আগুন দেখা

কুর’আন পড়ার ব্যাপারে আল্লাহর চমৎকার একটি দিক নির্দেশনা আছে – তাদাব্বুর। অর্থাৎ নেহায়েত পড়ে যাওয়ার বদলে সক্রিয় পঠন। আমরা পড়ব, ভাবব, আমাদের চারপাশের সাথে মিলিয়ে দেখব। কুর’আনের তাফসির পড়লে চমৎকৃত হতে হয় যে আমাদের পূর্বসূরী আলিমরা কী গভীর অধ্যায়নই না করে গেছেন। তাদাব্বুর মানে কিন্তু তাফসির রচনা নয়। কুর’আনকে আমাদের মতো করে ব্যাখ্যা করতে গেলে বিপদ আছে, তাফসিরের জন্য সালাফদের কাছে এবং সাথে থাকাই নিরাপদ। বর্তমান প্রেক্ষাপটেো ক্লাসিকাল স্কলারদের তাফসির কার্যকর। এ পাঠ অনেক সময় অনেক নতুন চিন্তা জগতের দরজা খুলে দেয়।
যেমন ধরা যাক সূরা মুত্বফ্ফিফিনের শেষ অংশগুলোর কথা। ‘আম্মা পারায় অবস্থিত ৮৩ নম্বর এ সূরাটি শেষ করা হয়েছে যেনবা উত্তরাধুনিক একটি দৃশ্যপট দিয়ে। আপনাকে নিয়ে য়ুনিভার্সিটিতে সবাই বেশ হাসাহাসি করে। আপনার দাঁড়ি দেখে। মেয়েদের সাথে কথা বলার অনাগ্রহ দেখে। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে গিয়েও সময়মত সলাত পড়া দেখে। আপনাকে নিয়ে আপনার অফিসে সবার কৌতুক মিশ্রিত কৌতুহল আছে। এই লোক করপোরেট জগতে টিকবে কীভাবে? আপনি রুমে ঢুকলে একজন কলিগ বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে পাশের মানুষটিকে চোখ টিপ মেরে ইশারা করল, ‘হুজুর আসছে’। সুদ নিয়ে আতঙ্কিত হয়। অফিস পার্টিতে শরাব চাখা তো দূরে থাক, পার্টির পথই মাড়ায় না। সে পার্টিতে আলোচনার বিষয়বস্তু আপনি। আপনি বুদ্ধু, গোল্লায় গেছেন।
যারা নিজেরা পাপে ডুবে আছে তারা একটুও নিজেদের নিয়ে চিন্তিত নয়। বিবেকে তালা ঝোলানো আছে। বাপ-মায়ের সূত্রে চালু এসব মুসলিমদের বিনোদনের খোরাক ঈমান আনা মুসলিমরা। যারা আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ বলে স্বীকার করে নিয়েছে। আল্লাহর হুকুমগুলো আপন জীবনে মানা শুরু করেছে। গভীরভাবে বিশ্বাস করতে শিখেছে যে একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
যারা মানসচক্ষে ব্যাপারটাকে কল্পনা করতে পারছেন তাদের জন্য একটা সাহিত্যিক স্বাদ অপেক্ষা করছে এর পরে। আল্লাহ সুবহানাহু সূরাটা শেষ করলেন টেবলটা উলটে দিয়ে।
এমন একটা দিন আসবে যেদিন সত্যিকারের মুসলিমরা হাসবে। কুফফারদের দিকে তাকিয়ে। তারা উঁচু আসনে বসে দেখবে আর হাসবে। হাসির ঋণ শোধ হাসিতেই। এরপরে শেষ বাক্যে আল্লাহ যে শব্দতীর ছুড়েছেন সেটার শক্তি ধারণ করার সাধ্য আমার নেই। কাফিরদের জন্য অতীতকাল ব্যবহার করে একটা ভবিষ্যদ্বাণী আছে। তাতে একটা তাচ্ছিল্য আছে। হুমকি আছে। মুসলিমদের প্রতি আশার বাণী আছে: কাফেররা যা করে তার পুরষ্কার কী তাদের দেওয়া হয়নি?
ভবিষ্যতে যা হবে তার জন্য অতীতকাল কেন? কালচিন্তা মানুষের – আল্লাহর কাছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত একই সাথে, একই সমতলে। আল্লাহ সুবহানাহু সময়ের প্রবাহের উর্ধে। তবে মানুষ নয়। তাই মানুষকে বলা—অতীতে যা ঘটেছে সেটা যেমন নিশ্চিত তেমন ভবিষ্যতেও যে কাফেরদের পাওনা হিসেবমতো বুঝিয়ে দেওয়া হবে সেটাও নিশ্চিত। তুমি তখন উঁচু আসনে বসে বসে দেখবে। আর হাসবে।
উত্তরাধুনিকতা থেকে সমকালে নামি।
ইসরায়েলের ইয়াহুদ কাফেররা ইদানিং পাহাড়ে চড়া শিখেছে। গার্ডেন চেয়ার, গাড়ির সিট এমনকি সোফা নিয়ে এরা অবসরে বসে পাহাড়ের চূড়ায়। হাতে বিয়ারের ক্যান। হালকা খাবার সাথে। চুমুক দিচ্ছে মদের বোতলে আর হাসছে। কী দেখে হাসছে? কীসের ছবি তুলছে স্মার্ট ফোনে? কী শুনছে কান পেতে?
জনবসতিতে বোমা পড়ার দৃশ্য দেখে আনন্দে গড়িয়ে পড়ছে এই কাফেররা। হত্যাযজ্ঞের ছবি তুলছে। আহত শিশুদের চিৎকার শুনে আনন্দ প্রকাশ করছে পশুর চেয়েও অধম এই কুফফার শ্রেণী।
এই দৃশ্যটি ধরে রাখা আছে আল-কুর’আনে। সূরা বুরুজে। আল্লাহ সুবহানাহু দু’দলের কসম করেছেন। যারা দেখছে, যাদের দেখা হচ্ছে। বিশাল এক পরীখা খুড়েছিল কাফিররা। তাতে আগুন ঢেলেছিল। এরপর মুসলিমদের ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল এই আগুনের গর্তে। তারপর গর্তের ধারে বসে তারিয়ে তারিয়ে মজা নিচ্ছিল। মানুষ পুড়তে দেখার মজা। কত শত বছর আগেকার দৃশ্য। আজও গাজাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। পুরো গাজাটাই এখন উখদুদ—আগুনে গর্ত। তরুণ-নারী-বৃদ্ধ-শিশু – তাদের অপরাধ তারা মুসলিম। এতই অবুঝ শিশু যারা এই যুদ্ধের দামামাতেও সাগর তীরে খেলছিল। সেখানেও আঘাত হানে আগুনে মিসাইল। ইসরায়েলের আত্মরক্ষা!
সারা বিশ্ব বসে বসে মজা দেখছে। ইসরায়েলের ইহুদিরা পাহাড়ে আর তাদের অভিভাবকরা মিডিয়ার পর্দায়। ফেসবুক আর পত্রিকার ছবিতে।
সূরা বুরুজে আল্লাহ আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন—তিনি সবকিছুর সাক্ষী, শুধু নিষ্ক্রিয় দর্শক নয় সাক্ষী। তাঁর শাস্তি ভয়াবহ, মর্মন্তুদ। কী শাস্তি আছে এই কুফফারদের জন্য আমরা ভাষায় বোঝাতে পারব না। তবে আজ যারা বোমায় নিহত হচ্ছেন, তাদের জন্য একটি দিন আসবে। সেদিন নির্যাতিত শহীদেরা উঁচু আসনে বসে বসে কাফেরদের শাস্তি দেখবে আর হাসবে। আল্লাহ এভাবেই একটুও অবিচার না করে পাল্লার দুই দিকটিকে সমান করে দেন।
আল্লাহ বলেছেন কুফফারদের পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হবে। কড়ায়-গণ্ডায়। সে পাওনাটা অনন্তকালের জন্য চলতে থাকবে। আজকে বোমা হামলায় আহত কিশোরটি দুদিন কষ্ট পাবে তারপর সে আল্লাহর সন্তুষ্টির সান্নিধ্যে চলে যাবে। করুণা তো তাই ফিলিস্তিনি ভাইটির জন্য না, সেই ইহুদি যুবকটির জন্য যার শাস্তির কোন শেষ থাকবে না। অনন্তকাল? জি। আল্লাহ গত ৬০ বছর ধরে ইসরায়েলকে ক্ষমতা দিয়েছেন। এই ৬০ বছরে ফিলিস্তিনকে জাহান্নাম বানানোর সব চেষ্টা করা হয়েছে এবং করা হচ্ছে। মানুষকে আল্লাহ অনন্তকাল সময় দিলে সে অনন্তকাল ধরেই আল্লাহর অবাধ্যতা করত। যুলম করত। অন্যায়-অবিচার করত। আল্লাহ তাই পরীক্ষার সময়টা বেধে দেন সামান্য কিছু ঘন্টা-দিন কিংবা বছরের হিসেবে। কিন্তু যখন আল্লাহ বিচার করে প্রতিফল দেন তার কোনো সময়সীমা থাকবে না।
আল্লাহর এ ন্যায়বিচার কিন্তু ফিলিস্তিনের জন্য আবদ্ধ নয়। ইরাক, চীন, রাশিয়া, শ্রীলংকা, আসাম, গুজরাট, বার্মা সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রযোজ্য মতিঝিলের শাপলা চত্বরের জন্যও। সাধু, সাবধান।
– শরীফ আবু হায়াত অপু