ছাহাবী চরিত

আল বারা ইবন ‘আযিব ’(রা)

মদীনার বিখ্যাত আউস গোত্রের বনু হারেসা শাখার সন্তান আল-বারা’। আনসারী সাহাবী। কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু ‘উমার, মতাস্তারে আবু আমর বা আবুত তুফাইল। উবনুল আসীরের মতে আবু আমর সর্বধিক সঠিক। পিতা আযিব ইবনুল হারেস সাহাবী ছিলেন। মাতা হাবীবা বিনতু আবী হাবীবা ইবনুল হুবাব, মতান্তাতরে উম্মুল খালিদ বিনতু সাবিত। মায়ের নাম যাই হোক না কেন তিনি বদরী সাহাবী আবু বুরদ্হা নিয়ার এর আপন বোন এবং প্রখ্যাত সাহাবী আবু সা’ঈদ আল খুদরঅর (রা) চাচতো বোন। সাহীহাইন ও বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে  আল-বারা’র সম্মনিত পিতা আসির সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল-বারা বলেন: একবার আবু বকর (রা) আযিবের নিকট থেকে দশ দিরহাম দিয়ে একটি জিন কেনেন। তারপর তিনি আযিবকে বলেন আপনি আল-বারা কে একটু বলুন সে যেন জিনটি আমার বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসে। আযিব বললেন: না তা আমি বলছিনা যতক্ষণ না আপনি আমাদেরকে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে আপনার হিজরাতের সফরকাহিনী শুনাচ্ছেন। অগত্যা আবু বকর (রা) বলতে শুরু করলেন। হযরত রাসূলে করীম (সা) যখন মদীনা হিজরাত করেন তখন আল-বারা নয় দশ বছরের কিশোর। মদীনায় তখন ইসলামের দা’ওয়াত জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর মামা আকাবায় বাই’য়াত করেছেন এবং পিতাও তাওহীদ ও রিসালাতের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এমনই দুইটি পরিবারে আল-বারা বেড়ে  ওঠেন। তাই যিরক্ল বলেছেন: তিনি ছোট্ট বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। সেই কৈশোরে তিনি ইসলামের হুকুম –আহকাম ও মাসালা-মাসায়িল শেখার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। মদীনায় তখন হযরত মুস’য়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুমের (রা) মজলিস কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মূলত: তিনি শৈশবের শিক্ষা সেকানেই লাভ করেন। প্রথামে পবিত্র কুরআন পড়তে শুরু করেন। পরবর্তীকালে আল-বারা রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মদীনায় আসেন মুস’য়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকুতম। তাঁর দু’জন আমাদের কুরআন শেখাতেন। উমার ইবনুল খাত্তাব। তাদের পর আবু বকরকে সংগে নিয়ে আসেন রাসূলুল্লাহর (সা)। উৎফুল হতে আর কোন ব্যাপারে দেখিনি। তিনি যথন আসেন তখন আমি সাব্বিহ ইসমা বাব্বিকাল আ’লা’-এর মত মুফাসসাল সূরা মাত্র পড়েছি। বদর যুদ্ধ যখন হয় তখন আল-বারা কৈশোর অতিক্রম করেননি। তাবে তাঁর ঈমানী আবেগ ছিল যেবৈনে ভরপুর। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে হাজির হলেন; কিন্তু যুদ্ধের বয়স না হওয়ায় তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। বদর যুদ্ধ সম্পর্কে হযরত আল-বারা’র একটি বর্ণনা আছে। তিনি বলেন: আমরা বলাবলি করতাম, বদর যুদ্ধ ছিল তিন শো দশজনের কিছু বেশী- তালুতের সাথে নদী অতিক্রম করেছিল তাদের সমসংখ্যক। আর তলুতের সাথে নদী অতিক্রম করেছিল কেবল ঈমানদাররা ব্যক্তিরাই। তিনি আরও বলেন: বদরে আমি ও ইবন উমার যুদ্ধের উপযোগী বয়স থেকে ছোট হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহর (সা)  আামাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। বদরের দিন মুহাজিরদের সংখ্যা ছিল ষাটের কিছু বেশি, আর আনসারদের সংখ্যা ছিল দুই শো চল্লিাশের কিছু বেশী।

হযরত আল-বারা সর্বপ্রথম কোন যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা)  সাথে যোগ দেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা)  সাথে তার যুদ্ধের সংখ্যা মোট কত সে সম্পর্কে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। ইবনুলন আসীর ইবন আবদিল বার ইবন হিশাম, ওয়াকিদী ইবন সাদ, আল-ওসকারীর ত সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতে তিনি সর্ব প্রথম খন্দক যুদ্ধে যোগদান করেন। ইবন হিশাম বলেনঃ রাসূল (সা) তাকে বদরে ফিরিয়ে দেন এবং খন্দকে অনুমতি দান করেন। তখন তাঁর বয়স পনোরো বছর। ওয়াকীদী বলেনঃ ইবন উামার আল-বারা ইবন আযিব আবু সাঈদ আল-খুদরি ও যয়িদ ইবন আরকাম-এ চার জন সাদ মুহাম্মদ ইবন আযিবকে যুদ্ধে যোগ দেন। নাফে’র বর্ণনামতে এটাই সর্বাধিক সঠিক। ইবন সা’দ মুহাম্মদ ইবন আযিবকে যুদ্ধে যাওয়ার আনুমতি দান করেন। তখন তার বয়স পনেরো বছর। এর পূর্বে তিনি অনুমতি দেননি। উপরোক্ত মতপার্থক্যের কারণে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে তিনি মোট কতটি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন সে সম্পর্কে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। যাঁরা তাঁর উহুদ শরীক হওয়ার কথা বলেছে, তাদের হিসাবে পনেরটি; আর যাঁরা উহুদ বাদ দিয়েছেন তাদের হিসেবে চৌদ্দটি। আর এই যুদ্ধের সাথে যদি অন্য সফর যোগ করা হয় তাহলে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে তাঁর মোট পনেরটি যুদ্দ করেছি। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহর (সা)  আঠোরটি সফরের সঙ্গী হয়েছি। খন্দক থেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় সংঘটিত সকল যুদ্ধে তিনি যোগদান করেন। ষষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার বাই’য়াতে অংশ গ্রহন করেন। এ বছর রাসূল (সা) ১৪০০ সঙ্গী নিয়ে উমরার উদ্দেম্য মক্কায় যাচ্ছিলেন। এই কাফেলায় আল-বারা ও ছিলেন। পথিমধ্যে কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রাসূল (সা) হুদাইবিয়া উপত্যকায় শিবির স্থাপন করেন।সঙ্গীরা বরলেন, এখানে তো পানি নেই। তবে সেখানে একটি মরা কূপ ছিল। রাসূল (সা) নিজের বান্ডিল থেকে একটি তঅর বের করে  একজনের হাত দিয়ে বললেন, যাও ঐ কূপের মদ্যে গেড়ে দিয়ে এসো। সে তীরটি হাতে নিয়ে কূপের মধ্যে নেমে গেঁড়ে দিয়ে আসতেই পানি উথলে উঠতে শুরু করলো। ইবন ইসহাক বলেছেন, আল-বারা দাবী করতেন তিনিই সেই ব্যক্তি যে হুদাইবিয়ার কূপে রাসূলের (সা) তীর গেড়ে ছিল। তবে ইবন হাজার আসকিলানী বলেন, প্রসিদ্ধ মাতে তীর গেড়ে ছিলেন নাজিয়াহ্ ইবন জুনদুব।

এই হুদায়বিয়ার বাই’য়াত সম্পর্কে আযিবের একটি মন্তব্য বুখারী সহ সঅরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। আল-বারা বলতেন, লোকেরা মক্কা বিজয়কে আল-ফাত্হ বা মহা বিজয় বলে মনে করে। হাঁ, মক্কাকে বিজয় ও একটি বিজয়। তবে হুদাইবিয়ার দিনের বাই’য়াতে রিদওয়ানকে আমরা প্রকৃত বিজয় বলে মনে করি। সেই দিন আমরা রাসূলুল্লাহর (সা)  সাথে ১৪০০ লোক ছিলাম। তিনি হুনাইন যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন এবং খুব সাহসের সাথে শত্র“র মুকাবিলা করেছিলেন। বুখারী আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বনু কায়েসের এক ব্যক্তিকে আল-বারা ইবন আযিবের নিকট প্রশ্ন করতে শুনেছেন। প্রশ্নটি এই রকম: আচ্ছা, হুনাইনের দিন আপনারা কি রাসূলুল্লাহর (সা)  ছেড়ে পালাননি। হাওয়াযিন গোত্র তীর চালনায় পারদর্শী। আমরা হামলা চালালে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তভন আমরা গনীমাত সংগ্রহের জন্য ঝাপিয়ে পড়ি। বনু হাওয়াযিন আবার তীর দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। আমি তখন রাসূলুল্লাহর (সা) তাঁর সাদা খচ্চরের ওপর বসে থাকতে এবং আবু সাফিয়াকে তার লাগাম ধরে রাখতে দেখেছি। খচ্চরের ওপর বনেস তিনি এই কথগুলি উচ্চারণ করছিলেন।

আমি নবী, একা মিথ্যা নয়। আমি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর। হে আল্লাহ, আপনার সাহায্য পাঠান।’

আল-বারা বলেন, যখন ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হলো তখন আমরা রাসূলুল্লাহকে (সা) ঘির আড়াল করে দাঁড়ালাম।

তায়িফ যুদ্ধের এবং বিদায় হজ্জের পূর্বে হযরত রাসূলে কারীম (সা) ইয়ামানবাসীদের নিকট ইসলামের দা’ওয়াত পৌছানোর উদ্দেশ্যে একদল লোক সেখানে পাঠান। হযরত আল-বারা’ ইবন ’আযিবও সেই দলে ছিলেন। বায়হাকী বর্ণনা করেন, আল-বাা’ ইবন ’আযিব বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সা) ইয়ামনবাসীদের নিকট ইসলামের দা’ওয়াত পৌছানোর উদ্দেশ্যে খালিদ ইবন ওয়ালীদকে সেখানে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ছয়মাস ধরে আমরা মানুষকে ইসলামের দা’ওয়াত দিলাম কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। অত:পর রাসূল(সা) ইবন ’আলী ইবন আবী তালিবকে পাঠালেন এবং নির্দেশ দিলেন, খালিদের সাথে যারা আছে তাদের কেই ইচ্ছা করলে আলীর সাথে থেকে যেতে পারে। আল-বারা’ বলেন: আমি আলীর সাথে থেকে গেলাম। যখন আমরা হামাদান গোত্রে গেলাম, তারা আমাদের কাছে আসলো। যেয়ে আমাদের নিয়ে নামায আদায় করলেন। নামায শেষে আমরা কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালাম। আলী আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ইয়ামনবাসীদের প্রতি লেখা রাসূলুল্লাহর (সা) পত্রখানি পঠ করে শোনালেন। হামাদান গোত্রের লোকেররা ইসলাম গ্রহণ করলো। আলী তাদের ইসলাম গ্রহণের খবর জানিয়ে রাসুলকে (সা) পত্র লিখলেন। পত্র পাঠ করে তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর মাথা উঠিয়ে দুইবার বললেন: ‘আস্সালামু’ আলা-হামাদান, ’আস্সালামু ’আলা-হামাদান।’

খলীফা হযরত ’উমার ইবনুল খাত্তাবের খিলাফতকালে হিজরী ২০ সনে পারস্যের তুসতার বিজয়ে তিনি আবূ মুসা আল-আ’য়ারীর বাহিনীতে ছিলেন। আবু আমর আশ-শায়বানী বলেন, আল-বারা’ ইবন ’আযিব হিজরী ২৪ সনে পারস্যের রায় জয় করেন। ইমাম নাবাবী বলেন: আল-বারা’ ইবন আযিব ও তাঁর ভাই ’উবাইদ ইবন ’আযিব উট, সিফ্ফীন ও নাহ্রাওয়ানের-দ্ধগুলিতে আলীর পক্ষে যুদ্ধ করেন।

শেষ জীবনে তিনি কুফায় একটি বাড়ী তৈরী করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এ সময় অন্ধ হযে যান।

হিজরী ৭২ মতান্তরে ৭১ সনের হযরত মুসয়া’ব ইবন যুবাইর যখন কুফার আমীর তখন আল-বারা’ সেখানে ইনতিকাল করেন। ইতহাসে তাঁর এই সন্তানগুলির নাম পাওয়া যায়: আর-বারী’, ’উবাইদ, লুত, সুওয়াই ও ইযায়ীদ। তবে ইমাম নাবাবী বলেছেন: তিনি ইযায়ীদ ও সুওয়াইদ নামে দুই ছেলে রেখে যান। ইমাম নাবারীর এই মত সঠিকবলে মনে হয় না। কারণ ’তাহজীবুল কামাল ফী আসমায়র রিজাল’ গ্রন্থকার বলেছেন, তাঁর চার ছেলে- আল-রাবী, ’উবাইদ, লুত ও ইযায়ীদ তাঁদের পিতার নিকট থেকে হাদীস শুনেছে এবং বর্ণনাও করেছেন। ইযায়ী এক সময় আম্মানের আমীরও হয়েছিলেন। সুওয়াইদের জীবনীতে ইবন সা’দ লিখেছেন যে, সুওয়াইদ আম্মানের সর্বোত্তম আমীর হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলেন। সম্ভবত” ইযায়ীদ ও সুওয়াইদ দুই জনই আম্মানের আমীর হয়েছিলেন।

হযরত আল-বারা’ ইবন ’আযিব সব সময় হাতে একটি সোনার আংটি পরতেন। লোকে বললো: সোনা তো পুরুষের জন্য হারাম। তিনি বললেন: শোন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা) গনীমাতের মাল বন্টন করলেন। শুধু একটি আংটি থেকে গেল। তিনি এদিক ওদিক তাকালেন। তারপর আমাকে ডেকে বললেন: ধর, এটা পরো। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমাকে পরাচ্ছেন। একণ তোমরাই বল, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাকে পরিয়েছেন, আমি তা কেমন করে খুলি?

হযরত আল-বারা’ ইবন ’আযিব ছিলেন একজন অতি মর্যাদাবান সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সা) হাদীসের প্রচার ও প্রসারে ছিলেন বিশেষ মনোযোগী। ঁতার সূত্রে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৩০৫ টি। তারমধ্যে ২২টি মুত্তাফাক আলাইহি। ১৫টি বুখারী এবং ৬টি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।

হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি বিশে সতর্কথা অবলম্বন করতেন। এ শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন। খোদ রাসূলে পাকের (সা) নিকট থেকে। এবার রাসূল (সা) তাঁকে একটি দু’আ শিখিয়ে দেন। তিনি আবার তা আল-বারা’র মুখ থেকে শুনতে চান। আল বারা’ ’বিাবিয়্যিকা’-এর স্থলে ‘বিরাসুলিকা’ পাঠ করেন। রাসূল (সা) শব্দটি তাঁকে শুধরে দেন। এর ফলাফল এই হয় যে, হাদীস বর্ণনার সময় তিনি যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতেন।

একবার তিনি স্বীয় বর্ণিত হাদীসের প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: যে সকল হাদীস আমি বর্ণনা করে থাকি তার সব আমি রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে শুনিনি। আমরা উটের রাখালি ও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতাম। এ কারণে এসব রাসূলুল্লাহর (সা) মজলিসে হাজির থাকতে পারতাম না। আমার বর্ণিত হাদীসের অনেকগুলি অন্য সাহাবীদের নিকট থেকে শোনা।

আল-বারা’ ইবন ’আযিব সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যে সকল সাহাবীর নিকট থেকেি তনি হাদীস শুনে বর্ণনা করেছেন তাঁরা প্রত্যেকে আপন আপন স্তুরে নেতৃস্থানীয়। যেমন: বিলাল ইবন রাবাহ, সাবিত ইবন ওয়াদীয়া আল-আনসারী, হাস্সান সাবিত, আবু আইউব আল-আনসারী, আবু বকর ইবন আবী কুহাফা, ’আলী ইবন আবী তালিব ও ’উমার ইবনুল খাত্তাব।

যাঁরা তাঁর ছাত্র হওয়ার এবং তাঁর থেকে হাদীস বর্ণণার গৌরব লাভ করেন তাঁরা সকলে শ্রেষ্ঠ তাবে’ঈ। ‘তাহজীবুল কামাল’ গ্রন্থকার তাঁর এমন ৫০ জন তাবে’ঈ ছাত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। তারমধ্যে বিশেষ কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা গেল: ইয়াদ ইবন লাকীত, সাবিত ইবন ’উবাইদ, হারাম ইবন সা’দ, তাঁর ছেলে আর-রাবী’ ইবনুল বারা, ’উবাদ ইবনুল বারা’, লুত ইবনুল বারা’, ইয়াযীদ ইবনুল বারা’, ইবনুল আবদির রহমান, সা’ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লা, যায়িদ ইবন ওয়াহাব আল- জুহানী, সা’দ ইবন ’উবাইদা, আবু বুরদাহ্ ইবন আবী মুসা আল-আশ’য়ারী প্রমুখ।

তাঁর হাদীসের দারসে কো কোনসময় সাহাবীরাও হাজীর হয়েছেন। এমন কিছু সাহাবীর নাম সীরাতের গ্রন্থসমূহে পাওয়া যা। তাঁরা আল-বারা’ সূত্রে হাদীসও বর্ণণা করেছেন। যেমন: ’আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযীদ আল-কথামী, আবু জুহাইফা ওয়াহাব ইবন ’আবদিল্লাহ প্রমুখ। তাছাড়া অনেক সাহাবী হঠাৎ করে তাঁর দারসে হাজির হয়ে যেতেন। একদিন কা’ব ইবন হুজর (রা) আরো কয়েকজন সাহাবীর সাথেতার দারসে হাজির হয়েছেন।

তাঁর মজলিসে উপস্থিত ছাত্ররা নানা ধরনের প্রশ্ন কতো। কেউ প্রশ্ন করতো কুরআনের আয়াত সম্পর্কে, আবার কেই বা করতো ফিকাহর কোন মাসয়ালা বিষয়ে।

এক ব্যক্তি একবার সূরা আল-বাকারার ১৯৫নং আয়ত নিজের জীবনকে তোমরা ধ্বংসের সম্মুখীন করো না’- মস্পকের্ তাঁকে প্রশ্ন করলো। বললো: এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কি পৌত্তলিকদের ওপর আক্রমণ শামিল হবেনা? উত্তরে তিনি বললেন: তা কি করে হয়, কারণ, আল্লাহ তো রাসূলকে (সা) জিহাদের হুকুম দিয়ে বলেছেন” ‘আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করতে থাক, তুমি নিজের সত্তা ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে জিম্মাদার নও। তিুমি মুসলমানদেরকে উৎসাতি করতে থাক।’ (সূরা আন-নিসা: ৮৪) তিনি আরো বললেন: তুমি যে আয়াত পেশ করেছো তা হচ্ছে খরচের ব্যাপারে।’ অর্থাৎ এমন বিশ্বাস যেন না জন্মে যে, আল্লাহর পথে খরচ করলে ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন বিশ্বাস হলে ধ্বংস।

অপর একটি বর্ণণায় এসেছে, লোকটি জানতে চেয়েছিল: উপরোক্ত আয়াত দ্বারা কি এ ব্যাক্তিকে বুঝানো হয়েছে যে শত্র“র সাক্ষাৎ পেয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং মুতুবরণ করে? তিনি বললেন: না। বরং আয়াতের উদ্দেশ্য ঐ ব্যক্তি যে কোন পাপ করে। অত:পর বলে, আল্লাহ এ পাপ ক্ষমা করবেন না।

একবার আবদুর রহমান ইবন মুত’য়িমের এক বুন্ধ কিছু দিরহাম একটি নির্দিষ্ট সমরে জন্য বিক্রি করলেন। আবদুর রহমান তাঁর বন্ধুকে প্রশ্ন করলেন: এমন বিক্রী কি জায়েয? তিনি বললেন: হাঁ, জায়েয। আমি এর আগেও এভাবে বিক্রি করেছি, কেউ মন্দ বলেনি। আবদুর রহমান আল-বারা’ ইবন ’আযিবের নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। শুনে তিনি বললেন: রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনীয় আসেন তখন আমরা এভাবে কেনা বেচা করতাম। তা দেখে তিনি বললেন: নগদা-নগদি হলে এমন বেচাকেনায় দোষ নেই। তবে বাকীহলে জায়েয হবে না। তারপর তিনি আবদুর রহমানাকে বললেন: তমি আরো নিশ্চিত হতে চাইলে যায়িদ ইবন আরকামের কাছে জিজ্ঞেস করতে পার। তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। আবদুর রহমান যায়িদ ইবন আরকামের কাছে যান। তিনি আল-বারা’র কথা সমর্থন করেন। ঘটনাটি বখারীতে বর্ণিত হয়েছে।

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে। আবুল মিনহাল বলেন: একবার আমি যাদি ইবন আকাম ও আল-বারা’ ইবন ইবন ’আযিবের কাছে ‘সারফ’ বা মুদ্রা বিনিমরে ব্যাপারে জিজ্ঞেস কলাম। আমি যখন তাঁদের একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম তখণ তিনি অন্য জনের কথা বলে বললেন: তাঁর কাছে জিজ্ঞেস কর। কারণ, তিনি আমার চেয়ে ভালো এভং আমার চেয়ে বেশি জানেন।

হযরত রাসূলের কারীমের প্রতি সীমাহীন মুহাব্বত, সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ এবং বিনয় ও ভীতি ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট। সুন্নাত অনুসরণেল ক্ষেত্রে অবস্থা এমন ছিল যে, তাঁর নামাযের প্রতিটি বিষয় রাসূলুল্লাহর (সা) অনুরূপ ছিল। একদিন তিনি পরিবারের লোকদের জড় করে বললেন: যেভাবে রাসূল (সা) ওজু করতেন এবং যেভাবেনামায পড়তেন, আজ আমি তোমাদের তা দেখাবো। কারণ, আল্লাহই জানেন, আমি আর কতদিন বাঁচবো। তিনি ওজু করে জুহর, ’আসন, মাগরিব ও ’ঈশার নামায সেইভাবে আদায় করেন। আর একদিন তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সিজদার অনুসরণ করে দেখান। একবার আবু দাউদ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। আল-বারা’ প্রথমে সালাম করেন এবং তাঁর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে একচোট প্রাণখূলে হাসেন। পরে বলেন: জান, আমি এমনিট কেন করেছি? রাসূল (সা) একবার আমার সাথে এরূপ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, যখন দুইজন মুসলমান পরস্পর মিলিত হয় এভং নিজেদের কোন স্বার্থ প্রতিবন্ধক না হয় তখন তাদের পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

হাদীসে নামায্যের কাতারে ডান দিকে দাঁড়ানোর অনেক বেশি ফজীলাতের কথা এসেছে। এ কারণে তিনি ডান দিকে দাঁড়ানো পছন্দ করতেন।

নিজের জান মাল থেকেও অনেক বেশী রাসূলকে (সা) ভালোবাসতেন। প্রতিটি কথা ও কাজে তার প্রমাণ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) চেহারা সুরাতের বর্ণণা যখন দিতেন তখন তাঁর প্রতি শব্দহতো প্রেম রসে সিক্তা। বলতেন: রাসূল (সা) ছিলেন জগতের সকল মানুষ থেকে সুন্দর। আমি লাল চাদর গায়ে জড়িয়ে দেখেছি, তা যতখানি রাসূল্লাহর (সা) গায়ে সুন্দর দেখাতো অন্যের গায়ে ততখানি নয়।

একবার একজন প্রশ্নকরলো, রাসূলুল্লাহর (সা) মুবারাক চেহারার দীপ্তি কি তরবারির ঔজ্জল্যের মত ছিল? বললেন: না। চাঁদের মত ছিল।

তিনি রাসূলকে (সা) মেন গভীরভাবে ভালোবাসতেন তেমনি ভয়ও করতেন। তিনি বলেন: একবার আমি রাসূলের (সা) নিকট একটি বিষয় জিজ্ঞেস করতে চাইলাম; কিন্তু তাঁর প্রতি অত্যধিক ভীতির কারণে দুই বছর দেরী করলাম।

বিনয় ও নম্রতার তিনি ছিলেণ বাস্তব প্রতিচ্ছবি। অতি উঁচু মর্যাদার সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও অতি নগন্য মনে করতেন। একবার একি ব্যক্তি তাঁকে বললো, আপনার কত বড় খোশ কিসমত যে, আপনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্য্য লাভ এবং বাইয়াতে রিদওয়ানে শরীফ নেই, রাসূরুল্লাহর (সা) পরে আমরা কি কি করেছি।

ড. মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button