স্রষ্টা ও সৃষ্টি

মানব সৃষ্টির ইতিহাস


রফীক আহমাদ


পৃথিবীতে মানবজাতি মহান আল্লাহ তা‘আলার এক অনন্য সৃষ্টি। শ্রেষ্ঠ কাজ করার জন্যই মানুষের সৃষ্টি। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। অতঃপর শ্রেষ্ঠত্বের এক সম্মানজনক আনুষ্ঠানিকতা পালনের ইচ্ছায় ফেরেশতাকুলকে আদম (আঃ)-এর প্রতি সিজদা করার আদেশ করেন। শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের প্রতিহিংসায় ইবলীস আল্লাহ আদেশ অমান্য করল। সে আদম (আঃ)-কে সিজদা করল না, বাকী সকলেই সিজদা করল। ফলে মানব সৃষ্টিতে এক বিতর্কের অবতারণা হ’ল।
মহান প্রভু এসব কিছুই জানতেন। তিনি মানুষকে ইবলীসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সর্বদাই জয়ী থাকার জন্য জ্ঞান-বিবেক সহ সৃষ্টি করে বহু পরামর্শ দান করেন। এদিকে ইবলীস এবং প্রাথমিক বিজয়ে বিপর্যস্ত আদম (আঃ)-কে পৃথিবীতে আগমন করতে হয়। এরপরই শুরু হয় মানব জাতির চরম ক্ষতি সাধনে ইবলীস এর দুর্গম অভিযান। ইবলীসের মিথ্যা ও কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের নিকট পরাজয়ের পর আদম (আঃ) লজ্জিত হন এবং আল্লাহ নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরম করুণাময়  আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ক্ষমা করে দেন এবং বিশেষ বিশেষ উপদেশমালাসহ পৃথিবীতে সাময়িক নির্বাসন দেন। এরপর আদম (আঃ)-এর পরবর্তী জীবন সাফল্যের মধ্যেই অতিবাহিত হয়।
আদম (আঃ)-এর জন্মবৃত্তান্ত ও প্রাথমিক বিপর্যয়ের ইতিহাস পবিত্র কুরআনে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, এখানে তা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হ’ল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّيْ جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيْفَةً قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيْهَا مَنْ يُّفْسِدُ فِيْهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّيْ أَعْلَمُ مَا لاَ تَعْلَمُوْنَ- وَعَلَّمَ آدَمَ الأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلاَئِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُوْنِيْ بِأَسْمَاء هَـؤُلاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ- قَالُواْ سُبْحَانَكَ لاَ عِلْمَ لَنَا إِلاَّ مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيْمُ الْحَكِيْمُ- قَالَ يَا آدَمُ أَنبِئْهُم بِأَسْمَآئِهِمْ فَلَمَّا أَنبَأَهُمْ بِأَسْمَآئِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّيْ أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُوْنَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ- وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلاَئِكَةِ اسْجُدُواْ لآدَمَ فَسَجَدُواْ
إِلاَّ إِبْلِيْسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ-
‘আপনার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে দাঙ্গা-দাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদাই আপনার গুণকীর্তন করছি এবং আপনার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। আল্লাহ বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না। আর আল্লাহ তা‘আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্ত্ত সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্ত্তকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। তারা বলল, আপনি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে আপনি যা আমাদেরকে শিখিয়েছেন (সেগুলো ব্যতীত), নিশ্চয় আপনিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন হেকমতওয়ালা। আল্লাহ বললেন, হে আদম! ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত আছি? আর সে বিষয়ও জানি, যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর। যখন আমি আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিলাম, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করল। সে আদেশ পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (বাক্বারাহ ২/৩০-৩৪)
একই বিষয়বস্ত্তর উপর অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّيْ خَالِقٌ بَشَراً مِّنْ صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ- فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيْهِ مِنْ رُّوْحِيْ فَقَعُواْ لَهُ سَاجِدِيْنَ- فَسَجَدَ الْمَلَآئِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُوْنَ- إِلاَّ إِبْلِيْسَ أَبَى أَن يَكُوْنَ مَعَ السَّاجِدِينَ- قَالَ يَا إِبْلِيْسُ مَا لَكَ أَلاَّ تَكُوْنَ مَعَ السَّاجِدِيْنَ- قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ- قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيْمٌ-
‘আপনার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি পচা কর্দম থেকে তৈরী বিশুদ্ধ ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্ট একটি মানব জাতির পত্তন করব। অতঃপর যখন তাকে ঠিকঠাক করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁক দেব, তখন তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যেও। তখন ফেরেশতারা সবাই মিলে সিজদা করল। কিন্তু ইবলীস সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হ’তে অস্বীকার করল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস, তোমার কী হ’ল যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হ’তে স্বীকৃত হ’লে না? ইবলীস বলল, আমি এমন নই যে, একজন মানবকে সিজদা করব, যাকে আপনি পচাকর্দম থেকে তৈরী ঠনঠনে বিশুষ্ক মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। তুমি বিতাড়িত’ (হিজর ১৫/২৮-৩৪)
মানব জাতির অলৌকিক সৃষ্টি এবং এর অন্যতম বিশেষত্বের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। এগুলোর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ নিঃসন্দেহে সাদৃশ্যপূর্ণ। শুধু বিষয়বস্ত্ত হ’তে কোন অজুহাত খাড়া করে কেউ সরে না পড়তে পারে, এজন্যেই উপরোক্ত আয়াতগুলো পুনঃপুনঃভাবে বর্ণিত হয়েছে। এখানে দৃশ্যতঃ হযরত আদম (আঃ)-কে সিজদা করতে বলা হ’লেও পরোক্ষভাবে মানুষের শ্রেষ্ঠ আত্মাকেই তা বলা হয়েছে এবং সমগ্র মানব মন্ডলীকে বললেও তা অত্যুক্তি হবে না। তাই মহাপবিত্র কুরআনুল করীমের মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়াতগুলো যে কোন মানবাত্মাকে মহৎ হ’তে মহত্তর করার এক অব্যর্থ অবলম্বন।
এ পর্যন্ত আলোচিত উপরের আয়াতগুলোতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, মানবসৃষ্টির মূল উৎস বা সূচনার অন্যতম প্রধান উপাদান মাটি। তাই তার স্বভাব ও আচরণের মধ্যে মাটির মানুষ অর্থাৎ অত্যন্ত সহিষ্ণু ও শান্ত প্রকৃতির মানুষের গুণাগুণ বিরাজমান। মানুষের বংশগতি, স্বভাব ও আগমন বার্তায় কোন প্রকারের পঙ্কিলতা নেই। এজন্য মানবকুল শিরোমণি আদম (আঃ) তাঁর সত্য, সরল, সহজ মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইবলীসের নিকট পরাজয় বরণ করেন- যা তাঁর সারা জীবনের জন্য মূল্যবান শিক্ষণীয় ছিল নিঃসন্দেহে। শুধু তাঁর নয়, তাঁর পরবর্তী সন্তানগণের জন্যও ছিল তা উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।
পক্ষান্তরে ইবলীস হ’ল আগুনের তৈরী, অর্থাৎ তার সৃষ্টির মূল উপাদান আগুন। আগুন হচ্ছে উত্তপ্ত, উষ্ণ, প্রচন্ড গরম জাতীয় পদার্থ। কাজেই ইহা স্বভাবতঃই দুঃসহ তাপদায়ক, দুঃখদায়ক, পীড়াদায়ক ও যন্ত্রণাদায়ক। হয়ত এই স্বভাবের বশবর্তী হয়েই ইবলীস আদম (আঃ)-এর প্রাধান্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, যা তাকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করার মত অপরিণামদর্শী স্পর্ধায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। অতঃপর সে তার অসামান্য ভূমিকায় (মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজে) দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে এবং একাজের জন্য আল্লাহ অনুমতি প্রার্থনা করে এবং আল্লাহ তা‘আলা তা অনুমোদন করেন। কারণ মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা সবচাইতে ভাল জানেন যে, তাঁর বিশ্বস্ত বান্দাদের ইবলীস কখনও বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি তাঁর সকল বান্দাকে ইবলীসের চক্রান্ত ও প্রতারণা হ’তে মুক্ত থাকার জন্য সকল মানুষের পক্ষে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সিজদার মাধ্যমে বরণ করে নেওয়ার মহৎ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মানবাত্মার পবিত্র জন্ম ইতিহাসে ইহা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। যারা এসব স্মরণ করে ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখে, তাদের জন্য ইহা নিঃসন্দেহে এক মহাস্মারক।
এই মহৎ অনুষ্ঠানের পর আদম (আঃ) ও ইবলীসের মধ্যে যা ঘটেছিল, তা সূরা আল-আ‘রাফ এর ১৯ হ’তে ২৫ আয়াতে সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে। আল্লাহ বলেন,
وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلاَ مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلاَ تَقْرَبَا هَـذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُوْنَا مِنَ الظَّالِمِيْنَ- فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُوْرِيَ عَنْهُمَا مِن سَوْءَاتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَـذِهِ الشَّجَرَةِ إِلاَّ أَن تَكُوْنَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُوْنَا مِنَ الْخَالِدِيْنَ- وَقَاسَمَهُمَا إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِيْنَ- فَدَلاَّهُمَا بِغُرُوْرٍ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْءَاتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِن وَرَقِ الْجَنَّةِ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَن تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُل لَّكُمَا إِنَّ الشَّيْطَآنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ- قَالاَ رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ- قَالَ اهْبِطُواْ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ وَلَكُمْ فِي الأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَى حِيْنٍ- قَالَ فِيْهَا تَحْيَوْنَ وَفِيْهَا تَمُوْتُوْنَ وَمِنْهَا تُخْرَجُوْنَ-
‘হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও, তবে এ বৃক্ষের কাছে যেও না। তাহ’লে তোমরা গোনাহগার হয়ে যাবে। অতঃপর ইবলীস (শয়তান) উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি, তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা হয়ে যাও চিরকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্খী। অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাদেরকে সম্মত করে ফেলল। অনন্তর যখন তারা বৃক্ষ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে খুলে গেল এবং তারা নিজের উপর বেহেশতের পাতা জড়াতে লাগল। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন তবে আমরা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব। আল্লাহ বললেন, তোমরা নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের জন্য পৃথিবীতে বাসস্থান আছে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ফল ভোগ আছে। আল্লাহ বললেন, তোমরা সেখানেই জীবিত থাকবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান থেকেই পুনরুত্থিত হবে’ (আ‘রাফ ৭/১৯-২৫)
উল্লিখিত আয়াত কয়’টি হ’তে আমাদের মানব জাতির পক্ষে আদম (আঃ)-এর পৃথিবীতে আগমন বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই প্রতিভাত হয়েছে। আদম (আঃ)-এর ভুলের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সমালোচিত হ’লেও এখানে মহান আল্লাহ নিকট তা ছিল স্বাভাবিক। কারণ আদম (আঃ) যে ভুল করেছিলেন সেটা সত্যের অনুসারীই ছিল। ইবলীস যে মিথ্যা কসম খেয়ে মিথ্যার প্রতি আহবান করেছিল, আদম (আঃ)-এর নিকট তা ছিল একান্তই সত্য ও সঠিক। এজন্যই মহাবিচারক আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমা করে দেন এবং ভবিষ্যতে এরূপ কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হ’তে হুঁশিয়ার করে দেন। অতঃপর তাঁর ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিরলস সতর্ক থাকার জন্য পবিত্র মহাগ্রন্থে পুনঃপুনঃ সতর্ক বাণী অবতীর্ণ করেন।
আদম (আঃ)-এর প্রতি অভিযোগ খন্ডন এর অনুকূলে একটি উল্লেখযোগ্য হাদীছের উদ্ধৃতি দেয়া হ’ল। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। আদম (আঃ) ও মূসা (আঃ) পরস্পর বাক্যালাপ করেছিলেন। মূসা (আঃ) আদম (আঃ)-কে বললেন, হে আদম! আপনি আমাদের পিতা, আপনি আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন ও বেহেশত হ’তে বহিষ্কৃত করেছেন। তখন আদম (আঃ) তাকে বললেন, হে মূসা! আল্লাহ আপনাকে স্বীয় কালাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন এবং তিনি স্বহস্তে (তওরাত কিতাব) আপনাকে লিখে দিয়েছেন। আপনি এমন একটি কাজের উপর আমাকে দোষারোপ করেছেন, যা আমাকে সৃষ্টি করার চল্লিশ বছর পূর্বে আল্লাহ নির্ধারিত করে দিয়েছেন। অতঃপর আদম (আঃ) মূসা (আঃ)-এর অভিযোগ খন্ডন করে বিজয়ী হ’লেন। নবী করীম (ছাঃ) একথাটি তিনবার বললেন (বুখারী হা/৩৪০৯; মুসলিম, মিশকাত হা/৮১)
আদম (আঃ) সাময়িকভাবে বেহেশত হ’তে বহিষ্কৃত হয়ে পৃথিবীতে অবতরণের পর আল্লাহ ইচ্ছানুযায়ী তাদের বংশবৃদ্ধি শুরু হয়। বিশ্ববাসীর অকৃত্রিম সম্মান, শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা ইত্যাদির বিশুদ্ধতম আনুগত্য লাভের ব্যাপক প্রয়াসে মহান আল্লাহ মানব জন্মের সূত্রপাত ঘটান। এ বিষয়টিও পবিত্র কুরআনুল করীমে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا فَلَمَّا تَغَشَّاهَا حَمَلَتْ حَمْلاً خَفِيْفاً فَمَرَّتْ بِهِ فَلَمَّا أَثْقَلَتْ دَّعَوَا اللّهَ رَبَّهُمَا لَئِنْ آتَيْتَنَا صَالِحاً لَّنَكُوْنَنَّ مِنَ الشَّاكِرِيْنَ-
‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে। আর তার থেকেই তৈরী করেছেন তার জোড়া, যাতে তার কাছে স্বস্তি পেতে পারে। অতঃপর পুরুষ যখন নারীকে আবৃত্ত করল, তখন সে গর্ভবতী হ’ল। অতি হালকা গর্ভ। সে তাই নিয়ে চলাফেরা করতে থাকল। অতঃপর যখন বোঝা হয়ে গেল তখনই উভয়ই আল্লাহকে ডাকল যিনি তাদের পালনকর্তা যে, আপনি যদি আমাদেরকে সুস্থ ও ভাল দান করেন তবে আমরা আপনার শুকরিয়া আদায় করব’ (আ‘রাফ ১৮৯)
এরপর উপরের আয়াতের সাদৃশ্যপূর্ণ বাণীতে সারা বিশ্বের মানবমন্ডলীকে আহবান জানিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُواْ رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيْراً وَنِسَاءَ وَاتَّقُواْ اللّهَ الَّذِيْ تَسَاَءلُوْنَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْباً-
‘হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাষ্ণা করে থাক এবং আত্মীয়-জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন’ (নিসা ১)
মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْباً وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ-
‘হে মানব মন্ডলী আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাছে সেই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন’ (হুজুরাত ১৩)
সূরা অন‘আম এর ৯৮ আয়াতে আলোচ্যধারায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হ’ল,
وَهُوَ الَّذِيْ أَنشَأَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ قَدْ فَصَّلْنَا الآيَاتِ لِقَوْمٍ يَّفْقَهُوْنَ-
‘তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অনন্তর একটি হচ্ছে তোমাদের স্থায়ী ঠিকানা ও একটি হচ্ছে স্বল্প মেয়াদী ঠিকানা। নিশ্চয়ই আমি প্রমাণাদি বর্ণনা করে দিয়েছি বিস্তারিতভাবে তাদের জন্যে, যারা চিন্তা করে’।
মানব সৃষ্টির প্রথম সুপরিকল্পিত ইতিহাস, উহার প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণ অধ্যায়সহ পৃথিবীতে প্রাথমিকভাবে মানবজন্মের সূত্রপাত নিয়ে পবিত্র কুরআনুল কারীম হ’তে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হ’ল। মূলতঃ পৃথিবীতে নারী-পুরুষের মধুর মিলন হ’তেই সন্তানাদি বা বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। উপরোক্ত আয়াত ক’টিতে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয়ভাবেই ব্যক্ত করা হয়েছে। মানব সৃষ্টির মৌল প্রক্রিয়ার মধ্যে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্য প্রযুক্তি রয়েছে, কোন বিজ্ঞানীর পক্ষে তা সঠিকভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। একমাত্র মহান আল্লাহ মহাজ্ঞান ভান্ডার (কুরআন) হ’তে প্রাপ্ত সঠিক ও যুক্তিযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে বা সুন্দরভাবে তা জানা সম্ভব। মানবতার বিকাশ সাধনে ও আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনে জ্ঞানের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা দানের জন্য ইহা একটি অনুকরণীয় মূল্যবান প্রযুক্তিভান্ডার, যা তাঁরই মালিকানাধীন।
আসলে মানব সৃষ্টির মূল উপাদান কী, কত মূল্যবান, কত উল্লেখযোগ্য বা আকর্ষণীয় তা জানা আবশ্যক। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা মানব জন্মের উপরোক্ত প্রক্রিয়াকে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে অভিন্ন অর্থে বিভিন্ন প্রসঙ্গে উপস্থিত করেছেন। সৃষ্টিতত্ত্বের গুপ্তরহস্যের অলৌকিক বর্ণনায় ইতিমধ্যে মানব প্রজনন সংক্রান্ত কুরআনুল কারীমের বিবরণ ও ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়, মানব সৃষ্টির প্রধান উপাদান মাটি। তাই মানব সৃষ্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপাদান মাটি বিষয়ক কয়েকটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়া হ’ল। এ বিষয়ে সূরা হিজর এর ২৬ ও ২৭ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ- وَالْجَآنَّ خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَّارِ السَّمُوْمِ-
‘আমি মানবকে পচাকর্দম থেকে তৈরী বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি এবং জিনকে এর আগে লু-এর আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করেছি’।
সূরা আর-রাহমানের ১৪ ও ১৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِن صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ- وَخَلَقَ الْجَانَّ مِنْ مَّارِجٍ مِّنْ نَّارٍ-
‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিশিখা থেকে’।
সূরা সিজদাহর ৭ আয়াতেও অনুরূপ বিধৃত হয়েছে-
الَّذِيْ أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِيْنٍ-
‘তিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন’।
অনুরূপভাবে সূরা আন‘আম এর ২ আয়াতেও বর্ণিত আছে যে,
هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُم مِّنْ طِيْنٍ ثُمَّ قَضَى أَجَلاً وَأَجَلٌ مُّسَمًّى عِندَهُ ثُمَّ أَْنتُمْ تَمْتَرُوْنَ-
‘তিনিই তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর নির্দিষ্টকাল নির্ধারণ করেছেন। আর অপর নির্দিষ্টকাল আল্লাহ কাছে আছে’।
উল্লিখিত আয়াত সমূহে মানব সৃষ্টির প্রধান উপাদান যে মাটি, ইহা সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হ’ল। অতঃপর সৃষ্টির সর্বব্যাপক কর্মসূচীর মাঝে অসংখ্য প্রাণীর উৎপত্তির সূত্রপাত হয়। এই প্রাণের বা জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বাণী একদিকে যেমন ব্যাপক, অন্যদিকে তেমনি বাস্তব ও সংক্ষিপ্তও বটে। সামগ্রিকভাবে প্রাণীকূল সৃষ্টির মূল উপাদান হচ্ছে পানি। এর সমর্থনে সূরা নূর এর ৪৫ আয়াতে প্রত্যাদেশ হয়েছে, وَاللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِن مَّاءٍ ‘আল্লাহ প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন’। যেহেতু সকল জীব বা প্রাণী সৃষ্টির মূল উপাদান পানি। সুতরাং মানব সৃষ্টির ক্ষেত্রেও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থাৎ মানব সৃষ্টির মূল উপাদান মাটি, অতঃপর পানি। ইহার সত্যায়নে সূরা ফুরক্বান এর ৫৪ নং আয়াতে অবতীর্ণ হয়েছে,
وَهُوَ الَّذِيْ خَلَقَ مِنَ الْمَاء بَشَراً فَجَعَلَهُ نَسَباً وَصِهْراً وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيْراً-
‘তিনিই পানি থেকে মানবকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে রক্তগত বংশ ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। তোমার পালনকর্তা সবকিছু করতে সক্ষম’।
এরপর সূরা মুরসালাত এর ২০ আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, أَلَمْ نَخْلُقكُّمْ مِّنْ مَّاءٍ مَّهِيْنٍ ‘আমি কি তোমাদেরকে তুচ্ছ পানি থেকে সৃষ্টি করিনি’।
পরবর্তীতে সূরা আত-তারেক এর ৫ ও ৬নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় মানব প্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, فَلْيَنظُرِ الْإِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ- خُلِقَ مِن مَّاءٍ دَافِقٍ- ‘মানুষের দেখা উচিত কি বস্ত্ত থেকে সে সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে, সবেগে স্খলিত পানি থেকে’।
মানব সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য, গুরুত্ব ও অপরিসীম তাৎপর্যের অন্তরালে মহান স্রষ্টার পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, মানব জাতির হৃদয় স্পন্দন করার প্রয়াসে, পাক কালামে বহু আয়াতের সমন্বয় ঘটেছে। উপরে বর্ণিত পানির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কযুক্ত বস্ত্তরও (বীর্যের) বহু আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা নাহল এর ৪নং আয়াতের তাৎপর্যপূর্ণ বাণী হ’ল,
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيْمٌ مُّبِيْنٌ-
‘তিনি মানবকে এক ফোঁটা বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন। এতদসত্ত্বেও সে প্রকাশ্য বিতন্ডাকারী হয়ে গেছে’।
সূরা ইয়াসীন এর ৭৭ আয়াতেও মহান আল্লাহ বলেন,
أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيْمٌ مُّبِيْنٌ-
‘মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি বীর্য থেকে? অতঃপর তখনই সে হয়ে গেল প্রকাশ্য বাকবিতন্ডাকারী’।
একই মর্মার্থে সূরা আদ-দাহার এর ২য় আয়াতেও পুনরায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيْهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيْعاً بَصِيْراً-
‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্র বিন্দু থেকে এভাবে যে, তাকে পরীক্ষা করব। অতঃপর তাকে করে দিয়েছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন’।
আরও বিস্তারিত তথ্য সহ সূরা হজ্জের ৫ আয়াতে মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُّضْغَةٍ مُّخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِّنُبَيِّنَ لَكُمْ،
‘হে লোক সকল আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি, এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট গোশতপিন্ড থেকে তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে’।
উপরের আয়াতগুলোতে শ্রেষ্ঠ মানবের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের প্রতীক স্বরূপ তার প্রজনন প্রক্রিয়ায় রয়েছে উচ্চতর কলা-কৌশল এবং বিভিন্ন প্রকারের উপাদানের সুস্পষ্ট বিবরণ। মানব শিশু তার জন্মলগ্নে মাতৃগর্ভে ক্ষুদ্রাকৃতির এক গোশতপিন্ডের মত দেখায়। কেন্দ্রস্থলটি মানবাকৃতির মত দেখালেও তখন আলাদা করে কিছুই বুঝা যায় না। পরে গোশতপিন্ডটি (ভ্রুণটি) ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে বৃদ্ধি থাকে। প্রবৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়েই গঠিত হয়ে থাক মানব শিশুর হাড়ের কাঠামো পেশ, স্নায়ুতন্ত্র, বিভিন্ন সরবরাহ যন্ত্র এবং অন্ত্রাদিও। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত এসব তথ্যচিত্র এখন সর্বজনবিদিত।
যাহোক মানব প্রজনন সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো অত্যন্ত সরল, সহজ ও সাধারণ ভাষায় এলোপাতাড়িভাবে বর্ণিত হয়েছে। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির ভয়াবহ বিশালতা ও কাঠিন্যতা ব্যতীত, অন্য কোন সৃষ্টির ক্ষেত্রে, মানব সৃষ্টির মত এত খুঁটি-নাটি বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৃষ্টিতত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়নি। ধর্মীয় উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বিশ্ববাসীর প্রতি অতীব সঠিক ও যুক্তিযুক্ত আধ্যাত্মিক বিষয়াদির বহু উদাহরণ উপস্থিত করা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যালোচনার জন্যই, মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়াতগুলোর অবতারণা যা মানুষের মুক্তির প্রকৃত পথের সন্ধান দিতে সহায়ক হ’তে পারে।
মানব সৃষ্টির নিভৃতে যে গোপনীয় গূড় রহস্য বিদ্যমান, সে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَّشَاءُ إِنَاثاً وَيَهَبُ لِمَنْ يَّشَاءُ الذُّكُوْرَ-
‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলারই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন’ (শূরা ৪৯)
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহ পরম সন্তুষ্টির বাণী হচ্ছে, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِيْ أَحْسَنِ تَقْوِيْمٍ- ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে’ (ত্বীন ৪)
আমরা আল্লাহ সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, চিন্তা-গবেষণা, মনোযোগ, অমনোযোগ ইত্যাদি আমাদের চিরসাথী। তন্মধ্যে চিন্তা-ভাবনা, বিবেক-বিবেচনা দ্বারা সত্য ধর্ম ইসলামে প্রতিষ্ঠিত থাকাই হ’ল আমাদের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব ও কর্তব্য। জীবন প্রবাহের মুহূর্তগুলোতে কারণে অকারণে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনায় অসংখ্য ভীড়ের উৎপত্তি হয়। অনাকাংখিত ঐসব অশুভ তৎপরতা হ’তে আত্মরক্ষার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সুনির্দিষ্ট বিধানাবলী প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে জন্ম-মৃত্যু নিয়ে গভীর চিন্তা করা উক্ত বিধানাবলীর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবশ্য এখানে শুধু জন্ম রহস্যের বৈচিত্র্যময় প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত বাণীগুলোরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে- যা আল্লাহ একত্ব সহ অন্যান্য সত্য বিধানে আকৃষ্ট করার উত্তম সহায়ক। মানুষ তার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, পান্ডিত্য প্রতিভা, অর্থসম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি, বিবেক-বিবেচনা প্রভৃতি গুণাবলীর মাঝে নিজের জন্ম বৃত্তান্তের অনুসন্ধান করুক, অতঃপর নিজের করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক, এটাই হ’ল প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপদেশমালা।


ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

  1. “মানব সৃষ্টির ইতিহাস” লেখাটি পড়লাম। অত্যন্ত বিস্তারিত কিন্তু দলিল সমেত! চমৎকার লেগেছে, এরকম আরও লেখা চাই! মাশা আল্লাহ্‌, লেখক সহ সকলের প্রতি রইল আন্তরিক দোয়া এবং ভালোবাসা। কিন্তু, আমারও একটি প্রশ্ন রয়েছেঃ “হযরত আদম (আঃ) হতে হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত পৃথিবীর বয়স আনুমানিক কতো বৎসর? এটি একটি পাবলিক প্রশ্ন, কেউ পারলে একটি স্ট্যাটিস্টিক উত্তর দিবেন দয়া করে।”

    ধন্যবাদ!

মন্তব্য করুন

Back to top button