আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনিল আস (রা)
নাম আবদুল্লাহ, কুনিয়াত আবু মুহাম্মাদ, আবু আবদির রহমান ও আবু নুসাইর। তবে প্রথমোক্ত কুনিয়াত দু’টি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পিতা প্রখ্যাত সেনানায়ক ও কূটনীতিবিদ হযরত ‘আমার ইবনুল’ আস (রা) ও মাতা রীতা বিনতু মুনাববিহ। বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহর ইসলাম-পূর্ব নাম ‘আল-আস’ (পাপী, অবাধ্য)। আবু যারয়া তাঁর তারীখে উল্লেখ করেছেন, একটি জানাযার অনুষ্ঠানে রাসূল (সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার নাম কি?’ তিনি যখন বললেন, ‘আল-আস’, আসূল (সা) তখন বললেন, না, আজ থেকে তোমার নাম হবে ‘আবদুল্লাহ’। সেই দিন থেকে ‘আল-আস’ হলেন আবদুল্লাহ।
ইবন সা’দ বলেন, আবদুল্লাহ তাঁর পিতা আমর ইবনুল আসের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পুত্র আবদুল্লাহ অপেক্ষা পিতা আমরের বয়স মাত্র দশ থেকে বারো বছর বেশী ছিল। তবে ওয়াকিদীর মতে পুত্র অপেক্ষা পিতা বিশ বছরের বড় ছিলেন। (তাজকিরাতুল হুফফাল, আল-ইসাবা, আল-ইসতিয়াব) পিতা-পুত্র উভয় মক্কা বিজয়ের পূর্বেই মদীনায় হিজরাত করেন। ইসলাম গ্রহণের পর অধিকাংশ সময় আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর (সা) সহবত বা সহচর্যে ব্যয় করতেন। ক্রোধ বা শান্ত উভয় অবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে যা কিছু বের হতো, তিনি সব কিছু লিখে রাখতেন। কোন কোন সাহাবী এমনটি না করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, উত্তেজিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে যা কিছু বের হয় তা না লেখা উচিত। বিষয়টি তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উত্থাপন করলেন। রাসূল (সা) বললেন, ‘তুমি আমার সব কথা লিখতে পার। সত্য ছাড়া অন্য কিছুই আমি বলতে পারিনে’। (মুসনাদে আহমদ, আল-ইসতিয়াব) তাঁর পিতা আমর অপেক্ষা রাসূল (সা) তাঁকেই বেশি ভালবাসতেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট তাঁর গুরুত্ব ছিল বেশী।
রাসূলল্লাহর (সা) সুহবত বা সাহচর্যে কাটানোর পর যে অতিরিক্ত সময়টুকু আব্দুল্লাহ পেতেন, তার সবটুকু প্রায় দিনে রোযা রেখে এবং রাতে ইবাদাতে কেটে যেত। ধীরে ধীরে এ কাজে তিনি এত গভীরভাবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন যে, স্ত্রী-পরিজন ও দুনিয়ার সবকিছুর প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তার পিতা রাসূলল্লাহর খিদমতে হাজির হয়ে তাঁর এই অস্বাভাবিক বৈ্রাগী জীবনে বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। রাসূল (সা) আব্দুল্লাহকে ডেকে পিতার আনুগত্যের নির্দেশ দেন।তিনি বলেন, ‘আব্দুল্লাহ, রোযা রাখ, ইফতার কর, নামায পড়, বিশ্রাম নেও এবং স্ত্রী-পরিজনে্র হকও আদায় কর। এই আমার তরীকা বা পন্থা। যে আমার তরীকা প্রত্যাখান করবে সে আমার উম্মাতের মধ্যে গণ্য হবেনা।’
রাসূলল্লাহর (সা) যুগে সংঘঠিত সব যুদ্ধে হযরত আব্দুল্লাহ অংশগ্রহন করেন। যুদ্ধের সময় সাধারণত সোয়ারী পশুর ব্যবস্থা করেন ও জিনিসপত্র পরিবহনের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হতো। একবার এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবু মুহাম্মদ, আমরা যেখানে বসবাস করি সেখানে দিরহাম ও দীনারের প্রচলন নেই। গৃহপালিত পশু ও জীব-জন্তু আমাদের প্রধান সম্পদ। আমরা ছাগলের বিনিময়ে উট ক্রয়-বিক্রয় করে থকি। এতে কোন আপত্তি নেই তো? তিনি বললেন, একবার রাসূলল্লাহ (সা) নির্দেশ দিলেন একটি উষ্ট্রারোহী বাহিনী গড়ার। আমার কাছে যতগুলো উট ছিল, এক এক করে সবগুলি বিলি করলাম। তবুও সোয়ারী বিহীন কিছু লোক রয়ে গেল। আমি রাসূলল্লাহর খিদমতে হাজির হয়ে আরজ করলাম, ‘ইয়া রাসূলল্লাহ (সা), আমার কাছে যতগুলি উট ছিল, সবগুলি বন্টন করার পরও একদল লোক রয়ে গেছে।’ রাসূল (সা) নির্দেশ দিলেন, ‘একটি উটের বিনিময়ে সদকার দু’টি, তিনটি করে উট দানের অঙ্গীকার করে কিছু উট খরীদ করে নাও।’ আমি সেই মত প্রয়োজনীয় উট সংগ্রহ করে নিলাম। (দারু কুতনী)
ইয়ামুকের যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি লড়াই করেন। এই যুদ্ধে হযরত ‘আমর ইবনুল আস তাঁর নেতৃত্বের ঝাণ্ডা আবদুল্লাহর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
সিফফীনে হযরত আমর ইবনুল আস ছিলেন হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষে। পুত্র আবদুল্লাহকে তিনি মুয়াবিয়ার বাহিনীতে যোগদান করতে বাধ্য করেন। প্রকৃতপক্ষে এই গৃহযুদ্ধের প্রতি তিনি ছিলেন ভীষণ বিতৃষ্ণ। এ কারণে মুয়াবিয়ার (রা) পক্ষে যোগ দিলেও বাস্তবে তিনি যুদ্ধে কোন প্রকার অংশগ্রহণ করেননি। বারবার তিনি পিতাকে এই আত্মঘাতী যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রা) সিফফীনে হযরত আলীর (রা) পক্ষে যোগদান করে শহীদ হন। আম্মারের শাহাদাত রাসূলুল্লাহর (সা) একটি বাণীর কথা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি পিতা আমর ইবনুল আসকে (রা) জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহকে (সা) একথা বলতে শুনেননি, আফসুস, ইবন সুমাইয়্যা (আম্মার)-কে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হত্যা করবে।’ একথা শুনে আমর ইবনুল আস হযরত মুয়াবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, আবদুল্লাহ যা বলছে, তা-কি আপনি শুনছেন না?’ আবদুল্লাহর কথার ব্যাখ্যা করে মুয়াবিয়া (রা) বলেন, ‘সে সবসময় নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে আসে। আম্মারকে কি আমরা হত্যা করেছি? প্রকৃতপক্ষে তাঁর হত্যার দায়-দায়িত্ব তাদের যারা তাকে ঘর থেকে বের করে এখানে সংগে নিয়ে এসেছে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
হযরত আম্মারকে (রা) দুই ব্যক্তি একই সাথে আক্রমণ করে হত্যা করে। তারা এককভাবে এ কৃতিত্ব দাবী করে ঝগড়া করতে করতে হযরত মুয়াবিয়ার নিকট হাজির হয়। ঘটনাক্রমে সেখানে হযরত আবদুল্লাহ (রা) উপস্থিত ছিলেন। তাদের ঝগড়া শুনে তিনি বলেন, ‘তোমাদের দ’জনের কোন একজনের উচিত সন্তুষ্ট চিত্তে তার প্রতিপক্ষের দাবী মেনে নেওয়া। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি, আম্মারকে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হত্যা করবে।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি হযরত মুয়াবিয়াকে বলেন, আম্মারের হত্যাকারীকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিন।’ একথা শুনে হযরত মুয়াবিয়া (রা) বিরক্তি সহকারে তাঁর পিতাকে বলেন, ‘আমর, তোমার এই পাগল ছেলেটিকে কি আমার সামনে থেকে দূরে সরিয়ে নেবে না?’ তারপর তিনি নিজেই আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন, ‘যদি এমনই হয়, তাহলে তুমি আমার সাথে কেন?’ হযরত আবদুল্লাহ জবাব দিলেন, ‘এজন্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যতদিন বাঁচবে তোমার পিতার অনুগত থাকবে।’
সিফফীনের এই আত্মঘাতী যুদ্ধে যদিও তাঁর হাত কলুষিত হয়নি, তবুও এতে শরীক হওয়ার জন্য আজীবন তিনি অনুশোচনার জর্জরিত হয়েছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘হায়, আমি যদি এর দশ বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করতাম!’ হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষ অবলম্বন করায় এবং তাঁর হাতে ঝাণ্ডা থাকায় সারা জীবন তিনি তাওবাহ ও ইসতিগফার করেছেন। (আল-ইসতিয়াব)
হযরত রাজা’ (রা) বলেনঃ একবার আমি একদল লোকের সাথে মসজিদে নববীতে বসেছিলাম। আব্দুল্লাহ ইবন আমর ও আবু সাঈদ খুদরীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হযরত ইমাম হুসাইনকে (রা) আসতে দেখে আবদুল্লাহ বলে উঠলেন, ‘এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমি কি আপনাদের একটি কথা জানাবো?’ লোকেরা বললো, ‘কেন জানাবে না?’ তিনি বললেন, ‘সিফফীনের যুদ্ধের পর থেকে তাঁর সাথে আমার কোন কথা হয়নি। অথচ তাঁর সন্তুষ্টি আমার নিকট দুনিয়ার সবকিছু থেকে অধিক প্রিয়।’ আবু সাঈদ খুদরী বললেন, ‘আপনি কি তাঁর কাছে গিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চান?’ তিনি বললেন, হাঁ !’ পরদিন আবু সাঈদ খুদরী (রা) তাঁকে সংগে করে হযরত হুসাইনের (রা) বাড়ী গেলেন। হযরত হুসাইন (রা) সাক্ষাৎ দান করতে প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করেন। পরে আবদুল্লাহর (রা) পীড়াপীড়িতে সম্মত হন। সিফফীনে তাঁর অংশগ্রহণের পটভূমি ব্যাখা করে তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ অনুযায়ী আমি আমার তরবারি উম্মুক্ত করিনি, নিযা দ্বারা যেমন কাউকে আহত করিনি তেমনি কোন তীরও চালাইনি।’ (উসুদুল গাবা)
জ্ঞান ও মান-মর্যাদার দিক দিয়ে সমগ্র সাহাবা সমাজের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ (রা) বিশেষ স্থান ছিল। মাতৃভাষা আরবী ছাড়াও হিব্রু ভাষায় তাঁর পান্ডিত্য ছিল। তাওরাত ও ইনজিল তিনি গভীরভাবে অধ্যায়ন করেছিলেন। তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমার একহাতে মধু, অন্য হাতে চর্বি এবং আমি তা চেটে চেটে খাচ্ছি। ‘স্বপ্নের এ কথা আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বললাম। তিনি বললেন, ‘তুমি দু’খানা গ্রন্থ তাওরাত ও আল-কুরআন পাঠ করবে’। (আল-ইসাবা)
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ নিঃসৃত বাণীর বিরাট একটি অংশ সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি তাঁর সংগ্রহটির নাম রেখেছিলেন ‘সাদেকা’। তাঁর কাছে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে এবং সে সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিতে কিছু না থাকলে উক্ত ‘সাদেকা’ দেখে উত্তর দিতেন। (মুসনাদে আহমদ) এই সংগ্রহটি ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। মুজাহিদ বলেনঃ একবার আমি তাঁর বিছানার নীচ থেকে একখানা বই বের করে দেখতে লাগলাম। তিনি নিষেধ করলেন। বললাম, ‘আপনি তো আমাকে কোন ব্যাপারে নিষেধ করেন না। আজ এমন করছেন কান?’ বললেন, ‘এ সত্যের সেই গ্রন্থ যা আমি একাই রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে শুনে সংগ্রহ করেছি’। তিনি আরও বলেন, ‘এই গ্রন্থখানি এবং পবিত্র কুরআন ও ওয়াহাজের ঐ জায়গীরটি যদি আমাকে দেওয়া হয় তাহলে দুনিইয়ায় আমার আর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সাত শত। তারমধ্যে সতেরটি মুত্তাফাক আলাইহি, আটটি বুখারী এবং কুড়িটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। (তাহজীব)
হযরত আবদুল্লাহর (রা) হালকায়ে দারসে-হাদীসের সীমা ছিল সুপ্রশস্ত। দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ হাদীস শোনার জন্য তাঁর দারসে হাজির হতো। তাছাড়া তিনি যেখানেই যেতেন, জ্ঞান পিপাসুদের বিশাল সমাবেশ ঘটতো তাঁর পাশে। একজন নাখয়ী শায়খ বর্ণনা করেন, ‘একবার আমি ইলিয়ার মসজিদে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করেছিলাম। এক ব্যক্তি আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। নামায শেষে চারদিক থেকে মানুষ তাঁর নিকট গুটিয়ে বসলো। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম, ইনি আবদুল্লাহ ইবন আমার ইবনুল আস।
হযরত আবদুল্লাহ তাঁর ছাত্রদের গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাঁর সমকালীন জ্ঞানীদের প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল। একবার তাঁর সামনে হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের (রা) প্রসঙ্গ উঠলো। তিনি বললেন, ‘তোমরা এমন এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ উঠিয়েছো যাঁকে আমি সেই দিন থেকে ভালোবাসি যেদিন রাসূল (সা) বলেছিলেন, তোমরা চার ব্যক্তির নিকট থেকে কুরআনের জ্ঞান অর্জন কর এবং সর্বপ্রথম তিনি আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের নামটি উচ্চারণ করেছিলেন।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বহু সংখ্যক সাহাবীর নিকট থেকে, যেমনঃ উমার, আবু দারদা, মুয়াজ, আবদুর রহমান বিন আউফ, তাঁর পিতা আমর প্রমুখ- হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবু নুয়াঈম বলেন, ‘সাহাবীদের মধ্যে ইবন উমার, আবু উমামা, মিসওয়ার, সায়িব ইবন ইয়াযিদ ও আবুত তুফাইল এবং বহু সংখ্যক বিশিষ্ট তাবেঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল-ইসাবা)
তাকওয়া, পরহিযগারী ও অতিরিক্ত ইবাদাতকারী হিসাবে আবদুল্লাহ ইবন আমরের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। ইতিহাসে তাঁকে প্রার্থনাকারী, তাওবাকারী, ইবাদাত গুজার, ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁর পিতা আমর ছিলেন যেমন বুদ্ধিমত্তা, চাতুর্য ও কৌশলীদের গুরু, তেমনি তিনি ছিলেন আবেদ, যাহেদ ও স্পষ্টবাদীদের মধ্যমণি। তাঁর জীবনের সবটুকু ইবাদাতে ব্যয় হয়েছে। যখন যতটুকু কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মুখস্থ করে ফেলেছেন। কুরআনের অবতরণ শেষ হলে তিনিও হলেন সমগ্র কুরআনের হাফেজ। জিহাদের ময়দানে সব সময় তাঁকে প্রথম সারিতে দেখা যেত। আবার সশস্ত্র জিহাদ শেষ হলে তাঁকে দেখা যেত মসজিদে-দিনে রোযাদার এবং রাতে ইবাদাত গুজার। কুরআন ও তাসবীহ তিলাওয়াত অথবা তাওবাহ ইসতিগফারে তিনি নিমগ্ন থাকতেন। মোটকথা, যখন জিহাদের ডাক না থাকতো, চব্বিশ ঘন্টা তিনি সাওম, সালাত ও তিলাওয়াতে ডুবে থাকতেন।
প্রকৃতিগতভাবেই রুহবানিয়্যাত বা বৈরাগ্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক প্রবণতা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) একবার তাঁকে ডেকে বললেন, ‘আবদুল্লাহ, আমি জানতে পেরেছি, তুমি সারাটি জীবন দিয়ে রোযা রেখে ও রাতে ইবাদাত করে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য সংকল্প করেছো’। তিনি বললেন, ‘হাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ রাসূল (সা) বললেন, ‘সে শক্তি তোমার নেই। রোযা রাখ, আবার ইফতারও কর এবং নামায পড়, আবার বিশ্রামও কর। মাসে শুধু তিন দিন রোযা রাখ। কারণ, প্রতিটি নেকীর দশগুণ বদলা দেওয়া হয়।’ তিনি আরজ করলেন, ‘আমি এর থেকেও বেশী শক্তি রাখি’। রাসূল (সা) বলেলেন, ‘একদিন রোয রাখবে এবং দইদিন ইফতার করবে’। তিনি আবার আরজ করলেন, ‘আমি এর থেকেও বেশী শক্তি রাখি। ‘রাসূল (সা) বললেন’, একদিন রোযা রাখবে এবং একদিন ইফতার করবে। এটাই হযরত দাউদের (আ) তরীকা এবং এটাই রোযার সর্বোত্তম তরীকা বা পদ্ধতি’। তিনি আবারও আরজ করলেন। ‘আমি এর থেকেও উত্তম রোযা রাখতে পারি’। রাসূল (সা) বললেন, ‘এর থেকে উত্তম রোযা আর নাই’। অন্য একবার রাসূল (সা) তাঁর বাড়ীতে যেয়ে বলেন, ‘তোমার দেহের, তোমার চোখের, তোমার পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের তোমার ওপর হক বা অধিকার আছে’।
সারাটি জীবন তিনি রোযার ক্ষেত্রে দাউদের (আ) অনুসরণ করেন এবং রাতের বেশীর ভাগ সময় ইবাদাতে অতিবাহিত করেন। কুরআন তিলাওয়াতের এত বেশী আগ্রহ ছিল যে, প্রতি তিন দিনে একবার খতম করতেন। তবে শেষ জীবনে এত অধিক ইবাদাত তাঁর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে আফসুস করে বলতেন, ‘হায়, যদি আমি রাসূলুল্লাহ (সা) প্রদত্ত ‘রুখসত’ বা কম করার অনুমতি গ্রহণ করতাম। (আল-ইসাবা)
দুনিয়ার প্রতি আবদুল্লাহর এই উদাসীনতা দেখে তাঁর পিতা ’আমর ইবনুল ’আস প্রায়ই রাসূলুল্লাহর কাছে অভিযোগ করতেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আবদুল্লাহর দাতটি ধরে তাঁর পিতার হাতের মধ্যে দিয়ে বলেন, ‘তোমাকে আমি যা বলি তাই কর, এবং তোমার পিতার ইতায়াত বা আনুগত্য কর’। [রিজালুন হাওলার রাসূল (সা)] আবদুল্লাহ আজীবন তাঁর পিতার আনুগত্য করেছেন। পিতার নির্দেশেই তাই তিনি মুয়াবিয়ার পক্ষে সিফফীনে গিয়েছেন।
হযরত ’আমর ইবনুল ’আস (রা) পৈত্রিক মীরাস থেকে বিশাল সম্পত্তি ও বহু দাস-দাসী লাভ করেন। তায়েফ ‘ওয়াহাজ’ নামক যে জায়গীরটি তিনি লাভ করেন তার মুল্য ছিল প্রায় দশ লাখ দিরহাম। (উসুদুল গাবা) তাঁর পক্ষ থেকে সেখানে চাষাবাদ করা হতো। এই জায়গীর নিয়ে একবার আম্বাসা ইবন সুফইয়ানের সাথে বিবাদ দেখা দেয়। উভয় পক্ষে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যাওয়ার উপক্রম হয়। আবদুলাহর ভাই হযরত খালিদ ইবনুল ’আস আসলেন তাঁকে বুঝানোর জন্য। তিনি খালিদকে বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের হিফাজত বা রক্ষণবেক্ষোণ করতে যেয়ে নিহত হবে সে শহীদ-তোমার কি রাসূলুল্লাহর (সা) এ বাণী স্মরণ নেই?’ (মুসনাদে আহমদ)
হযরত আবদুল্লাহর (রা) মৃত্যুর সন ও স্থান সম্পর্কে সীরাত লেখকদের মতভেদ রয়েছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স কত হয়েছিল সে সম্পর্কেও ঐতিহাসিকরা একমত হতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে যেমন শাম, মক্কা, তায়েফ ও মিসরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি সন হিসাবে ৬৫, ৬৮ ও ৬৯ হিজরীর কথা বলা হয়েছে। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে তিনি হিজরী ৬৫ সনে ‘ফুসতাত’ (মিসর) নগরে ৭২ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তখন মারওয়ান ইবনুল হাকাম ও আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছিল, এ কারণে তাঁর লাশ সাধারণ গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁকে তাঁর আবাস স্থলেই দাফন করা হয়। (আল-ইসাবা, তাজকিরাতুল হুফফাজ)