ছাহাবী চরিত

সাহল ইবন সা’দ (রা)

তাঁর ভালো নাম সাহল। ডাকনাম কয়েকটি। যেমন: আবুল ‘আব্বাস, আবু মালিক ও আবু ইয়াহইয়া। পিতার নাম সা’দ ইবন মালিক। মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনু সায়িদার সন্তান। একজন বিখ্যাত আনসারী সাহাবী। পিতা সা’দও সাহাবী ছিলেন।

রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের পাঁচ বছর পূর্বে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর পিতা নাম রাখেন ‘হুয্ন’। রাসূল (সা) মদীনায় আসার পর পরিবর্তন করে তাঁর নাম রাখেন ‘সাহল’। একথা ইবন বিব্বান বর্ণনা করেছেন। হিজরাতের পূর্বেই তাঁর পিতা সা’দ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং তিনি মুসরমান হিসেবেই বেড়ে ওঠেন।

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মদীনা আগমনের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের সময় তিনি সাত বছরের এক বালক মাত্র। যুদ্ধে তোড়জোড় চলছে, এতমন সময় তার পিতা হযরত সা’দ ইনতিকাল করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। বদর যুদ্ধের পর রাসূল (সা) গনীমতের একটি অংশ তাঁর মরহুম পিতাকেও দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বদর যুদ্ধে যোগদানের সংকল্পন করেছিলেন।

হিজরী তৃতীয় সনে উহুদ যুদ্ধের সময় তাঁর সম বয়সী ছেলেদের সাথে মিলে মদীনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ যুদ্ধে হযরত রাসূলে কারীম (সা) আহত হয়ে রক্তরঞ্জিত হয়েছিলেন। যখন তাঁর সেই রক্ত সাফ করা হয়েছিল, তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

হিজরী পঞ্চম সনে যখন খন্দক যুদ্ধ হয় তখন তিনি ধশ বছরের বালক মাত্র। তা সত্ত্বেও তীব্র আবেগ ও উৎসাহ ভরে খন্দক খননে অংশ নেন এবং কাঁধে করে মাটি বহন করেন। মোট কথা হিজরী এগারো সনে রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের সময় তাঁর বয়স মাত্র। পনেরো বছর। তখনও তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি।

খিলাফতে রাশেদার সময় কালের তাঁর জীবনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। হিজরী ৭৪ সনে স্বৈরাচারী ও উৎপীড়ক উমাইয়্যা শাসক হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের রোষানলে পড়েন। হাজ্জাজ তাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন: আপনি খলীফা উসমানকে সাহায্য করেননি কেন? তিনি বলেন: করেছি। হাজ্জাজ বলেন: সত্য বলছে না। এরপর তিনি অপমান ও লাঞ্ছনার প্রতীক স্বরূপ ত৭ার ঘাড়ে ছাপ মেরে দেওয়ার দির্নেশ দেণ। হাজ্জাজের এ অপকর্মের হাত থেকে হযরত আনাস ও জাবির ইবন আবদিল্লাহর মত মর্যাদাবান সাহাবীদ্বয়ও রেহাই পাননি। হাজ্জাজের এ কাজের উদ্দেশ্যে ছিল যাতে মানুষ তাঁদের থেকে দূরে াকে এবং তাঁদের কায় কান না দেয়।

ইমাম যুহরী বলেন: রাসূলুল্লাহর ইনতিকালের সময় সাহল ইবন সা’দের বয়স হয়েছিল ১৫ বছর। আর তিনি হিজরী ৯১ সনে মদীনায় মারা যান। ওয়াকিদীর মতে তিনি এক  শো বছর জীবন লাভ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন ছিয়ানব্বই বছর বা তার চেয়ে কিছু বেশী। ইবন হাজারের মতে হিজরী ৮৮ সনে তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ১০০ বছরের উর্দ্ধে। ইবন আবী দাউদের ধারণা, তিনি ইসকান্দারিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। কাতাদা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি মিসরে মারা যান। ইবন হাজার বলেন, এ সব ধাণণা মাত্র। ওয়াকিদী বলেন: একথা বর্ণিত আছে যে, মদীনায় মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী জাবির ইবন আবদিল্লাহ। তবে সঠিক এই যে, জিরী ৯১ সনে সাহল ইবন সা’দ আস-সা’য়িদী মদীনায় মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী। তাঁর জীবনের শেষ ভাগে মদীনায় আর কোন সাহাবী ছিলেন না। ইসলামী খিলাফতের অন্যান্য অঞ্চলও তখন সাহাবীদের বরকত থেকে প্রায় মাহরূম হয়ে পড়েছিল। তিনি নিজেই বলতেন: আমি মারা গেলে ‘কালার রাসূল (রাসূল বলেছেন) বলার কেউ থাকবে না।

হযরত সাহল ইবন সা’দ ছিলেন খ্যাতিমান সাহাবীদের একজন। বিশিষ্ট সাহাবীদের মুত্যুর পর তিনি জনগণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। অতি আবেগ ও উৎসাহের সাথে অগণিত মানুষ হাদীস শোনার জন্য তাঁর কাছে ভীড় জমাতো।

রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় যদিও তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন, বতুও বহু হাদীস শুনেছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালেরর পর হযরত উবাই ইবন কা’ব আসিম ইবন ‘আদী, ‘আমার ইবন আবাসা প্রমুখ খ্যামিান সাহাবীর নিকট থেকে এ শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন। মারওয়ান যদিও সাহাবী ছিলেন না, তবুও তাঁর নিকট থেকে কিছু হাদীস তিনি গ্রহণ করেছেন।

সাহাবী ও তাবে’ঈদের অনেকেই তাঁর নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন এবং বর্ণনাও করেছেন। তাঁদের বিশেষ কয়েকজনের মাত্র এখানে উল্লেখ করা হলো:

আবু হুরাইরা, ইবন আব্বাস, সা’ঈদ ইবন মুসায়্যিব, আবু হাযিম ইবন দাীনায, যুহরী, আবু সুহাইল সুবহী, ‘আব্বাস ইবন সাহল (ছেলে), ওয়াফা ইবন শুরাইহ হাদরামী, ইয়াহইয়া ইবন মায়মুন হাদরামী, আবদুল্লাহ ইবন আবদির রহমান ইবন আবী জুবাব, আমর ইবন জাবির হাদরামী প্রমুখ।

হরত সাহল ইবন সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সর্বমোট ১৮৮ টি। তার মধ্যে ২৮টি মুত্তাফাক আলাইহি।

হযরত রাসূল কারীমকে (সা) তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতিটি কাজ ও আচার-আচরণ অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। রাসূল (সা) একটি কাঠোর খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। একবার তিনি একটি মম্বরের কথা বললেন। হযরত সাহল সাথে সাথে জঙ্গলে চলে যান এবং মিম্বরের জন্য কাঠ কেটে নিয়ে আসেন। একবার তিনি নিজ হাতে রাসূলকে (সা) ‘বুদা’য়া’ কূপের পানি পান করিয়েছিলেন। একথা তিনি বর্ণনা করেছেন। উল্লেখ্য যে, এটা মদীনার একটি কূপ। মদীনাবাসীরা তাতে ময়লা-আবর্জনা ফেলতো। তবে কূপটি বড় ছিল এবং তাতে অনেক ঝর্ণা ছিল।

সত্য বলা ছিল হযরত সাহলের (রা) চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁর জীবদ্দশায় একবার মাওয়ান বংশের এক ব্যক্তি মদীনার আমীর হয়ে আসেন। তিনি হযরত সাহলকে (রা) ডেকে হযরত আলীকে (রা) গালি দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সেই শ্বৈরাচারী শাসকের নির্দেশ পালন করতে কঠোরভাবে অম্বীকার করেন। তখন সেই আমীর আদার করেন, অন্ততঃ এতটুকুই বলেন যে, ‘আবু তুরাবের ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ জবাবে হযরত সাহল বলেনঃ আবু তুরাব ছিল আলীর প্রিয়তম নাম। রাসূল (সা) তাঁকে এ নামে ডেকে খুশী হতেন। এরপর তিনি আলীর (রা) আবু তুরাব নাম করণের ব্যাখ্যা করে শোনালে আমীর চুপ হয়ে যান।

একবার সাহল ইবন সা’দ, আবু জার, ‘উবাদা ইবনুস সামিত, আবু সা’ঈদ আল-খুদরী, মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা ও ষষ্ঠ এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে একথার ওপর বাই’য়াত করেন যে, আলÍাহর ব্যাপারে তাঁরা কোন তিরষ্কারকারীর তিরস্কারের পরোয়া করবেন না। তাঁর জীবন-ইতহিাস একথা প্রমাণ করে যে, আমরণ তিনি এ বাই’য়াতের ওপর অটল ছিলেন।

তাঁর হাদীসের দারসের মজলিসে কেউ উদাসীন বা অমনোযোগী থাকলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যেতেন। এ ধরনের একটি ঘটনা তাবারানী তাঁর আল-কাবীর’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আবু হাসেম বলেন, একবার এক মজলিসে তিনি হাদীস শোনাচ্ছেন। শ্রোতাদের কেউ কেউ তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল। িিন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন: এদেরকে দেখে রাখ। আমার দু’চোখ রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যা কিছু দেখেছে, দু’কান যা কিছু শুনেছে, আমি তাই এদের নিকট বর্ণনা করছি, আর এরা তা না কক্ষনো ফিরে আসবো না। আমি জানতে চাইলাম। কোথায় যাবেন? বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বেরিয়ে যাব। বললাম: আপনার ওপর এখন তো আর জিহাদ ফরজ নয়। আপনি এখন ঘোড়ার ওপর বসতে পারেন না, তরবারি দিয়ে আঘাত করার শক্তি রাখেন না এবং তীর-বর্শাও ছুড়তে পারেন না।

বললেন: আবু হাসেম! আমি ময়দানে গিয়ে সারিতে দাঁড়িয়ে থাকবো। একটা অজানা তীর বা পাথর উড়ে এসে আমাকে আঘাত করবে এবং আল্লাহ তাতেই আমাকে শাহাদাত দান করবেন।

– ড. মুহাম্মদ আবদুল মা’বুদ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button