খুবায়েব বিন আদী (রাঃ)
ভূমিকা : ছাহাবায়ে কেরামের সীমাহীন ত্যাগ ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বজনীন ও শাশ্বত জীবনাদর্শ ইসলাম পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাঁরা নির্দ্বিধায় নিজেদের জান-মাল কুরবানী করে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে গেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা জীবন বাজি রেখে বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। সাক্ষাৎ মৃত্যুর কথা জেনেও তাঁরা কখনও পিছপা হননি। দ্বীনের খেদমত ও সহায়তায় জীবনোৎসর্গ করেছেন হাসিমুখে। এজন্য তাঁরা ইসলামের ইতিহাসে সোনালী মানুষ হিসাবে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। যাঁরা নিজেদের জীবনকে আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেছেন, খুবায়েব বিন আদী (রাঃ) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এ নিবন্ধে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম খুবায়েব, পিতার নাম আদী। তাঁর পূর্ণ বংশ পরিক্রমা হচ্ছে খুবায়েব বিন আদী বিন বানী জাহজাবী বিন আওফ বিন কিফলাহ বিন আওফ বিন আমর বিন আওফ আল-আনছারী।[1] কেউ তাঁর বংশ পরিচয় এভাবে উল্লেখ করেছেন, খুবায়েব বিন আদী বিন আমের বিন মুজদা‘আহ বিন জাহজাব আল-আনছারী।[2] কারো মতে, তাঁর বংশক্রম হ’ল- খুবায়েব বিন আদী বিন বানী আমর বিন আওফ আল-আনছারী আল-আওসী।[3] তার জন্ম ও শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
জিহাদে অংশগ্রহণ : তিনি বদর ও ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।[4]অতঃপর ৪র্থ হিজরীতে সারিয়া রাজী‘তে অংশগ্রহণ করেন ও শাহাদত বরণ করেন।
শাহাদত বরণের ঘটনা : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে ‘আযাল ও ক্বাররাহ (عَضَلٌ وَالْقَارَّةُ) গোত্রের সাতজন লোককে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরয করে যে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। এক্ষণে তাদেরকে দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য ও কুরআন পড়ানোর জন্য কয়েকজন উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন ছাহাবীকে পাঠালে আমরা উপকৃত হ’তাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে ‘আছেম বিন ছাবিত (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৬ জন মুহাজির ও ৪জন আনছারসহ ১০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন।[5] তবে ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দশ ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসাবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠান।[6] ঐ দলের নেতা ‘আছেম ছিলেন ওমরের শ্বশুর এবং ‘আছেম বিন ওমরের নানা। তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী রাজী‘ নামক ঝর্ণার নিকটে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হুযায়েল গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দায তাদের উপর হামলা করে। এতে ‘আছেম সহ ৮জন শহীদ হন এবং খুবায়েব বিন ‘আদী ও যায়েদ বিন দাছেনাহকে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়।[7]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তাঁরা উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হাদাআত নামক স্থানে পৌঁছলে হুযায়েল গোত্রের লেহইয়ান শাখার প্রায় দু’শত তীরন্দাযকে তাঁদের পিছু ধাওয়া করার জন্য পাঠায়। এরা তাঁদের চিহ্ন দেখে চলতে থাকে। ছাহাবীগণ মদীনা হ’তে সঙ্গে নিয়ে আসা খেজুর যেখানে বসে খেয়েছিলেন। অবশেষে এরা সে স্থানের সন্ধান পেয়ে যায়। তখন তারা বলল, ইয়াছরিবের খেজুর। অতঃপর এরা তাঁদের পদচিহ্ন দেখে চলতে থাকে। ‘আছেম ও তাঁর সাথীগণ এদের দেখে একটি উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তখন কাফিররা তাঁদের ঘিরে ফেলল এবং তাঁদেরকে বলতে লাগল, তোমরা অবতরণ কর ও স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব বরণ কর। আমরা তোমাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তোমাদের মধ্য হ’তে কাউকে আমরা হত্যা করব না। তখন দলনেতা ‘আছেম ইবনু ছাবিত (রাঃ) বললেন, أَمَّا أَنَا فَوَاللهِ لاَ أَنْزِلُ الْيَوْمَ فِى ذِمَّةِ كَافِرٍ، اللَّهُمَّ أَخْبِرْ عَنَّا نَبِيَّكَ. ‘আল্লাহর কসম! আমি তো আজ কাফিরদের নিরাপত্তায় অবতরণ করব না। হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছে দিন’। অবশেষে কাফিররা তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল। আর তারা ‘আছেম (রাঃ) সহ সাত জনকে শহীদ করল। অতঃপর অবশিষ্ট তিনজন খুবায়েব আনছারী, যায়েদ ইবনু দাছিনা (রাঃ) ও অপর একজন তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের উপর নির্ভর করে তাদের নিকট অবতরণ করলেন। কাফিররা তাঁদেরকে আয়ত্তে নিয়ে তাদের ধনুকের রশি খুলে ফেলে তাঁদের বেঁধে ফেলল। এ সময়ে তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠলেন,هَذَا أَوَّلُ الْغَدْرِ، وَاللهِ لاَ أَصْحَبُكُمْ، إِنَّ لِى بِهَؤُلاَءِ أُسْوَةً. ‘এযে গোড়াতেই বিশ্বাসঘাতকতা! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না। যারা শহীদ হয়েছেন আমি তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করব’। কাফিররা তাঁকে শহীদ করে ফেলে এবং খুবায়েব ও ইবনু দাছিনাকে নিয়ে চলে যায়। অবশেষে তাঁদের উভয়কে মক্কায় বিক্রি করে দেয়।[8]
খুবায়েবকে ক্রয়কারী : খুবায়েবকে হত্যার জন্য ৮০ মিছক্বাল স্বর্ণ মতান্তরে ৫০টি উটের বিনিময়ে খরীদ করেন হুজায়ের বিন আবু ইহাব তামীমী, যিনি বদর যুদ্ধে নিহত হারেছ বিন ‘আমের-এর সহোদর ভাই ছিলেন।[9] কারো মতে, হারেছ বিন আমের বিন নওফেলের মেয়ে ১০০ উটের বিনিময়ে খুবায়েবকে ক্রয় করে।[10] মা‘মার ইবনু শিহাব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হারেছ ইবনু আমের ইবনে নওফেলের বংশধররা খুবায়েবকে ক্রয় করে নেয়।[11] ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন যে, হারেছ বিন আমেরের পুত্ররা খুবায়েবকে ক্রয় করে নেয়। কারণ বদর যুদ্ধের দিন খুবায়েব (রাঃ) হারিছ ইবনু আমিরকে হত্যা করেছিলেন। খুবায়েব (রাঃ) কিছু দিন তাদের নিকট বন্দী থাকেন।[12]
শূলে বিদ্ধ করার স্থান ও হত্যাকারী : হারাম এলাকা থেকে বের করে ৬ কি. মি. উত্তরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার গোলাম নিসতাস ইবনুদ দাছিনাকে হত্যা করে। অতঃপর একই দিনে খুবায়েবকে সেখানে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়।[13] ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন যে, তারা খুবাইবকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে হারাম-এর নিকট হতে হিলের দিকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল।[14] ওক্ববা বিন হারেছ বিন ‘আমের খুবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বিন খালাফ যায়েদকে হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা নেয়।[15] কিন্তু আববাদ ইবনু আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের স্বীয় পিতার সূত্রে উক্ববা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবকে হত্যা করিনি। কেননা তখন আমি ছোট ছিলাম। তবে বনু আব্দুদ দারের মিত্র আবু মায়সারা একটি ছোট বর্শা নিয়ে আমার হাতে ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর সে বর্শা সহ আমার হাত ধরে খুবায়েবকে আঘাত করে তাকে হত্যা করে’।[16]
শূলে চড়ার আগে খুবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি, এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর কাফেরদের জন্য বদ দো‘আ করেন এবং মর্মন্তুদ কবিতা বলেন, যা ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ ও জীবনী গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। খুবায়েবের সেই বিখ্যাত দো‘আটি ছিল নিম্নরূপ-اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا- ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে এক এক করে গুণে রাখ। তাদেরকে এক এক করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও অবশিষ্ট রেখো না’। অতঃপর তাঁর পঠিত সাত বা দশ লাইন কবিতার বিশেষ দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ-
وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا* عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ فِي اللهِ مَصْرَعِي
وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ * يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ
‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোন পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে শোয়ানো হচ্ছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।[17]
খুবায়েবের সাথী যায়েদ বিন দাছেনাকে হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবার সহ বেঁচে থাক? তিনি বলেন,لاَ وَاللهِ الْعَظِيمِ مَا أُحِبُّ أَنْ يَفْدِيَنِي بِشَوْكَةٍ يُشَاكَهَا فِي قَدَمِهِ ‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে তাঁর পায়ে একটি কাঁটারও আঘাত লাগুক’। একথা শুনে বিস্মিত আবু সুফিয়ান বললেন,مَا رَأَيْتُ مِنَ النَّاسِ أَحَدًا يُحِبُّ أَحَدًا كَحُبِّ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا ‘মুহাম্মাদের সাথীরা মুহাম্মাদকে যেরূপ ভালোবাসে সেরূপ কাউকে আমি দেখিনি’।[18]
মৃত্যুর পূর্বে খুবায়েবের শেষ বাক্য ছিল- اللَّهمَّ إنَّا قَدْ بَلَّغْنَا رِسَالَةَ رَسُولِكَ، فَبَلِّغْهُ الْغَدَاةَ مَا يُصْنَعُ بِنَا ‘হে আল্লাহ, আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে তুমি তাঁকে আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি পৌঁছে দাও’।[19]
ওমর (রাঃ)-এর গভর্ণর সাঈদ বিন ‘আমের (রাঃ) যিনি খোবায়েবের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের নিহত হবার দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কতবড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে থোকা থোকা আঙ্গুর খেতে দেখা গেছে। অথচ ঐসময় মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না’।[20]
দাফন : বীরে মা‘উনার মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ছাহাবী ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী প্রহরীদের লুকিয়ে অতীব চতুরতার সাথে খুবায়েবের লাশ এনে সসম্মানে দাফন করেন।[21]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) উল্লেখ করেন যে, নবী করীম (ছাঃ) মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ ও যুবায়ের ইবনুল আওয়ামকে প্রেরণ করেন খুবায়েব (রাঃ)-কে শূলের কাষ্ঠ থেকে নামানোর জন্য। তাঁরা দু’জন তানঈমে পৌঁছে ৪০ জন নেশাগ্রস্ত মাতাল লোক দেখতে পান। তাঁরা খুবায়েবকে নামান এবং যুবায়ের তাকে স্বীয় ঘোড়ায় উঠিয়ে নেন। তাঁর দেহ তখনও সজীব ছিল, কিছুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। এ সময় মুশরিকরা এসে তাঁদেরকে ধমক দিল ও সতর্ক করল। তারা সন্নিকটে চলে আসল, তখন যুবায়ের (রাঃ) খুবায়েবের লাশ ফেলে দিলেন। যমীন লাশকে গিলে ফেলল। ফলে তার নামকরণ হ’ল بليع الأرض ‘যমীন কর্তৃক গ্রাসকৃত’।[22]
খুবায়েবের অনুপম ব্যবহার : খুবায়েব যুলকা‘দা মাসে বন্দী হন। এটা ছিল হারাম মাস। এজন্য তাকে বনু আব্দে মানাফের দাসী মু‘আবিয়ার বাড়ীতে বন্দী রাখা হয়।[23] অন্য বর্ণনায় আছে, হুজায়েরের দাসী, যিনি পরে মুসলমান হন, তার বাড়ীতে খুবায়েবকে বন্দী রাখা হয়। তিনি বলেন যে, খোবায়েব আমার বাড়ীতে আটক ছিল। একদিন আমি তাকে বড় এক থোকা আঙ্গুর খেতে দেখি। অথচ তখন মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না। তিনি বলেন, হত্যার সময় উপস্থিত হ’লে তিনি আমাকে বলেন, আমার জন্য একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিন, যাতে হত্যার পূর্বে আমি ক্ষৌরকর্ম করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারি। তখন আমি আমার বাচ্চাকে দিয়ে তাঁকে একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিলাম। পরক্ষণে আমি বলে উঠলাম, হায়! আমি এটা কি করলাম? আল্লাহর কসম! লোকটি নিজের হত্যার বদলে আমার বাচ্চাকে হত্যা করবে। অতঃপর সে বাচ্চার হাত থেকে ক্ষুরটি নিয়ে বলল, তোমার জীবনের কসম! তোমার মা যেন আমার বিশ্বাসঘাতকতার ভয় না করেন, যখন তিনি তোমাকে এই ক্ষুরসহ আমার কাছে পাঠিয়েছেন। অতঃপর সে বাচ্চাকে ছেড়ে দিল’।[24]
ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, আমাকে ওবায়দুল্লাহ ইবনু আয়ায অবহিত করেছেন, তাঁকে হারিছের কন্যা জানিয়েছে যে, যখন হারিছের পুত্রগণ খুবায়েব (রাঃ)-কে শহীদ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল, তখন তিনি তার কাছ থেকে ক্ষৌর কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে একটা ক্ষুর ধার চাইলেন। তখন হারিছের কন্যা তাকে একখানা ক্ষুর ধার দিল। সে সময় ঘটনাক্রমে আমার ছেলে আমার অজ্ঞাতে খুবায়েবের নিকট চলে যায় এবং আমি দেখলাম যে, আমার ছেলে খুবায়েবের উরুর উপর বসে আছে এবং খুবায়েবের হাতে রয়েছে ক্ষুর। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। খুবায়েব আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন যে, আমি ভয় পাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তুমি কি এ ভয় কর যে, আমি শিশুটিকে হত্যা করব? কখনও আমি তা করব না। আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবের মত উত্তম বন্দী কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ! আমি একদা দেখলাম, তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় ছড়া হ’তে আঙ্গুর খাচ্ছেন, যা তাঁর হাতেই ছিল। অথচ এ সময় মক্কায় কোন ফলই পাওয়া যাচ্ছিল না। হারিছের কন্যা বলতো, এ তো ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হ’তে প্রদত্ত জীবিকা, যা তিনি খুবায়েবকে দান করেছেন।[25]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, কুরায়েশরা খোবায়েবকে হারেছ বিন ‘আমেরের বাড়ীতে কয়েকদিন বন্দী রাখে। এ সময় তাকে কোন খাদ্য বা পানীয় দেওয়া হয়নি। একদিন হঠাৎ হারেছ-এর ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটি ধারালো ছুরি নিয়ে খেলতে খেলতে তার কাছে চলে আসে। তিনি তাকে আদর করে কোলে বসান। এ দৃশ্য দেখে বাচ্চার মা চিৎকার করে ওঠেন। তখন খোবায়েব বলেন, মুসলমান কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
ইবাদত-বন্দেগী : তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু, ধার্মিক, আবেদ ও তাপস। তিনি রাত্রে দীর্ঘ ক্বিরাতে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করতেন।[26] সুন্নাত পালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতি আন্তরিক ও সদা সচেতন। যেমন তিনি ক্ষৌরকর্মের জন্য মৃত্যুর পূর্বে হারেছের কন্যার নিকটে ক্ষুর চেয়ে নেন। এছাড়া তিনি হারাম-হালালের ব্যাপারে অতি সজাগ ও হুঁশিয়ার ছিলেন। যেমন হুজায়েরের দাসী যখন জিজ্ঞেস করে তোমার কোন প্রয়োজন আছে কি? তখন তিনি বলেন, আমি তোমার নিকটে ৩টি বিষয় কামনা করি। ১. তুমি আমাকে মদ পান করাবে না, ২. দেব-দেবীর নামে উৎসর্গিত বা যবেহকৃত জিনিস আমার থেকে দূরে রাখবে, ৩. তারা যখন আমাকে হত্যা করতে চাইবে, তখন তুমি আমাকে অবহিত করবে।[27]
মানাকিব ও কারামাত : খুবায়েবের মর্যাদা সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তিনি শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেছেন। আর তাঁর কারামাত হ’ল মক্কায় যখন কোন ফল পাওয়া যেত না, তখন তিনি আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক হিসাবে আঙ্গুরের থোকা থেকে ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছেন।[28]
খুবায়েব (রাঃ)-এর জীবনীতে উপদেশ ও শিক্ষা : খুবায়েব (রাঃ)-এর শাহাদতের ঘটনায় অনেক উপদেশ রয়েছে। এসব উপদেশ মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনুসরণীয়। তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের সহযোগিতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
২. বন্দীত্ব বরণে কল্যাণ মনে করলে মুসলিম ব্যক্তি তাৎক্ষণিক হত্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য কাফির-মুশরিকের নিকটে বন্দীত্ব বরণ করতে পারে।
৩. মুশরিকদের শিশু সন্তান ও মুশরিক শিশুদের হত্যা করা থেকে বিরত থাকা।
৪. এ ঘটনায় কারামাতে আওলিয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে। যেমন (ক) বিনা মওসুমে খুবায়েরের আঙ্গুর ফল খাওয়া (খ) আছেম বিন ছাবিতের লাশকে হেফাযত করা। যখন কুরাইশ কাফিরদেরকে এ সংবাদ পৌঁছানো হয় যে, ‘আছেম (রাঃ)-কে শহীদ করা হয়েছে, তখন তারা তাঁর কাছে এক লোককে পাঠায়, যাতে সে ব্যক্তি তাঁর লাশ হ’তে কিছু অংশ কেটে নিয়ে আসে, যাতে তারা তা দেখে চিনতে পারে। কারণ বদর যুদ্ধের দিন ‘আছেম (রাঃ) কুরাইশদের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন। ‘আছেমের লাশের (রক্ষার জন্য) মৌমাছির ঝাঁক প্রেরিত হল, যারা তাঁর দেহ আবৃত করে রেখে তাদের ষড়যন্ত্র হ’তে হিফাযত করল। ফলে তারা তাঁর শরীর হ’তে এক খন্ড গোশতও কেটে নিতে পারেনি’।[29]
(গ) তাদের দো‘আয় রাসূলের নিকটে গোয়েন্দা দলের সংবাদ পৌঁছানো। যেমন ‘আছেম (রাঃ) দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ أَخْبِرْ عَنَّا نَبِيَّكَ. ‘হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছে দিন’। খুবায়েব (রাঃ) দো‘আ করেন, اللَّهمَّ إنَّا قَدْ بَلَّغْنَا رِسَالَةَ رَسُولِكَ، فَبَلِّغْهُ الْغَدَاةَ مَا يُصْنَعُ بِنَا ‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে তুমি তাঁকে আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি পৌঁছে দাও’।[30]
৫. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে যে কোনভাবে পরীক্ষা করতে পারেন। এর মাধ্যমে ঐসব মুসলিমদের সম্মানিত করতে ও তাদেরকে পুরস্কৃত করতে চান। কেননা মুমিনদের জন্য আল্লাহর নিকটে প্রত্যাবর্তনই উত্তম, দুনিয়ায় বেঁচে থাকার চেয়ে।
৬. স্বভাবগত সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য রাখা যরূরী, সেটা যেকোন প্রতিকূল অবস্থায়ই হোকনা কেন।
৭. যুদ্ধক্ষেত্রে অনুসন্ধানকারী দল থাকা যরূরী। এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
৮. শত্রুদের জন্য নিজেদের পরিচয় প্রকাশক কোন জিনিস ছেড়ে যাওয়া থেকে মুসলিম বাহিনীকে সতর্ক ও সাবধান হ’তে হবে। যেমন ‘আছেম বিন ছাবিতের দলের ফেলে যাওয়া খেজুরের অাঁটি দেখে মুশরিকরা তাদের গতিপথ জেনে যায়।
৯. তীরন্দাযী যে যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য শক্তি, এ ঘটনা তার প্রমাণ। এতে কাফেররা ৭ জন মুসলিম মুজাহিদকে তীর নিক্ষেপে শহীদ করে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ إِنَّ الْقُوَّةَ الرَّمْىُ ‘নিশ্চয়ই শক্তি হচ্ছে তীরন্দাযীতে’।[31]
১০. মুসলিমের সুন্দর আচরণ ও উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশের মাধ্যমে ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রকাশ ঘটে। যেমন খুবায়েব (রাঃ) বনু হারেছের জনৈক মহিলার বাড়ীতে বন্দী থাকাবস্থায় তার ছেলেকে হাতের কাছে পেয়েও অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেন। তিনি নিহত হবেন এটা জানার পরও তিনি প্রতিশোধ নেননি। যে কারণে মহিলা অকপটে স্বীকার করেন,وَاللهِ مَا رَأَيْتُ أَسِيْرًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ خُبَيْبٍ ‘আল্লাহর কসম! আমি খুবায়েবের চেয়ে উত্তম কোন বন্দি কখনও দেখিনি’।[32]
১১. আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন। যেমন আল্লাহ খুবায়েবকে রিযক দান করেছিলেন।
১২. কুরাইশরা ‘হারামকে’ সম্মান করত। তারা মুশরিক হওয়া হারামের মধ্যে বন্দীদেরকেও হত্যা করতো না, বরং তারা তাদেরকে হারাম এলাকার বাইরে নিয়ে যেত। তারা হারাম মাসেও কাউকে হত্যা করতো না।
১৩. মুসলিম ব্যক্তির নিহত হওয়ার পূর্বে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা শরী‘আত সম্মত। খুবায়েব (রাঃ)ই প্রথম এ সুন্নাত চালু করেন।
১৪. মুসলমানদের জন্য কাফিরদের বিরুদ্ধে দো‘আ করা বৈধ। যেমন খুবায়েব (রাঃ) দো‘আ করেন
اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا-
১৫. কোন কোন কাফের তাদের বিরুদ্ধে কৃত মুসলমানদের দো‘আকে ভয় করে। এজন্য দেখা যায়, খুবায়েব (রাঃ)-এর হত্যা কান্ডের সময় উপস্থিত অনেকেই মূর্ছিত হয়ে পড়ে। তাদের উপরে খুবায়েবের দো‘আ বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি এটা ছিল তাদের কারো কারো ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক কারণ।
১৬. হত্যার সময় কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করা যায়। যেমন খুবায়েব (রাঃ) করেছিলেন। যা খুবায়েবের ঈমানী শক্তি ও দ্বীনের উপরে দৃঢ়তার প্রমাণ বহন করে।
১৭. এতে মুসলমানের দো‘আ কবুল হওয়া এবং জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর তাদের সম্মানিত হওয়ার প্রমাণ মেলে। যেমন- ‘আছেম-এর লাশ আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা লোক পাঠান। কিন্তু আল্লাহ তার লাশের হেফাযতের জন্য এক ঝাঁক ভীমরুল প্রেরণ করেন। ফলে মুশরিকরা তার লাশের নিকটে যেতে পারেনি। কেননা ‘আছেম আল্লাহর নিকটে অঙ্গীকার দিয়েছিলেন,لاَ يَمَسَّهُ مُشْرِكٌ، وَلاَ يَمَسَّ مُشْرِكًا أَبَدًا فِي حَيَاتِهِ ‘যেন কোন মুশরিক তাকে স্পর্শ না করে এবং তিনিও কোন মুশরিককে তাঁর জীবদ্দশায় কখনো স্পর্শ না করেন’। পরে ওমর (রাঃ) বলেন,مَنَعَهُ اللهُ بَعْدَ وَفَاتِهِ، كَمَا امْتَنَعَ مِنْهُ فِي حَيَاتِهِ ‘আল্লাহ তাঁকে মুশরিকের স্পর্শ থেকে মৃত্যুর পরেও হেফাযত করেছেন, যেমন তাকে জীবিত অবস্থায় হেফাযত করেছিলেন’।[33]
আর আল্লাহ মুসলমানদের হত্যা করা থেকে কাফেরদের বাধা দেন না। কেননা তিনি শাহাদতের মাধ্যমে মুসলমানদের সম্মানিত করতে চান।
১৮. এ ঘটনায় আরো প্রমাণিত হয় যে, খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা কাফেরদের বৈশিষ্ট্য। যেমন তারা আব্দুল্লাহ বিন তারেককে হত্যা করে এবং খুবায়েব ও যায়েদকে কুরাইশদের নিকটে বিক্রি করে দেয়।[34]
উপসংহার : খুবায়েব (রাঃ)-এর শাহাদতের ঘটনা মুসলিম উম্মাহর জন্য স্মরণীয় এক অনন্য ঘটনা। আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অসীম সাহসী, ইবাদত গুযার, সুন্নাতের পাবন্দ ও ইসলামের উপর দৃঢ়পদ এ ছাহাবীই মৃত্যুকালে নফল ছালাত আদায়ের সুন্নাত চালু করেন। তিনিই প্রথম মুসলিম, যাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। তাঁর জীবনী থেকে মুসলিম জাতির জন্য অনেক শিক্ষা ও উপদেশ রয়েছে। এগুলি আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে সফলতার সোনালী সোপানে আরোহণ করতে পারব; সফলতা লাভ করতে পারব জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পেয়ে; কামিয়াবী হাছিল করতে পারব জান্নাতে দাখিল হয়ে। আল্লাহ আমাদের সকলকে উভয় জীবনে সফলতা দান করুন-আমীন!
– ডা. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
[3]. ছালাহুদ্দীন আছ-ছাফাদী, আল-ওয়াফী বিল ওয়াফিয়াত, (বৈরূত : দারু ইইয়াইত তুরাছ ১৪২০/২০০১ খ্রিঃ), ১৩/১৭৮ পৃঃ।