হুবাব ইবনুল মুনজির (রা)
নাম হুবাব, ডাকনাম আবু ’উমার বা আবু ’আমর। পিতা মুনজির এবং মাতা শামূস বিনতু হাক্ক। মদীনার খাযরাজ গোত্রের সন্তান। আকাবার অন্যতম নাকীব এবং বিরে মা’উনার অনতম শহীদ আল-মুনজির ইবন ’আমর আস-সা’য়িদীর (রা) মামা। হানবীর মদীনায় হিজরাতের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে বদর থেকে নিয়ে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বদর যুদ্ধে খাযরাজ গোত্রর ঝান্ডা তাঁরই হাতে ছিল। ইবন সা’দ বলেন: ‘তিনি যে বদর যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, এ ব্যাপারে প্রায় ইজমা হয়ে গেছে। তবে মুহাম্মদ ইবন ইসহাক তাঁকে বদরীদর মধ্যে গণ্য করেননি। আমাদের মতে এটা তাঁর ভুল। কারণ, বদরে হুবারের কর্মকান্ড অতি প্রসিদ্ধ।’
বদরের কাছাকাছি পৌঁছে রাসূল (সা) শিবির স্থাপনের জন্য অবতরণ করলেন। হুবাব আরজ করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখানে শিবির স্থাপনের সিদ্ধান্ত কি আল্লাহর পক্ষ থেকে, না আপনার নিজের? রাসূল(সা) বললেন: আমার নিজের। হুবার বললেন: তাহলে এখানে নয়। আমাদেরকে শত্রুপক্ষের কাছাকাছি সর্বশেষ পানির কাছে নিয়ে চলুন। সেখানে আমরা একটি পানির হাউজ তৈরী করবো, পাত্র দিয়ে উঠিয়ে সেই পানি পান করবো, আর শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবো। এছাড়া অন্যসব কূপের পানি আমরা ঘোলা করে ফেলবো। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হুবাব বললেন: আমরা হচ্ছি যোদ্ধা সম্প্রদায়। আমার মত হচ্ছে, একটি মাত্র কূয়ো ছাড়া বাকি সবগুলি কূয়োর পানি ঘোলা করে ফেলা। যাতে কোন অবস্থানে আমাদের পানি কষ্ট না হয়। পক্ষান্তরে শত্রুরা পানির জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে।
হুবারের পরামর্শ দানের পর জিবরীল (আ) এসে রাসূলকে (সা) জানান যে, হুবারের মতটিই সঠিক। অত:পর রাসূল (সা) হুবাবকে ডেকে বলেন, তোমার মতটিই সঠিক। একথা বলে তিনি গোটা বাহিনী সরিয়ে নিয়ে বদরের কূয়োর ধারে অবতরণ করেন।
এই বদর যুদ্ধে রাসূল (সা) তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন, এ কারণে তিনি ‘জু’আর-রায়’ বা সিদ্ধান্ত দানকারী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। ইমাম সা’য়ালাবী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন: ‘বদরে তিনি ছিলেন পরার্মদাতা। রাসূল (সা) পরামর্শ গ্রহণ করেন। জিবরীল (আ) এসে বলেন: হুবাব যে মত পেশ করেছে তাই সঠিক। জাহিলী ’আমলেও তিনি অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত ও মতামত প্রদান করেছেন।’
মক্কায় যারা রাসূলুল্লাহকে (সা) সবচেয়ে বেশী উৎপীড়িত করেছিল নরাধম আবু কায়স ইবন আল-ফাকিহ তাদের অন্যতম। বদরে সে নিহত হয়। একটি বর্ণনা মতে হযরত হুবাবই তাকে হত্যা করেন। এ যুদ্ধে তিনি হযরত বিলালের (রা) উৎপীড়ক উমাইয়্যা ইবন খালাফের একটি উরু তরবারির আঘাতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। তাছাড়া ’আম্মার ইবন ইযাসির ও তিনি একযোগে উমাইয়্যার ছেলে আলীকেও হত্যা করেন। এ যুদ্ধে তিনি খালিদ ইবন আল-আ’লামকে বন্দী করেন।
উহুদ যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী এমন তোড়জোড় সহকারে মদীনার দিকি আসে যে, গোটা মদীনায় একটা শোরগোল পড়ে যায়। কুরাইশ বাহিনী মদীনার অনতিদূরে জুল হুলায়ফায় পৌঁছালে রাসূল (সা) দু’জন গুপ্তচর পাঠালেন এবং তাদের পিছনে হুবাবকেও পাঠালেন। তিনি শত্রু বাহিনীর মধ্যে ঘুরে ঘুরে নানা তথ্য সংগ্রহ করেন এবং শত্রু বাহিনীর সংখ্যা সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা রাসূলুল্লাহকে (সা) দান করেন। এ যুদ্ধেও খাযরাজ গোত্রের ঝান্ডা ছিল তাঁর হাতে। অনেকের ধারণা, ঝান্ডা বাহক তিনি নন, বরং সা’দ ইবন ’উবাদা।
এই উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলমানদের বিপর্যয় দেখা দেয় এবং মুসলিম বাহিনী হযরত রাসূলে কারীম (সা) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন যে ১৫ জন মুজাহিদ জীবন বাজি রেখে রাসূলুল্লাহকে (সা) ঘিরে রাখেন তাঁদের একজন ছিলেন এই হুবাব। এ যুদ্ধে তিনি মৃত্যুর জন্য বাই’য়াত করেছিলেন।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জা ও বনু নাদীরের বিষয়ে সাহাবীদের নিকট পরামর্শ চাইলে হুবার বলেন: আমরা তাদের বাড়ী ঘর ঘেরাও করে তাদের যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলবো। রাসূল (সা) তাঁর মতই গ্রহণ করেন।
খাইবার যুদ্ধে খাযরাজ বাহিনীর একাংশের এবং হুনাইন যুদ্ধে গোটা খাযরাজ বাহিনীর ঝান্ডা বাহক ছিলেন তিনি। একটি বর্ণনা মতে তাবুক যুদ্ধের সময়ও রাসূল (সা) খাযরাজ বাহিনীর ঝান্ডা তাঁর হাতে তুলে দেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর মদীনার আউস ও খাযরাজ সহ গোটা আনসার সম্প্রদায়ের লোকেরা মসজিদে নববীর অনতিদূরে সাকীফা বনী সা’য়িদা নামক স্থানে সমবেত হয়ে পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা শুরু করে। আনসার নেতা সা’দ ইবন ’উবাদার একটি ভাষণের পর তাঁরা প্রায় তাঁকেই খলীফা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। এদিকে আনসারদের এ সমাবেশের খবর আবু বকরের (সা) কানে গেল। তিনি ’উমারকে (রা) সাথে নিয়ে সেখানে ছুটে গেলেন। সেখানে খলীফা মুহাজির না আনসারদের মধ্য থেকে হবে, এনিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল বাক-বিতন্ডা হয়। এই বিতর্কে হযরত হুবাব ছিলেন হযরত আবু বকরের (রা) সাথে বিতর্কে লিপ্ত হন এবং দু’ পর্যায়ে দু’টি জ্বালামীয় ভাষণ দেন। হযরত আবু বকরের (রা) ভাষণ শেষ হলে হুবার উঠে দাঁড়ান এবং আনসারের সম্বোধন করে বলতে শুরু করেন:
‘ওহে আনসার সম্প্রদায়! তোমাদের এ অধিকার তোমরা হাত ছাড়া করো না। জনগণ তোমাদেরই সাথে আছে। তোমাদের চরিত্রের ওপর আঘাত হানতে কেউ দু:সাহসী হবে না। তোমাদের মতামত ছাড়া কেউ কোন সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সক্ষম হবে না। তোমরা হচ্ছো সম্মানী ধনবান, সংখ্যাগুরু, অভিজ্ঞ, সাহসী ও বুদ্ধিমান। তোমরা কি সিদ্ধান্ত নেবে তা দেখার জন্য মানুষ তাকিয়ে আছে। তোমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করোনা। বিভেদ সৃষ্টি করলে তোমাদের অধিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে। তোমাদের প্রতিপক্ষ মুহাজিররা তোমাদের দাবী যদি না-ই মানে তাহলে আমাদের মধ্যে থেকে একজন এবং তাদের মধ্য থেকে একজন মোট দু’জন আমীর হবেন।’
হযরত হুবারের (রা) এই দুই আমীরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হযরত ’উমার (রা) বলে ওঠেন: ‘দূর! এক শিং এর ওপর দু’জনের অবস্থান অসম্ভব।’ ’উমারের (রা) বক্তব্য শেষ হলে তিনি আবার বলতে শরু করেন: তোমরা নিজেদের আধিকার শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। এ ব্যাক্তির কথায় কান দিওনা। তাঁর কথা শুনলে তোমাদের এই ক্ষমতার অধিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমি আমার সম্প্রদায়ের আস্থাাভাজন ব্যক্তি এবং মানুষ আমার সিন্ধান্ত দ্বারা উপকৃত হয়। আল্লাহার কসম! তোমরা চাইলে এ খিলাফতকে আমরা পাঁচ বছরের একটি উটের বাচ্চায় রুপান্তরিত করে ছাড়বো। তারপর তিনি মুহাজিরদের লক্ষ্য করে বলেনঃ ব্যাপারটি আপসাদের হাতে ছেড়ে দিতে আমরা কার্পণ্য করতাম না। যদি না আমাদের আশস্কা হাতো, যে সম্প্রদায়ের লোকদের পিতা ও ভ্রাতাদের আমরা হত্যা করেছি তারাই এটা হস্তগত করে নেই। তখন তোমরা মরণই শ্রেয়ঃ অর্থ্যৎ ‘উমার (রা) আশ্বাস দিলেন এমনটি কক্ষনো হবেনা। আমাদের যাঁরা প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁদেরই একজনের হাত আমরা বাই‘য়াত করবো। যিনি তোমাদের ওপর কোনরকম অন্যায় অবিচার করবেন না’।
এত কিছু সত্ত্বেও তিনি উপস্থিত জনতাকে হযরত আবু বকরের (রা) হাতে বাই‘য়াত (আনুগত্যের শপথ) থেকে বিÍত রাখেতে পারলেন না। আনসারদের মধ্যে সর্ব প্রথম হযরত বাশীর ইবন সা‘দ (রা) আবু বকরের (রা) হাতে বাই‘য়াত করেন। তখন বাশীরকে লক্ষ্য করে হুবাব বলেন: তুমি নিজ সম্প্রদায়েরা বিরুদ্ধাচারণ করলে? তোমরা চাচাতো ভাইয়ের ইমারাত বা নেতৃত্বকে ঈর্ষা করলে? বাশীর জাবাব দিলেনঃ ‘তা নয়; বরং একটি সম্প্রদায়কে আল্লাহ যে অধিকার দিয়েছেন তা নিয়ে বিবাদ করা আমি পছন্দ করিনি’।
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালে তিনি ইনতিকাল কনে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চাস বছরের মত। বদর যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল তেত্রিশ বছর। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আবুত তুফাইল ‘আমের ইবন ওয়াসিল তাঁর ছাত্র। তিনি হুবাবের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
কবিত্ব ছিল তৎকালীন আরবদের স্বাভাজাত গুণ। হযরত হুবাবের মদ্যেও এ গুণটি ছিল। তিনি কবিতা রচনা করেছেন। ইতিহাসের কোন কোন গন্থে তাঁর নাম কিছু পংক্তি হয়েছে। তাঁর কয়েকটি পংক্তির আনুবাদ নিম্নরুপ:
১.আল্লাহ তোমাদের দুজনের পিতামাতার ভলো করুন! তোমরা কি জাননা যে, মানুষ দু রকমের অন্ধ ও চক্ষুস্মান?
২.আমরা এবং মুহাম্মদের দুশমনরা –সকলেই সিংহ-পুরুষ। যাদের হুংকার সারা বিশ্বে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
৩.তাবে পার্থক্য এই যে, আমরা তাঁকে সাহায্য করেছি এবং আশ্রয় দিয়েছি। আমরা ছাড়া তাঁর আর কোন সাহায্যকারী নেই।
তিনি একজন তুখোড় বক্তা ছিলেন। তাঁর ভাষা ছিল বিশুদ্ধ ও অলস্কারপূর্ণ। সাকীফা বনী সা‘য়িদায় তিনি যে দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন তা পাঠ করলে তাঁর বাগ্নিতা ও আলস্কারিতা সস্পর্কে ধরনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আনসাররা যে ভিলাঠতের ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম, যে কথাটি তিনি একটি অলঙ্কার মন্ডিত বাক্যে ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন: আল্লাহর কসম! তোমর যদি চাও তাহলে অবশ্যাই আমরা এ খিলাফতকে উপের সাথে তুলনা করেছেন। অর্থ্যৎ ইচ্ছা করলে আমরা যুদ্ধকে শক্তিশালী করতে পারি। তেমনিভাবে তিনি আনসারদের মধ্যে স্বীয় মর্যাদা ও স্থান বর্ণনা করেন এভাবে: আমি আনসারদের চর্মরোগ্রস্থ উটের শরীর চুলকাবার খুঁটি এবং তাদরে দীর্ঘ ও ফলবান বৃক্ষের ঠেস দাসেনর খুঁঠি বা প্রাচীর।
আরবে চর্মরোগগ্রস্ত উটের জন্য একটি খুটি বা কাঠ গেঁড়ে দেওয়া হতো যাতে সে গা চলকাতে পারে এবং এর মধ্যে সে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। তেমনিভাবে যে খেজুর গাছটি লম্বা বা ফলবান হওয়ার কারণে উপড়ে পড়ার আশঙ্কা হতো, তাতে ঠেস দিয়ে একটি খুঁটি পুতে দেওয়া হতো অথবা একটি প্রচীর খাড়া করে দেওয়া হতো। হযরত হুবার নিজেরকে সেই খুঁটি ও প্রাচীরের সাথে তুলনা করেছেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মা’বুদ