আবু সালামা ইবন আবদিল আসাদ রা:
নাম আবদুল্লাহ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু সালামা। পিতা আবদুল আসাদ, মাতা বাররাহ বিনতু আবদিল মুত্তালিব। রাসুলুল্লাহর সা: ফুফাতো ভাই। তাছাড়া সঠিক বর্ণনা অনুযায়ী রাসুলুল্লাহর সা: দুধভাই। আবু লাহাবের দাসী ‘সুওয়াইবা’ রাসুল্লাহ সা: হামযা ও আবু সালামাকে দুধ পান করান। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৯৬)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: হযরত আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে অবস্থান নেওয়ার পূর্বে তিনি মুমিনদের দলে শামিল হন। হযরত আবু বকর রা: ইসলাম গ্রহণের পর সর্বপ্রথম উসমান ইবন আফফান, তালহা ইবন উবাইদিল্লাহ, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাসকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তাদের সকলকে রাসুলুল্লাহর সা: এর খিদমতে নিয়ে আসেন। তারা সকলে একসাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরের দিন তিনি উসমান ইবন মাজউন, আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ, আবদুর রহমান ইবন আউফ, আবু সালামা ও আল আরকাম ইবন আবিল আরকামকে রাসুলুল্লাহর সা: কাছে নিয়ে যান। তারাও এক সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। (আল বিদায়াহ-৩/২৯) তার স্ত্রী হযরত উম্মু সালামাও তাকে অনুসরণ করেন। (উসুদুল গাবা-৫/২৮১)।
হাবশায় হিজরতকারী প্রথম দলটির সাথে তিনি ও স্ত্রী উম্মু সালামা হিজরাত করেন। এই হাবশার মাটিতে তাদের কন্যা যায়নাব বিনতু আবী সালামা জন্ম গ্রহণ করেন। (সীরাতু ইবনু হিশাম-১/৩২২, ৩২৬)। কিছুদিন পর তিনি হাবশা থেকে চলে আসেন এবং আবু তালিব ইবন আবদিল মুত্তালিবের নিরাপত্তায় মক্কায় প্রবেশ করেন। বনু মাখযুমের কিছু লোক আবু তালিবের নিকট এসে অভিযোগের সুরে বলে: ওহে আবু তালিব, আপনি আপনার ভাতিজা মুহাম্মাদকে আমাদের হাত থেকে হিফাজতে রেখেছেন। এখন আবার আমাদেরই এক লোককে নিরাপত্তা দিচ্ছেন? আবু তালিব বললেন: ‘সে আমার কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে। তাছাড়া সে আমার বোনের ছেলে। যদি বোনের ছেলেকে নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে ভায়ের ছেলেকেও আমি নিরাপত্তা দিতে পারি নে।’ এক পর্যায়ে আবু লাহাব উঠে দাড়িয়ে বলেন: কুরাইশ বংশের লোকেরা! তোমরা এই বৃদ্ধের সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করছো। যদি এটা বন্ধ না কর, আমরা এই বৃদ্ধের পাশে এসে দাড়াবো।’ আবু লাহাবের এ কথায় বনী মাখযুমের লোকেরা সরে পড়ে। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৬৯,৩৭১)। দ্বিতীয়বারও তিনি সস্ত্রীক হাবশায় হিজরাত করেন। শেষবার হাবশা থেকে মক্কা প্রত্যাবর্তন করে কিছুদিন পর আবার মদীনায় চলে যান।
আবু সালামার স্ত্রী হযরত উম্মু সালামা তাদের মদীনায় হিজরাত সম্পর্কে বলেন: আবু সালামা মদীনায় হিজরাতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তার উটটি প্রস্তুত করলেন। আমাকে উটের পিঠে বসিয়ে আমার ছেলে সালামাকে আমার কোলে দিলেন। তারপর উটের লাগাম ধরে তিনি টেনে নিয়ে চললেন। আমার পিতৃ গোত্র বনু মুগীরার লোকেরা তার পথ আগলে ধরে বললো: তোমার নিজের ব্যাপারে তুমি যা খুশী করতে পার। কিন্তু আমাদের এ মেয়েকে তোমার সাথে বিদেশ যেতে দেব না। তারা আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। এতে আবু সালামার গোত্র বনু আবদিল আসাদ ক্ষেপে গেল। তারা বললো: তোমরা যখন তোমাদের মেয়েকে কেড়ে নিয়ে গেছ, তখন আমরা আমাদের সন্তানকে অর্থাৎ সালামাকে তার মায়ের কাছে থাকতে দেব না। তারা আমার ছেলেটি নিয়ে গেল। আমি বন্দী আমার পিতৃগোত্র বনু মুগীরার হাতে, আমার কোলের বাচ্চা সালামা তার পিতৃগোত্র বনু আবদিল আসাদে, আর আমার স্বামী আবু সালামা মদীনায়। এভাবে তারা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিল।
আমি প্রতিদিন মক্কার ‘আবতাহ’ উপত্যাকায় গিয়ে বসে বসে শুধু কাঁদতাম। প্রায় এক বছর আমি চোখের পানি ফেললাম। অবশেষে একদিন আমার পিতৃগোত্রের এক ব্যক্তি আমাকে এ অবস্থায় দেখে তার অন্তরে দয়া হলো। সে বনু মুগীরাকে বললো: তোমরা কি এ হতভাগিনীকে মক্কা ছাড়তে দেবে না? এভাবে স্বামী সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন? তখন বনু মুগীরা আমাকে বললো: তুমি ইচ্ছা করলে তোমার স্বামীর কাছে যেতে পার। বনু আবদিল আসাদও আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিল। আমি উটে চড়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে মদীনার পথ ধরলাম। আমার সাথে আল্লাহর আর কোন বান্দা ছিল না। আমি যখন তানয়ীমে পৌঁছলাম তখন উসমান ইবন তালহার সাথে আমার দেখা। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো: আবু উমাইয়্যার মেয়ে, কোথায় যাবে? বললাম: মদীনায় আমার স্বামীর কাছে। জিজ্ঞেস করলো: সাথে আর কেউ নেই? বললাম: এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। সে আমার উটের লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলো এবং আমাকে মদীনার উপকন্ঠে কুবার বনী আমর ইবন আউফের পল্লী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বললো: তোমার স্বামী এখানেই থাকে। এ কথা বলে সে আবার মক্কার পথ ধরলো। এখানে আমার স্বামীর সাথে মিলিত হলাম। এই উসমান ইবন তালহা হুদাইবিয়ার সন্ধির পর ইসলাম গ্রহণ করে। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৫৮-৫৯)।
হযরত আবু সালামা ইয়াসরিব বাসীদের আকাবায় রাসুলুল্লাহর সা: হাতে শপথের এক বছর পূর্বে মদীনায় হিজরাত করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৬৮)। বুখারীর একটি বর্ণনামতে তিনিই মদীনায় গমনকারী প্রথম মুহাজির। কিন্তু অন্য একটি বর্ণনায় মুসয়াব ইবন উমাইরকে মদীনার প্রথম মুহাজির বলা হয়েছে। আল্লামা ইবন হাজার রহ: এই দুই বর্ণনার সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে বলেন: আবু সালামা হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে এলে মক্কার মুশরিকরা তার ওপর পুনরায় অত্যাচার শুরু করে। তিনি তখন মদীনা যান- কুরাইশদের ভয়ে, সেখানে স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্য নয়। অপরদিকে মুসয়াব ইবন উমাইর মদীনায় যান হিজরাতের নির্দেশ আসার পর। এই হিসাবে দুই বর্ণনার মধ্যে মূলত: কোন বিরোধ নেই। (ফাতহুল বারী-৭/২০৩)।
আবু সালামার মদীনায় উপস্থিতির দিনটি ছিল মুহাররম মাসের ১০ তারিখ। আমর ইবন আউফের খান্দান পুরো দুই মাস তাকে আতিথ্য দান করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: মদীনায় এসে হযরত খুসাইমা আনসারী ও তার মাঝে মুওয়াখাত বা ভাতৃত্ব সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন এবং পৃথক বসবাসের জন্য একখন্ড জমিও দান করেন।
বদর ও উহুদ যুদ্ধে তিনি সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উহুদ যুদ্ধে আবু উসামা জাশামীর একটি তীর তাঁর বাহুতে বিদ্ধ হয়। দীর্ঘ একমাস চিকিতসা গ্রহণের পর বাহ্যিকভাবে সেরে উঠলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় তাঁর ওপর ‘কাতান’ অভিযানের দায়িত্ব অর্পিত হয়।
‘কাতান’ একটি পাহাড়ের নাম। এখানে বনু আসাদের বসতি ছিল। হযরত রাসূলে কারীম সা: খবর পেলেন, তুলাইহা ও আসাদ ইবন খুওয়াইলিদ নিজ গোত্র এবং তাদের প্রভাবিত অন্যান্য গোত্রকে মদীনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলছে। রাসূলে কারীম সা: এমন কার্যকলাপ বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি মুহাজির ও আনসারদের সম্মিলিত দেড়শো মুজাহিদীনের একটি বাহিনী গঠন করে আবু সালামার নেতৃত্বে হিজরী ৪ সনের মুহাররাম / সফর মাসে ‘কাতান’ অভিমুখে যাত্রার নির্দেশ দেন। রাসুলুল্লাহ সা: আবু সালামার হাতে ঝান্ডা দিতে গিয়ে বলেন: রওয়ানা হয়ে যাও। বনু আসাদ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আগেই তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করে দাও।
হযরত আবু সালামা অপ্রসিদ্ধ পথ ধরে অগ্রসর হয়ে হঠাত বনু আসাদের জনপদে গিয়ে হাজির হন। তারা এই আকস্মিক আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পালাতে শুরু রে। আবু সালামা তার বাহিনীকে তিনভাগে বিভক্ত করে তাদের পিছু ধাওয়ার নির্দেশ দেন। তারা বহু দূর পর্যন্ত তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে যান এবং প্রচুর পরিমাণে উট ও ছাগল বকরী গাণীমাত হিসাবে লাভ করেন। সকল গাণীমাতই মদীনায় রাসুলুল্লাহর খেদমতে হাজির করেন।
হযরত আবু সালামা ‘কাতার’ অভিযান থেকে মদীনায় ফিরলেন। এদিকে ওহুদ যুদ্ধে তীরবিদ্ধ ক্ষতস্থানে আবার বিষক্রিয়া শুরু হল। বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর হিজরী ৪ সনের মতান্তরে ৩ সনের জামাদিউল আখার মাসের ৩ তারিখ ইনতিকাল করেন। ঘটনাক্রমে তার শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহুর্তে রাসূলে কারীম সা: তাকে দেখার জন্য উপস্থিত হন। তার রুহটি বেরিয়ে যাওয়ার পর রাসূল সা: নিজের পবিত্র হাতে তার খোলা চোখ দুটি বন্ধ করে দিয়ে বলেন: মানুষের রুহ যখন উঠিয়ে নেওয়া হয় তখন তার দুটি তাকে দেখার জন্য খোলা থাকে।’ (তাবাকাতু ইবন সা’দ-৩/১৭২)।
একদিকে পর্দার অন্তরালে মহিলারা মাতম শুরু করে দেয়। রাসূল সা: তাদের নিবৃত্ত করে বলেন: এখন দুআর সময়। কারণ, যে সকল ফিরিশতা আসমান থেকে মৃতের কাছে আসে তারাও এই দুআকারীদের দুআর সাথে ‘আমীন‘ বলে। তারপর রাসূল সা: তার জন্য এভাবে দুআ করেন: ‘হে আল্লাহ, তার কবরকে প্রশস্ত ও আলোকিত করে দাও। তার গুনাহ খাতা মাফ করে দাও এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত জামায়াতের মধ্যে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দাও।’ (ইবন সা’দ-৩/১৭২)।
হযরত আবু সালামা মদীনার উপকন্ঠে ‘আলীয়াহ’ নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কুবা থেকে এসে এখানেই বসতি স্থাপন করেন। বনী উমাইয়্যা ইবন যায়িদের কূপ- ‘ইয়াসীরা-র’ পানি দিয়ে তাকে গোসল দেওয়া হয় এবং মদীনার পবিত্র মাটিতে তাকে দাফন করা হয়।
সাহাবাদের মধ্যে হযরত আবু সালামা রা: বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে হযরত রাসূলে কারীম সা: প্রায়ই তাকে দেখতে যেতেন।
হযরত উম্মু সালামা রা: বলেন: একদিন আবু সালামা খুব উতফুল্লভাবে রাসুলুল্লাহর সা: দরবার থেকে ঘরে ফেরেন। তারপর বলতে থাকেন, আজ রাসুলুল্লাহর সা: একটি বাণী আমাকে খুবই খুশি করেছে। তিনি বলেছেন: কোন বিপদগ্রস্থ মুসলমান তার বিপদের মধ্যে যদি আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে বলে: হে আল্লাহ আমাকে এই বিপদে সাহায্য কর এবং আমাকে এর উত্তম প্রতিদান দাও- তাহলে আল্লাহ তার দুআ কবুল করেন। সুতরাং আবু সালামার মৃত্যুতে আমি যখন ভীষণ দু:খ পেলাম, তখন আমিও ঐ দুআ করলাম। কিন্তু তক্ষুণি আমার মনে হল, আবু সালামার উত্তম বিনিময় আর কে হতে পারে? আমার ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন খোদ রাসূল সা: বিয়ের পয়গাম পাঠান তখন আমি বুঝলাম আল্লাহ উত্তম বিনিময়ের ব্যবস্থা করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ ইবন হাম্বল-৪/১২৭)। এভাবে উম্মু সালামা হলেন উম্মুল মুমিনীন।
হযরত আবু সালামা দুই ছেলে সালামা ও উমার এবং দুই মেয়ে যয়নাব ও দুররাহ রেখে যান।
খলীফা হযরত উমার রা: তার খিলাফতকালে যখন প্রত্যেকের জন্য ভাতা নির্ধারণ করেন তখন মুহাজির ও আনসার যারা বদরে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সন্তানদের জন্য দু হাজার করার নির্দেশ দেন। যখন আবু সালামার ছেলে উমারের ব্যাপারটি এলো, তখন বললেন, তাকে এক হাজার বেশি দাও। মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ- যার পিতা আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, যিনি উহুদে শহীদ হন, প্রতিবাদ করে বলেন: তার পিতার আমাদের পিতাদের অপেক্ষা বিশেষ কোন মর্যাদা নেই।
খলীফা বললেন: তার পিতা আবু সালামার জন্য তাকে দু হাজার, আর তার মা উম্মু সালামার জন্য অতিরিক্ত এক হাজার। তার মার মত তোমার একজন মা থাকলে তোমাকেও এক হাজার বেশি দিতাম। (হায়াতুস সাহাবা-১/ ২১৬)-১৭)।