পরিবার ও দাম্পত্য

সফল পরিবার গঠনে কাম্য কিছু মূল্যবোধ (Values) যা কখনো অলক্ষে থেকে যায়

কখন একটি পরিবারকে নিজেকে সফল ভাবতে পারে? উত্তর দেয়ার আগে প্রশ্ন রাখতে হবে: এই পরিবারের ভ্যালুজ কী? অর্থাৎ কোন বিষয়গুলোকে সে মূল্যবান কিংবা অর্জনের যোগ্য মনে করে?

একটি পরিবারের সদস্যরা: নামাযী, লেখাপড়ায় খুবই ভাল, গান শোনে, মুভি দেখে, মানুষের সাথে তাদের ব্যবহার সুন্দর, সম্পদশালী কিন্তু সকলের উপার্জন হালাল নয়, সদস্যদের মধ্যে মিলমিশ খুব বেশি, দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা নেই।

অন্য একটি পরিবারের সদস্যরা: দ্বীনদার, লেখাপড়ায় মোটামুটি ভাল, গান-মুভি থেকে দূরে, মানুষের সাথে ব্যবহার কখনও কিছুটা কর্কশ, মধ্যবিত্ত কিন্তু হালাল উপার্জনের ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কিছুটা রেশারেশি আছে, দ্বীনের জ্ঞান অর্জনে অত্যন্ত সচেষ্ট।

উভয়ের মধ্যে কোন পরিবারটি অধিকতর সফল? জবাব নির্ভর করছে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর গুরুত্বের ক্রমের ওপর।

মুসলিম পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা এর মূল্যবোধ (ভ্যালুজ) অনেক। এর অনেকগুলোই সুস্পষ্ট এবং জ্ঞাত। এখানে এমন কয়েকটি উল্লেখ করা হল যা অনেক ক্ষেত্রে অলক্ষিত থেকে যায়:

কল্যাণ কামনা ও অন্তরের পরিচ্ছন্নতা

একজন মুসলিম সকলের কল্যাণকামী। তার অন্তর অন্য মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা, অন্যকে তুচ্ছজ্ঞান করার অনুভূতি থেকে মুক্ত:

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই – যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ  রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু। (সূরা আল হাশর, ৫৯ : ১০)

নফল ইবাদত মুসলিম পরিবারের বিলাসিতা

এতটুকু মুসলিম পরিবারের ধর্মীয় অবস্থার ন্যূনতম স্তর যে সকলেই ফরয বা বাধ্যতামূলক ইবাদত পালন করে থাকে এবং নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দূরে থাকে। কিন্তু মুসলিম পরিবারের বিলাসিতা নফল ইবাদত ও জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নেয়ার মাঝে। আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ বলেন:

مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ

যে আমার কোন বন্ধুর সাথে শত্রুতা করবে, আমি তাকে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি। আমার বান্দা আমার প্রিয় অন্য কোন কিছুর দ্বারাই আমার ততটা নিকটবর্তী হয়না, যতটা এমন বিষয়ের দ্বারা হয় যা আমি বান্দার উপর ফরয করেছিআমার বান্দা আমার আরও নিকটবর্তী হতে থাকে নফল কাজগুলোর দ্বারা, আর শেষপর্যন্ত আমি তাকে ভালবাসতে শুরু করি… [বুখারী (৬৫০২)]

আত্মমর্যাদার বোধ

মুসলিম হিসেবে, মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদার বোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা বিনয়ের বিরোধী নয়। একজন ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সাফল্যের জন্য অহংকারহীন আত্মমর্যাদা গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য। তাই মুসলিম পরিবারে তা লালিত হওয়া উচিৎ।

সত্যবাদিতা ও সত্যান্বেষণ

সত্য মুসলিম জীবনের ভিত্তি। ইসলাম সত্য। কুরআন আল্লাহর বাণী, যা খাঁটি সত্য। সত্যের অনুসরণ করতে গিয়েই একজন মুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং সত্যবাদিতা ও সত্যান্বেষণের বৈশিষ্ট্য মুসলিম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেদীপ্যমান একটি দিক।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

হে মুমিনগণতোমরা আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও(সূরা আত তাওবা, ৯ : ১১৯)

إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يَكُونَ صِدِّيقًا وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ كَذَّابًا

সত্য সৎকার্যের দিকে পরিচালিত করে আর সৎকার্য জান্নাতে পৌঁছে দেয়কোন ব্যক্তি অবিরাম সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে অবশেষে সিদ্দীক এর দরজা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মহামিথ্যাচারী প্রতিপন্ন হয়ে যায়। [বুখারী (৬০৯৪), মুসলিম (২৬০৭)]

হালাল উপার্জন

একজন মুসলিমের জন্য সতর্কবাণী হিসেবে এটুকুই যথেষ্ট হওয়ার কথা যে কোন ব্যক্তির দেহ হারাম উপার্জনের দ্বারা লালিত হলে তার দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না এবং সে দেহ জাহান্নামের উপযোগী:

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا وَإِنَّ اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ ( يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّى بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ) وَقَالَ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ) ». ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ ».

আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র, আর পবিত্র ছাড়া কিছু তিনি কবুল করেন না। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ রাসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সে নির্দেশই মুমিনদেরকে দিয়েছেন এবং বলেছেন: “হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর এবং সৎকার্য কর, নিশ্চয়ই তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমি পরিপূর্ণ অবহিত।” এবং বলেছেন: “হে ঈমানদারেরা, আমি তোমাদেরকে যে পবিত্র বস্তুগুলো রিযিক হিসেবে দিয়েছি তা থেকে তোমরা খাও।” এরপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন যে দীর্ঘ সফরে এলোচুলে ধূলিমলিন বেশে তার দুই হাত আকাশের দিকে তুলে প্রার্থনা করছে হে আমার রব, হে আমার রব – অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, সে লালিত হয়েছে হারামের দ্বারা, তবে কিভাবে তার প্রার্থনার জবাব দেয়া হবে! [মুসলিম (১০১৫)]

لا يدخل الجنة جسد غذي بالحرام

সেই শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না যেটি হারামের দ্বারা লালিত হয়েছে। [আবু ইয়ালা ১/২৯, আস সিলসিলা আস সাহীহাহ (২৬০৯)]

إِنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ النَّارُ أَوْلَى بِهِ

হারামের দ্বারা বেড়ে ওঠা গোশত [দেহ] জান্নাতে প্রবেশ করবে না, আগুনই তার জন্য অধিক উপযোগী। [আহমদ (১৪৪৮১), হাকিম (৭১৬৩) ও অন্যান্য]

মূল্যবোধের সাথে আপোষহীনতা

একজন মুসলিম কোন অবস্থাতেই নিজ মূল্যবোধের সাথে আপোষ করে না।

যুলমের সাথে সহাবস্থান না করা

মুসলিম যুলম করে না, যুলমকে প্রশ্রয় দেয় না। মুসলিম পরিবারের কর্তা নিজে যুলমের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবেন এবং তার অধীনস্থদের মাঝে কেউ কাউকে যুলম করবে তা কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন:

يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا

হে আমার বান্দারা, আমি নিজের ওপর যুলমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে একে নিষিদ্ধ করে দিয়েছি, অতএব তোমরা পরস্পরের ওপর যুলম করো না…। [মুসলিম (২৫৭৭)]

নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা

ঘুম থেকে ওঠা, ঘুমাতে যাওয়া, সালাত, খাওয়া, লেখাপড়া, বিনোদন – সবকিছু নিয়মমাফিক হওয়া সাফল্যের অন্যতম উপকরণ।

ভাষার উৎকর্ষ

মুসলিম পরিবারের ভাষা শুধু শালীন ও মার্জিতই নয় বরং বিশুদ্ধ হওয়াও বাঞ্ছনীয়। কেননা ভাষাই মানুষের বিশ্বাসকে অন্য মানুষের কাছে বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য রূপ দেয়। ভাষার দুর্বলতার কারণে সত্যের প্রকাশও দুর্বল হয়ে পড়ে, আবার ভাষার শক্তিমত্তায় ডাহা মিথ্যাও প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।

[এই নিবন্ধটি ড. আব্দুল কারীম বাক্কার রচিত ‘আত-তারবিয়াহ আর রাশীদাহ’ সিরিজের প্রথম বইতে বিদ্যমান আলোচনার আলোকে রচিত]

 

– মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ

মন্তব্য করুন

Back to top button