জীবনের বাঁকে বাঁকে

আত্মত্যাগ

কিছু কিছু জিনিস আমাদের চোখ সওয়া হয়ে যায়। এমনই চোখ সওয়া যে তার পেছনের কাহিনীগুলো আমরা আর আমলে দেই না। যেমন ধরা যাক টেবলের উপরে ধোঁয়া-ওঠা মাছের তরকারীটা। খেতে একদম ভালো লাগছে না—লবণ ঠিক হয়নি বলে। কিন্তু যে জিনিসগুলো ঠিক হয়েছে তার কী হবে? মাছ কাটা-ধোয়া-পেয়াজ কাটা-মসলা-বাটা-কসানো—চুলোর আগুনে ঘামা—এ কাজগুলো আমরা দেখি না, এগুলোর দামও আমরা বুঝি না। আমাদের চোখে ধরা পড়ে ডাক্তার ব্যাটা কসাই, ৫০০ টাকা কী হাজার টাকা ভিজিট নেয়। কিন্তু এর পেছনে যে কত বছরের যন্ত্রণাদায়ক পড়াশোনা লুকিয়ে আছে তার খবর কে রাখে? যে জিনিসটার খবর কেউ রাখে না তার নাম আত্মত্যাগ।

মানুষের জন্মের শুরু থেকেই আছে আত্মত্যাগের পরশ। মায়ের গর্ভধারণে কী জ্বালা ছেলেটা কোনোদিনও টের পায় না। মেয়েটা টের পায় যখন সে মা হয়। ততদিনে মায়ের জানের ওপর ওঠা শেষ। যে রাতে শিশুটা ভূমিষ্ঠ হয় সে রাতে ধাত্রী জেগে ছিল। জেগে ছিল আয়াটা। জেগে ছিল দারোয়ান। আমরা ধরে নেই এটা এদের কাজ। এরা বেতন তো পায় এটা করার জন্যই। আসলে কী টাকাই সব? আপনাকে-আমাকে টাকা দিলেই কী আমরা এ কাজগুলো করতাম? আর পৃথিবীর কত জন মানুষ তার টাকাটা হালাল করে কামাই করে?

আমাদের চারপাশে এমন অনেক কিছুই আমরা দেখি যাদের কাজটা, আত্মত্যাগটা আমরা আমাদের প্রাপ্য মনে করি, ‘অধিকার’ বলে ধরে নিই। ট্র্যাফিক পুলিশ রিকশাওয়ালার কাছ থেকেও ১০ টাকা ঘুষ খায়—খুব ছোটলোকি কাজ সন্দেহ নেই কিন্তু সে যে রোদের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আটটা ঘন্টা তার কী হবে? আমাদের দেশে আইন মানার যে দশা তাতে দুমিনিটে শহর অচল হয়ে যেত। আমরা দোষটা ধরি, গাল পাড়ি—ঠিক আছে, কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জায়গাতে আমরা নিদারুণ ছোটলোক। ঐ পুলিশটার চেয়েও। ও না হয় ইসলাম বোঝে না, আমরা এত ইসলাম বুঝে কী করলাম? যে চোখের সামনে থাকা মানুষটার কাজের জন্য ধন্যবাদ দিতে পারে না, সে অদেখা আল্লাহর কী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তা বেশ বোঝা যায়।

এই যে সমাজে থাকা মানুষগুলো সেই সমাজের অন্যান্যদের জন্য কিছু করে তার নানা চেহারা আছে, ধরণ আছে। কেউ হয়ত তার সময় দিচ্ছে। কেউ টাকা। কেউ গায়ে খেটে কাজ করে দিচ্ছে। গতবছর আমরা বাকেরগঞ্জ গিয়েছিলাম কম্বল নিয়ে। যেখানে রেখেছিলাম আর যে স্কুল থেকে বিতরণ করা হবে তার মাঝে ভালো দূরত্ব ছিল। তো আমরা ৭-৮ জন ভাগাভাগি করে কম্বলগুলো নিয়ে রওনা দিলাম। শীতের মধ্যে ঘেমে হাপিয়ে গেছি। আস্তে আস্তে হাটার গতি স্লথ হচ্ছে। আমাদের মধ্যে একজন ছিল খেলোয়ার। সে সবার আগে জায়গায় পৌছে তার বোঝা রেখে আবার ফিরে এলো আমাদের কাছে। আমাদের সবার কাছ থেকে একটা করে নিয়ে সে আবার রওনা দিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, শিভ্যালারি। আসলে এটাও একটা আত্মত্যাগ। কায়িক শ্রম দিয়ে। মানুষ এগুলো দেখে না, বোঝে না।

আত্মত্যাগের একটা অদ্ভুত দিক আছে। মানসিক প্রশান্তির দিক। দুনিয়াতে আমি শুধু আমার জন্য বাঁচি না—এটা মানুষের মনে একটা শ্রদ্ধাবোধ জন্ম দেয়। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা। নিজেকে তখন মানুষ কুকুর-বেড়ালের চেয়ে উঁচু প্রাণী হিসেবে আবিষ্কার করে। তবে এটাও অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথরের মতো। যারা যত বেশি আত্মত্যাগ করে তাদের মনে হয় কিছুই করতে পারিনি। এরা মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করে না, আল্লাহকে খুশি করার জন্য করে।

মহান আল্লাহ-ও এর বিনিময়ে কার্পণ্য করেন না। আল-কুর’আনে আল্লাহ সুবহানাহু আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ‘যা’-ই খরচ করি না কেন আল্লাহ তার বিনিময় দেন।[i] আমরা আল্লাহর এই আয়াতটা পড়ি, কিন্তু বিশ্বাস করি না। আল্লাহ তো আমাদের মানুষদের মতো ছোটলোক না যে ৫০ টাকার বিনিময়ে এক কেজি ঢেড়স দেবেন। তার বিনিময় মানুষের বিনিময়ের মতো নয়। তিনি যে কতগুণ বাড়িয়ে দেন—ইহকালে ও পরকালে এটা মানুষকে কে বোঝাবে? আমরা হাদিসে পড়ি রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, প্রকৃত মুমিন হতে হলে অন্যের জন্য তাই চাওয়া লাগবে আমরা নিজের জন্য যেটা পছন্দ করি। আমরা আমাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি—আসবাবপত্র-পোশাক-খাবার… এই আমরাই মাসজিদের হুজুরদের বেতন ঠিক করি মাসে ৩,০০০ টাকা। হুজুর মানুষ এত টাকা দিয়ে কী করবে? তবে যখন আমাদের ড্রাইভার বেতন না বাড়ালে চলে যাওয়ার হুমকি দেয় তখন ঠিকই বেতনের অংকটা দশের ঘর পেরিয়ে যায় স্বচ্ছন্দে।

উদ্বৃত্ত টাকা থেকে দেওয়াটা ত্যাগ কিন্তু এক ভাইয়ের বিপদে নিজের সঞ্চয়টা তুলে দেওয়াকে বলে আত্মত্যাগ। আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সমস্ত সম্পদ জিহাদের তহবিলে দান করার পরে বলেছিলেন যে ঘরে আল্লাহ এবং তার রসুলকে রেখে এসেছেন। আমাদের ঘরে এত জিনিস যে আল্লাহ ও তার রসুলের জায়গাই হবে না। আপদ বিদেয় করার নাম আত্মত্যাগ না, নিজের ভালোলাগার জিনিস, পছন্দের জিনিসটা দান করার নাম আত্মত্যাগ। ৫০ হাজার টাকার মোবাইল কিনে ৫০০০ টাকা দেওয়া আত্মত্যাগ না। ৫০০০ টাকার মোবাইল কিনে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া আত্মত্যাগ। যা ভালোবাসি তাকে ছেড়ে না দিতে পারলে কী আর তাকওয়া অর্জন হয়? আর আল্লাহ খুব ভালোই জানেন কে কী দেয়।[ii] কতটা রেখে কতটা দেয়।

আমরা মনে করি আমাদের দান দিয়ে অন্যদের খুব উপকার করে দিলাম। এটা আত্মত্যাগ না। সেকুলার দৃষ্টিতে দেখলে ব্যাংকে টাকা রাখা মানে আত্মত্যাগ না, সঞ্চয়। ইসলামের দৃষ্টিতে দেখলে দান মানে আল্লাহর ব্যাংকে সঞ্চয়। এমন ব্যাংক যাতে সুদ ছাড়াই জমা বাড়ে সাতশ গুণ পর্যন্ত। এমন ব্যাংক যাতে টাকা রাখলে পরকালে পুরো লাভ তো পাওয়া যায় বটেই পৃথিবীতেও দারিদ্র্য দূর হয়। সেই সঞ্চয় কী আসল সঞ্চয় না যা মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাবে?

রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন কেউ যদি কোন বিশ্বাসীকে পৃথিবীর কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করে আল্লাহ তাকে কিয়ামাতের দিন বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।[iii]

পরিশেষে একটা কথা, আমাদের অনেক ভাই-বোন তাদের টাকার অংকটা নিয়ে লজ্জায় থাকেন। প্রথমত, আল্লাহ অল্প আমল, কিন্তু নিয়মিত আমল বেশি পছন্দ করেন। যারা রমযান মাসের জাকাত দেওয়ার কালচার থেকে বেরিয়ে বছরব্যাপী আত্মত্যাগের চেষ্টায় থাকেন তারা আসলেই শ্রদ্ধাষ্পদ। হালাল কামাইয়ের সামান্য অংকের শক্তি অনেক।

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ দানের অংকের চেয়ে বেশি দেখেন মানুষের হৃদয়। কারো দানের ৫০ টাকা হয়ত আল্লাহ কবুল করে নিতে পারেন, আবার কারো ৫০ হাজার টাকা লোক দেখানোর দোষে দুষ্ট হলে দাতাকে জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে। তাই আমরা যখন টাকা দেব তখন থেকে যেন মনে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু কামনা না করি। নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নির্দ্বিধায় এগিয়ে গেলে আল্লাহ প্রতিনিয়ত আমাদের সামর্থ্য আরো বাড়িয়ে দেবেন। এমনটাই আল্লাহর সুন্নাত। তিনি বান্দাকে ভালো কাজ করার তাওফিক দেন, আবার ভালো কাজ করার পরে সেই কাজটার কয়েকগুণ বেশি বিনিময় দেন।

আল্লাহ যেন আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী হবার তাওফিক দেন। আমিন।

– শরীফ আবু হায়াত অপু


[i] সূরা সাবা’, ৩৪:৩৯

[ii] সূরা আলে ইমরান, ৩:৯২

[iii] সহীহ মুসলিম

মন্তব্য করুন

Back to top button