স্রষ্টা ও সৃষ্টি

মানুষ তার অভিজ্ঞতার সমান ছোট

আমাদের মাথার ওপরে যে আকাশটা আছে, সেটা কত দূরে, কত ওপরে? খালি চোখে তাকালে মেঘেদের উড়ে যাওয়া দেখলে মনে হতে পারে এইতো, সামান্য কয়েক হাজার মিটারই হয়তো হবে বড়জোর। এরোপ্লেনে যে চড়েছে সে-ই কেবল দেখতে পেয়েছে মেঘ কেবল তার ওপর দিয়ে নয় নিচে দিয়েও ওড়ে! যে মহাকাশযানে চড়েছে সে আরও বেশি কিছু দেখেছে।

কোনো মানুষ আর্কিটেক্টকে যদি আসমান-জমিনের ডিজাইন করতে দেওয়া হতো, তাহলে আকাশটাকে কতখানি উঁচুতে রাখা সে যথেষ্ট মনে করত? বিশেষ করে যখন আধুনিক এসব স্কাইক্র্যাপার বিল্ডিং, আকাশ ও মহাকাশযানের অস্তিত্ব ছিল না—তখন হলে? বেশি হলে পাখিদের ওড়ার জন্য হয়তো হাজারখানেক মিটার উঁচুতে রাখার চিন্তা করত।

কিন্তু মহান আল্লাহ কী করেছেন? এই ক্ষুদ্র মানুষের দৃষ্টি মেলে তাকানোর জন্য এত বিশাল ও বিস্তৃত মহাশূন্য রেখেছেন! আকাশ যে আসলে সত্যিকারে কত দূরে তা জানার অভিজ্ঞতা মানুষ হয়তো কখনও অর্জন করতে পারবে না; কিন্তু মানুষ ভাববে, বিশ্বাস করবে যে, আকাশ আছে—একটা দুটা নয়, সাত সাতটা।

সত্যিই, মানুষ নিজের অভিজ্ঞতার দ্বারা তার চিন্তাকে শানিত না করে যদি নিজেকে কেবল অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখে, তবে সে অভিজ্ঞতা তাকে কেবল ছোটই করে। এই অর্থে মানুষ তার অভিজ্ঞতার সমান ছোট, চিন্তার সমান বড়।

এখানে এসেই বস্তুবাদিতা আর ঈমানের দুটি পথ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুদিকে যাত্রা শুরু করে। বস্তুবাদীরা নিজেদেরকে কেবল অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র সীমায় আবদ্ধ করে রাখে, আর বিশ্বাসী মানুষেরা বিশ্বাসের ডানায় ভর করে অসীম দিগন্তে, নিঃসীম অনন্তে ছুটে বেড়ায়।

আর যদি মানুষের সত্যিকার অতিপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার কথাও বলি, সেটাও এই মুসলিম জাতিরই সবচেয়ে বেশি। কোনো জাদুকরের জাদুর সাময়িক ভেলকিবাজিতে নয়; বরং মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ইতিহাসে এমন অসংখ্য বাস্তব ঘটনার জীবন্ত সাক্ষী আমরা, যেগুলোকে কোনো বস্তুগত সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। নুহের প্লাবন, আদ সামুদ ও কওমে লুতের ধ্বংস, ইউসুফের ঘ্রাণ, সুলাইমানের অভিযাত্রা, মুসার লাঠি, ঈসার ঊর্ধ্বগমন, মুহাম্মাদের মিরাজ—আলাইহিমুস সালাম— বদরের ফেরেশতা, খন্দকের গোশত-রুটি, এমন আরও অসংখ্য ঘটনা—যা গুনে শেষ করা যাবে না।

বস্তুসূত্রের বিপরীত এতসব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ জাতির কিছু মানুষও কেন যেন মহান আল্লাহর অস্তিত্ব সংক্রান্ত আলোচনায় এসে নিজেদের চিন্তাকে কেবল বস্তুসূত্রের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলতে চান। বস্তুগত বিষয়ে প্রযোজ্য যুক্তিকে বস্তুর স্রষ্টার ওপর প্রয়োগ করতে চান তারা। মহান আল্লাহ তাঁর নিজ অস্তিত্ব সংক্রান্ত আলোচনায় নিজের সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটাকে সাধারণ অর্থে গ্রহণকে দেহবাদিতা আখ্যা দেওয়ার এটাই হয়তো একটা সুপ্ত কারণ, বাকি আল্লাহই ভালো জানেন।

বস্তুগত অভিজ্ঞতার যুক্তিতে চিন্তাকে আবদ্ধ করার ব্যাপারটাকে একটু বুঝিয়ে বলি। যেমন ধরুন, আপনি মানুষ। আপনি মানুষের কথা শুনেছেন এবং অন্যান্য জীবজন্তু ও পশুপাখির ডাক শুনেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা হলো, কথা বলা এমন একটা কাজ যা করতে হলে একটা মুখগহ্বর, ঠোঁট, জিহ্বা, কণ্ঠনালী ইত্যাদি থাকতে হয়। এখন আপনি যখন শুনছেন যে ‘মহান আল্লাহ মুসার সঙ্গে কথা বলেছেন’ তখন কথা বলার ব্যাপারটাকে অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে রেখে কল্পনা করতেই আপনার চোখে ভেসে ওঠে মুখগহ্বর, ঠোঁট, জিহ্বা, কণ্ঠনালী ইত্যাদি। আসলেই কি ব্যাপারটা আপনার অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে আবদ্ধ? আশ‘আরিদের সঙ্গে ইমাম ইবনু কুদামার এক বিতর্কে তিনি ব্যাপারটি চমৎকারভাবে এবং খুব সহজে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন।

আশ‘আরিরাও মুসা ‘আলাইহিস সালামের সঙ্গে আল্লাহর কথা বলা প্রসঙ্গে বলেছিল যে, আল্লাহ যদি শব্দ, অক্ষর, বাক্য, এসব দিয়ে কথা বলেন, তাহলে আল্লাহর মুখ, জিহ্বা, গলা, ফুসফুস, কণ্ঠনালী ঠোঁট ইত্যাদি থাকা অবধারিত হয়ে পড়ে। ইমাম ইবনু কুদামা এ বক্তব্যের বিপরীতে কোনো যুক্তি প্রদর্শন করেননি। তিনি কেবল একটি হাদিস উল্লেখ করে জবাব দিয়েছেন। হাদিসটি হলো, জাবির বিন সামুরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,

إِنِّي لَأَعْرِفُ حَجَرًا بِمَكةَ كَانَ يُسَلِّمُ عَلَي قَبْلَ أَنْ أُبْعَثَ إِنِّي لَأَعْرِفُهُ الْآنَ

আমি মক্কার একটি পাথর চিনি, যা নবুওতের পূর্বে আমাকে সালাম দিত। এখনও আমি পাথরটিকে চিনতে পারি। [সহিহ মুসলিম, হাদিস ২২৭৭]

সালাম দেওয়া তো কথা বলার অন্তর্ভুক্ত একটি কাজ। বলুন, পাথরের কোথায় মুখ, কোথায় জিহ্বা? কোথায় কণ্ঠনালী? কোথায় ফুসফুস, আর কোথায় ঠোঁট? কোথায়ই-বা তার প্রাণ?

আসমান-জমিনের সবকিছু আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে, গাছ সিজদা করে, চন্দ্র-সূর্য সিজদা করে; কিয়ামতের দিন মানুষের চামড়া ও হাত কথা বলবে, পা সাক্ষ্য দেবে। ইসলামি জ্ঞানের মধ্যে ইত্যাদি রকম আরও অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যেগুলো মানুষের সাধারণ বস্তুসুত্রের বাইরে। তা ছাড়া মানুষের অভিজ্ঞতা যদি সর্বোচ্চ পর্যায়েও পৌঁছায়, তবুও তা সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে; কিন্তু মহান আল্লাহ তো তার বাইরে, তিনি তো স্রষ্টা। তিনি যেখানে বলেই দিয়েছেন ‘তাঁর মতো কিছু নেই’ সেখানে কেন আল্লাহর অস্তিত্বসংক্রান্ত বর্ণনাকে সাধারণ অর্থে গ্রহণ করলে তার দ্বারা অভিজ্ঞতালব্ধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত করা হবে?

আল্লাহর অস্তিত্বসংক্রান্ত বর্ণনাকে কোনোরকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সাদৃশ্য ও সাযুজ্য স্থাপন ব্যতীত তার সাধারণ অর্থে গ্রহণ করাই আহলুস সুন্নাহর সালাফে সালেহিনের বিশ্বাস, মত ও পথ। আল্লাহ আমাদের সেই বিশ্বাস, মত ও পথের ওপর অটল অবিচল রাখুন।

লিখেছেন : আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক
প্রধান সম্পাদক, সিয়ান পাবলিকেশন

[‘তাঁর পরিচয়’ বইয়ের সম্পাদকীয় থেকে]

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button