নষ্ট ঘড়ি
জনৈক বাবার বক্তব্য: “নিঃসন্দেহে সময়ই প্রতিটি মানুষের মূল পুঁজি। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদেরকে সময়ানুবর্তিতার গুরুত্ব শেখানোর জন্য একটি ঘড়ি কিনলাম। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল ঘড়িটা নষ্ট – ঠিকমত সময় দিচ্ছে না। কিছুদিন পর আরও একটা ঘড়ি কিনলাম – সেটাও নষ্ট। আমার মনে হল এই নষ্ট ঘড়িগুলো আমাদের প্রকৃত অবস্থারই প্রতিফলন।”
ঠিকই। যদি আপনাকে অনুষ্ঠান শুরুর সময় ৪টা বলা হয়, তবে ভাল করে আপনার জানা আছে যে ৫টার আগে কেউ আসবে না।
বাচ্চাদেরকে ছোটবেলা থেকেই সালাত, লেখাপড়া, খেলাধুলা, খাওয়া, আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ, ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে উঠা সহ অন্যান্য কাজ ঘড়ি ধরে করতে শেখানো অত্যন্ত জরুরী। যদি মা-বাবা সন্তানদেরকে এটা অভ্যাস করাতে পারেন, তবে তারা তাদের এত বড় উপকার করলেন যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।
সময় এত গুরুত্বপূর্ণ যে স্বয়ং আল্লাহ সময়ের শপথ করে আল-কুরআনের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সূরা নাযিল করেছেন:
“সময়ের শপথ। নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করে করেছে, আর যারা পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও পরস্পরকে ধৈর্য্যের উপদেশ দেয়।”
সূরা আল-আসর
ইমাম আশ শাফিঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি সূরা আল-আসর সম্পর্কে বলেন: “যদি মানুষ এই একটি সূরা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করত তবে এটি তাদের জন্য যথেষ্ট হত!”
লক্ষণীয় যে এই সূরায় আল্লাহ তাআলা মানুষের লাভ-ক্ষতিকে সময়ের সাথে সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন। মানুষ যেন কতগুলো মুহূর্তের সমষ্টি। জীবনের একেকটি মুহূর্ত চলে যাওয়া পার্থিব অস্তিত্বের একেকটি অংশ হারিয়ে যাওয়ার মত!
যে জাতির ধর্মগ্রন্থে সময়ের শপথ দিয়ে অধ্যায়ের [সূরা] সূচনা হয়, সে জাতি কিভাবে সময়ানুবর্তিতার ব্যাপারে বিমুখ হতে পারে?
একজন স্কুল শিক্ষকের বক্তব্য:
“শ্রেণীকক্ষে অন্যতম বড় সমস্যা হল ছাত্রদের ক্লান্ত, অবসন্ন থাকা। কারণ অনুসন্ধান করে বুঝতে পারি যে এদের সবারই একই সমস্যা – বাসায় ঘুমানোর সময়, ঘুম থেকে ওঠার সময়, খাওয়া-দাওয়ার সময় – কোন কিছুই নির্ধারিত নয়। কারও কারও অভিভাবকের সাথে বারবার আলাপ করেও ফল হয় না – সময়ানুবর্তিতা এতই কঠিন! একটা সন্তান সময়ানুবর্তিতার অভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে – কিন্তু অভিভাবকদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই! সত্যিই মনে হয় গাড়ি চালানোর লাইসেন্সের চেয়ে অভিভাবকত্বের লাইসেন্স অনেক বেশি জরুরী এবং এরকম অভিভাবকদের লাইসেন্স সরকার কর্তৃক বাতিল হওয়া উচিৎ!”
বাস্তবিকই আমরা নির্বিকারভাবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে চলেছি।
বাচ্চাদেরকে সময়ের গুরুত্ব বোঝানোর পদ্ধতি শিক্ষক-অভিভাবক সহ সকল ‘মুরব্বী’কে শিখতে হবে। আগে নিজেরা সময়ানুবর্তী হতে হবে, এরপর বাচ্চাদের মধ্যে তা প্রোথিত করতে হবে।
লক্ষণীয় যে সময়-ব্যবস্থাপনা সাফল্যের অন্যতম হাতিয়ার। যেকোন বিষয় অর্জনের জন্য প্রথম ধাপ হচ্ছে উপযুক্ত সময় বরাদ্দ করা।
একজন কুরআন শিখতে চায় – তার প্রথম কাজ দিনের একটা সময় বের করা, যে সময়টুকু সে প্রতিদিন কুরআন পড়ার কাজে ব্যয় করবে।
একজন স্বাস্থ্য ঠিক করতে চায়, তার প্রথম কাজ দিনের এমন একটা সময় বের করা, যে সময়টুকুতে সে প্রতিদিন হাঁটবে বা শারীরিক পরিশ্রম করবে।
প্রতিদিন রাত নটায় বিছানায়। প্রতিদিন হোমওয়ার্ক করার সময় ছটা – আটটা। বিকালে খেলার সময় পাঁচটা থেকে ছটা। খাওয়ার টেবিলে আসার সময়…, গল্পের বই পড়ার সময়… সবই পূর্বনির্ধারিত। যদি পরিবারগুলো এ ধরনের সাধারণ সময়সূচী অনুসরণ করতে পারে, তবে দেশ হবে সোনার দেশ, মানুষগুলো হবে সোনার মানুষ।
এর অর্থ এই নয় যে বাচ্চাদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপাতে হবে। প্রয়োজনমাফিক পড়ার সময় কমিয়ে [বৈধ] বিনোদনের সময় বাড়ানো যেতে পারে – কিন্তু সবকিছুই হবে সময়মাফিক, এলোমেলো নয়।
আসুন, আমরা সকলে আজ থেকেই পরিবারে সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা বাস্তবায়ন করি, ইনশাআল্লাহ দ্রুত এর ফল আমরা সচক্ষে দেখতে পাব।
– মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ