকিব আইপিএলে ঝড় তুলেছে – আহা এত গর্ব রাখি কোথায়? বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত সিলটি ফুরী ব্রিটেনে এমপি হয়েছে – পাটা মাটিতে পড়েই না। এদিকে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পুলিশের মার খেয়ে মারা যাচ্ছেন, তাতে আমাদের ভাববিকার নেই। মন্ত্রীর দুর্নীতি ধরা পড়ায় ড্রাইভার বেচারা গুম হয়ে গেল। সাধারণ মানুষ তো আগেই হচ্ছিল, প্রাক্তন সন্ত্রাসী, দাপুটে রাজনীতিক রাত-দুপুরে হাওয়া হয়ে গেল! আর তার প্রতিবাদে আরেক ড্রাইভারের জ্যান্ত দেহ দাহ করা হল গাড়ীসমেত। আমার বাবা গ্রামে ফুলকপি চাষ করে তার খরচটুকুও তুলতে পারেননা, আর এদিকে ঢাকায় কাঁচাবাজারে গেলে মুখ কাল করে ফেরেন।

চলছে জনগণ গাধার মত। কাধে ঋণের বোঝা, পিঠে পেটমোটা মন্ত্রী আর আমলার দঙ্গল। খালি চোখের সামনে প্রাপ্তির মূলো – সমুদ্রসীমা জয়, এভারেস্ট বিজয়, দৌড়া – বাংলার বাঘ আইল! একি যা তা মূলো? এ আমাদের জাতীয় অহংকার! শিক্ষিত উচ্চ আর মধ্যবিত্তের মাথায় ঢুকল: খাও-দাও-ফুর্তি কর, এ দেশের অসামান্য সন্তানদের কৃতিত্বে গর্ববোধ করতে থাক। আর সাধারণ মানুষের দুষ্কৃতিতে কষে গালি দিয়ে বল – ‘শালার চোরের দেশে সব শালাই চোর’’

৩.

আমরা বন্ধুরা মিলে যখন বেড়াতে যেতাম, তখন মূল উদ্দেশ্য থাকত ঢাকার দমবন্ধ করা আটপৌরে জীবন থেকে মুক্তি নেয়া। প্রকৃতির কাছাকাছি হওয়া, তার সৌন্দর্যটা দুচোখ ভরে দেখা। আজ যখন সুরা নাবায় ‘জান্নাতুন আলফাফা’ বা ঘন সবুজ উদ্যান কথাটা পড়ি তখন মনের পর্দায় ভেসে যায় শঙ্খনদীর দু’তীরের ছবিগুলো। আমাদের এই সমস্ত ঘুরে বেড়ানো থেকে জাগতিক কোন লাভ হয়নি, বরং জমানো টাকা খরচ হয়েছে। এ ভ্রমণ থেকে কি লাভ হয়েছে সেটা শীশা-লাউঞ্জে বসে মাস্তি করতে থাকা তরুণদের বোঝানো যাবে না। থাইল্যান্ডে ত্রিশ হাজার টাকায় বডি ম্যাসেজ করতে যাওয়া ধনকুবেররা বুঝবেনা নৌকা ভাড়া বাঁচাতে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে রুমাবাজার পর্যন্ত হেটে এসেও ক্লান্ত এগার জোড়া পা মসজিদে জামাতে দাঁড়িয়েছিল কি জন্য। কারো কোন ভাল কাজ দেখে নিজের সেটি করার ইচ্ছা জাগাকে বলে অনুপ্রেরণা। অন্যের কোন অর্থহীন কাজকে নিয়ে আত্মতৃপ্তি বোধকে বলে বোকামো।

ন’টা-ছ’টা অফিস শেষে তিন ঘন্টা রাস্তায় বসে জীবন কাটিয়ে দেয়া মানুষের পঙ্গপালকে বোঝানো খুব কঠিন যে জীবন মানে কি। এরা এক বিশাল নগরীতে পানি-বাতাস ছাড়াও যে কোন মূল্যে আঁকড়ে পড়ে থাকাকেই জীবনের সফলতা মনে করে। এরা হয়ত কখনও বুঝবে না ফাই-ফরমাশ খাটা পিওনটার চেয়ে একজন পাহাড়ী জুম চাষী অনেক সজীব জীবন যাপন করে। সে নীল আকাশ দেখে, সাদা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়, আঁজলা ভরে শীতল স্বচ্ছ পানি পান করে। গবাদিপশুর মত জীবন যাপন করে যাওয়া নাগরিকের ইচ্ছে নেই দুনিয়াটা দেখতে চাওয়ার – বুকে সাহস নেই জমানো টাকাতে হাত দেয়ার, দেহে হিম্মত নেই বনের পথে মাইলকে মাইল হেটে বেড়ানোর। আরে হাটতেই যদি রাজী ছিলাম তাহলে কি মহাখালি থেকে মোহাম্মদপুর, এক ঘন্টার পথ তিন ঘন্টা বাসে বসে থাকি? আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য তাই পাহাড় জয়ের গল্প ঔষধ হিসেবে কাজ করে। যে ঔষধ জাতির একজন খেলে বাকি সবাই ঔষধপানকারীর সুস্বাস্থ্য কামনার মাধ্যমে আপন কর্তব্য থেকে ভারমুক্ত হয়। ‘মাথায় ছোট বহরে বড় বাঙালি’ সন্তানের উপযুক্ত ঔষধ বটে!

একজন নারীর যে মাহরাম পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ভ্রমণ করা অনুচিত সেই ইসলামী জ্ঞান বিতরণ করব না। চলার পথে আরোহণকারীরা মুসলিম হিসেবে দাবী করার ন্যুনতম কর্তব্য – দৈনিক পাঁচবার সলাত আদায় করেছেন কিনা সে প্রশ্নও তুলব না। মাউন্টেনিয়ারিং এর মত ব্যয়বহুল ক্রীড়া আমাদের মত ছাপোষা গরীব জাতির পোষায় কিনা সে তর্কেও যাবনা। IPL এর অনুকরণে BPL করে যখন সাদা চামড়ার অতীত প্রভুদের টেক্কা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি সেখানে মাউন্টেনিয়ারিং আর কি দোষ করল? এক রঙের ঠুলি পরে থাকতে আর কত ভাল লাগে? বলদ বলে কি আমরা মানুষ না?

কোন একটা কঠিন কাজ করার প্রচেষ্টা, সেটা করার জেদ থাকা এবং শেষমেশ সফল হওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু সে কঠিন কাজটা অর্থবহ হলে ভাল হয় না? মানুষ যখন অভিনন্দনের প্লাবন বইয়ে দিচ্ছে তখন বোন নিশাত মজুমদারের একটা উক্তি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে –

“একটা প্রশ্ন খালি ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মনের মধ্যে। কেন মানুষ এতো কষ্ট করে পর্বতারোহণ করে। আমি এর কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। এতো কষ্ট করে কি দরকার পর্বতারোহণ করার। তো এভারেস্টের শীর্ষে পা রেখে সেই প্রশ্নটার কি কোন উত্তর পেয়েছেন? এর জবাবে নিশাত বলেন, এখনও নিজেকে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর পাইনি।”

এভারেস্টের তথাকথিত বিজয় এবং সেটা নিয়ে মানুষের আদিখ্যেতাতে মনে হচ্ছে এটাই বুঝি মানবজনমের সাফল্যের মাপকাঠি। আমরা বিনোদনের জন্য যা করি সেটা জীবনের অনুষঙ্গ হলেও কখনও জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। যারা ক্রীড়া-কৌতুককে জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়ে নিয়েছেন তারা কি ভেবে দেখেছে মানুষের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? পুরষ্কার, সম্মাননা আর তথাকথিত জনগণের ভালবাসা মরার পরে আসলে কি কাজে লাগে? ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা নামের মূল্য কত? প্রকৃতিকে আবিষ্কার করা মানে তাকে হারিয়ে দেয়া নয়, তাকে চেনা – তার স্রষ্টার ক্ষমতার বিশালত্ব উপলব্ধি করা। এভারেস্ট বিজিত হয়েছে এই মিথ্যা গর্ববোধ সেই উপলব্ধি আনবে না। কারণ এ কাজটি করতে হবে প্রত্যেক মানুষকে, একাকী, ব্যক্তিগতভাবে। কারো হয়ত জানালা দিয়ে গলে আসা এক চিলতে চাঁদের আলো চেয়ে দেখলেই চোখটা খুলে যাবে। কারো চোখ খুলবে কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত, বগার নীল হৃদ কিংবা শুভলং এর ঝর্ণা দেখে। আর যারা চোখ খুলতে নারাজ তারা মিথ্যা আত্মতৃপ্তি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে।

আল্লাহ যেন আমাদের চোখের ঠুলিটা খুলে ফেলে তার দুনিয়াটা দেখার সামর্থ্য দেন। আল্লাহ যেন আমাদের মিথ্যা বিজয়ের আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য বিজয়টা উপলব্ধি করার তৌফিক দেন। আমিন।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

৩০ শে জুমাদাউস সানি, ১৪৩৩ হিজরি।

মন্তব্য করুন

Back to top button