জীবনের বাঁকে বাঁকে

উপবাসী কথা

আরভি পেলিক্যানে বসে আছি। এটা একটা গবেষণা জাহাজ, গালফ অফ মেক্সিকোতে পানি দূষণের কারণে সৃষ্ট অক্সিজেন স্বল্পতা বিভিন্ন জলজ প্রাণীর উপর কী কী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। থাকার ব্যবস্থা বাঙ্কে, তবে খাওয়ার ব্যবস্থা রাজসিক। গবেষকদলের অনেক সদস্যেই ধারণা এ জাহাজের কুক অ্যামেরিকার সবচেয়ে ভালো শেফদের একজন। তার কাজ ভোর ছ’টায় নাস্তা, দুপুর বারোটায় লাঞ্চ আর সন্ধ্যা ছটায় ডিনার দেয়া। কিন্তু এখানে সুবহে সাদিক ভোর ছ’টার অনেক আগে আর ইফতারের সময় হতে হতে প্রায় রাত ন’টা। সফর হিসেবে যদিও ইসলামে কিছু ছাড় আছে, তাও রমাদান মাসের কল্যাণটা ছাড়তে ইচ্ছে করল না। প্রথমবারের মতো সমুদ্রে আসার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একদিকে মাথার মগজ পেন্ডুলামের মতো দুলছে। অন্য দিকে চোখের সামনে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে অন্যদের ভুঁড়িভোজন। মনে পড়ল বহুদিন আগে একজন আত্মীয় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমাকে না খাইয়ে রাখাতে আল্লাহর কী লাভ? তোমাকে কষ্ট দিয়ে তাঁর কি কোনো লাভ আছে?’ আসলেই তো, আমরা যে পুরো একমাস দিনে না খাওয়ার নিয়ত করেছি, বুঝে হোক-না বুঝে হোক রোজা রাখছি—কেন?

একজন সচেতন আর একজন অজ্ঞ মানুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে জ্ঞান। অজ্ঞ মানুষ অনেকটা ভাসমান শ্যাওলার মতো, স্রোত যখন যেদিকে নিয়ে যায় সে সেদিকেই ভেসে চলে। মাছের পেটে গেল নাকি নৌকার বৈঠাতে জড়িয়ে গেল নাকি তীরে থমকে গেল—এতে তার খুব বেশি আসে যায় না। কিন্তু সচেতন মানুষ কোনো কাজ করার আগে ভাবে—কেন করছি? এর ফলাফল কী? সচেতন মানুষ মাত্রই যে মস্ত বড় জ্ঞানী তা নয়; কিন্তু সে জানতে চায়, বুঝতে চায়।

আমাদের মুসলিমদের যখন কেউ প্রশ্ন করে, ‘এ কাজটা কেন করলে?’ তখন তার উত্তর হওয়া উচিত—আল্লাহ বলেছেন তাই। এর পর যখন প্রশ্নকর্তা জানতে চাইবে আল্লাহ কোথায় বলেছেন, তখন আমরা কুরআন সুন্নাহ ঘেঁটে তাকে খুঁজে বের করে দেবো। এর নাম আল্লাহর জ্ঞানের উপরে ভরসা। তিনি যেহেতু সর্বজ্ঞানী তাই তিনি আমাদের কিছু করতে বলবেন আর তাতে কল্যাণ থাকবে না—এমনটি অসম্ভব।

কোন কাজের কী কল্যাণ তা আমাদের নাও জানা থাকতে পারে বা জানার পরেও নাও বুঝতে পারি। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহর প্রতিটি বিধানে আমাদের জন্য ভালো কিছু নিশ্চয়ই আছে। কোনো একটি কাজ কেন করছে—এই বিষয়টা মানুষ যত গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করে, সে কাজটাকে ততটা ভালোবাসতে শুরু করে, আর সুন্দর ভাবে করে। এজন্য কিছু কাজের আদেশ দিয়ে আল্লাহ সাথে সাথে জানিয়েও দিয়েছেন কেন তিনি এই আদেশ দিলেন। রমাদান আসলেই আমরা তাই মাসজিদে খতিবদের মুখে সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত শুনি—লা’আল্লাকুম তাত্তাক্বুন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কেউ আমাদের বুঝিয়ে দেয় না আসলে তাক্বওয়া বলতে কি বোঝায়; কেন আল্লাহ পুরো একমাস সিয়াম পালন আমাদের উপর বাধ্যতামূলক করেছেন।

তাক্বওয়া শব্দটি যে আরবি মূল থেকে এসেছে তার অর্থ নিরাপত্তা। রসুলুল্লাহ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ সিয়ামকে ঢালের সাথে তুলনা করেছেন, যে ঢাল তাকে নিরাপত্তা দেবে। কিসের থেকে নিরাপত্তা? ব্যক্তির অন্যায় থেকে তাকে এবং অন্যকে নিরাপদ রাখে তাক্বওয়া। যাবতীয় অন্যায় কার্যকলাপ থেকে নিরাপদ থাকতে হবে এই বোধের নাম তাক্বওয়া। এই বোধটা যখন মানুষের মনে জাগ্রত থাকে তখন সে খারাপ কাজ করার আগে দুবার ভাবে। কোনো একটা ভালো কাজ করার সুযোগ পেলে ঝাপিয়ে পড়ে সেটা করতে। জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে আল্লাহর পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে সজাগ থাকার নাম তাক্বওয়া। ইমাম ইবনে কাসিরের মতে তাক্বওয়া মানে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা। উবাই বিন কা’ব উমার ইবনুল খাত্তাবকে ؓ বলেছিলেন—কাঁটাভরা পথে কাপড় গুটিয়ে সাবধানে চলার নাম তাক্বওয়া।

রমাদান মাসের বাধ্যতামূলক সিয়ামটা আসলে একটা পুনর্বাসন প্রকল্প। এ প্রকল্পটা মানুষের সত্তার উন্নয়ন সাধনের সাথে সম্পর্কিত বিধায় মহান আল্লাহ আগেও মানুষকে সিয়ামের বিধান দিয়েছিলেন। তবে কালক্রমে তার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমরা ইহুদিদের ইয়োম কিপুর বা তিশআ বা’ভ, নাসারাদের absolute fasting কিংবা হিন্দুদের নিরম্ভু উপবাসের মতো ধর্মীয় আচার পালন করতে দেখি। সময়ের আবর্তে এদের মতো আমাদের মুসলিমদের ‘সিয়াম’টাও নেহায়েত ‘রোজা’ অর্থাৎ না খেয়ে থাকা হয়ে গিয়েছে। অথচ সিয়াম শব্দটার অর্থ ছিল বিরত থাকা, ফযরের শুরু থেকে সূর্যাস্ত অবধি আল্লাহর নিষিদ্ধ করা সবকিছু থেকে বিরত থাকা। মানুষ সারাবছর নিজের খেয়ালখুশি মতো চলতে চলতে পশুর পর্যায়ে নেমে যায়। রমাদানের এক মাসে আল্লাহ মানুষকে এমন একটা ইবাদাত পালনে বাধ্য করেন যার মাধ্যমে সে আবার তার হারানো মনুষ্যত্ব ফিরে পেতে পারে।

ইমাম ইবনুল কায়্যিম দেখিয়েছেন যে একেক মানুষের মধ্যে একেকরকম পশুসত্তা প্রবল। কারও স্বভাব কুকুরের মতো, যতক্ষণ না তাকে একটা হাড় ছুঁড়ে দেয়া হবে ততক্ষণ সে ঘেউ ঘেউ করতে থাকবে। এরা কিছু পাওয়ার জন্য হাত পেতে থাকে—কিছু পেলে খুশিতে গদগদ হয়ে লেজ নাড়তে থাকে। যদি না দেয়া হয় তবে দাঁত বের করে তাড়া করবে। যেই তাকে কিছু দেবে সে তারই গোলাম বনে যাবে। দাতার মহত্ব তাকে এমনই আচ্ছন্ন করবে যে ন্যায়-অন্যায় বিচার গৌণ হয়ে যাবে, আর দাতার তুষ্টি হয়ে যাবে মূখ্য। অপরদিকে যার কাছ থেকে সে কিছু পাবে না, তার ক্ষতি করতে সে বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না। সিয়াম রাখতে হয় দিনে, যখন সে জেগে থাকে, কাজ করতে থাকে। একজন সায়েম কীভাবে উপার্জন করছে সেদিকে লক্ষ্য রাখবে, কতটুকু তার প্রাপ্য, আর কতটুকু প্রাপ্য নয় সেটা সে চিন্তা করে দেখবে। অন্যের অধিকার সংরক্ষণ করবে, প্রত্যেকের প্রাপ্য তাকে বুঝিয়ে দেবে।

আমাদের বিশ্রী ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরার জন্য সিয়াম খুব বড় একটা অস্ত্র। কারও সাথে খারাপ আচরণ তো দূরের কথা, কেউ গায়ে পড়ে এসে ঝগড়া করতে চাইলে রসুলুল্লাহ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ আমাদের বলতে বলেছেন, আনা সা‘ঈমুন, আনা সা‘ঈমুন। অর্থাৎ দুবার বলা যে ‘আমি সিয়াম পালন করছি’। এর মানে এই না যে তাকে জানান দিলাম—আমি রোযা আছি দেখে তুই আজকে বেঁচে গেলি। এর মানে নিজেকে বার বার বলা—আমি আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখছি। আল্লাহকে খুশি করার জন্য আমার ক্রোধ, প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেকে দমন করা শিখছি। কারণ রসুলুল্লাহ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ সাবধান করে বলেছেন,

যে বাতিল কথা ও কাজ এবং মূর্খতাপূর্ণ আচরণ পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।

রমাদানের সমার্থক শব্দ দান। পৃথিবীতে মানুষ পেতে আসেনি, দিতে এসেছে—এ বোধটা তার মধ্যে জাগ্রত হবে। আরেকজন সায়েমকে ইফতার করালে তার জন্য আছে একটা সিয়ামের সমান সাওয়াব—এ তথ্যটা তাকে মনে করিয়ে দেবে রিযক নিয়ে কুকুরের মতো কামড়া-কামড়ি করা মানুষের কাজ নয়। মানুষের কাজ অল্প একটু খাবার হলেও সেটা সবার সাথে ভাগ করে মিলেমিশে খাওয়া।

গাধা বোঝা বহন করে। জ্বালানি কাঠ, খাবার বা পোশাক—কোনো কিছুতেই তার ভাগ নেই—তবু সে পিঠে ভার নিয়ে চলতেই থাকে। আমাদের মধ্যেও তেমনি কিছু মানুষ আছে যাদের পিঠে জ্ঞানের বোঝা, অথচ তা থেকে তাদের বিন্দুমাত্র উপকার হয় না। এরা অবাক বিস্ময়ে গবেষণা করে একটি মাত্র হরমোন কীভাবে পুরো দেহে শতখানেক জৈবিক বিক্রিয়া শুরু করে যার প্রভাবে মানুষ আস্তে আস্তে রাতে ঘুমিয়ে যায়। অথচ যে আল্লাহ এত নিখুঁতভাবে ধারাবাহিক বিক্রিয়াসমেত পুরো ঘটনাকে সাজালেন, তিনি মানুষকে কী শিক্ষা দিলেন সেটা আর তার জ্ঞানবোঝাই মাথায় ধরে না!

ইউনিভার্সিটি থেকে পিলপিল করে শিক্ষিত মানুষ বের হচ্ছে যাদের অর্জিত শিক্ষা ভালো-মন্দের ভেদাভেদ শেখাতে পারেনি। রাতের তারাবীর সলাত আপাত ধার্মিক এমন অনেক মানুষেরই কেবল কষ্টের বোঝা বাড়ায়, কিন্তু জীবনে বা মননে কোথাও কোনো পরিবর্তন আনে না। এ মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। রসুলুল্লাহ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ তাঁর শিক্ষক জিবরিলের কাছে রমাদানে একাধিকবার কুরআন পড়ে শেষ করতেন। তাই আমরাও কুরআন ‘খতম’ করি মাসজিদে মাসজিদে। কারও কাছে বসে কুরআন পড়তে শেখা, মানে বোঝা তো বহু দূরের কথা; আমরা হাফেজ সাহেবকে তাড়া দিয়ে যাই তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য। সারাবছর যে গাধার মতো বোঝা বহন করে চলেছে, রমাদান যেন তার উপর বাড়তি বোঝা চাপাল; সে মানুষ হবার সুযোগ আর পেল না।

মানুষের মধ্যে একদলকে বলদের সাথে তুলনা করলে অত্যুক্তি হবে না। এদের জীবনের লক্ষ্য ‘কাজ’ করে যাওয়া। ঘানি ঘুরলে তেল বের হয়, মাঠ চাষ করলে ফসল ফলে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘানি কিংবা জোয়াল টেনে এরা ঘরে গিয়ে ঘুমায় আবার পরের দিনে একই কাজ করার জন্য। যে কাজের ফলাফল চোখে দেখা যায় না সেটা বলদ সদৃশ এ মানবগোষ্ঠীর কাছে অকাজ। এরা আমৃত্যু অন্য মানুষের গোলাঘর কিংবা তেলের শিশি ভরে যায়। কাজের ব্যস্ততায় তারা ভুলেই যায় যে মানুষ পৃথিবীতে আয় করতে আসেনি, এসেছে আল্লাহর ইবাদাত করতে। হালাল অর্থ উপার্জন করা ইবাদাতের অংশ, কিন্তু এটাই জীবনের সব নয়। জীবনের কোনো একটি অংশকে যেন মানুষ পুরো জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভেবে ভুল না করে সেজন্য আল্লাহ সিয়ামের মাধ্যমে তার গতানুগতিক জীবনকে পরিবর্তন করে দেন, কর্মস্পৃহা কমিয়ে দেন; আল্লাহর জন্য, পরিবারের জন্য সময় বের করতে বাধ্য করেন।

কিন্তু আমরা পুরো ব্যাপারটাকে উল্টো করে ফেলেছি। যে বাসায় এগার মাস দুপদ রান্না হতো সে বাসায় রমাদানে চার পদ খাবার হয়—গৃহকর্ত্রীর আর কুরআন পড়ার সময় হয় না। ইফতারের পর যদিওবা ফুরসত মেলে, তবে সে সময়টুকুও চলে যায় ঈদের জন্য কেনাকাটা করতে। ব্যবসায়ী আর ক্রেতা সবারই নাভিশ্বাস ওঠে, ওদিকে ফরজ সলাতটাও ইফতারের উচ্ছিষ্ট সালাদের মতো চলে যায় ভাগাড়ে।

কিছু মানুষ আছে স্বভাবগতভাবেই বিদ্রোহী। ইঁদুর যেমন খাদ্য-অখাদ্য সামনে যা পায় তাই দাঁত দিয়ে কাটতে থাকে, এরাও তা-ই। কারও কর্তৃত্ব মানতে এরা রাজি নয়—সবকিছুকে ধ্বংস করা, নষ্ট করা—এগুলোই এদের কাজ। হালাল-হারামের ভেদাভেদ এদের কাছে নেই। এমন মানুষদের জন্য সিয়াম শিক্ষা দেয় যে আল্লাহ রব্বুল আলামিনই সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী; যেখানে কারও কর্তৃত্ব চলে না, সেখানেও আল্লাহর কর্তৃত্ব আছে। তিনি মানুষকে সাময়িক অবকাশ দিলেও তিনি সবকিছু দেখছেন, শুনছেন। ক্ষুধা এবং পিপাসার মতো অবিচ্ছেদ্য জৈবিক সত্তাকে যদি মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দমন করতে পারে, তাহলে কেন সে নিজের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে পারবে না? হালাল খাবারকে একটা সময়সীমায় হারাম সাব্যস্ত করে মহান আল্লাহ মানুষকে জানিয়ে দেন হালাল-হারামের সীমা নির্ধারণ মানুষের নয়, আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। এই সীমা যে লঙ্ঘন করবে তার ক্ষতি অবধারিত। সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতারের মধ্যে কল্যাণ আছে বলে রসুলুল্লাহ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ আমাদের জানিয়েছেন।  আমরা যেমন না খেয়ে ছিলাম আল্লাহর আদেশে, সূর্যাস্তের সাথে সাথে খাবার মুখে দেয়াও তেমনি আল্লাহর নির্দেশ। লক্ষ্যণীয়, এখানে আরও কিছুক্ষণ না-খেয়ে থেকে কষ্ট করার মধ্যে তাক্বওয়া নেই; তাক্বওয়া আছে রসুলুল্লাহ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ -এর সুন্নাতের অনুসরণের মধ্যে।

কিছু মানুষের মধ্যে রয়েছে বিষধর সাপের বৈশিষ্ট্য। এরা মানুষের ভালো দেখলে সহ্য করতে পারে না। ‘আইনুল হাসাদ’ অর্থাৎ দৃষ্টির হিংসার বিষে এরা মানুষের ক্ষতি করে। এদের কথার বিষে ভাই-ভাইয়ে সৃষ্টি হয় শত্রুতা, পরিবার ভেঙে যায়। অনেক সময় নিজের অজান্তে বলে ফেলা একটা ছোট্ট কথাও মানুষের মনে বড় ধরনের আঘাত করতে পারে, তার মনের শান্তি কেড়ে নিতে পারে। এজন্য সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে আদেশ দিলেন জিহ্বা সংবরণ করার জন্য। পরনিন্দা এবং পরচর্চা না ছেড়ে সিয়াম পালন করে কোনো লাভ নেই, আছে শুধু অনর্থক ক্ষুধার কষ্ট।

মানুষের উন্নতি দেখে, সুন্দর কিছু দেখে ঈর্ষাকাতর হওয়ার বদলে ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় তার কল্যাণের জন্য দু‘আ করতে।  যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মঙ্গল তা যেন আল্লাহ বাড়িয়ে দেন—মানুষের মনকে উদার করার, ভেবেচিন্তে কথা বলার যে শিক্ষা সিয়াম দিয়েছিল সেটাও আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

বনের হিংস্র পশুদের সাথে মানুষের পার্থক্য হলো—পশুরা অন্যের অধিকারের তোয়াক্কা করে না, মানুষ করে। অথচ এমন কিছু মানুষ আছে যারা অফিস-ফেরত লোকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নেয় মাসের বেতনটা। হালালভাবে টাকা আয় করতে যে কত পরিশ্রম করতে হয় সেটা যে করে সে-ই বোঝে। সেই কষ্টের উপার্জনটা যখন অন্যায়ভাবে কেউ ছিনিয়ে নেয়, তখন যে কী কষ্ট লাগে সেটা যার গেছে শুধু সে-ই বোঝে। দেশের গরিব মানুষদের উপরে চাপিয়ে দেয়া করের টাকাতে যেসব সংসদ সদস্য-মন্ত্রী-আমলারা বাড়ি-গাড়ি করে, তারা আবার ইফতার পার্টিরও আয়োজন করে। এই মানুষগুলো আল্লাহর দ্বীনের সাথে এত বড় প্রহসন করছে; অথচ তারা বোঝে না আল্লাহর সাথে করা পাপ হয়তো আল্লাহ ক্ষমা করবেন, কিন্তু মানুষের সাথে করা পাপের ক্ষমা মানুষের কাছ থেকেই নিতে হবে। পৃথিবীর আদালতে বিচার হয় না বলে কি আল্লাহর আদালতেও বিচার হবে না?

সিয়াম আমাদের শিক্ষা দেয় লোভ সংবরণ করতে। হারাম টাকা দিয়ে কেনা চকবাজারের ইফতারির চেয়ে রিকশা চালিয়ে হালাল আয়ের টাকায় কেনা এক মুঠ মুড়ি দিয়ে ইফতার করা অনেক ভালো। ভালো থাকার লোভ, ভালো পড়ার লোভ, ভালো খাওয়ার লোভে যদি পেটে আগুনই ভরলাম তাহলে আর সিয়াম থাকার মানেটা কী?

কিছু মানুষের চরিত্র অনেকটা শুকরের চরিত্রের মতো। পৃথিবীর যাবতীয় ক্লেদ-মলের প্রতি এদের আগ্রহ, ভালো কোনো কিছু এদের মুখে রোচে না। স্বভাবগত নোংরামির কারণে এদের কাছে সম্পর্কের পবিত্রতা রক্ষার চেয়ে জননেন্দ্রিয়ের সুখই প্রধান। বিবেকহীন ভোগ আর যৌনতায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য সিয়াম অনেক বড় একটা ধাক্কা। বিয়ের মতো পবিত্র একটা সম্পর্কে বাঁধা দুটো মানুষ যখন সিয়ামের জন্য দিনের সিংহভাগ সময় বৈধ মেলামেশাকে ‘না’ বলতে বাধ্য হয়, তখন অভিশপ্ত অবৈধ সম্পর্কের কথা তো ভাবাই যায় না।

মানুষ আর জানোয়ারে তফাৎ কী? মানুষও তো একধরনের জানোয়ার। উপরের বৈশিষ্ট্যগুলো কি আমাদের মধ্যে নেই? অবশ্যই আছে; কোনোটা কম, কোনোটা বেশি। যেসব মানুষদের মধ্যে অনেকগুলো পশুর বৈশিষ্ট্য প্রবল হয়ে ওঠে তখন তারা চারপেয়ে পশুদের চেয়েও নিম্নস্তরে নেমে যায়। অন্য মানুষদের প্রতি এরা এতটাই নৃশংস আচরণ করে যে পশুরাও এমন করতে অক্ষম।

মানুষ কিন্তু এমন পর্যায়ে একদিনে নামে না, ধীরে ধীরে নামে। তাই মানুষের অধঃপতনটা ঠেকানোর জন্য আল্লাহ যেসব ইবাদাতের ব্যবস্থা করেছেন তার মধ্যে সিয়াম অন্যতম। সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সেই সৃষ্টির অনুকরণ করে যাদের খাদ্য গ্রহণ অথবা প্রজনন কোনোটারই প্রয়োজন পড়ে না। মালাইকা বা ফেরেশতাদের আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এমনভাবে যে তাদের জৈবিক তাড়না বা পাপ করার ক্ষমতা কোনোটাই নেই; কিন্তু মানুষের তা আছে। মানুষ যখন জৈবিক চাহিদাকে দমন করে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য; লোভ-হিংসা-পরচর্চা-পরনিন্দা পরিত্যাগ করে নিজেকে বিশুদ্ধ করার জন্য; অন্যের সম্পদ-সম্মান-অধিকারকে সংরক্ষণ করে আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার জন্য তখন সে তার মানবীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মালাইকাদের চেয়ে অধিক সম্মানিত বলে বিবেচিত হয়।

আমরা সিয়াম পালন করি আল্লাহর অভিমুখে তাঁর সন্তুষ্টির দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য; যে পাপের পোকাগুলো আমাদের মনুষ্যত্বকে খেয়ে ফেলে সেগুলো থেকে বাঁচার জন্য; ক্ষমা অর্জনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্যশীল বান্দা হওয়ার জন্য। বছর জুড়ে প্রতিদিন যেসব কাজ করে আমরা আমাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারিত করে নিয়েছি সেই কাজগুলো থেকে নিজেদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সিয়াম থাকি। এর দ্বারা আমরা আল্লাহকে ধন্য করে দিই না, নিজেরা নিজেদের বাঁচাই। তাই রসুলুল্লাহ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ শিখিয়েছেন যেন আমরা রমাদানের শেষ লগ্নে এসে রাতের সলাতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহকে বলি, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফুয়ান্নি”—হে আল্লাহ নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাস, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

আল্লাহ যেন আমাদের পাশবিকতা থেকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করেন, সিয়ামের মর্মবাণীটা বুঝে আমাদের সিয়াম পালনের তৌফিক দেন। আমীন।

– শরীফ আবু হায়াত অপু; ১৫ রমাদান, ১৪৩৩।

মন্তব্য করুন

Back to top button