পরিবার ও দাম্পত্য

ঝেড়ে কাশুন প্লিজ

“আপা, ছেলে/মেয়ের বিয়ে দেব। আমাকে একটা দ্বীনি মেয়ে/ছেলে খুঁজে দেন যে দ্বীন বোঝে, দ্বীনের চর্চা করে”।

শুরুটা হয় এভাবেই।

তারপর বায়োডাটা সংগ্রহ, আদানপ্রদান, নিরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, আলোচনা, পর্যালোচনা। মূল বিবেচ্য বিষয় ছেলে কি করে, কত টাকা বেতন পায়, মেয়ে দেখতে কেমন – হাইট, ওয়েট, গায়ের রং। কেউ কেউ শুরুতেই ছবি চেয়ে বসেন, চেহারা দেখেই রিজেক্ট হয়ে যায় অর্ধেক প্রপোজাল।

বাকী অর্ধেককে পেরোতে হয় হাইট, ওয়েট, গায়ের রঙ ছাঁকার চালুনি দিয়ে। তারপর হঠাত যোগ হতে থাকে এমন সব ক্রাইটিরিয়া যেগুলো “থাকলে ভাল হয়”। বাবামা উভয়ে বেঁচে আছেন কিনা (মা না থাকলে জামাই আদর কে করবে?), ঢাকায় বাড়ি আছে কিনা (যাদের নিজের বাড়ি নেই তারা কি পথে থাকে?), সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ কেমন (তাতে তোমার কি যদি তুমি যৌতুকের লালসা না কর?) ইত্যাদি ইত্যাদি। সব মিলে বিয়ের বাজারে যেন এখন ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিংয়ের চাইতেও কাটথ্রোট অবস্থা।

শেষতক সুন্দর, লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা, বাপের বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ সবই মিলে কিন্তু দ্বীনের ব্যপারটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মেয়ে চমৎকার, কিন্তু গায়ের ওড়নাটকু মাথায় টেনে দিতে রাজ্যের আপত্তি। ভাল চাকরী, টাকাপয়সাওয়ালা ছেলে পাওয়া যায়, কিন্তু মেয়ের সাথে মনমানসিকতা মিলবে কিনা, নামাজী কিনা, কুরআন পড়ে কিনা তার খোঁজ আর নেয়া হয়না।

দ্বীনি ভাইয়েরা/বোনেরা, আপনারা কি জানেন আমাদের জীবনের প্রতিটি মূহূর্ত আমাদের আখিরাতের জীবনের জন্য পরীক্ষা? আপনারা দেদারসে আরেকজনের পরীক্ষা নেন, ইচ্ছেমত পাস ফেল করান। পরীক্ষায় আপনারা পাস করছেন কিনা ভেবে দেখেছেন তো?

আপনি যদি ভাবেন আপনার মেয়ের রিজিক আপনার হবু জামাইয়ের হাতে তাহলে কিন্তু ঈমানটাই খুইয়ে বসবেন। আল্লাহ নিজের নাম জানিয়েছেন রাজ্জাক – যিনি রিজিক দেন – আবার চাইলে তুলেও নিতে পারেন। ছেলের চাকরি দেখে বিয়ে দিচ্ছেন? চাকরী কি যায়না? নাকি যার চাকরী নেই তার কোনদিন চাকরী হয়না?

ব্যবসায়ী? ব্যাবসা উঠতে কতক্ষণ, পড়তে কতক্ষণ? বাড়ি গাড়ি? যার নেই সে কি পথে পড়ে থাকে? নাকি যার আছে তার কখনো অ্যাকসিডেন্ট হবেনা এমন কোন গ্যারান্টি আল্লাহর কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছেন?

আল্লাহ নিজে তার সৃষ্টি নিয়ে অহংকার করেছেন, “আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম অবয়বে” (৯৫:৪)। তিনি বলেছেন, “মুমিনগণ কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে, কেননা সে উপহাসকারীর চাইতে উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী যেন অপর কোন নারীকে উপহাস না করে কেননা সে উপহাসকারিনীর চেয়ে শ্রেয় হতে পারে” (৪৯:১১)।

সেই সৃষ্টির বিবেচনা শুধুমাত্র বাহ্যিক আবরণটুকু দিয়ে কি করা যায়? না করা উচিত? আপনি শুধু একজন মানুষকেই অবমাননা করছেন না বরং যিনি তাঁকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন তাঁর অহংকারকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন, নাউজুবিল্লাহ।

বায়োডাটা তো ঠিক তাই – বায়োলজিক্যাল ডাটা। কিন্তু বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কি বায়োলজিক্যাল ক্রিচারের চাইতে উচ্চতর কিছু নয়? তার জীবনের কি উচ্চতর আর কোন লক্ষ্য নেই? একটা মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, স্বভাব, চরিত্র, মানবিক গুণাবলী, সামাজিক গুণাবলী কিছুই কি বিবেচনার দাবী রাখেনা? যে দ্বীনের কথা বলে ছেলে/মেয়ের বিয়ের কথা শুরু করা হয়, সেটাই বা কই যায়?

দ্বীনের চর্চার পরিমাণ কি চেহারায় লেখা থাকে? নইলে ছবি দেখেই কিভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়? একজন মানুষের মানবিক গুণাবলী কি বায়োডাটায় লেখা থাকে? তাহলে বায়োডাটাই কিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্রাইটিরিয়া হতে পারে? এটা বড়জোর হতে পারে একটা ইন্ট্রোডাকশন – পরিচিতিপর্ব। কিন্তু একটা ছেলে বা মেয়ের আর কোন তথ্য না জেনে, তার সাথে কথা না বলে কিভাবে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়?

ভাবছেন, এতজনের সাথে কথা বলব কিভাবে? ভেবে দেখেছেন, এতজন দেখছেন কিসের আশায়? বাজারে হরেকরকম জামা পাওয়া যায়, সব আপনি কিনতে পারলেও পরতে পারবেন না। সুতরাং, আপনি পুরো বাজার ঘুরলে কেবল হতাশই হবেন। বরং অল্প কিছু জামা দেখলে যেটা নেবেন সেটাতেই সন্তুষ্ট হবেন।

মানুষের কাছে অহংকার করতে পারবেন কিনা, লোকে কি বলবে, তার চেয়ে ছেলেটি বা মেয়েটি আপনার পরিবারের সাথে খাপ খাবে কিনা, আপনার সন্তান সুখী হবে কিনা সেটা চিন্তা করা কি বেশি জরুরী নয়? আপনার সবচেয়ে পার্ফেক্ট ছেলে বা মেয়েটিকেই লাগবে কেন সেটা ভেবে দেখুন। আপনি কি পার্ফেক্ট? আপনার সন্তান কি পার্ফেক্ট?

তাহলে পার্ফেক্ট একজন আপনাদের পছন্দ করবে কেন সেটা ভাবুন। যাদের বাবামা নেই, যাদের পারিবারিক সমস্যা আছে, যাদের টাকাপয়সা কম, যারা নায়ক নায়িকা নয় তাঁদের কি তাহলে বিয়ে হবেনা? ব্যাপারটা ভয়াবহ পর্যায় উপনীত হচ্ছে।

আমার এক কাজিন বলছিল, “আপু, আজকালকার বাবামায়েরা মনে করেন অনুষ্ঠানটাই বিয়ে। অনুষ্ঠানে একটা ছেলেকে মেহমানদের কাছে কিভাবে পরিচয় দেয়া যায়, একটা কনেকে স্টেজে বসালে দেখতে কেমন স্টানিং দেখাবে সেটুকুই তাঁরা বিবেচনা করেন।

বিয়ের পরদিন থেকে ছেলেমেয়ের অ্যাডজাস্টমেন্ট হবে কিনা, মেন্টালিটি মিলবে কিনা, পরস্পরের পরিবারকে তারা গ্রহণ করবে কিনা এসব চিন্তা তাঁরা মাথায় রাখেন না। ফলে যা হবার তাই হয়। কয়েক মাসের ভেতর অশান্তি। অনেকক্ষেত্রে ডিভোর্স। নইলে নিরুপায় হয়ে জীবনটাকে কোনক্রমে বয়ে নিয়ে চলা”। সে নিজে ভুক্তভোগী, সুতরাং তার কথায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

আল্লাহ বলেছেন, “আপনি কি তাকে দেখেছেন যে নিজের খেয়াল খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করে নিয়েছে?” (৪৫:২৩)। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই তা করে থাকে, তাঁদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু যারা দ্বীনের কথা বলেন, আল্লাহর কাছে রহমত আশা করেন, অতঃপর আল্লাহর বান্দাদের প্রতি বিন্দুমাত্র রহম করেন না তাঁদের ব্যপারে আমি বড়ই হতাশ।

এক ছোট ভাই বলেই ফেললেন, “আপা, আমরা যা করি তা হল মূলত নিজেদের খেয়াল খুশির অনুসরণ। তারপর যদি সুযোগ থাকে তখন আসে দ্বীনের ব্যপার। কিন্তু দ্বীনের জন্য নিজেদের খেয়াল খুশিকে দমন করার পর্যায়ে আমরা অনেকেই সারা জীবনেও পৌঁছতে পারিনা”।

কে কোন জিনিসকে উপাস্য স্থির করতে চান, কোন ক্রাইটিরিয়াতে অন্যকে বিবেচনা করতে চান সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু আল্লাহর ওয়াস্তে দ্বীনের কথা বলে ছেলে/মেয়ে খুঁজতে বলবেন না যখন পার্থিব চাহিদার ভিড়ে দ্বীন হারিয়ে যায়। বলুন আমার একটা পয়সাওয়ালা ছেলে চাই, বলুন আমার একটা সুন্দরী মেয়ে চাই। অন্তত যা চান সে ব্যপারে সততার পরিচয় দিন।

আর একটা অনুরোধ, দ্বীনের কথা বলার আগে একবার যাচাই করে দেখুন দ্বীন আপনার কাছে কি? আরেকজনের কাছে দ্বীন আশা করার আগে ভাবুন, আপনি দ্বীন বুঝেন তো? আপনি দ্বীনের জন্য, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য কুরবানি করছেন তো? নিজের কষ্টিপাথরেই যাচাই করুন আরেকজনের কাছে এই আশা রাখার আপনার অধিকার রয়েছে কিনা। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিন আপনার আসলে কি চাই।

– রেহনুমা বিনতে আনিস

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button