আবুল আস ইবন রাবী (রা:)
আবুল আসের প্রকৃত নামের ব্যাপারে ইতিহাসে বিস্তর মতভেদ দেখা যায়। যেমন: লাকীত, হিশাম, মিহশাম, ইয়াসির, ইয়াসিম ইত্যাদি। তবে তার কুনিয়াত বা ডাকনাম আবুল ‘আস’। এ নামেই তিনি ইতিহাসে খ্যাত। তার পিতা ‘রাবী’ ইবনে ‘আবদিল উযযা’ মাতা হযরত খাদীজার রা: সহোদরা হালা বিনতু খুওয়াইলিদ। তিনি কুরাইশ গোত্রের ‘আবদু শামস’ শাখার সন্তান হওয়ার কারণে তাকে সংক্ষেপে ‘আবশামী’ বলা হয়। খালা হযরত খাদীজা রা: ও খালু রাসুলুল্লাহ সা: বাড়ীতে আবুল আসের অবাধ যাতায়াত ছিল। তিনি ছিলেন খালা খালুর অতি স্নেহের পাত্র। আবুল আস ধীরে ধীরে যৌবনে পদার্পণ করেন। তার আকর্ষণীয় চেহারা সকলের মন কেড়ে নেয়। বংশ গৌরব এবং আরবীয় বীরত্ব, প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ ইত্যাদি গুণের জন্য তৎকালীন মক্কার যুবকদের মধ্যে তিনি এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। তদুপরি কুরাইশদের যে বিশেষ গুণের কথা কুরআনে ঘোষিত হয়ে- রিহলাতাশ শিতায়ি ওয়াস সাইফ- শীতকালে ইয়ামানের দিকে এবং গ্রীস্মকালে শামের দিকে তাদের বাণিজ্য কাফিলা চলাচল করে- আবুল আসের মধ্যেও এ গুণটির পুরোপুরি বিকাশ ঘটে। মক্তা ও শামের মধ্যে সব সময় তার বাণিজ্য কাফিলা যাতায়াত করে। সেই কাফিলায় থাকে কমপক্ষে একশো উটসহ দুশো লোক। তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি, সততা, ও আমানতদারীর জন্য মানুষ তার কাছে নিজেদের পন্যসম্ভার নিশ্চিন্তে সমর্পণ করে। ইবন ইসহাক বলেন, ‘অর্থ সম্পদ, আমানতদারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি তখন মক্কার গণ্যমান্য মুষ্টিমেয় লোকদের অন্যতম। (আল ইসাবা-৪/১২২)।
সময় আপন গতিতে বয়ে চললো। এদিকে মুহাম্মাদের সা: বড় মেয়ে যয়নাব বেড়ে ওঠেন। মক্কার সম্ভ্রান্ত যুবকরা তাঁকে জীবন সঙ্গীনী হিসেবে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর ব্যাকুল হবেই বা না কেন? যয়নাব হলেন, মক্কার কুরাইশ গোত্রের সর্বোত্তম শাখার কন্যা। পিতা মাতার দিক দিয়ে যেমন সর্বাধিক সম্মানিত, তেমনি চরিত্র ও আদব আখলাকের দিক দিয়েও সবচেয়ে বেশি পুত:পবিত্র। এমন পাত্রীর আশা করলেই কি সবার ভাগ্যে জোটে? অবশেষে মক্কার যুবক তারই খালাত ভাই আবুল আস ইবন রাবী এ গৌরব লাভে ধন্য হন।
আবুল আসের সাথে যয়নাবের রা: বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে মুহাম্মাদ সা: নবুওয়াত লাভ করেন। সত্য দ্বীন ও হিদায়াত সহকারে তিনি প্রেরিত হন। নিজের নিকট আত্মীয়দের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর নির্দেশ লাভ করেন। হযরত খাদীজা রা: ও তার কন্যারা যথা: যয়নাব, রুকাইয়া, উম্মু কুলসুম ও ফাতিমা রা: রাসুলুল্লাহর সা: ওপর ঈমান আনেন। অবশ্য ফাতেমা তখন খুব ছোট। রাসুলুল্লাহর সা: জামাই আবুল আস স্ত্রী যয়নাবকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং সম্মানও করতেন। কিন্তু তিনি পূর্ব পুরুষের ধর্মত্যাগ করে প্রিয়তমা স্ত্রীর নতুন দ্বীন কবুল করতে রাজী হলেন না। এ অবস্থা চলতে লাগলো। এদিকে রাসুলুল্লাহ সা: ও কুরাইশদের মধ্যে মারাত্মক দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। কুরাইশরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো,
“তোমাদের সর্বনাশ হোক! তোমরা মোহাম্মাদের বিয়ে করে তার দুশ্চিন্তা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছ। তোমরা যদি এ সকল মেয়েকে তার কাছে ফেরত পাঠাতে তাহলে সে তোমাদের ছেড়ে তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।” তাদের অনেকে এ কথা সমর্থন করে বললো, “ এ তো অতি চমৎকার যুক্তি!” তারা সবাই আবুল আসের কাছে যেয়ে বললো, “আবুল ’আস, তুমি যে কুরাইশ সুন্দরীকে চাও, আমরা তাকে তোমার সাথে বিয়ে দেব।” আবুল আস বললেন, “আল্লাহর কসম! না, তা হয় না। আমার স্ত্রীকে আমি ত্যাগ করতে পারিনে। তার পরিবর্তে সকল নারী আমাকে দিলেও আমার তা পছন্দনীয় নয়।”
রাসুলুল্লাহ সা: অন্য দুই মেয়ে রুকাইয়া ও উম্মু কুলসুমকে তাদের স্বামীগৃহ থেকে বিদায় দিয়ে পিতার কাছে পাঠিয়ে দিল। কন্যাদের স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে ফিরে আসায় হযরত রাসূলে কারীম সা: খুব খুশী হলেন। তিনি মনে মনে কামনা করলেন, অন্য দু’ জামাইর মত আবুল আস ও যদি যয়নাবকে বিদায় দিত! যেহেতু আবুল আসের হাত থেকে যয়নাবকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাসুলুল্লাহর সা: ছিল না এবং মুশরিকদের (পৌত্তলিক) সাথে মুমিন নারীদের বিয়ে তখনও হারাম ঘোষিত হয়নি, এ কারণে তিনি চুপ থাকলেন।
সময় দ্রুত বয়ে চললো। হযরত রাসূলে কারীম সা: মদীনায় হিজরাত করলেন। কুরাইশদের সাথে সামরিক সংঘাত শুরু হলো। কুরাইশরা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বদরে সমবেত হল। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবুল আস কুরাইশদের সাথে বদরে গেলেন। কারণ কুরাইশদের মধ্যে তার যে স্থান তাতে না যেয়ে উপায় ছিলনা। বদরে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। তাদের বেশ কিছু নেতা নিহত হয় এবং বহু সংখ্যক যোদ্ধা বন্দী হয়। আর অবশিষ্টরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এই বন্দীদের মধ্যে রাসুলুল্লাহর সা: জামাই আবুল আসও ছিলেন। ইবন ইসহাক বলেন, বদরে হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর ইবন নুমান রা: তাকে বন্দী করেন। তবে ওয়াকীদীর মতে হযরত খিরাশ ইবন সাম্মাহর রা: হাতে তিনি বন্দী হন। (আল ইসাবা-৪/১২২)
বদরের বন্দীদের ব্যাপারে মুসলমানদের সিদ্ধান্ত হল, মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। বন্দীদের সামাজিক মর্যাদা এবং ধনী দরিদ্র প্রভেদ অনুযায়ী এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ নির্ধারিত হল। বন্দীদের প্রতিনিধিরা ধার্যকৃত মুক্তিপণ নিয়ে মক্কা মদীনা ছুটাছুটি শুরু করে দিল। নবী দুহিতা হযরত যয়নাব স্বামী আবুল আসের মুক্তিপণ দিয়ে মদীনায় দূত পাঠালেন। ওয়াকীদির মতে আবুল আসের মুক্তিপণ নিয়ে মদীনায় এসেছিল তার ভাই আমর ইবন রাবী। হযরত যয়নাব মুক্তিপণ দিরহামের পরিবর্তে একটি হার পাঠালেন। এই হারটি তার জননী হযরত খাদীজা রা: বিয়ের সময় তাকে উপহার দিয়েছিলেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: হারটি দেখেই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন এবং স্বীয় বিষন্ন মুখ একটা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেললেন। প্রিয়তমা স্ত্রী ও কন্যার স্মৃতি তার মানসপটে ভেসে উঠলো।
কিছুক্ষণ পর হযরত রাসূলে কারীম সা: সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন, “যয়নাব তার স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে এই হার পাঠিয়েছে। তোমরা ইচ্ছা করলে তার বন্দীকে ছেড়ে দিতে পার এবং এ হারটিও তাকে ফেরত দিতে পার।” সাহাবীরা বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনার সন্তুষ্টির জন্য আমরা তাই করবো।” সাহাবীরা রাজী হয়ে গেলেন। তবে রাসুলুল্লাহ সা: আবুল আসকে মুক্তি দেওয়ার আগে তার নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নেন যে, সে মক্কায় ফিরে গিয়ে অনতিবিলম্বে যয়নাবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেবে।
আবুল আস মক্কা ফিরে গিয়েই প্রতিশ্রুতি পালনের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। তিনি স্ত্রী যয়নাবকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। তিনি যয়নাবকে এ কথাও বললেন যে, মক্কার অনতিদূরে তোমার পিতার প্রতিনিধিরা তোমাকে নেওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আবুল আস স্ত্রীর সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তার ভাই আমর মতান্তরে কিনানকে ডেকে যয়নাবের সাথে যেতে বললেন এবং তাকে অপেক্ষমান দূতদের হাতে তুলে দিতে বললেন।
ইবন ইসহাক বলেন, সফরের প্রস্তুতি শেষ হলে যয়নাবের দেবর কিনানা ইবন রাবী একটি উট এনে দাঁড় করালো। যয়নাব উটের পিঠের হাওদায় উঠে বসলেন। আর কিনানা স্বীয় ধনুকটি কাঁধে ঝুলিয়ে তীরের বাণ্ডিলটি হাতে নিয়ে দিনে দুপুরে মক্কা থেকে বের হলো। কুরাইশদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল। তারা ধাওয়া করে একটু দূরেই ‘যী-তুওয়া’ উপত্যকায় তাদের দুজনকে ধরে ফেললো। আলোচ্য ঘটনা সম্পর্কে সীরাত গ্রন্থসমূহে নানা রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো। কিনানা ইবন রাবী কুরাইশদের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে কাঁধের ধনুকটি নামিয়ে হাতে নিয়ে তীরের বাণ্ডিলটি সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, “তোমাদের কেউ যয়নাবের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্ঠা করলে তার বক্ষ হবে আমার তীরের লক্ষ্যস্থল।” কিনানা ছিল একজন দক্ষ তীরন্দায, তার নিক্ষিপ্ত কোন তীর সচরাচর লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো না, কিনানার এ কথা শুনে আবু সুফইয়ান ইবন হারব তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “ভাতিজা, তুমি যে তীরটি আমাদের দিকে তাক করে রেখেছো তা একটু ফিরাও, আমরা তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।” আবু সুফইয়ান বললো, “তোমার কাজটি ঠিক হয়নি, তুমি প্রকাশ্যে মানুষের সামনে দিয়ে যয়নাবকে নিয়ে বের হয়েছো, আর আমরা বসে বসে তা দেখছি। সমগ্র আরবের অধিবাসী জানে, বদরে আমাদের কী দূর্দশা ঘটেছে এবং এই যয়নাবের বাপ আমাদের কী সর্বনাশটাই না করেছে। তুমি যদি এভাবে প্রকাশ্যে তার মেয়েকে আমাদের নাকের ওপর দিয়ে নিয়ে যাও তাহলে সবাই আমাদেরকে কাপুরুষ ভাববে এবং এ কাজটি সবাই আমাদের জন্য অপমান বলে বিবেচনা করবে। তুমি যয়নাবকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কিছুদিন সে তার স্বামীর ঘরে থাকুক। এদিকে যখন লোকেরা বলাবলি করতে শুরু করবে যে, আমরা যয়নাবকে মক্কা ছেড়ে যেতে বাধা দিয়েছি, তখন তুমি তাকে গোপনে তার বাপের কাছে পৌঁছে দিও।”
এ কথায় কিনানা/ আমর রাজী হয়ে গেল, যয়নাব মক্কায় ফিরে এল। কিছুদিন পর রাতের অন্ধকারে সে আবার যয়নাবকে নিয়ে মক্কা থেকে বের হলো এবং ভায়ের নির্দেশমত তাঁকে তার পিতার প্রতিনিধিদের হাতে নির্দিষ্ট স্থানে সমর্পণ করলো।
তাবরানী উরওয়াহ ইবন যুবাইর হতে বর্ণনা করেছেন। এক ব্যক্তি যয়নাব বিনতু রাসুলুল্লাহকে সাথে নিয়ে বের হলো, কুরাইশদের দু ব্যক্তি পিছু ধাওয়া করে তাদের ধরে ফেলে। তারা যয়নাবের সংগী লোকটিকে কাবু করে তাঁকে উটের পিঠ থেকে ফেলে দেয়। যয়নাব একটি পাথরের ওপর ছিটকে পড়েন। তার শরীর কেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। এ অবস্থায় তারা যয়নাবকে আবু সুফইয়ানের নিকট নিয়ে যায়। আবু সুফইয়ান তাকে বনী হাশিমের মেয়েদের কাছে সোপর্দ করে। পরে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন, উটের পিঠ থেকে ফেলে দেওয়ায় যয়নাব যে ব্যাথা পান, আমরণ তিনি সে ব্যথা অনুভব করতেন এবং সেই ব্যথায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন। এ জন্য লোকে তাঁকে শহীদ মনে করতো। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৭১)।
হযরত আয়িশা রা: হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহর সা: কন্যা যয়নাব কিনানার সাথে মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশ্যে বের হলো। মক্কাবাসীরা তাদের পিছু ধাওয়া করলো। হাব্বার ইবনুল আসওয়াদ সর্বপ্রথম যয়নাবকে ধরে ফেললো। সে যয়নাবের উটটি তীরবিদ্ধ করলে যয়নাব পড়ে গিয়ে আঘাত পেল। সে ছিল সন্তান সম্ভবা। এই আঘাতে তার গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়। অত:পর বনু হাশিম ও বনু উমাইয়া যয়নাবকে নিয়ে বিবাদ শুরু করে দিল। অবশেষে সে হিন্দা বিনতু উতবার নিকট অবস্থান করতে লাগলো। হিন্দা প্রায়ই তাকে বলতো, ‘তোমার এ বিপদ তোমার পিতার জন্যই হয়েছে।’
একদিন রাসুলুল্লাহ সা: যায়িদ ইবন হারিসাকে বললেন, ‘তুমি কি যয়নাবকে আনতে পারবে? যায়িদ রাজী হলো। হযরত রাসূলে কারীম সা: যায়িদকে একটি আংটি দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে যাও। এটা যয়নাবের কাছে পৌঁছাবে।” আংটি নিয়ে যায়িদ মক্কার দিকে চললো। মক্কার উপকন্ঠে সে এক রাখালকে ছাগল চড়াতে দেখলো। সে রাখালকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কার রাখাল?’ রাখাল বললো, ‘আবুল আসের।’আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ছাগলগুলি কার?’ বললো, ‘যয়নাব বিনতু মুহাম্মাদের।’ যায়িদ কিছুদূর রাখালের সাথে চললো। তারপর তাকে বললো, আমি যদি একটি জিনিস তোমাকে দেই, তা কি তুমি যয়নাবের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে? সে রাজী হলো। যায়িদ তাকে আংটিটি দিল, আর রাখাল সেটি যয়নাবের হাতে পৌঁছে দিল।
যয়নাব রাখালকে জিজ্ঞাস করলো, ‘এটি তোমাকে কে দিয়েছে?’ বললো, ‘একটি লোক।’ আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তাকে কোথায় ছেড়ে এসেছো?’ বললো, ‘অমুক স্থানে।’ যয়নাব চুপ থাকলো। রাতের আঁধারে যয়নাব চুপে চুপে সেখানে গেল। যায়িদ তাকে বললো, ‘তুমি আমার উটের পিঠে উঠে আমার সামনে বস।’ যয়নাব অস্বীকৃতি জানিয়ে বললো, না আপনিই আমার সামনে বসুন।’ এভাবে যয়নাব যায়িদের পেছনে বসে মদীনায় পৌঁছলো। হযরত রাসূলে কারীম সা: প্রায়ই বলতেন, ‘আমার সর্বোত্তম মেয়েটি আমার জন্যই কষ্ট ভোগ করেছে।’ (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৭১-৭২)।
স্ত্রী যয়নাব থেকে বিচ্ছেদের পর আবুল আস কয়েক বছর মক্কায় কাটালেন। রাসুলুল্লাহ সা: মক্কা বিজয়ের অল্প কিছুদিন আগে একটা বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে তিনি সিরিয়া গেলেন। বাণিজ্য শেষে তিনি মক্কায় ফিরছেন। একশো উট ও প্রায় এক শো সত্তর জন লোকের কাফিলা। যখন তারা মদীনার কাছাকাছি স্থানে তখন মদীনা থেকে যায়িদ বিন হারিসার নেতৃত্বে প্রেরিত একটি ক্ষুদ্র টহলদানকারী বাহিনী তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং উটসহ সকল লোক বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যায়। তবে আবুল আস পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
অবশ্য মূসা ইবন উকবার মতে, আবু বাসীর ও তার বাহিনী আবুল আসের কাফিলার ওপর আক্রমণ চালায়। উল্লেখ্য যে, এই আবু বাসীর ও আরো কিছু লোক হুদাইবিয়ার সন্ধির পর ইসলাম গ্রহণ করে। তবে সন্দির শর্তানুযায়ী মদীনাবাসীরা তাদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। ফলে তারা মক্কা থেকে পালিয়ে গিয়ে লোহিত সাগরের উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করতে থাকে। তারা মক্কার বাণিজ্য কাফিলায় অতর্কিত হামলা চালাতে থাকে। তাদের ভয়ে কুরাইশদের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। মক্কার কুরাইশরা বাধ্য হয় তাদেরকে মদীনায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সা: কে অনুরোধ করে। (আল ইসাবা-৪/১২২)।
যাই হোক, আবুল আস পালিয়ে মক্কায় না গিয়ে ভীত সন্ত্রস্তভাবে রাতের অন্ধকারে গোপনে মদীনায় প্রবেশ করেন এবং সোজা যয়নাবের কাছে পৌঁছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করেন। যয়নাব তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেন।
রাত কেটে গেল। হযরত রাসূলে কারীম সা: ফজরের নামাযের জন্য মসজিদে গেলে। তিনি মিহরাবে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীরে তাহরীমা বেঁধেছেন। পেছনের মুক্তাদীরাও তাকবীরে তাহরীমা শেষ করেছে। এমন সময় পেছনে মেয়েদের কাতার থেকে যয়নাবের কন্ঠস্বর ভেসে এল, ‘জনমণ্ডলী, আমি মুহাম্মাদের কন্যা যয়নাব। আমি আবুল আসকে নিরাপত্তা দিয়েছি, আপনারাও তাকে নিরাপত্তা দিন।’
সালাম ফিরিয়ে রাসুলুল্লাহ সা: লোকদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যা শুনেছি, তোমরাও কি তা শুনেছো?’
লোকেরা জবাব দিল, ‘হাঁ, ইয়া রাসুলুল্লাহ!’ রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘যার হাতে আমার জীবন, সেই সত্তার শপথ, আমি এ ঘটনার কিছুই জানিনে। সে সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে তাকে নিরাপত্তা দান করেছে।’ অত:পর তিনি বাড়ীতে যেয়ে মেয়েকে বললেন, ‘আবুল আসের সম্মানজনক ব্যবস্থা করবে। তবে জেনে রেখ তুমি আর তার জন্য হালাল নও।’ তারপর রাসুলুল্লাহ সা: সেই বাহিনীর লোকদের ডাকলেন, যারা আবুল আসের কাফিলার উট ও লোকদের বন্দী করে নিয়ে এসেছিল। তিনি তাদের বললেন, ‘আমাদের মধ্যে এই লোকটির (আবুল আস) মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জ্ঞাত আছ। তোমরা তার বাণিজ্য সম্ভার কেড়ে নিয়ে এসেছো। তোমরা তার প্রতি সদয় তার মালামাল ফেরত আমি খুশি হব। আমরা তোমরা রাজী না হলে আমার কোন আপত্তি নেই। আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে তোমরা সেই মাল ভোগ করতে পার। তোমরাই সেই মালের অধিক হকদার।’ তারা সকলে বললো, ‘শোন আবুল আস, কুরাইশদের মধ্যে তুমি একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি রাসুলুল্লাহর চাচাত ভাই এবং তার জামাই। তুমি এক কাজ কর। ইসলাম গ্রহণ করে মক্কাবাসীদের এই মালামালসহ মদীনায় থেকে যাও। বেশ আরামে থাকবে।’ আবুল আস বললেন, তোমরা যা বলছো তা খুবই খারাপ কথা। আমি কি আমার নতুন দ্বীনের জীবন শুরু করবো শঠতার মাধ্যমে?
আবুল আস তার কাফিলা ছাড়িয়ে নিয়ে মক্কায় পৌঁছলেন। মক্কায় যার যার মাল তাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘ওহে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! আমার কাছে তোমাদের আর কোন কিছু পাওনা আছে কি? তারা বললো, ‘না, আল্লাহ তোমাকে উত্তম পুরষ্কার দান করুন। আমরা তোমাকে চমৎকার প্রতিশ্রুতি পালনকারী রূপে পেয়েছি।
আবুল আস আরো বললেন, ‘আমি তোমাদের হক পরিপূর্ণরূপে আদায় করেছি। এখন আমি ঘোষণা করছি- আশহাদু আন লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান রাসুলুল্লাহ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।’
মদীনায় অবস্থানকালে আমি এ ঘোষণা দিতে পারতাম। কিন্তু তা দেইনি এ জন্য যে, তোমরা ধারণা করতে আমি তোমাদের মাল ফেরত আত্মসাত করার উদ্দেশ্যেই এমনটি করেছি। আল্লাহ যখন তোমাদের যার যার মাল ফেরত দেওয়ার তাওফীক আমাকে দিয়েছেন এবং আমি আমার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছি, তখনই আমি ইসলামের ঘোষণা দিচ্ছি।
অত:পর হযরত আবুল আস মক্কা থেকে বের হয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহর খিদমতে হাজির হন। হযরত রাসূলে কারীম সা: সম্মানের সাথে তাকে গ্রহণ করেন এবং তার স্ত্রী যয়নাবকেও তার হাতে সোপর্দ করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: তার সম্পর্কে প্রায়ই বলতেন, ‘সে আমাকে যা বলেছে, সত্য বলেছে। আমার ওয়াদা করেছে এবং তা পালনও করেছে।’
হযরত আবুল আস রা: ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহর সা: সাথে কোন যুদ্ধে যোগদানের সুযোগ পাননি। হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে হিজরী ১২ সনের জিলহজ্জ মাসে তিনি ইনতিকাল করেন। তবে ইবন মুন্দাহর মতে, তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। (আল ইসাবা-৪/১২৩, আল ইসতিয়াব)।
হযরত যয়নাব ও আবুল আসের মেয়ে উমামাকে রাসুলুল্লাহ সা: খুবই স্নেহ করতেন। নামাযের মধ্যে তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিতেন বলে বর্ণিত আছে।